www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বাংলাদেশের কাশ্মীর


নদীর সাথে পরিচয় জন্ম থেকে থাকলেও পাহাড়,মেঘালয়,পাথরের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে নি আগে। সেই সখ্যতার গল্প নিয়েই আজকের এই ভ্রমনকাহিনী। সেমিস্টার চলাকালীন সময়ে ট্যুরের প্ল্যান হলো। আমরা ৫ বন্ধু যাবো আর ৫ দিন থাকবো,এইরকম একটা বাজেট তৈরী করলো সজল আর সৌরভ ।তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম যে সেমিস্টার শেষ হবার ৭ দিন পর আমরা রওনা দিব ,কারন টিউশনের টাকা পেতে একটু দেরী হবে সবার। সাত দিন পর যথারীতি রওনা দিলাম। আমরা ৪(আমি,সজল,দিপ্ত,সৌরভ ) জন রওনা দিলাম খুলনা থেকে ,আর সাকিব রওনা দিলো ঢাকা থেকে।সেই স্বর্গের কাহিনীই আজ আপনাদের বলবো।

[img

রাতারগুলঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘন বনের মাঝখান দিয়ে ডিঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছি আমরা। বনের কোথাও কোথাও গাছের মাঝখান দিয়ে চুইয়ে পড়ছে আলো।নিস্তব্দ বনের মাঝে শুধু একটি শব্দ-বৈঠা আর জলের শব্দ। হঠাৎ  আমরা চমকে উঠি গাছের পাতার খসখানির শব্দে,তারপর আবিষ্কার করলাম একদল বানর।উচু একটা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে যেখান থেকে পুরো রাতারগুলের ভিউ দেখা যায়। মাঝি ওয়ালা আমাদের কিছু মুভির স্পট ঘুরালেন। চারদিকে পানি আর বড় বড় গাছপালায় ভরপুর। মাঝে মাঝে পাখির কিচির মিচির শব্দগুলা খুব শোনা যায়। মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল কিন্তু এই গাছপালার ভিড়ে তেমন ভিজতে ছিলাম না।ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে মাঝিকে নামিয়ে আমরা ঘুরতেছিলাম।অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা।

বিছাকানান্দিঃ প্রকৃতি যেখানে তার জমিনের বুকে অকৃপণ হাতে বিছিয়ে দিয়েছে পাথরের বিছানা,যেখানে পাহাড়ের গহ্বরে মুখ লুকিয়ে আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় শুভ্র মেঘের দল,সেই মেষ পাহাড়ের মিতালির দেশ বিছানাকান্দি।যার পাথুরে বিছানার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কাঁচের মত স্বচ্ছ ,হিমশীতল পানির স্রোতে ভাসতে ভাসতে কেউ নিজেকে সুখী মানুষ ভাবতেই পারে।নৌকা ভাড়া করে চললাম স্বর্গের দিকে,সামনে শুধু মেঘালয়ের  পাহাড় আর পাহাড়ের বুক চিরে বড় বড় ঝর্না আহবান।মনে হয় এইতো মেঘালয় । চারদিকে শুধু পাথর,দেখে মনে হয় এই বুঝি পাথরের দেশ। নৌকা থেকে নেমেই চললাম পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা সেই ঝর্নার পানির কাছে।ঝর্নার পানি খুব ঠান্ডা হয়। মনে হচ্ছিল আমরা খুব লাকি,যে এই সৌন্দর্যের  কাছে পৌছাতে পেরেছি। হঠাৎ করে ইইই’১৫ এর কিছু ভাইদের সাথে দেখা,তারাই ৯-১০ আসছেন। কুয়েটের আরেকজন আপুকেও দেখলাম ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে আসছে বিছানাকান্দি তে।তারপর অনেকক্ষন গোসল করলাম। এইখানে কম টাকায় ইন্ডিয়ান ড্রিংক্‌স,পাতা পাওয়া যায়,তবে হ্যা এইগুলা কিনতে গিয়ে ঠকবেন না যেন!

মাজার আর সাস্টঃ  সিলেট আসবেন আর মাজার জিয়ারত করবেন না,সেটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের হোটেল থেকে অল্প দূরেই হযরত শাহজালাল এর মাজার। আমরা সবাই সেটা জিয়ারত করলাম আর আরেকটু দূরেই হযরত শাহজালাল এর  স্নেহভাজন ভাগিনা হযরত শাহপরান এর মাজার। আর সিলেট এসে সাস্ট না ঘুরা মানে অপূর্ণতা থেকে যাওয়া ।অপরূপ সুন্দর একটা ক্যাম্পাস।অনেক বিশাল জায়গা নিয়ে অবস্থিত। অনেকে একাডেমিক বিল্ডিং আর হলের পাশাপাশি আছে অনেকগুলা ছোট বড় পাহাড়,আর ছোট ছোট পুকুর। এখানে ওখানে বসে আড্ডা দেওয়ার মতো অনেক জায়গা আছে। আর অনেক বেশী  চা স্টল,আর খাবারের দোকান। আর আছে নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া নামক পাহাড় ,যেখান থেকে মেঘালয়ের পাহাড় আর মেঘগুলো দেখা যায়।

জাফলংঃ প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেতের জাফলং। পাহাড়ের বুকে চিড়ে বয়ে চলেছে ঝর্না, আর নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের নুড়ি পাথর।দূর থেকে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়।পাহাড়ের গায়ে নরম তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। মায়াবী ঝর্না তে গিয়ে সিদ্ধান্ত হলো যে সবাই ঝর্নার পানিতে গোসল করবে আর আমি নিচে বসে থাকবো। এইদিকে এক মামাকে ঠিক করলাম আমাদের পিক তুলে দিবে,প্রতি পিস ৪ টাকা করে।ওদের গোসল করা দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না,ড্রেস চেঞ্জ করে চলে গেলাম গোসল করতে।গোসল করা শেষে চলে গেলাম খাসিয়া পল্লীতে।ইজিবাইক ভাড়া করে চললাম পল্লীর দিকে,এই পল্লীটা তিনটি পুঞ্জীতে বিভক্ত।তারপর গেলাম বিশাল এক চাইয়ের বাগানে,চা বাগানে ঢুকতেই  দিপ্ত কে জোঁকে ধরে বসলো। তারপর আবার ব্যাক করলাম সেই ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজের সামনে,খুব ইচ্ছে হয় ওইখান থেকে ঘুরে আসার কিন্তু ওইটা ভারতের জায়গায় ছিল।মায়াবী ঝর্না , ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ,পিয়ান নদীর স্বচ্ছ জলরাশি যে কাউকে বিমোহিত করবে।

তামাবিলঃ এইটা একটা বর্ডার এরিয়া। জাফলং থেকে অল্প একটু  পথ। একপাশে বিজিবি আর আরেকপাশে বিএসএফ। আর মাঝখানে এল্প একটু জায়গা,যাকে বলা হয় নো ম্যান্স ল্যান্ড। আমরা ওইখানে গেছিলাম,তারপর কতিপয় ইন্ডিয়ানের সাথে কথা হয়।তো আমাদের এক ফ্রেন্ড খুব ভাল হিন্দী বলতে পারে সে সুবাধে এক ইন্ডিয়ান সুন্দরী রমনির সাথে আমাদের কথা হয়,উনি আমাদের সাথে পিক তুলেন।কথা হয়েছিলো নো ম্যান্স ল্যান্ডে। কথা বলে সিনএনজি উঠার পর,দেখি এক বিজিবি আসিতেছে।উনি এসে বললো ভাই আপনারা কি বাংলাদেশী। সো আমরা বললাম ,হ্যা ভাই।সিএনজি ওয়ালা মামাও উনাকে বলতেছিলো যে আমাদের উনি নিয়ে আসছে সিলেট থেকে। আর বিজিবির স্যার বলতেছিলো যে,বিএসএফ নাকি তারে বলছে যে আমরা ভারতীয়।তারপর আমাদের একজনের আইডি কার্ড(কুয়েটের) নিয়ে গেলো,তারপর ভেরিফাই হয়ে আবার আসলো।  

মাধবপুর লেকঃ হাজারো চায়ের বাগানের মাঝপথ দিয়ে চলছি মাধবপুর লেকের উদ্যেশে ।চারদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত।আস্তে আস্তে যতই সামনের দিকে এগোতে থাকবেন ততই ভাল লাগবে,চারদিকে সবুজ পাহাড় আর চায়ের পাতার গন্ধ যে কারো মনকে চাঙ্গা কর তুলবে।  একটা বিশাল বড় লেক,আর পদ্মফুলে ভরপুর। লেকের পাড় ঘেসে পাহাড় কেটে হাটার রাস্তা করা হয়েছে। এই লেকের পানি সবসময় ছেয়ে থাকে নীল ও সাদা রঙের পদ্মফুলে।লেকের উপর দিয়ে দিয়ে প্রায় সবসময় বাতাস চলায় লেকটিকে একটি নদী অথবা শান্ত সাগরের মত দেখায়।আমরা খুব সকালে গেছিলাম,আর গাছপালার ভ্যাপ্সা গরমে পুলাপাইন গেঞ্জি খুলে ঘুরতেছিলো। ।লেকের চারপাশ দিয়ে পাহাড়ে ঘেরা আর পাগাড়ের গা ঘেঁষে অসংখ্যা চায়ের বাগান। পাহাড় থেকে পুরো মাধবপুরের ভিউটা দেখা যায়।

২২ টিলাঃ নাম শুনেই মনে হচ্ছে এইখানে বুঝি ২২ টি টিলা রয়েছে ,আসলে ব্যপারটা তেমন নয়। এইখানে এখন আর তেমন টিলা নেই,তবে লোকমুখে শুনলাম এইখানে নাকি একসময় অনেকগুলো টিলা ছিলো,সেই থেকেই নামকরন।এইখানে এসে খুব কম টাকায় নৌকা ভাড়া করে ঘুরা যায়। আর জায়গাটাও অনেক সুন্দর।


লাউয়াছড়াঃশেষ উদ্দেশ্য  শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া উদ্দ্যান। উদ্দ্যান বললে ভুল হবে আসবে একে জংগল বলা উচিত।বহু বছরের বন বিনাশ আর অযত্নের ফলে এটি আজ একটি বিচ্ছিন্ন জঙ্গল হিসেবে টিকে আছে।উদ্যানে ঢুকতেই আপনার চোখে পড়বে আকাশ ছোয়া সব গাছের সারি,রাস্তার দুপাশে সারি সারি টিলা আর খাদ,প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এই এলাকায়, তাই ঝোপঝাড়ে ভেতর দিয়ে বেশিদূর যাবো না।একটু ভেতরে ঢুকতেই শুনতে পাবেন পাখির দাক,মাঝে মাঝে দেখতে পাবেন নানা প্রজাতির বানর।আর মাঝে মাঝে দেখতে পাবেন বৃষ্টির পানির প্রবাহী নালা। ৫০ শতকের অস্কারজয়ী মুভি ‘Around the world in 80 days’ এর শুটিং হয়েছিলো এইখানে।এই উদ্দ্যানের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে এক লম্বা রেললাইন।   আপনি একা গেলে হয়তো হারিয়ে যাবেন বনের ভিতরে। দিনের বেলায়ও অনেকবেশী অন্ধকার থাকে বনের ভিতরে। আর হ্যা ভিতরে গিয়ে মোবাইলে কোন নেটওয়ার্ক পাবেন না।


সময় হলে একবার ঘুরে আসবেন বাংলাদেশের কাশ্মীরে!!
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ২৬৫৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০৮/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সুন্দর
  • মোহাম্মদ মাইনুল ০৭/০৯/২০১৯
    ভালো লিখেছেন।
  • সিলেটের সৌন্দর্য বেশ মনে করিয়ে দিলেন ভাই... সাথে জুল ভার্ন
  • বেশ লেগেছে
  • বেশ!
  • দীপঙ্কর বেরা ১১/০৮/২০১৯
    জানলাম।
 
Quantcast