www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বাঙালির বোধ-বিকৃতি ও ভারতের ইতিহাস--প্রথম পর্ব

“...হিন্দু না ওরা মুসলিম! ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কান্ডারী, বলো ডুবিছে মানুষ,সন্তান মোর মা’র...।‌”
একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া,মানবতাবাদের,সাম্যবাদের এমন উদার জয়ধ্বনি বোধ হয় তাঁর সমসাময়িক আর কারও কাছ থেকে শোনা যায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—কেন শোনা যায়নি? সাময়িক মন-ভোলানো কথায় অনেকেই হয়তো বলবেন যে গানটা তো আজও গাওয়া হয়। হ্যাঁ,গাওয়া হয় ঠিকই,কিন্তু দুঃখের বিষয়,তার অন্তর্নিহিত ভাবনাকে প্রোথিত করা হয় না হৃদয়ে।

আজকের সমাজে বাঙালি,অতি বাঙালিদের অদ্ভুতাচরণ আশ্চর্যজনকভাবে অপরিবর্তিত। এই প্রবন্ধে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ, খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করি। ফেব্রুয়ারি,২০০৯-এর ঘটনা। দক্ষিণ ২৪ পরগণার ঢোলা হাট থেকে বাসে চেপে আমি যাচ্ছিলাম ১০-১২ কিলোমিটার দূরবর্তী জুমাইলস্কর হাটের দিকে। পার্শ্ববর্তী আসনে বসা,দেখতে বেশ ধোপদুরস্ত,শিক্ষিত-দর্শন দু’জন সহযাত্রীর একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন—‘দাদা, কোথায় যাবেন?’ জবাবে আমার গন্তব্য স্থানের নাম তাঁদের কর্ণগোচর করায়,অন্য ভদ্রলোক ছুঁড়ে দিলেন তাঁর বক্তব্য—‘আপনাকে এই বাসরুটে প্রথম দেখছি তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমার পোশাক-পরিচ্ছদ বা কথনশৈলীতে হয়তো আমাকে একটু অন্যরকম মনে হয়েছিল তাঁদের, ভেবে নিলাম,তাই এই যেচে আলাপচারিতা।   যা-ইহোক, আমি মৃদু হেসে বললাম—‘ঠিকই ধরেছেন আপনারা। আমি আন্দামানে থাকি,সচরাচর এই অঞ্চলে চলাফেরা আমার নেই। বছরে একবার এখানে আসি,গরমের ছুটিতে।‌’...এরপর যেন ম্যাজিকের মতো কাজ হ’ল। সবিস্ময়,কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাঁরা আন্দামান সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। চলন্ত বাসের মধ্যে শব্দদূষণ উপেক্ষা ক’রে যতটা সম্ভব শোনালাম আন্দামান-বৃত্তান্ত।

আলাপতৃপ্ত সহযাত্রীদ্বয় যেন কৃতার্থ হলেন এবং তাঁদের একজন শেষ সংলাপ পরিবেশন করলেন—‘খুব ভাল লাগল আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে। কিন্তু আপনার নামটা তো জানা হ’ল না!’ আমি জানালাম—‘আমার নাম রইসউদ্দিন গায়েন।‌’
আমার নামটা তাঁদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করামাত্রই তাঁদের মুখ-চোখে ফুটে উঠল এক চরম হতাশার ছবি। কেমন যেন নির্বাক হয়ে গেলেন দুজন বঙ্গভাষী,বঙ্গবাসী। তাঁরা আর একটিও বাক্য বিনিময় করলেন না আমার সঙ্গে। এমনকী যথাসময় তাঁরা তাঁদের নির্দিষ্ট বাস-স্টপে নেমে গেলেন অথচ নামার সময় আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালে না—বিদায়ী মুহূর্তের সৌজন্যমূলক শুভেচ্ছা-জ্ঞাপন তো দূরের কথা!

আজ আন্দামানে বসে ভাবছি, শুধু ওদেরই বা দোষ খুঁজি কেন! এই তো সেদিন,আন্দামানের এক নব-কবি-সম্পাদক আমাকে বলেই ফেললেন—‘আপনারা (অর্থাৎ মুসলমানরা) তো বাঙালি নন্,আপনাদের ভাষা আরবী,ঊর্দু।‌’
মন্তব্যকারী একজন ইতিহাসের শিক্ষক,পূর্ব পাকিস্তান-আগত উদ্বাস্তু সেটলার-বংশধর। অথচ,এই উক্তিটি করার সময় তাঁর মনেই পড়েনি যে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি,পূর্ব-পাকিস্তানে বাংলা-ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য, বাংলা-ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য, বাংলা মা’র অসীম সাহসী সন্তান রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার বুক পেতে নিয়েছিলেন ঊর্দুভাষী শাসকদের বুলেট,রক্তের আলপনায় সাজিয়েছিলেন ঢাকা শহরের রাজপথ। এই বীর সন্তানদের পরিচয় কি আমরা ‘আরবী-ঊর্দুভাষী-মুসলমান ব'লে দেব না ‘বাঙালি’ বলে দেব? ভোলা কি যায়, মুক্তিযুদ্ধ’র সহস্র শহিদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ আজ জগৎসভায় স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষার একমাত্র ‘স্বাধীন’ দেশ হিসেবে!

মাঝে মাঝে আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি—‘বাঙালির কেন এই বোধ-বিকৃতি?’ অনেক চিন্তা-ভাবনার পর মনের কাছ থেকে যে উত্তর পাই,তা হ’ল— এই বোধ-বিকৃতির জন্য ভারতীয় ইতিহাসই দায়ী। এ বিষয়ে কিছু বলার আগে, কয়েকজন নিরপেক্ষ ভারতীয় মনীষী ও ঐতিহাসিকদের মন্তব্য অনুধাবন করা দরকার।

তৎকালীন আনন্দবাজার, যুগান্তর ও বসুমতী-প্রশংসিত ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস (প্রথম খন্ড) গ্রন্থে শ্রী ধনঞ্জয় দাস মজুমদার লিখেছেন ‘ইংরাজগণ শাসকজাতি ছিলেন। ভারতের আর্যগোষ্ঠী-বহির্গত পন্ডিত ও ঐতিহাসিকগণের মধ্যে বাংলার ইংরাজের সংস্কৃতিতে অভিজাত ও বেতনভুক ঐতিহাসিক ও শাস্ত্রকারগণ তাঁদের শাস্ত্রগ্রন্থের বহু তালপত্র বদলাইয়া তাঁহাদের ইচ্ছামতো শ্লোক প্রক্ষিপ্ত করেন। আবার বহু তারপত্র ধ্বংস করিয়াছেন। এই শাসকগোষ্ঠীর ভারত শাসনের সুবিধার জন্য তাঁহারা হিন্দু শাস্ত্রের বহু তথ্য গোপন,বহু তথ্য বিকৃত এবং বহু মিথ্যা প্রক্ষিপ্ত করিয়া যে মিথ্যা ইতিহাস প্রস্তুত করিয়াছেন তাহার বহু প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে।... বিভেদের সুযোগে ইংরাজ রাজত্ব চিরস্থায়ী করিতে চেষ্টা করেন। এই জন্য তাঁহারা তাঁহাদের নবগত হিন্দুদিগকে এইরূপ মিথ্যা ইতিহাস লিখিতে অনুপ্রেরণা দিয়াছিলেন।...(পৃ: ৬৬-৬৭)

শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘ভারতে ইতিহাস রচনাপ্রণালী’ গ্রন্থের ৬০-৬১ পৃষ্ঠায় বলেছেন—“...সাম্প্রতিক কালে সরকারী নির্দেশমত সত্যকে এবং ইতিহাস রচনাশৈলীর মৌল নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়া ইতিহাস রচনার প্রয়াসকে সমর্থন করা যায় না।‌”

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন—“অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থের দু’একটি স্থল ঈষৎ পরিবর্তনপূর্বক, কোথাও বা প্রমাণসূত্রটাক বদলাইয়া,সমগ্র গ্রন্থখানিকে ‘হিন্দু’ করিয়া তোলা হইয়াছে। পরবর্তীকালে ভাষার পরিমার্জনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা আদি কবি কৃত্তিবাসও পরিমার্জিত হইয়াছেন। কবির কাব্য পরিষ্কৃত করিতে যাইয়া সংশোধকগণ আবর্জনারাশির দ্বারা কৃত্তিবাসকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছেন।...ইহা ছাড়া অন্যান্য পুরাণ,উপ-পুরাণ হইতে মনোরম অংশও লিপিকারগণ বাছিয়া আনিয়া কৃত্তিবাসে জুড়িযা দিয়াছেন।...(সমালোচনা সংগ্রহ/কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,চতুর্থ সংস্করণ,পৃ: ২৮৩-২৮৪)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—“ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক দু:স্বপ্নের কাহিনীমাত্র।‌” .....(ক্রমশ:)
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৫১০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/১১/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রেনেসাঁ সাহা ০৪/১১/২০১৪
    অনেক কিছু জানলাম কবি । বেশ ভালো লাগল জানতে।
 
Quantcast