www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দানবের পেটে দুদশক

ইন্ দ্য বেলী অফ্ দ্য বীস্ট
প্রিয় পাঠক-লেখক বন্ধুরা,
আপনারা কি ‘IN THE BELLY OF THE BEAST’ বইটির কথা শুনেছেন বা পড়েছেন কি? ১৯৯৮ সালে AJANTA BOOKS INTERNATIONAL, DELHI থেকে এই প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক- ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। এটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ‘দানবের পেটে দু’দশক’ নামে। আসুন, আমরা দেখি, বইটিতে কী এমন আছে যে-কারণে বিদগ্ধ মহলে এবং বিদেশে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। এমনকি, AMERICA LIBRARY OF CONGRESS, বইটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করেছে।
এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন—তনিকা সরকার। ভূমিকা-‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এই বইটি আমাদের সব বাঙালির অবশ্যপাঠ্য একটি প্রয়াস। লেখক পারিবারিক সূত্রে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে আগের প্রজন্ম থেকে যুক্ত। নিজেও দু’দশক ধরে নিষ্ঠাভরে কাজ করেছেন। এমন একজন স্বয়ংসেবক কেন সঙ্ঘ ছাড়লেন, এবং শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা উচিত মনে করলেন, তা আমাদের আজকের পরিপ্রেক্ষিতে খুঁটিয়ে বোঝা উচিত। প্রসঙ্গত, সঙ্ঘ হলো ভারতীয় জনতা পার্টির জনক ও শিক্ষক। দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদা নয়, ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পর সংযুক্ত।
বইটিতে আছে সঙ্ঘের বিশ্লেষণ এবং তার ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক রাজনীতির সাহসী সমালোচনা। যে রাজনীতির জন্য বহু চিন্তা করে অবশেষে লেখক তাঁর একদা-প্রিয় সঙ্ঘের সঙ্গে নাড়ির টান ছিঁড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। একজন উদারপন্থী ভারতীয় ও বাঙালি হিসেবে, একজন রবীন্দ্র অনুরাগী হিসেবে, তাঁর পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না।
বইটিতে আমরা আরও পাই সঙ্ঘের কার্যাবলীর বিশদ আলোচনা, যা অন্য এ ধরনের আলোচনায় বিরল। লেখক, সঙ্ঘের বিপজ্জনক রাজনীতির শক্তির উৎস কোথায়, তার সন্ধান করেছেন। যেসব রাজনৈতিক দল নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করেন, তাঁরা আশা করি এর থেকে এখনো কিছু শিখতে চেষ্টা করবেন’।
আসুন, এখন লেখকের প্রারম্ভিক কিছু কথা শোনা যাক— ‘আজ ২০২১ সালে ভারত এক চরম সঙ্কটকালীন অবস্থায়। যে আরএসএস একসময়ে এক প্রান্তিক উপহাস্যাস্পদ শক্তি ছিল, অথবা অবজ্ঞার বিষয় ছিল, তা আজ সত্যিই এক ভয়ঙ্কর দানবের মতো ভারতবর্ষকে গ্রাস করে ফেলেছে। ঘৃণা, বিভেদ, হিংসা, ভয় ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্ট বিজেপি’র মাধ্যমে ভারতের শাসন ক্ষমতায় প্রবলভাবে জাঁকিয়ে বসেছে, এবং একদিকে তাদের ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী ডক্ট্রিন্ ও অন্যদিকে গণতন্ত্রবিরোধী, বহুধর্ম ও বহুজাতিত্ব-বিরোধী ফ্যাসিস্ট্ কার্যকলাপের মাধ্যমে সহনশীল, শান্ত দেশকে চিরকালের মতো ধ্বংস করে দিতে উদ্যত। তাদের একসময়ের প্রচারিত স্বদেশী অর্থনীতি থেকে আজ তারা বহুদূরে—বহুজাতিক ও ভারতীয় ওয়ান পার্সেন্ট আজ দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে। বাংলার মতো উদারপন্থী, রবীন্দ্র-নজরুল-লালন-বাউল-কীর্তণ-ভাটিয়ালির দেশেও তারা তাদের বিষবৃক্ষের ফল ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালি মনন, বাঙালি ইতিহাস, বাঙালি চেতনা ও বাঙালি জীবন দর্শন আজ এক খাদের কিনারায়। ঠিক এই ক্রান্তিকালীন সময়ে বাংলায় এই বইটি প্রকাশের জরুরি প্রয়োজন ছিল। বন্ধু ডাঃ সুমিতা দাসের অকৃপণ সহায়তায় এবং উচ্চমানের অনুবাদ-দক্ষতায় বইটি বাংলায় প্রকাশ করা সম্ভব হলো। বাংলার মানুষ—হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, আস্তিক, নাস্তিক সকলেই বইটি পড়ুন, এবং রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রামকৃষ্ণ-রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিতের বাংলা নবজারণকে সম্পূর্ণ বিস্মৃতি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করায় অঙ্গীকারবদ্ধ হোন, লেখক হিসেবে, রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে এই আমার আশা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, ফ্যাসিস্ট দানবদের নির্মম, রক্তলোলুপ হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করুন’।
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
জানুয়ারি, ২০২১

প্রস্তাবনা
ওদের নিয়ে আমার সমস্যাটা ঠিক কী?
অনেক বছর আগের কথা। তখন আমি খুব ছোট। আমার বাবা আমাকে আমাদের উত্তর কলকাতার গোয়াবাগানের “সঙ্ঘ শাখা”য় নিয়ে যান। তার পর থেকে আমার জীবনের অনেকগুলি মূল্যবান বছর আমি সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর কাজে ব্যয় করেছি। ওখানে বছরের পর বছর খেলা করেছি, গান গেয়েছি, রাস্তায় নেমেছি আলোচনায় অংশ নিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি, আরো অনেক কিছু করেছি। ওখানে আমার অসংখ্য বন্ধু হয়েছে। বাঙালি বন্ধু, অবাঙালি বন্ধু। কিন্তু শেষকালে ওই সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসার পর তা নিয়ে আমার একটুও অনুতাপ হয়নি, বরং শেষ পর্যন্ত যে ওদের থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি, সেজন্র আমি খুশি। তবে আমার অনেক পুরনো ভাল বন্ধুকে চিরদিনের মতো হারিয়েছি, তার জন্য আমার গভীর দুঃখ আছে। ওদের হারানো মানে জীবনের একটা বিরাট অংশকেই হারানো।
কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে যে আমি সন্ত্রস্ত। যখন আমি সঙ্ঘের কথা ভাবি, সেটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। সঙ্ঘকে আমি দেখি প্রাচীন এক খোলসের মধ্যে ক্রমশ বেড়ে চলা অশুভ এক দানব হিসেবে, যে নিজেকে পাল্টে ফেলে দিন দিন বড় হচ্ছে, সবকিছু গিলে খাচ্ছে। কিন্তু খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে না। এমনভাবে সবার চোখের আড়ালে ধীরে ধীরে কিন্তু নিয়মিতভাবে সে বেড়ে চলেছে, সবকিছু গিলে খাচ্ছে, যে সেটা কত বড় একটা বিপদ তা কেউ বুঝছে না। এর একটা কারণ হলো কেউ তাকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পায় না। কেউ দেখে, রঙিন উদ্যানের এক কোনে বড়োসড়ো একটা গুটির মধ্যে সবসময়ে সে নিজের মনে কিছু চিবিয়ে চলেছে। কেউ দেখে একটা অদ্ভুত দর্শন, বিকট জিনিস, যা নিয়ে তারা মজা করে। আবার কেউ তাকে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হিসেবে, যা নিয়ে তারা অ্যাকাডেমিক মহলে নানা আলোচনা করে। কিন্তু ইতিমধ্যে এই জীবটি দিন দিন বড় হতে থাকে, নিজেকে পাল্টাতে থাকে। তার সামনে থাকা সবকিছুকে গিলে খায়। চারপাশের জীবনের তারুণ্য থেকে, যৌবন থেকে, নিজের রসদ সংগ্রহ করে দিন দিন আরো বড়, আরো শক্তিমান ও আরো কুৎসিত হয়ে ওঠে সে।
তারপর একদিন লোকে দেখে যে একদা-সুন্দর সেই বাগানে আর কোনো সবুজ নেই। সবকিছু মরা, ধূসর, বিষন্ন আর বিগত-যৌবন। নানা ধরনের প্রাণে ভরা সেই উদ্যান থেকে সব শক্তি গিলে নিয়ে জীবটি এখন বিশাল এক দানব। এখন সে যা করতে চায় তা থেকে তাকে রুখবার সাহস নেই কারো। সে এখন এক দৈত্য, যে বোতল থেকে ছাড়া পেয়েছে। আর তাকে বোতলের মধ্যে পোরা যাবে না।
আমাকে হতাশ শোনাচ্ছে? তার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু যখন আমি আমার সময়ের বা তার আগের আরএসএস-এর সঙ্গে এখনকার আরএসএস-এর তুলনা করি, তখন এই সংগঠন ও তার বেড়ে ওঠা নিয়ে আমার এরকমটাই মনে হয়।
অনেক বন্ধুরা আমাকে বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান পনের-কুড়ি বছর সঙ্ঘে কাটানোর পর, কেন আমি বেরিয়ে এসেছিলাম তার কারণগুলি যেন লিখি। এক কথায় বললে বলতে হয় যে ওদের মিথ্যেগুলো আমি বুঝে ফেলেছিলাম, আর তাতে আমি নিজেই খুব আঘাত পেযেছিলাম। আমি যে ওদের সম্পর্কে কতটা আশাহত সেটা বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লেগেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম, এবং নিজেকে ওদের থেকে মুক্ত করেছিলাম। মিথ্যে আর আত্মপ্রতারণার সঙ্গে আমি আর থাকতে পারছিলাম না।
তথাকথিত “সঙ্ঘ পরিবারের” অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে কয়েকটি নিয়ে আমার সমস্যা হচ্ছিল। সেগুলোকে আমার অনৈতিক মনে হচ্ছিল। যেমন, (১) তাদের অরাজনৈতিক হওয়ার ভান; (২) যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তীব্র পক্ষপাত—একমুখিনতা—তারা প্রচার করে ও মেনে চলে; (৩) “অন্য রকম সংগঠন” হওয়ার দাবি, যে ভন্ডামির এখন মুখোশ খুলে গেছে; (৪) খেলাধুলার মধ্য দিয়ে সামরিকীকরণের প্রচেষ্টা; (৫) কমবয়সীদের তারা যেভাবে খেলাধুলা ও সংস্কৃতির ছুতোয় ধরে ও নিয়ন্ত্রণ করে; (৬) নারী ও পুরুষকে আলাদা রাখা; (৭) তাদের ফ্যাসিবাদী, আধিপত্যবাদী, সাম্প্রদায়িক ও অপরকে বাদ দিয়ে চলার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক মতবাদ।
আমার মতে, ওগুলো হল সঙ্ঘ পরিবারে “সাতটি পাপ”। কোনোক্রমেই এগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। এখনই যদি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে, তীব্র বিরোধীতার মাধ্যমে সবাই মিলে একে প্রতিহত না করা যায়, তবে এইসব পাপ ভবিষ্যতে ভারতের ভয়ানক ক্ষতি করবে, এবং আমাদের দেশের ধ্বংস ডেকে আনবে।
এই বইয়ে আমি দেখাবো যে সঙ্ঘের তথাকথিত “অরাজনৈতিক” মুখটি কীরকম মিথ্যেয় ভরা। দেখাবো যে কেমন করে তারা তাদের সদস্যদের সবাইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিককালে তাদের এই মুখোশ খসে পড়ছে, আসল মুখ বেরিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ১৯৮০-র দশকে ভারতীয় জনতা পার্টি তৈরির পর থেকে ও দুনিয়া জুড়ে সমাজতন্ত্রের পিছিয়ে যাওয়ার পর আরএসএস-এর ভিতরে যে হিন্দুত্ববাদী জোয়ার আসে তা তার সমস্ত ফ্রন্টের মধ্য দিয়ে তাদের যুবক এবং বয়স্ক সব কর্মীদের রাজনীতিকরণ করেছে। মূল সংগঠন আরএসএস, বিজেপি’র ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলি—যেমন, যুবমোর্চা ও মহিলামোর্চা;বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভি.এইচ.পি) এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা বজরং দল, দুর্গা বাহিনী এবং ভারত বন্ধু সমাজ; এবিভিপি অর্থাৎ অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ; বিএমএস বা ভারতীয় মজদুর সংঘ; রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি (মেয়েদের আরএসএস) এবং সঙ্ঘের তৈরি অন্য নানা সংগঠন স্থানীয়, রাজ্য স্তরে ও কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার জন্য তাদের সদস্যদের অক্লান্তভাবে মন্ত্র দিয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরএসএস-পন্থী গোষ্ঠীগুলি, যেমন হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল(এইচএসসি),ভিএইচপি-আমেরিকা, ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি, হিন্দু বিবেক কেন্দ্র ও গ্লোবাল হিন্দু ইলকেট্রনিক নেটওয়ার্কও এই প্রচারে অংশ নিয়েছে। অবশ্য হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল বা ভিএইচপি-আমেরিকা ভেবে-চিন্তেই ওপর ওপর আরএসএস-এর সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখে। কারণ, আমেরিকাতে সাংবিধানিক নানা বিধিনিষেধ রয়েছে, যা তাদের মেনে চলতে হয়।
১৯৯৭ সালে আমেরিকা থেকে দেশে গিয়ে আমি যখন ভারতের বিভিন্ন আরএসএস কেন্দ্রে ঘুরছিলাম তখন সঙ্ঘের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার জন্য কী পরিমাণ লোভ দেখা দিয়েছে, তা দেখে অবাক হয়েছিলাম। আরএসএস এখন বিজেপি’র যেসব রাজনৈতিক কৌশলগুলিতে মদত দেয়, তাতে সেই লোভের পরিচয় মেলে—দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসের মতই নিজেকে “অন্যরকম দল” বলে দাবি করা বিজেপিও ভয়ানক সব অপরাধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে একসাথে চলেছে। উদ্দেশ্য একটাই। কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করা। (এই বাংলা বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময়ে যা তারা বিশালভাবে দখল করে আছে)
আরএসএস, বিজেপি ও ভিএইচপি-র শ্রেণিচরিত্র যে কংগ্রেসের থেকে আলাদা কিছু নয়, সেটা তাদের কাজকর্ম থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাদের নেতারা প্রায় সবাই উচ্চবর্ণের রক্ষণশীল পুরুষ—ধনী জমিদার, ব্যবসায়ী, আমলা, পুরোহিত—চিরাচরিতভাবে যারা ভারতে রাজা তৈরি করে এসেছে। কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা থেকে এরা জানে যে ক্ষমতা, শুধুমাত্র ক্ষমতাই, তাদের এতদিন ধরে বোনা জাল টিকিয়ে রাখতে পারবে। ক্ষমতা না থাকলে তা ভেঙে পড়বে। সেজন্যেই বিজেপি এখন এত মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেজন্যেই বিজেপি’র অনৈতিক রাজনীতিকে আরএসএস এত মদত যুগিয়ে চলেছে।...(ক্রমশঃ)

সেবার ১৯৯৭ সালে আমি যখন ভারতে ঘুরছিলাম, তখন কলকাতার এক বিজেপি-পন্থী সাংবাদিক আরএসএস-এর বাংলা সাপ্তাহিক ‘স্বস্তিকা’ পত্রিকার এক সভায় আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন। ওখানে তিনি বলেন, বিজেপি নেতৃত্ব যে এখন নেহরু-পন্থী জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরছে এবং কাশী মথুরার মন্দিরের বিষয়গুলিকে সরিয়ে রাখছে সেটা ভন্ডামি, আর এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল।
[এই বাংলা বইটি প্রকাশিত হবার সময়ে বিজেপি ও আরএসএস আবার অযোধ্যা রামমন্দির নিয়ে অতি-ব্যস্ত, কারণ তাদের অর্থনৈতিক জালিয়াতি মানুষের চোখে ধরা পড়ে গেছে। তাদের আবার এখন ধর্মের রাস্তা দরকার। মুসলমান বিদ্বেষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বিদ্বেষ এবং রামমন্দির—এগুলোই এখন সঙ্ঘ পরিবারের নতুন খেলার কৌশল।]
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরএসএস তার সামরিক ধরনের কাজের মধ্যে দিয়ে অজ্ঞ ও প্রশ্নহীন অনুগত সদস্যদের এক বাহিনী গড়ে তুলেছে, যারা সঙ্ঘের আসল চরিত্র জানেও না, জানতে চায়ও না। এই প্রশ্নহীন আনুগত্য আরএসএস-এর নানা স্তরের সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনা জাগিয়ে তোলা ও তাদের ধরে রাখার ক্ষত্রে সুবিধেজনক হয়েছে। এই হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনাগুলি কী রকম এবং সেগুলি কীভাবে এই গোষ্ঠীর মধ্যে বা বাইরে কোন প্রকৃত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি বললেই চলে, সেটা আমি এই বই-এ ব্যাখ্যা করব। এই অত্যন্ত সংগঠিত ধর্মীয় দক্ষিণপন্থার আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের প্রগতিশীলরা বড়জোর দু-একটা অসংগঠিত প্রচেষ্টা করেছেন। আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে এমন আশ্চর্য মিল—ঠিক আমেরিকার মতোই ভারতেও দক্ষিণপন্থীরা যতদূর সম্ভব দক্ষিণে যেতে পারে, চরমপন্থী হতে পারে, কিন্তু মূল ধারার মধ্যপন্থীরা (যেমন কংগ্রেস পার্টি) তাদের মধ্যপন্থা প্রমাণ করতে এবং সমাজতান্ত্রিক গণআন্দোলন থেকে দূরত্ব রক্ষা করতে ব্যস্ত। কংগ্রেসের মধ্যে কোনো শক্তিশালী জাতীয় নেতৃত্ব আজ আর তেমন নেই।
আরএসএস-এর ভেতরে যেটুকু বিরোধীতা হয়েছে সেটা আবার এসেছে তাদের মধ্যে অতি দক্ষিণপন্থী অংশ থেকে। অযোধ্যায় রামমন্দিরের বিষয়টিকে সাময়িকভাবে সরিয়ে রাখার কৌশলের বিরোধীতা করেছেন স্বাধ্বী ঋতাম্বরা’র মতো নেতারা। নির্বাচনের আগে তাদের এই বিরোধীতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, কিন্তু ভিএইচপি ও আরএসএস মন্দিরের ইস্যুটিকে আবার সামনে নিয়ে আসছে। (বরং তাত্ত্বিক নেতা ও আরএসএস প্রচারক গোবিন্দাচার্য’র মতো দু’একজন ব্যতিক্রমী নেতা বিজেপি’র দরিদ্র-বিরোধী, জনবিরোধী কাজের সোচ্চার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এখন বিজেপি লাগামছাড়া। সৎ তাত্ত্বিক নেতাদের তারা আর গ্রাহ্য করে না। তাদের মিডিয়াগুলোতে মোদী, শাহ জাতীয় নেতা ছাড়া আর কারোর মুখ দেখানো হয় না।)
অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সামাজিক কাঠামো অপরিবর্তনীয়ভাবে বদলে যাবে। এই বদল ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এক সময়ের নানা রঙের বাগানটি হয়ে উঠবে ধূসর, বিবর্ণ, পুষ্পপত্রহীন এক জঙ্গল—বাচ্চারা যেখানে খেলা করতে যায় না, যুবক-যুবতীরা প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে যায় না, প্রেম করতে যায় না। ওই জঙ্গলে যে কুৎসিত জীবটি বাস করে তাকে দেখলে সবাই ভয় পাবে। সে এখন ওখানকার দানব রাজা। ঔজ্জ্বল্যের প্রতি, সামাজিক প্রগতির প্রতি, ভালবাসা, স্বাধীনতা ও জীবনের প্রতি সে দানব নিষ্ঠুর।
পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমি আরএসএস এবং তার সন্তান যেমন বিজেপি, এবিভিপি ও ভিএইচপি আসলে কী এবং এই আরএসএস পরিবারকে, সঙ্ঘ পরিবারকে রুখতে গেলে আমাদের কী করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করব।
১। পবিত্র কুমার ঘোষ, বর্তমান, ১৯ জুন, ১৯৯৭। ওই সভাতে আরএসএস-এর তাত্ত্বিক এইচ.ভি.শেষাদ্রি জোর দিয়ে বলেন, যে ঊনবিংশ শতকের “বাংলার রেনেসাঁস” ছিল একটি হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন। হাস্যকর প্রস্তাব, কারণ আসলে তা ছিল হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলন। (ক্রমশঃ)
পৃষ্ঠা-১৯ (পর্ব-৪)
আরএসএস—রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ
সঙ্ঘ কী, এবং কী নয়
‘যিশুখ্রিস্ট একটি ফালতু ধারণা। হিন্দুদের জানার সময় হয়েছে যে যিশুখ্রিস্ট কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বা নৈতিক শক্তির প্রতীক নন, তিনি সমাজবাদী আগ্রাসনের নৈতিক ভিত্তি তৈরির একটা উপাদান মাত্র। এ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদীদের কাজে লেগেছেন তিনি। হিন্দুদের তাই জানা উচিত যে তাদের দেশের ও সংস্কৃতির পক্ষে যিশুখ্রিস্ট সমস্যা ছাড়া কিছু নয়’।
আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও তাত্ত্বিক, যিশুখ্রিস্ট সম্পর্কে তাঁর বইয়ে একথা লিখেছেন।
১৯২৫ সালের হিন্দুদের পুণ্যতিথি বিজয়া দশমীতে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে ডঃ কে বি হেডগেওয়ার আরএসএস সংগঠনটির পত্তন করেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এই দিনে শ্রীরাম রাক্ষসরাজ রাবণের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। সঙ্ঘ ও তার সন্তান সংগঠনগুলি (যেমন বিজেপি) হিন্দু ভোট পাওয়ার জন্য ও মুসলিম-বিরোধী ঘৃণা উসকে দেওয়ার জন্য সাফল্যের সঙ্গে রামের নাম ব্যবহার করে আসছে। মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পাশাপাশি ভারতীয় জনসঙ্ঘ (এখন বিজেপি) এবং ভিএইচপি (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ) ভারতে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত।
আরএসএস-এর এখন আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ শাখা-সংগঠন আছে—বজরং দল (ভিএইচপি’র যুব শাখা) এবং বনবাসী কল্যাণ আশ্রম—আদিবাসীদের তাদের দলভুক্ত করার লক্ষ্যে যে সংগঠনটির জন্ম দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আছে ছাত্র সংগঠন এবিভিপি এবং শ্রমিক সংগঠন বিএমসি (ভারতীয় মজদুর সংস্থা)।
বিজেপি-র সংসদীয় নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী সারা জীবন আরএসএস-এর সদস্য ছিলেন। এখনকার মোদী, শাহ যোগীর মতো প্রথম সারির নেতারাও তাই। বিজেপি-র বেশিরভাগ নেতা ও সক্রিয় কর্মী এসেছে আরএসএস থেকে। তারা হিন্দু আধিপত্যবাদের তত্ত্বে আপাতমস্তক ডুবে আছে। বাজপেয়ী আগে ছিলেন সঙ্ঘের পুরো সময়ের কর্মী, যেমন ছিলেন আদবানি। পরে তাকে বিজেপির কাজে ছেড়ে দেওয়া হয়। যেমন আমার বাবা জিতেন্দ্রনাথ, যিনি বাজপেয়ী ও আদবানির সতীর্থ ছিলেন, তাঁকেও আরএসএস জনসঙ্ঘের কাজ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে পাঠায়। এ বিষয়ে পরে আরও বিশদ বিবরণ আছে।
তাঁর রচিত এক কবিতায় বাজপেয়ী বললেন, “হিন্দু হিন্দু মেরা পরিচয়”। অর্থাৎ ‘আমার পরিচয় হল আমি হিন্দু’। এ থেকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রচারের সময় তাঁর বক্তৃতার কথা মনে পড়ে যায়। “এদেশে হিন্দু হওয়া কি অপরাধ?” এখনও বাজপেয়ী সেই হিন্দুত্ববাদী হিন্দু। শুধু তাঁর কথা একটু পরিশীলিত হয়েছে, একটু সংযমের ছাপ পড়েছে। বিজেপির সাম্প্রতিক কাজকর্মের ধরনে সাম্প্রতিক কালে যেমন একটু পালিশ পড়েছে।
বিজেপির এই উল্কা-সম “অস্পৃশ্য” ধর্মীয় সংখ্যলঘু ও নারী—যারা চিরাচরিতভাবে নিপীড়িত—তাদের ওপর আরও সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। বিজেপি-র মিত্র শিবসেনা ও শিবসেনার নেতা বাল ঠাকরে খোলাখুলি ভাবেই নিপীড়ক সামাজিক ব্যবস্থার সমর্থক। ঠাকরে বলেছিলেন যে ভারতের জন্য গণতন্ত্র ঠিক নয়—ভারতীয়দের জন্য দরকার একটি “ভালো একনায়কতন্ত্র”। বিজেপি-র গুরুত্বপূর্ণ নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদবানি এখন খোলাখুলি ভাবে ভারতের বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতি-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রস্থাব এনেছেন। এ প্রস্তাব খুবই চিন্তার ব্যাপার। এটি স্বৈরাচারী শাসনের সূচক।
গোয়ালিয়র রাজ পরিবারের রানিমা বিজয়া রাজে সিন্ধিয়া বে-আইনী ঘোষিত “সতী” প্রথার পক্ষে কথা বলেছেন। কথা বলছেন হিন্দুদের জাতপাত ব্যবস্থার পক্ষে—যেখানে ব্রাহ্মণ ও উঁচু জাতির লোকেরা সমাজের নেতা, আর নিচুতলায় দারুণ দারিদ্রের মধ্যে, মৃত্যুর মধ্যে অবস্থান নিচু জাত ও অস্পৃশ্যদের। এম এস গোলওয়ালকর ও বালাসাহেব দেওরস যদিও আজকের এই “অধঃপতিত” জাত-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা জাতিভেদ প্রথা তুলে দেওয়ার কথা বলেননি।
আরএসএস ও তার বিভিন্ন শাখা সংগঠনে জাত-ব্যবস্থা মানা হয়, প্রয়োগও করা হয়। হিন্দুত্ববাদ মাফিয়ারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে দলিত ও তথাকথিত নিচু জাতের মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন করে যাচ্ছে। এরা অনেকে সরাসরিভাবে হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত। অনেকে আবার হাওয়ায় ভেসে আসা সমর্থক গুন্ডা।
তবে সব জাতের হিন্দুদের তাদের কৃত্রিমভাবে তৈরি “ঐক্য প্ল্যাটফর্মে” একত্রিত করার উদ্দেশ্যে ইসলাম ও অন্যান্য “বিদেশী” ধর্মের প্রতি ঘৃণার একটি ধারণা তৈরি করা হয়েছে। দলিত, বনবাসী ও সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণীগুলির সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যে বীরসা মুন্ডা-র মতো “নিচু জাতে”-র বিখ্যাত সব বীরদের নাম আরএসএস-এর একাত্মতা স্তোত্রে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের কোনো নাম নেই।
ভারতীয় রাজনীতির নতুন তারকা বিজেপি সম্পর্কে জানতে হলে আরএসএস কী (?) তা খোলা মনে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ভারতীয়রা, বিশেষ করে যাদের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই, তাঁরা আরএসএস সম্পর্কে, বিশেষ করে আরএসএস কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে বিশেষ জানেন না, অথবা পূর্ব ধারণার কারণে সেগুলি দেখতে অস্বীকার করেন। তাঁদের অনেকেরই চোখে নানা রঙের চশমা আছে। আমার মতে, এই অজ্ঞতা, এই অস্বীকারের ফলে সঙ্ঘের নানা সংগঠনগুলি এত দ্রুত বেড়ে উঠতে পেরেছে।
আসলে আরএসএস-কে তার নিজের খেলাতেই পরাস্ত করতে হবে। তাদের আধিপত্যবাদী ও বিভাজনকারী হিন্দুত্বের তত্ত্বকে হারাতে হবে হিন্দুধর্মের অসাম্প্রদায়িক এবং সবাইকে নিয়ে চলার ধারণা দিয়ে—যে হিন্দুধর্ম শ্রীচতৈন্য, রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও ভক্ত কবীরের ধর্ম। এঁদের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবার ও অন্যান্য সামাজিক-ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর ফারাক দেখিয়ে দিতে হবে। তবেই, একমাত্র তবেই, সব বিষয়ে তাদের ধর্মান্ধতা ও প্রতারণা ঠিক কতটা, সেটা ঠিকমত বোঝা যাবে ও তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।...(ক্রমশ)

পৃষ্ঠা- ২১, পর্ব-৫
আরএসএস সমর্থকই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল।
৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮, ভারতের স্বাধীনতার এক বছর পূর্ণ হওয়ারও আগে মহারাষ্ট্রের এক ধর্মান্ধ হিন্দু নাথুরাম গডসে দিল্লিতে এক প্রার্থনা-সভায় মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে। নাথুরাম গডসে ছিল আরএসএস-এর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, এবং আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডঃ কে বি হেডগওয়ারের ঘনিষ্ঠ। গান্ধী হত্যার ঠিক আগে গডসে অবশ্য আরএসএস ছেড়ে দিয়েছিল, এবং সাভারকারের প্ররোচনায় আরেকটি আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়েছিল।
তাহলে গান্ধী হত্যায় আরএসএস-কে কখনো অপরাধ সাব্যস্ত করা যায়নি কেন?
গান্ধীহত্যায় যে আরএসএস-কে কখনই সরকারিভাবে জড়িত করা বা তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়নি, তার নানা কারণের একটা হল, নাথুরাম গডসে-কে কখনই আরএসএস-এর সদস্য প্রমাণ করা যায়নি। কেন যায়নি? কারণ, আরএসএস-এর সদস্যদের নামের কোন রেজিস্টার নেই, কোনদিন ছিলও না। আরএসএস-এর কাজকর্ম বা সভার কোন লিখিত বিবরণীর ব্যাখ্যা হয় না, হতও না। আমার প্রায় দু-দশকের আরএসএস জীবনে আমি কখনো কোনো সাংগঠনিক সদস্য তালিকায় থাকিনি, কিংবা কোনো সদস্য-চাঁদাও দিইনি। অথচ আমি সঙ্ঘশাখায় শিক্ষক, মুখ্যশিক্ষক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলাম।
আরএসএস তার কর্মীদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনে কাজ করতে পাঠায়। বিজেপি ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের ফ্রন্ট অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর ক্যাডারদের পরামর্শ দেয় আরএসএস। তাদের তৈরি করে দেয়। যেসব সদস্য শিল্পক্ষেত্রে কাজ করে, তাদের পাঠানো হয় আরএসএস-এর শ্রমিক ফ্রন্ট ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘে (বিএমএস)। ব্যবসায়ী জগতের বয়স্ক এবং সাধারণত ধনী কর্মীদের পাঠানো হয় সম্পদশালী ধর্মীয় সংগঠন ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ বা ‘ওয়ার্ল্ড হিন্দু কাউন্সিল’। এবিভিপি ও বিএমএস ইউনিয়ন দখল করার জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়, জেতার জন্য গুন্ডামিও করে থাকে, কিন্তু তারা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দাবি করে। ...(ক্রমশঃ)
পৃষ্ঠা-২২, পর্ব-৬
আরএসএস, শিবসেনা ও ফ্যাসিবাদের প্রতি মুগ্ধতা
আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর হেডগেওয়ার এই ধারণা প্রচার করেন যে ভারতের সমস্ত অ-হিন্দু, যেমন মুসলিম ও ক্রিস্টানরা, যে আমাদের জাতির অংশ নয়, সেটা ঘোষণা করলে তবেই জাতীয় ঐক্য আসবে। কারণ, তাঁর মতে, অহিন্দুরা হিন্দু প্রথা, চিন্তা ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে। হেডগেওয়ার তাঁর নিজের হাতে গড়া শিষ্য মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারের (যাঁকে সাধারণত বলা হয় গুরুজি) মধ্যেও এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করে দেন। গোলওয়ালকারও এসেছেন আরএসএস-এর আঁতুড়ঘর নাগপুর থেকে। অন্যদের বাদ দিয়ে চলার এই ধারণা (exclusionary idea) নিয়ে সবচেয়ে ভালো বিবরণ পাওয়া যাবে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত গোলওয়ালকারের স্বলিখিত পুস্তিকা ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিভাইন্ড’-এ।
এই চটি বইটিতে হিটলার ও তার জাতিগত আধিপত্যবাদী তত্ত্বের কথা বারবার শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আরএএস-এর কাছে এটি দিন দিন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছিল। কিছুদিন পর এটি বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়।
এই বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক:
‘জার্মান জাতি গর্ব আর সবার আলোচনার বিষয়। জাতি ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য জার্মানি তাদের দেশ থেকে সেমিটিক জাতির লোকেদের—ইহুদিদের—বের করে দিয়ে দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে জাতি তার সর্বোচ্চ উচ্চতার প্রকাশ পেয়েছে। জার্মানি আরো দেখিয়েছে যে জাতি ও সংস্কৃতির পার্থক্য যেহেতু শিকড় পর্যন্ত প্রসারিত, তাই মিশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার—আমাদের হিন্দুস্থানের (অর্থাৎ হিন্দুদের ভূমি) পক্ষে এটি একটি ভাল ও লাভজনক শিক্ষা’।
‘গুরুজি’ কাদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে বলছেন?
বুদ্ধিমান জাতিগুলির অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, হিন্দুস্থানের অ-হিন্দু জাতিগুলির লোকেদের হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দুধর্মকে সম্মান করতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির মাহাত্ম্য ছাড়া কোনও ধারণা পোষণ করা চলবে না; অর্থাৎ তাদের শুধু তাদের অসহনীয়তা ও এই দেশ ও তার প্রাচীন প্রথাগুলি সম্পর্কে অকৃতজ্ঞতা বাদ দিলেই চলবে না, তার বদলে, এক কথায়, ভালোবাসা ও ভক্তির ইতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে হবে; তাদের বিদেশী হয়ে থাকা বন্ধ করতে হবে। নইলে এদেশে তাদের হিন্দু জাতির সম্পূর্ণ অধীন হয়ে থাকতে হবে। কোনও অধিকার চাওয়া চলবে না। কোনও সুবধা পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে না। তারা, কোন বিশেষ সুবিধা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি নাগরিক অধিকারও অধিকারও থাকবে না তাদের’।
আরএসএস মহলে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় হিন্দু মহাসভা নেতা সাভারকর ঘোষণা করেন:
‘আমরা হিন্দুরা যদি শক্তিশালী হয়ে উঠি তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের মুসলিম বন্ধুদের অবস্থা হবে জার্মানী ইহুদের মতো’। ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিভাইন্ড’-এর পর গোলওয়ালকর লেখেন ‘বাঞ্চ অফ থটস’। এটি এখন সংঘের ‘বাইবেল’। এতে আরএসএস-এর জাতীয়তার ফ্যাসিবাদী ধারণাকে একটা ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পোশাকে মোড়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা সবসময় ভয়ানকভাবে মুসলিমবিরোধী ও খ্রিস্টান বিরোধী। এমনকি ভারত সরকার যখন আব্দুল হামিদ ও কেলকর ভাইদের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তাদের দেশপ্রেম ও সাহসের জন্য সম্মান প্রদর্শন করেন, গোলওয়ালকর তারও বিরোধিতা করেছিলেন। কোন অহিন্দু সৈন্য ভারতের জন্য যতই আত্মত্যাগ করুন না কেন, তাদের সম্মানিত করা হোক এটা গোলওয়ালকর চাননি।
আরএসএস-এর এই মুসলিম-বিরোধী মনোভাব এতদূর বিস্তৃত যে উর্দুকেও তারা বিদেশি ভাষা আখ্যা দেয়।
‘উর্দু শব্দটির অর্থ ও তার তাৎপর্য জাতীয় আত্মসম্মানের প্রতি এত ক্ষতিকর যে তা এই ভাষার প্রতি সমস্ত ভালবাসাকে ছাপিয়ে যায়। কেমন করে বা কেন আমরা এমন একটা ভাষা রাখব যার নামটি প্রতিনিয়ত আমাদের রাজনৈতিক অধীনতার কথা মনে করিয়ে দেবে? আমাদের হিন্দু পূর্বপুরুষরা আমাদের সংস্কৃত ও হিন্দি দিয়ে গেছেন, উর্দু আনার ব্যাপারে তাঁদের কোনও ভূমিকা নেই’।
সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক মিত্র শিবসেনা এখনও হিটলার ও নাৎসি জার্মানির প্রশংসা করে। তাদের প্রাক্তন প্রধান বাল্ ঠাকরে প্রায়ই প্রকাশ্য জনসভায় ও সাক্ষাৎকারে হিটলারের প্রশস্তি করে এসেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের তাড়নায় সঙ্ঘ এখন আর এই ঝামেলা চায় না। তবে এ নিয়ে ঠাকরের সমালোচনাও করেনি তারা।
পৃষ্ঠা—২৪, পর্ব—৭
প্রথমে আরএসএস, জনসঙ্ঘ, তারপর বিজেপি
১৯৫১ সালে গান্ধী হত্যায় আরএসএস-এর যোগ নিয়ে তাদের প্রতি জনগণের মনে যে ঘৃণার সঞ্চার হয় তার মোকাবিলায় আরএসএস তার রাজনৈতিক শাখা ভারতীয় জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে। পাশাপাশি অবশ্য ১৯৫২ সালে এদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নিজেদের বক্তব্য প্রচারের ব্যাপারটাও ছিল। এই রাজনৈতিক শাখার বর্তমান নাম বিজেপি। বাংলার হিন্দু মহাসভার নেতা, অতি জাতীয়তাবাদী ও বিখ্যাত বক্তা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে জনসঙ্ঘের প্রধান করা হয়। সঙ্ঘের অভিযোগ, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে কংগ্রেস বা শেখ আবদুল্লার পার্টি কাশ্মীরের জেলে খুন করে। এরপর সঙ্ঘের কর্মী দীনদয়াল উপাধ্যায়কে জনসঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট করা হয়। শান্ত-প্রকৃতির মৃদুভাষী শ্রী উপাধ্যায়ও খুন হন। অভিযোগ, এঁকেও খুন করে রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের লোকেরা। এরপর জনসঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট হন অটলবিহারী বাজপেয়ী (মধ্যে কিছুদিন দেবপ্রসাদ ঘোষ সভাপতি ছিলেন)। তিনি দু’দশক ধরে এই দায়িত্ব সামলেছেন। সে-সময়ে জওহরলাল নেহরু ও পরে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের স্বর্ণযুগ চলছিল। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পরই অন্যান্য বিরোধী জাতীয় দলের সঙ্গে সুবিধাবাদী জোট গড়ে জনসঙ্ঘ নতুন জীবন পায়।
ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে কারাগারে বন্দি হওয়ার ফলে জনমানসে হারিয়ে যাওয়া বাজপেয়ী, আদবানি-রা জাতীয় তারকা হয়ে উঠলেন। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর জনপ্রিয়তা তেমন জোরদার আছে, এই ভুল ধারণার ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলেন। এই নির্বাচনে শ্রীমতি গান্ধী ও তাঁর কংগ্রেস দল প্রায় মুছে গেল। তার পেছনে ছিল সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ব্যাপক জন আন্দোলন। একটি মিলিজুলি সরকার গঠিত হল। বাজপেয়ী ও আদবানি সেই সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পেলেন। বাজপেয়ী পেলেন বিদেশ মন্ত্রক, আদবানি পেলেন তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তর। (বিজেপি-র এর একজন, ব্রিজলাল ভার্মা পান গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মন্ত্রকের ভার। সঙ্ঘের অনেক কর্মীও এতে অবাক হয়েছিলেন। এর কারন হল, সঙ্ঘের ান্র এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা নানা দেশমুখ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।) এর আগে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে এই দুই পেশাদার রাজনীতিক ও তাদের দল বিজেপি-র এমন সুদিন আসবে। (ক্রমশঃ)
পৃষ্ঠা-২৫, পর্ব—৮
“গুরু দক্ষিণা”—প্রচুর কাঁচা টাকা
প্রতি বছর গুরু-দক্ষিণার (গুরু মানে এখানে গেরুয়া পতাকা, ভাগোয়া ঝান্ডা) দিন বিশাল পরিমাণ কাঁচা টাকা সঙ্ঘের তহবিলে জমা পড়ে । প্রায় পুরোটাই ক্যাশ । ফলে, কালো টাকা সাদা করার সুবর্ণ সুযোগ ব্যবসায়ী মহলের কাছে । কত টাকা জমা পড়লো, তার কোনো হিসাব সরকারকে দেওয়া হয় না, ফলে কর দেওয়ারও প্রশ্ন নেই । এছাড়া আরএসএস বিদেশে তার সদস্য ও সমর্থকদের কাছ থেকেও বিশাল পরিমাণ টাকা পায় ।
বিজেপি-র নির্বাচনী তহবিলে টাকা দেওয়া ছাড়াও বিদেশে বসবাসকারী সঙ্ঘ-সমর্থকরা আরএসএস-এর বিদেশি সংস্করণ হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখায় ‘গুরু দক্ষিণা’ জমা দেন । এছাড়াও ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি, ভিএইচপি অপ আমেরিকা ও হিন্দু স্টুডেন্টস কাউন্সিল অফ আমেরিকা-র মাধ্যমেও টাকা আসে বলে জানা যায় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যেসব হিন্দু মন্দির আছে সেগুলি সাধারণত রক্ষণশীল ও অরাজনৈতিক । দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী মার্কিন-ভারতীয় যুবকদের ধরার জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আয়োজিত হিন্দু-সামার ক্যাম্প ও হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল আয়োজিত নানা ধর্মীয় সভার মধ্য দিয়ে আরএসএস এখন মন্দিরগুলিকে হাতের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে । সাংস্কৃতিক শিক্ষার নামে একটি গোটা প্রজন্মকে অন্ধ, বিচ্ছিন্নতাকামী ধর্মান্ধে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলছে । ভারত থেকে আসা অনেকেই বিজেপি ও আরএসএস-এর সঙ্গে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সম্পর্কের কথা জানেন না । সঙ্ঘ পরিবারের ফ্যাসিবাদী ধরনের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যেতে এদের ব্যবহার করা হচ্ছে। (ক্রমশঃ)
পৃষ্ঠা—২৬, পর্ব—৯
৯০-এর দশকের রাম-আন্দোলন
বিশ্বে নানা স্থানে অন্য যেসব ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী আছে তারা যে সমাজ তৈরি করতে চায় তাদের কাছে তার একটা স্পষ্ট রূপ আছে। কিন্তু সঙ্ঘের প্রস্তাবিত হিন্দু-রাষ্ট্র কীরকম হবে, সেটা তারা ইচ্ছে করেই অস্পষ্ট রেখে দিয়েছে। কারণ, আরএসএস হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণের যে কাজে নেমেছে তার জন্য সমর্থক-ভিত্তি বাড়াতে হবে, আর এখানেই নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। গরিব ও নিচু জাতের মানুষদের কাছে আরএএস-এর হিন্দুত্বের বাহ্মণ্যবাদী ধারণা বিশেষ সমর্থন পায় না। তাদের হিন্দু আধিপত্যবাদীর ধারণার মধ্যে জাত ও শ্রেণিগত, জাতিগত, ভাষাগত ও স্থানীয় আনুগত্যের বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করা হয়। এইসব সমস্যার মুখে পড়ে আরএসএস তার উচ্চাকাঙ্খী হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি বিষয় নিয়ে এলো—(১) ভারতের [কংগ্রেস ও অন্যান্য সমাজবাদী] সরকারের প্রতি ঘৃণা, ও (২) ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে তোলা। এই দুটি লক্ষ্য পূর্ণ করতে তারা রাম জন্মভূমি কর্মসূচি হাতে নেয়, পাশাপাশি দেশ জুড়ে সঙ্ঘের জঙ্গি কর্মীদের দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। এইসব দাঙ্গায় হিন্দুর তুলনায় অনেক বেশি মুসলমান হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি ভাঙচুর ও ধ্বংসের শিকার হয়েছেন। সঙ্ঘ পরিবার এখন নিজেদের হাজির করে এক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে, “সমাজতান্ত্রিক ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী” রাষ্ট্রশক্তি যাদের বিরোধিতা করছে। তাদের অভিযোগ, এই রাষ্ট্রশক্তি মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের বেশি লাই দিয়ে চলেছে—যদিও সঙ্ঘ ভালো করেই জানে যে মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুরা আসলে এ দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে চিরাচরিতভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের অবস্থানে থেকেছেন।
নব্বইয়ের দশকে তাই আরএসএস, ভিএইচপি ও বিজেপি একসাথে রাম-মন্দিরের হিন্দু পুনরুত্থানবাদী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলে। অযোধ্যায় শ্রীরামের “ঐতিহাসিক” জন্মস্থান নিয়ে তারা আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের বক্তব্য, ঐ জায়গায় অবস্থিত বাবরী মসজিদ (বাবরের নামানুসারে) নামের মসজিদটি নাকি গড়ে তোলা হয়েছিল “মুসলিম” আগ্রাসনকারীদের হাতে—ওখানে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের ওপর। সঙ্ঘের বক্তব্য অনুসারে, সেই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল শ্রীরামের পবিত্র জন্মস্থানকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। সঙ্ঘের বক্তব্য এই যে, একাদশ শতক থেকেই ওখানে স্তম্ভসহ একটি মন্দির ছিল।
কিন্তু বেলজিয়ামের উৎসাহী বিজেপি-পন্থী লেখক কনরাড এলস্ট পর্যন্ত তার বইয়ে স্বীকার করেছেন—
“মন্দিরটি কবে ধ্বংস করা হয়েছিল সেটা আমরা ঠিকঠাক জানি না। কোথাও এই ঘটনার কোনও বর্ণনা পাওয়া যায় না। মহম্মদ ঘোরীর সেনাবাহিনী এসেছিল ১১৯৪ সালে—তারা ধ্বংস করে থাকতে পারে। তার পরে সেটা তৈরি করা হয়েছিল।, এমনটাও হয়ে থাকতে পারে। আবার পরবর্তী কালের মুসলমান সেনাপতিরাও এটিকে ধ্বংস করে থাকতে পারে। তাই এটা সম্ভব যে ১৫২৮ সালে বাবরের সেনাপতি মীর বাকি যখন এখানে আসেন, তিনি হয়ত দারুন একটা হিন্দু মন্দির নয়, একটা ধ্বংসস্তুপ বা পুরনো একটা মসজিদ দেখতে পেয়েছিলেন”। অন্য পুরাতত্ত্ববিদরা পরিষ্কার জানিয়েছেন যে ওখানে কোন ইটের বা পাথরের মন্দিরের অস্তিত্বের কোন রকম প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পৃষ্ঠা-২৭, পর্ব- ১০)
ঘটনা হল, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যটি ভারতের সংসদে সবচেয়ে বেশি সাংসদ পাঠায়। এই রাজ্যের ভোট কোন্ দিকে পড়ছে সেটা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দিন ধরেই বিজেপি তাই এই রাজ্যটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চলছে। ১৯৯০-৯২-এর রাম জন্মভূমি আন্দোলন তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয় যখন ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সঙ্ঘের জঙ্গিরা বাবরি মসজিদটিকে ধ্বংস করে দেয়, আর তারই ফলশ্রুতিতে সারা ভারত জুড়ে, বিশেষ করে উত্তর ভারত আর মুম্বাইয়ে, বিরাট সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। এর ফল হিসেবে আবার প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম ধর্মান্ধদের হাত শক্ত হয়—তারা হিন্দু মন্দির ও হিন্দুদের সম্পত্তি ধ্বংস করে, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালায়।
১৯৯৫ সালে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে একটা স্বল্পস্থায়ী জোট-সরকারে ঢুকতে সমর্থ হয়। এর ফলে ঐ রাজ্যে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তারা বেশ ভাল ফল করে। ১৯৯৭ সালে তারা আবার “দলিতদের” দল কাঁসিরাম ও মায়াবতীর ‘বহুজন সমাজ পার্টি’ (বিএসপি)-র সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করে। ঠিক হয়েছিল, প্রথম ছ’ মাস মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তারপর বিজেপি। কিন্তু ১৯৭৭-র শেষাশেষি বিএসপি সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয়। তা সত্ত্বেও বিজেপি পেশীশক্তি ও টাকার জোরে প্রচুর “ঘোড়া কেনাবেচা” করে সরকারে যেতে সমর্থ হয়। নতুন যারা বিজেপি-র সাথে আসে তাদের মন্ত্রীত্ব দিয়ে তুষ্ট রাখা হয়। সে জন্য নতুন নতুন মন্ত্রকও তৈরি করতে হয়। বোঝাই যায়, নাগপুরের সদর দপ্তর থেকে আরএসএস-এর এইসব কাজকর্মে মদত দেওয়া হয়।
“বাজপেয়ী ও বিজেপি-র অন্য নেতারা এখনও বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্থানে রাম মন্দির গড়তে চান। এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময়ে মোদী ও যোগী সরকারের আনুকূল্যে তা অনেকদূর এগিয়ে গেছে, এবং ১৯৯২ ডিসেম্বরের মসজিদ ধ্বংস ও দাঙ্গার সমস্ত দোষীকে আদালত অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। রক্ষণশীল উচ্চ জাতের হিন্দুদের কাছে সঙ্ঘের দেওয়া শপথ অযোধ্যায় রাম মন্দির। বাজপেয়ী কি নাগপুর থেকে আসা নির্দেশ অমান্য করবেন? তার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আবার উত্তরপ্রদেশেরই মথুরায় কৃষ্ণের জন্মস্থানকে “মুক্ত” করার জন্য আরেকটি আন্দোলন শুরু করতে উন্মুখ। মায়াবতী কাঁসিরামের পার্টি বিএসপি সেটা চায় না। এখন উত্তরপ্রদেশে বিরোধী দল মুলায়ম ও অখিলেশ যাদবের পার্টি। তারা কোন্ অবস্থান নেয়, তা বলা যায় না। (ক্রমশঃ)
পৃষ্ঠা- ২৮, পর্ব-১১
বিজেপি সরকারের পারমাণবিক পরীক্ষা: নতুন টানাপোড়েনের জন্ম
১৯৯৮ সালের ১১ মে ভারত সরকার রাজস্থানে তিনটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। মার্চে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী লোকসভায় বলেন, “আমাদের পার্টি মনে করে যে ভারতে এই বোমা থাকা দরকার, কারণ তা এই দেশকে বাইরের বিশ্বে অন্য দেশগুলির সাপেক্ষে একটা শক্ত জায়গায় দাঁড় করাবে”। মনে হয় এর মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার চীন, পাকিস্তান ও বাইরের বিশ্বকে একটা উগ্র দেশপ্রেমের বার্তা দিতে চেয়েছিল। প্রায় সবাই জানত যে পাকিস্তান তখন পারমাণবিক বোমা তৈরির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।, বাজপেয়ী সরকারের এ কাজ তাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। ভারতীয় উপমহাদেশে কি তাহলে পারমাণবিক যুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে? সত্যি হোক বা মিথ্যে, সিআইএ একটা রিপোর্টে জানায় যে অতি সম্প্রতি সেরকম একটা গুরুতর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটি কাটানো গেছে। যাই হোক, ১১মে-র ঘটনার পর এ উপমহাদেশে পারমাণবিক যুদ্ধ আর কষ্টকল্পিত নয়। (ক্রমশঃ)


পৃষ্ঠা-২৯, পর্ব-১২
আরএসএস কি সত্যিই ফ্যাসিবাদী?
কোনো কোনো মহলে আরএসএস-কে ফ্যাসিস্ট বলা হয়ে থাকে। এ দাবির সারবত্তা কতটা? কাউকে ফ্যাসিস্ট বলা হয় কেন? আরএসএস বা বিজেপি-কে ফ্যাসিস্ট বলার আগে দেখে নিতে হবে ফ্যাসিস্ট কথাটার মানে কী, আর তাদের ধারণাগুলির সঙ্গে “সঙ্ঘ” পরিবারের কাজকর্ম মেলে কিনা।
ফ্যাসিবাদ বলতে বোঝায় ১৯২০-র দশকে ইউরোপে জনপ্রিয় হওয়া কিছু বিশ্বাসগুচ্ছ—অনেক সময় আবার একে অপরের সঙ্গে মেলে না। জার্মানির যোহানেস গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মার্ক ট্রিশ-এর কথা অনুসারে, কোনও দল বা সংগঠন নিম্নলিখিত ধারণাগুচ্ছ (বা এর কিছু অংশ) মেনে চললে তাকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দেওয়া যায়—
১) “জাতির প্রাচীন গৌরবে” ফিরে যাওয়ার তত্ত্ব প্রচার—যা হিটলার করেছিল;
২) স্তর-বিভাজিত, সামরিক ধরণের কর্পোরেট সামাজিক সংগঠন—অর্থাৎ হিটলারের আদলে গেস্টোপো বা এসএস বাহিনি এবং তার নানা স্তর;
৩) নেতাকে প্রায় পুজো করা—যা এখন ভারতের মিডিয়ার কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে করা হচ্ছে (কিন্তু আসল চালক হলেন আরএসএসের নেতা)।;
৪) জাতীয় আত্মনির্ভরশীলতার ডাক দেওয়া;
৫) “পূর্ণ কর্মসংস্থান”-এর ডাক দেওয়া;
৬) আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদী বিদেশ নীতি।
ডঃ ট্রিশ-এর কথা অনুসারে, এ সবগুলি পয়েন্ট মিললে তবেই সমস্যা দেখা দেয়, তবে প্রথম তিনটি পয়েন্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আরএসএস এবং বিজেপি বা ভিএইসপি-র মত তার ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলি কি এইসব ধ্যানধারণা মেনে চলে? দুঃখের বিষয়, এর উত্তর হল হ্যাঁ। প্রাচীন তথাকথিত হিন্দু জাতির “গৌরবোজ্জ্বল ভারতীয় প্রথা”-য় ফিরে যাওয়া হল তাদের প্রধান বিশ্বাস, প্রধান পথ। আরএসএস প্রতিদিন তার সামরিক ধরনের শাখা বা জমায়েতে তাদের কর্মী ও সমর্থকদের এই শিক্ষাই দেয় যে হিন্দুদের “সর্ব-প্রাচীন জাতি ভারতবর্ষ” ছিল বিশ্বে “সর্বশ্রেষ্ঠ”; তার অধিবাসীরা “সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও ধার্মিক”। সঙ্ঘের নেতারা কখনোই এটা বলতে ভোলেন না যে ভারতের সব সমস্যার শুরু হল তখনই, যখন হিন্দুদের “অনৈক্যের ফলে” মুসলমান ও তারপর ব্রিটিশ আক্রমণকারীরা ভারতে হানা দেয় ও এই “পবিত্র ভূমি” দখল করে নেয়। সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘকালীন লক্ষ্য হল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে “অখন্ড ভারত” গড়ে সেই “প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল যুগ” ফিরিয়ে আনা। অখন্ড ভারতের অর্থ “হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী” ও “গান্ধার থেকে ব্রহ্মদেশ”, অর্থাৎ উত্তরে তিব্বত থেকে ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, অর্থাৎ বার্মা, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। সারা বিশ্বের হিন্দুদের সংগঠিত করে তাদের “ঐক্যের” এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে।
আরএসএস সত্যিই একটি স্তর-বিভাজিত সামরিক ধরনের সংগঠন, যা তার কর্মীদের সেনাদলের কায়দায় প্রশিক্ষিত করে।
আরএএস-এর একজন সর্বোচ্চ নেতা আছেন—‘সরসঙ্ঘচালক’। ইনি নির্বাচিত নন। প্রকৃতপক্ষে আরএএস-এর কোনও নেতাই নির্বাচিত নন—এই সংগঠনের ভিতরে নির্বাচনের কোনও ব্যবস্থাই নেই। সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশ, বিনা প্রশ্নে পালন করা হয়। তাছাড়া সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ কেশবরাও বলিরামরাও হেডগেওয়ার, দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বিখ্যাত সর্বোচ্চ নেতা মাধবরাও সদাশিবরাও গোলওয়ালকর বা “গুরুজী”—এদের যেভাবে প্রায় দেবজ্ঞানে ভক্তির সঙ্গে স্মরণ করা হয় তা প্রায় পূজার সামিল। এ দুজনকে আরএসএস অবতারের মর্যাদা দেয়। আরএসএস-এর অফিসে, তাদের দোকানে এদের ছবি পাওয়া যায়, সঙ্ঘের কর্মীদের বাড়ির দেওয়ালে এদের ছবি শোভা পায়। এদের জীবন সম্পর্কে নানা গল্প—প্রায়শ অতিরঞ্জিত—আরএসএস-এর শিবির ও অন্যান্য জমায়েতে নিয়মিতভাবে বলা হয়। এদের জীবন ও কাজের ওপর প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধগুলি পুরস্কার পায়। (ক্রমশঃ)
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩৩৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/১২/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast