www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

চা বাগানের সেই সময়

সেটা ছিল ১৯৮৯ সালের ঘটনা | বাংলার পাহাড় অশান্ত হতে শুরু করেছে | চারিদিকে গোর্খা জাতিগোষ্ঠী আন্দোলন ধিকিধিকি জ্বলছিল |নানা দাবি দাওয়া নিয়ে বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ শুরু হলো |সিংতোম চা বাগান আর সেখানকার চা শ্রমিকদের ভিতর থেকে একটা নাম বার বার ভেসে উঠতে লাগলো বিনতাই গুরুং |চা শ্রমিকদের অনেক চাহিদা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে সেই দাবিতে গর্জে উঠলো আন্দোলন |এমনিতেই ব্রিটিশ রাজ শেষ হবার পর বাগানগুলোর মালিকানা যখন ভারতীয়দের হাতে আসে তখন থেকেই চায়ের চাষে আধুনিকীকরণ এবং তার গুণমান নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছিল|শ্রীলংকা ,ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য দেশ চা চাষ শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় চায়ের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু হয়|এই বাগানের আন্দোলন শুরু হবার সাথে সাথে আসে পাশের বাগানগুলো তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে|ঠিক এই সময় একটি নাম এই গোর্খা জনগোষ্ঠীর ভিতর থেকে উঠে আসে যার নেতৃত্বে স্বাধীন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলন শুরু হয়|এই দুই আন্দোলন মিলে মিশে যেন রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করতে থাকে|এদের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় ছত্রে রাই নাম এক সদ্য যুবা সুবক্তা গোর্খা নেতাকে|
বিনতাই গুরুং মালিক কর্তৃপক্ষকে আলোচনার জন্য দশ দফা দাবি পেশ করলো যার ভিতর বিনামূল্যে স্বাস্থ বীমা ,সঠিক হারে বেতন বৃদ্ধি,বোনাস আরো বেশ কিছু |মালিক পক্ষের থেকে যিনি প্রতিনিধি হিসেবে এলেন তিনি প্রতিমা চৌধুরী ,সদ্য আমেরিকা থেকে ফেরা বিসনেস ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রিধারী সুদর্শনা এক যুবতী , মালিক তেজ প্রতাপের কন্যা | একি এতো সেই বিনু ,ছোটবেলা বাবা তেজ প্রতাপ চৌধুরীর সাথে এই বাগানে আসা ছোট্ট মেয়ে প্রতিমার চিনতে অসুবিধা হলোনা | প্রতিমার স্কুল ছিল লরেটো এলিয়ট রোড |স্কুলের সেই দিনগুলোতে বাবা মায়ের সাথে ছোট্ট মিনু অর্থাৎ প্রতিমা গরমের ছুটিতে সুযোগ পেলেই এই বাগানে চলে আসত আর উঠতো বাগান ঘেঁষা সুন্দর বাংলোতে| ছুটির দিনগুলো কাটতো বিনু অর্থাৎ বিনতাইয়ের সাথে এই বাগানে খেলে|বিনুর বাবা নিমেন এই বাগানে কেয়ারটেকার ছিল| তেজ চৌধুরীর যথেষ্ট আস্থাভাজন ছিল এই নিমেন | হঠাৎ করে কি যে হলো|এক আফিঙের নেশায় বুঁদ হয়ে বাগানের এক দিনমজুর পরিনের সাথে পালিয়ে গেলো বৌ , ছেলে সব ছেড়ে দিয়ে|সেই থেকে বিনু কেমন যেন মনমরা হয়ে গেলো | গরমের ছুটিতে এখানে এলে বাবাকে অনেক বার মিনু জিজ্ঞেষ করতো বিনু কোথায় ?তত দিনে বিনুর মা পাশের বাগানের এক কর্মচারীর সাথে ঘর পেতেছে| আর বিনুর ঠিকানা হয়েছে সেইখানে মায়ের সাথে|তারপর এতগুলো বছর পার হবার পর প্রতিমার সামনে হাজির সেই বিনতাই গুরুং এক গুচ্ছ দাবি দাওয়া নিয়ে |মিনু কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারেনা|
পরিবেশটা যেন গুমোট আর তার ভিতর দমকা হাওয়া এনে দিলো প্রতিমা নিজেই |কি বিনু সব খবর ভালো তো ?আন্দোলনকারী আরো তিন জন শ্রমিক প্রতিনিধির সামনে এই বিনু সম্বোধনটা একটু যেন অপ্রস্তুত করে দিলো বিনতাই গুরুংকে |নিমেষে সাবলীল হবার মতো করে সে বললো হাঁ ম্যাডাম |শুরু হলো আলোচনা |এক দিনে এসব মেটার নয় সেটা দু পক্ষই বুঝতে পারছিলো |প্রতিমা খালি একবার বলে দিলো এর পরের বার আলোচনাটা হবে সাত দিন পরে এবং কুশল বিনিময় করে তারা বেরিয়ে গেলো | মনের কোণে একটা শ্রদ্ধা আর পুরোনো বন্ধুত্ব মিলে মিশে মিশ্র অনুভূতি জেগে উঠছে আর চায়ের পাতার একটা সুবাস | তার ভিতর দিয়ে বিনতাই ফিরলো বাড়িতে | ভাবতে লাগলো কি ভাবে মিনুর সাথে আলোচনাতে দাবি গুলো মিটবে আর শ্রমিকরা যারা ধীরে ধীরে তার উপর এতো আস্থা রেখেছে তার মর্যাদা রাখতে পারবে | এই ধরণের চা বাগানগুলোতে গড়ে ওঠা দাবিদাওয়া আর তাদের একত্রীকরণ করে বৃহত্তর আন্দোলনের স্বপ্ন দেখানো ছত্রে রাই সমস্ত বাগান শ্রমিকদের কাছে যেন এক মাসিহা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল |বিনু ভাবছিলো যে আন্দোলনের রাশ তার হাত থেকে যেন ছাত্রের হাতে চলে না যায়| এর ভিতর স্বায়ত্ত শাসন নিয়ে দাবি দাওয়া আর ছোট পরিসরে রইলোনা | ছত্রের নির্দেশে শুরু হলো পাহাড় জোড়া হরতাল |প্রশাসন তাদের আলোচনার আহ্বান করলো আর আন্দোলন স্থগিত রাখতে বললো | ছত্রের দল গোর্খা মোর্চা অনড় সেই হরতাল চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো | এটা আর শুধু পাহাড়ের ছোট পরিসরে রইলোনা যখন সরকারি অতিথিনিবাসে আগুন লাগানো হলো | জেগে উঠলো রাজ্য প্রশাসন আর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলো | প্রতিমার পক্ষে এই পরিস্থিতিতে সিংতোম চা বাগানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে গেলো |
আসামের কার্বি চা বাগানে তেজ চৌধুরীর প্রতি মাসে একবার করে যাওয়ার প্রয়াজন হতো | এখানে ম্যানেজার অশোক বহু বছর থেকে যথেষ্ট আস্থাভাজন এবং জনপ্রিয় ছিল | মালিকের সাথে সর্বদা পরামর্শ করে সে বাগান চালাতো | বাগানটাও লাভজনক হয়ে উঠেছিল |এখানেও কার্বি জনজাতি স্থানীয় স্তরে স্বায়ত্ত শ্বাসনের দাবিতে শুরু করেছিল তাদের আন্দোলন | বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগানগুলোতে তারা শুরু করেছিল তোলা আদায় | কার্বি চা বাগানেও ম্যানেজারকে তারা পঁচাশ লাখের দাবি জানায় | তেজপ্রতাপ চৌধুরী বাগানে গিয়ে এই নতুন দাবির কোথা শুনে সোজা থানায় লিখিত অভিযোগ জানালেন |খবরটা আন্দোলনকারীদের কানে হাওয়ার মতো পৌঁছে গেলো |পাঁচ জনের সশস্ত্র বাহিনী রাতেই ওই বাগানের বাংলোতে হানা দিলো আর অশোকের হাত পা বেঁধে তার চোখের সামনে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে তেজ প্রতাপকে হুড খোলা জিপের পিছনে বেঁধে টেনে হিচড়ে জঙ্গলের ভিতর নিমেষে উধাও হয়ে গেলো | সারা রাত ওই অবস্থাতে পরে থাকার পর পরদিন সকালে তাকে এক কর্মচারী এসে বাঁধন মুক্ত করলো | অশোক কলকাতায় ট্রাঙ্ক কল করে প্রতিমাকে সব ঘটনা জানালো | এর ভিতর হঠাৎ দার্জিলিঙের সিংতোম বাগান থেকে খবর এলো বিনতাই গুরুং নাকি কোনো এক রাজ্য প্রশাসনিক কর্তাকে শারীরিক নিগ্রহ করায় তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে | হঠাৎ সকালে উঠে তাদের আলিপুরের বাড়িতে কলিং বেলের শব্দ | দারোয়ান এসে বললো মিনু ম্যাডাম এক জন নেপালি লোক আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে | মিনু তাকে বৈঠকখানার ঘরে বসতে বলে নিচে এসে দেখি বিনতাই বসে আছে | মিনু জিজ্ঞেস করলো একি বিনু তুমি এখানে ? বিনতাই বললো আমার খুব ঝামেলা হয়েছে | ছত্রের দল আমাকে ওদের আন্দোলনে জড়িয়ে দিয়েছে আর একটা ঘটনাতে মাথা গরম করে ডিএমকে লোহার রড দিয়ে আঘাত করে দিয়েছে আর তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন | পুলিশ তাকে খুঁজছে | প্রতিমা বুঝে উঠতে পারছেনা এখন কি ভাবে সামলাবে ব্যাপারটা | এমনিতেই বাবাকে কার্বি আন্দোলনকারীরা তুলে নিয়ে গেছে আর তার কোনো খবর পর্যন্ত নেই | প্রতিমা বিনুকে বললো তুমি হাত মুখ ধুয়ে পাশের গেস্ট কোয়ার্টারে গিয়ে রেস্ট করো | দেখছি কি করা যায় | অনেক ভেবে সে ঠিক করলো আজই শিলচর হয়ে কার্বি বাগান পৌঁছতে হবে আর ওখানে গিয়ে সে যোগাযোগ করবে আন্দোলনকারীদের সাথে | বিনুকে ডেকে সেই কথা সে জানালো | বিনু কিছুতেই ম্যাডামকে একা ছাড়তে চাইলোনা | জেদ ধরলো আমি আপনার সাথে যাবো | অগত্যা বিনতাইকে সাথে নিয়ে মিনু রওনা হলো কার্বির উদ্দেশে |সকাল দশটাতে শিলচর বিমানবন্দরে নামতেই দেখলো অশোক গাড়ি নিয়ে হাজির | প্রতিমা,বিনতাই আর অশোক কার্বির দিকে রওনা দিলো | রাস্তাতেই নিজেরা আলোচনা করলো |অশোক বললো ম্যাডাম একবার যাবার সময় থানা হয়ে ঘুরে গেলে হতোনা? প্রতিমা জিজ্ঞেস করলো যারা বাবাকে তুলে নিয়ে গেছে তারা কোনো যোগাযোগ করেছে কি না | অশোক বললো না ম্যাডাম কোনো খবর নেই |যাবার সময় পথে থানা |সেখানে ঢুকতেই কর্তব্যরত এস আই জিজ্ঞেস করলেন অশোকবাবু, আপনাদের কাছে অপহরণকারীরা কেউ কোনো চিঠি পাঠিয়েছে কি? সাধারণত দেখা যায় এরা চিঠি পাঠিয়ে টাকার দাবি জানায় | এক্ষেত্রে তা না হওয়ায় আর ৪৮ ঘন্টা হয়ে যাওয়াতে একটু অন্য রকম ঠেকলো তাদের | প্রতিমা জিজ্ঞেস করলো বাবা থানাতে আসার পরে আপনারা ওনার জন্য দুজন রক্ষীর ব্যবস্থা করেননি কেন ? এস আই বললেন যে অনেকে তো এই লোকেদের সাথে আলোচনা করে মিটিয়ে নেয় আর তা ছাড়া তেজ প্রতাপ বাবু তো আমাদের ঠিক সে রম কিছু বলেন ও নি |ও আর একটা কথা ম্যাডাম ,তেজ সাহেবের কি কোনো আর্মস আছে মানে আমি লাইসেন্সড আর্মস এর কথা বলছি | প্রতিমা বললো এর কোনো প্রয়াজন কখনো হয়নি আর আমার এ বিষয়ে জানা নেই |থানা থেকে বেরিয়ে অশোক গাড়ি স্টার্ট করলো সোজা গার্ডেন গেস্ট হাউস | দুটো ঘর আর বাথরুম একটাই | বিনু আর প্রতিমা দুটো ঘরে ঢুকে পড়লো |
প্রতিমা সন্ধ্যাবেলা অশোক আর বিনতাইকে ডেকে নিলো আলোচনার জন্য | প্রথমেই অশোক বললো দিদিমণি ,সাহেবকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে কার্বি গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করা উচিত | ওরা কিন্তু খুব আত্মকেন্দ্রিক আর নিষ্ঠূর প্রকৃতির হয় | বিনতাই বললো আমাকে দায়িত্ব দিন | আমি ওদের সাথে জঙ্গলে গিয়ে কথা বলবো | প্রতিমা বললো তুমি তো এখানকার লোকেদের ভাষা , আদব কায়দা আর রাস্তা ঘাট কিছু জানোনা | তা ছাড়া ওরা তো নৃশংস হয় শুনেছি | বিনতাই বললো ও সব নিয়ে ভাববেননা | এই সময়কালের মধ্যে আমি বন্দুক চালানোতে পারদর্শী হয়ে উঠেছি | খালি একটা পিস্তলের ব্যবস্থা করে দিন | অশোক তাদের বাগানের গার্ডকে বলে একটা দেশি রিভলভার জোগাড় করে এনে দিলো | সেটা পকেটে নিয়ে বিনু পরদিন সকালে প্রথমে বাজারে একটা চায়ের দোকানে পৌঁছলো | হটাৎ তার নজর একটা জংলী পাহাড়ি লোকের দিকে গেলো |লোকটা ওকে যেন লক্ষ্য রাখছে | একটু পরে গ্রামটা যেখানে শেষ হয়ে এসেছে সেখানে এসে ডান দিক বাঁ দিক চেয়ে দেখলো | রাস্তা বুঝতে পারছেনা |পিছন থেকে দেখে সেই লোকটা এদিকেই এগিয়ে আসছে | ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে কি একটা বললো | সে ভাষা বিনু বুঝলোনা | বিনু জিজ্ঞেস করলো ভাই এই জঙ্গলের ভিতর শুনছিলাম একটা পুরোনো দিনের ভাঙ্গা গির্জা আছে |বলতে পারো কিভাবে সেখানে যাবো ?লোকটা এবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বললো তুম তো কিসি কো ঢুন্ডতা হেই না ? বিনু বুঝলো যে এ তাকে গেস্ট হাউস থেকেই ফলো করছে | লোকটা বললো হামকো ফলো কারো | জঙ্গলের মাটি আর এবরো খেবড়ো পথ একটু যাবার পর কেমন যেন ভিতরটা গভীর অন্ধকার হয়ে আসছে | বিনু লক্ষ্য করলো কাঁচা মাটির রাস্তাতে গাড়ির চাকার দাগ |অচেনা লোক অচেনা জায়গা |একবার ভাবলো ছত্রের পাল্লায় পরে ভাগ্গিশ বন্দুক চালানোটা শিখে একটু চোস্ত হয়ে উঠেছে | এই পরিস্থিতে ভয়টা একটু কম ই লাগছে | পকেটে একটা দেশি পিস্তল তো আছে |এক ঘন্টা এই ভাবে হাটতে হাটতে যখন ক্লান্ত লাগছে হটাৎ দেখলো দূরে একটা পরিত্যক্ত চার্চ | লোকটা পা চালিয়ে ঢুকে পড়লো সেখানে | ভিতরে দশ বারো জনের উপস্থিতি ওই নিভু আলোর মাঝেও বুঝতে পারছিলো বিনু | একটা পাতলা চেহারার লোক এক পিঠ এলো মেলো চুল নিয়ে এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো | কি মালিককে উদ্ধার করতে তুমি এসেছো ? বিনু পাল্টা জিজ্ঞেস করলো কেন তাকে আটক করেছো ? হেঁড়ে গলায় খেঁকিয়ে উঠে বললো শালা হারামি পুলিশ কাছে কমপ্লেইন করলো ? আমার কোনো ওকাত আছে কি না ? এখন বোঝ |
কথার ফাঁকে একটা গোঙ্গানির আওয়াজ যেন কোথা থেকে শুনতে পেলো বিনু | বুঝতে চাইলো কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে | সামনে দাঁড়ানো লোকটা বলে উঠলো তুমহারা বাবুকো হামনে গলি মারনিকা সোচা থা |ফির লাগা উস্কা বিবি অর বাচ্চা হায় | অব বোলো কিতনা রুপিয়া তুম দেগা ?বিনু বললো আমাকে আগে একবার বাবুর সাথে দেখা করাও | লোকটা ভাঙ্গা হিন্দিতে বললো আগে রুপিয়া ইন্তিযাম কারো , ফির আনা | বিনু ভাবলো পকেট থেকে বের করে এই মুহূর্তে দুটো দেগে দিই |তার পর আবার চিন্তা করলো সাহেবের যদি এরা বিপদ ঘটায় তবে সব ভেস্তে যাবে |সর্দারকে বললো আমি তোমাদের কালকে জানাৰো |সর্দার তার দলের সেই লোকটাকে ওদের ভাষায় কিছু একটা বললো |সেই লোকটা বিনুকে নিয়ে ফেরার পথ দেখানোর জন্য এগিয়ে চললো |পিছন থেকে সর্দার বললো বাজারকে চাই দুকানমে কাল ইয়ে হারকু মিলেগা | উসসে বাত কারকে রুপিয়াকা ঠিক কার লেনা তব মালিক মিলেগা| অনেকটা পথ হেটে দু ঘন্টা পরে গেস্ট হাউস ফিরলো বিনু | দেখে প্রতিমা আর অশোক বাগানের কয়েকটা লেবারকে সপ্তাহের টাকা দিচ্ছে | বিনুকে দেখে তারা উদগ্রীব হয়ে তাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়লো | হটাৎ বিনুর নজরে এলো হারকু নামের লোকটার হাতে যে মেরুন উল্কি দেখেছিলো ঠিক সেরকম যেন একটা লেবারের হাতে সে দেখতে পেলো | তবে কি এ ওদের দলের কোনো সদস্য ? প্রতিমাকে আজকের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করাতে প্রতিমা জেদ ধরলো তাকে কালকে ওদের ডেরায় নিয়ে যেতে হবে | সে তাদের কাছে বাবার প্রাণ ভিক্ষা করতেও প্রস্তুত | যাই হোক বিনু ভাবতে লাগলো সিংতোম চা বাগান আর গোর্খা জনজাতির আন্দোলন থেকে দূরে পালিয়ে এসে আর এক ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়লো | রাতে শুয়ে সে ভাবতে লাগলো সব চা বাগানে আর পাহাড়ে কেন এতো অসাম্য আর অশান্তি কে জানে ,কেন এগুলো সমাধান হয়না | লোকে বলে শান্তি থাকলে দেশের উন্নতি বেশি হয় | কম পড়ালেখা জানা বিনুর এই সব নানা চিন্তার মাঝে ঘুম চলে আসে | রাতে ঝঝমিয়ে বৃষ্টি |সে যেন আকাশ ভাঙ্গা আলোর ঝলসানি আর সাথে অবিরাম বৃষ্টি | সকাল বেলা উঠে চা আর ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিয়ে প্রতিমাকে অশোকের মোটর সাইকেল এ নিয়ে বাজারের দিকে চললো |সকাল আটটা | আরে আজ তো এই সময় সেই হারকু বলে লোকটার এই চায়ের দোকানে দেখা পাবার কোথা | বেটা কি তবে বেপাত্তা হয়ে গেলো ? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নজরে এলো একটা সাইকেল উল্টো দিক থেকে এসে ওদের পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো | মুখে গামছা ঢাকা হাতে সেই উল্কি আঁকা | যাবার সময় এক টুকরো কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে গেলো | বিনু তুলে দেখে ভাঙ্গা হিন্দিতে লেখা "হাইলাকান্দি জিন্দাবাদ | তোমরা পঁচাত্তর লক্ষ নিয়ে দেখা করো | চালাকি করলে মালিককে গলি মেরে দেব |" একি টাকার অঙ্ক বেড়ে গেলো দেখছি প্রতিমা জিজ্ঞেস করলো বিনুকে | যাই হোক এখন এদের সাথে ঝামেলা করার রাস্তা নেই |কিন্তু এতগুলো টাকা প্রতিমা কোথা থেকে কি ভাবে জোগাড় করবে এতো কম সময়ে বুঝতে পারলোনা | একবার মনে হলো সিংতোম বাগানটা বিক্রি করে দি | এমনিতেই ওখানে অনেক ঝামেলা আর বন্ধ বাগান বন্ধ পাহাড় কবে যে চালু হবে কে জানে ? তার পর ভাবলো বিক্রি করতে গেলে তো পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি লাগবে | বাগানটা বাবা তেজ প্রতাপের নামে আছে | এখন তো তাও সম্ভবনা |
প্রতিমা ভাবতে ভাবতে কুল পায়না কি করবে এখন | এদিকে পাঁচ দিন হয়ে গেলো তার বাবার কোনো খবর নেই | বাগানে যে কর্মচারীরা আছে তাদের ডেকে নিয়ে ম্যানেজারের ঘরে জমায়েত করলো আর প্রথমেই আবেদন করলো এই সময় তাদের সাথে থাকতে | হাতে নাতে কাজ হলো | রাতে একটা কাগজের টুকরো গেস্ট হাউসের দরজায় রেখে দিদিমনি বলে কেউ ছুটতে ছুটতে পালালো | তখন রাত দশটা বাজে | প্রতিমা দরজা খুলে দেখে দুটো লোক চাদর ঢাকা আর বাইকে উঠে উর্দ্ধশাসে যাচ্ছে | টর্চের আলো ফেলতেই দেখলো একটা লোক যার হাতে সেই লাল উল্কি আঁকা বাইক চালাচ্ছে | কাগজের টুকরোটা তুলে সে দেখে লেখা "বাবুসে মিলনা হায় তো লাস্ট চান্স আপ পচাস লাখ রুপিয়া লেকে কাল শাম পাঁচ বাজে গাওঁ কে বরা মন্দিরকে পিছে আ জানা | পুলিশকো খবর মত্ করনা | তাড়াতাড়ি সে কলকাতায় তার বন্ধু আশু কে টেলিগ্রাম করে টাকার ব্যবস্থা করতে বললো | পরদিন সকালে গৌহাটি থেকে আসাম সিমেন্ট কোম্পানির মালিক পবন জাজোডিয়া তাঁর শিলচর প্লান্টের ম্যানেজারকে পাঠালেন কার্বি বাগানে | তিনি এসে বললেন তাঁরা আশুর পরিচিত এবং টাকার ব্যবস্থা করে তিনি এসেছেন | অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে বিদায় করে মিনু বিনতাইকে রেডি হয়ে থাকতে বলে নিজে টাকাটা গুনে একটা ব্যাগে ভরে নিলো | ঠিক বিকেল চারটেতে বাগানের টাটা সুমো গাড়িটা নিয়ে অশোক , বিনতাই আর মিনু রওনা দিলো সেই বড় মন্দিরের দিকে | হটাৎ নজরে এলো একটা সাদা রংয়ের এম্বাসেডর তাদের পিছু নিয়েছে | প্রতিমা সেই মন্দিরের কাছে পৌঁছে অপেক্ষা করতে লাগলো | গাড়িতে অশোক আর বিনতাই টাকার ব্রিফকেস নিয়ে অপেক্ষায় থাকলো | প্রতিমার কথা অনুসারে বাবাকে যেই ওরা তাঁর হাতে প্রত্যর্পণ করবে সে ও ইশারাতে টাকার ব্যাগটা ওদের তুলে দেবে | কিছুক্ষন এই ভাবে বসে থাকার পর হঠাৎ মিনুর নজর পড়লো ওই মন্দিরের বাইরে দুটো ভিকারী কন্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে | আর মন্দিরটাতে দু একজন লোকের আসা যাওয়া ছাড়া কিছু নজরে আসছেনা |
মন্দিরের ঠিক পিছনের একটা রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে দুটো বাইক আসছে | একটাতে দুজন বন্দুক হাতে আর একটাতে তেজ প্রতাপ দুজনের মাঝে বসা | কিছু দূরে বাইক দুটো আসা মাত্রই তারা তেজপ্রতাপকে নামিয়ে দিলো |ইশারা করে প্রতিমাকে টাকার ব্যাগটা দিতে বললো | প্রতিমা অশোককে গাড়ি থেকে টাকার ব্যাগটা এগিয়ে দিতে বললো |প্রতিমা দেখে তার বাবা ভালো ভাবে দাঁড়াতে পারছেনা | পা দুটো হাঁটুর নিচ থেকে খুব বাজে ভাবে জখম হয়েছে মনে হলো আর এই ক দিনে অনেক রোগাও হয়ে গেছে | টাকার ব্যাগটা নিয়ে বিনতাই এগিয়ে গেলো ওই লোকগুলোর দিকে | ওরা তেজপ্রতাপকে তার হাতে তুলে দিলো | টাকা নিয়ে ওরা বাইক স্টার্ট করতেই হটাৎ করে বিনতাই ওদের দিকে লক্ষ্য করে রিভলভার থেকে গুলি চালালো | নিমেষের মধ্যে মন্দিরের সামনে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকা ওই দুই ভিখারী উঠে দাঁড়িয়ে রিভালভার বের করে ওই বাইক দুটোকে তারা করলো | প্রতিমা দেখে যে সাদা আম্বাসাডরটা ওদের পিছু নিয়েছিল সেটা ওই বাইক দুটোকে তারা করেছে | প্রতিমা তার বাবাকে গাড়িতে তুলে পিছন ফিরে দেখে বিনতাইকে একজন সাদা পোশাকের পুলিশ ধরে হাতের থেকে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়ে বললো আপনাকে আমরা এরেস্ট করলাম | প্রতিমা কিছু বলার চেষ্টা করলো | কিন্তু ওই পুলিশ কর্তা বললেন আপনি সাহেবকে নিয়ে বাংলো ফিরে যান | আমরা ওখানে রাতে এসে পুরো ব্রিফ নেবো | সন্ধে হয়ে গেছে ততক্ষনে | বাবা তেজ প্রতাপকে নিয়ে সে গেস্ট হাউস ফিরে একজন ডক্টরকে ডাকলো | ছ দিনে দাড়ি না কামানো অবস্থা আর দাঁড়াতে না পারা , বাবার অবস্থা দেখে প্রতিমার খুব কষ্ট হতে লাগলো | ডাক্তার এক ঘন্টার ভিতর এসে হাজির হলেন | তেজ প্রতাপকে পরীক্ষা করে বললেন পা দুটো ভেঙ্গে পায়ের পাতা ঘুরে গিয়ে খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে | উনি শিলচরে কোনো হসপিটালে ভর্তি করতে বললেন | ইতি মধ্যে সেই পুলিশ অফিসার আর একজন কনষ্টবলকে নিয়ে ঠিক রাত আটটাতে গেস্ট হাউসে হাজির হলেন | প্রতিমা জিজ্ঞেস করলো আপনারা কোথা থেকে হটাৎ হাজির হলেন ? অফিসার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন আমি কার্সিয়ং থানার এস আই | আমরা আসলে বিনতাইকে খোঁজ করতে আপনাদের কলকাতার বাড়িতে যাই | যখন শুনি আপনার সাথে সে এখানে কার্বির উদ্দেশে রওনা হয়েছে তখন আমরাও শিলচর হয়ে এখানে দু দিনে আগে পৌঁছই | এখানে এসে আমরা বিনতাই গুরুংকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকি | দেখি কিছু একটা গন্ডগোল এখানে হয়ে আছে | স্থানীয় থানাতে গিয়ে তেজপ্রতাপ বাবুর অপহরণের কথাটা শুনে তাদের কাছে একটা গাড়ি আর দু জন আর্মড কনস্টবল নিয়ে আমরা আপনাদের অনুসরণ করতে থাকি | আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল এই বিনতাই গুরুংকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া | আমরা তাতে সফল হয়েছি | আর অপহরণকারীদের একটি বাইক আমরা গুলি করে দুটি লোককে জখম করে গ্রেপ্তার করেছি | টাকাটা এখনো উদ্ধার হয়নি | স্থানীয় থানা ওই দুজনকে নিয়ে গেছে আর কাল ওদের কোর্টে তুলবে | বাকি আর একটা বাইক নিয়ে ওদের বাকি লোকগুলো পালিয়েছে | তেজ প্রতাপ একবার অফিসারের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানালেন আর বললেন বিনতাই এর কি হবে এখন ? অফিসার বললেন আমরা একে নিয়ে গিয়ে রাজসাক্ষী করে ছত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবো | এরা যে আন্দোলন শুরু করেছে তা ভাঙ্গতে না পারলে পরে অনেক বড় ঝামেলা অপেক্ষা করছে | হোম মিনিস্ট্রি থেকে সেরকম নির্দেশ আছে | মিনু আর শিলচর হাসপাতাল না গিয়ে সোজা এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দিলো | কারণ সকালের ফ্লাইট এক ঘন্টাতে কলকাতা পৌঁছলে প্রথমেই বাবাকে নিয়ে আলিপুরের বাড়ি হয়ে সোজা উডল্যান্ড নার্সিংহোমে পৌঁছতে হবে |
এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই বিচারাধীন অবস্থায় পালতে গিয়ে বিনতাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়| ছত্রে আর তার দল পাহাড় জুড়ে আন্দোলন বহুগুন বাড়িয়ে দেয় | সিংতোম বাগান এক গভীর নৈরাজ্যের ভিতর বন্ধ হয়ে পরে থাকে | এই সিংতোম বাগানের মতো অনেক চা বাগান দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় অনেক শ্রমিক অনাহারে বিনা রেশন আর চিকিৎসাতে মারা যেতে থাকে | কেউ আবার বাগান ছেড়ে ডুয়ার্স বা অন্যত্র চলে যায় | ঠিক দু বছর পরে তেজপ্রতাপ চৌধুরীকে টি বোর্ডের এক অনুষ্ঠানে দেখা যায় হুইল চেয়ার করে প্রবেশ করতে | সেই ঘটনাটাতে দুটো পা ওনার নষ্ট হয়ে যায় |
গল্পটা হলো একটা সময়ের একটা বাস্তবের আখ্যান মাত্র |
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/০৫/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast