www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মানু ও চার বন্ধু


বাংলায় জঙ্গলের অভাব না থাকলেও সব জঙ্গল কিন্তু ভূগোলের পৃষ্ঠায় এখনও নাম করতে পারে নি । এই গল্পটি তেমনই এক জঙ্গলের । উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই অরণ্যের পাতারা এখনও ঝকঝকে সবুজ , গাছে গাছে ফুল আর আছে নানারকমের টক-মিষ্টি নানান ফল । সন্ধ্যা হলেই পাখীদের দল ডানা মেলে সেইসব গাছে তাদের সুন্দর বাসায় ঘুম দেয় ।
এই অনামী জঙ্গলে চার বন্ধুর বহুকালের বন্ধুত্ব সকলের কাছেই শিক্ষণীয় । তারা একে অপরের সাথে যেমন সেই ছোট্ট থেকে খুনশুটি করে আসছে আবার , ঠিক সময় মত একে অপরের উপকারও করে । এমন ভালোবাসা মানুষের মধ্যে কিন্তু সচরাচর দেখতে পাওয়া ভার । বহু বছর আগে , চার বন্ধু আম গাছ , বেল গাছ , কাঁঠাল গাছ আর এক তাল গাছের জন্ম অদ্ভুতভাবে একই জায়গায় হয়েছিল । এখন অবিশ্যি তারা আর সেই ছোট্টটি নেই , বেশ সাবালক হয়ে গেছে । তাদের ঘরে সময় করে রাখা থাকে সুস্বাদু আম-বেল-তাল-কাঁঠাল ফল । তারা কৃপণ নয় মোটেই , জঙ্গলের ও আশেপাশের সকলকেই ভাগ বাটরা করে তাদের মিষ্টি ফল দেয় । তাই এই চার মূর্তিকে সকলেই পরম স্নেহ করে । আরও একজন করে , তার কথায় একটু পরেই আসছি ।
মানুষের মত অরণ্যদের সুখও স্থায়ী নয় । বরং অরণ্যে জীবন সংগ্রাম বেশ কঠিন , লড়াই করে বাঁচার শিক্ষা তাদের সকলকেই ছোটবেলা থেকে আয়ত্ত করতেই হয় । সব থেকে ঝামেলা হয় তখন , যখন মানুষ গিয়ে অরণ্যে থাবা বসায় । আমাদের এই চার বন্ধু তো কাওকে কোনদিন উপকার করা ছাড়া অপকার করে নি । কিন্তু তাদের ভাগ্যেও পরল ভয়ের ছায়া ।

উত্তরের এই গভীর জঙ্গলের পাশেই দল বেঁধে থাকে কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় । জঙ্গলের ফল-কাঠ বিক্রি করেই তাদের দিন চলে কোনক্রমে । তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে এই সকল ওরাং শ্রেণীর মানুষেরা নির্দিষ্ট দিনে দল বেঁধে অরণ্য পুজো করে । অরণ্যকে সব থেকে বেশী ভালোবাসে মানু বলে একটি ছোট্ট ওরাং মেয়ে । সে যখন রুক্ষ চুলে আলগোছে বেনী দুলিয়ে গভীর জঙ্গলে গিয়ে ওই চার বন্ধুর কাছে যায় তখন তাদের মধ্যে কতই না কথা হয় । খিদে পেলেই আম গাছ দিত মিষ্টি রসালো আম । শুধু তাই নয় বেল , তাল গাছও তাদের ফল দিত । কেবল , কাঁঠাল গাছের মাঝে মধ্যে হত মন খারাপ , সে বলত – “ মানু বোন আমার ফল ছোট থাকতে খাওয়া যায় না , বড্ড আঠা যে !”
মানু একগাল হেসে বলত – “ এতে মন খারাপ করছ কেন ? তুমি যে আমাকে প্রতিদিন বাড়ী যাওয়ার সময় এক কাঁধ ভরতি কাঠ দাও ।”
বাকী বন্ধুরা তা শুনে পাতা নাড়িয়ে বলল – “ ঠিক ঠিক ঠিক ।”
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল , মানু আর গাছেদের এই কথা কিন্তু আমি তুমি কেউ বুঝতেই পারি না । তাও , তোমাদের বোঝবার সুবিধার জন্য মানু যেমনটি আমাকে বলেছিল , আমি ঠিক সেইভাবেই তোমাদের বলছি । মানুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল এ বছরের ঠিক গোড়ার দিকে এক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ।

লোভে পাপ আর পাপে যে ক্ষয় মানুষের জীবনে হয় , একথা আমরা কে না জানি । তবুও আমাদের মধ্যে তা সর্বদা কোন না কোনভাবে উঁকিঝুঁকি মারে । বিশেষ করে মানুষের খিদের জ্বালা এক পরম শত্রু বিপথে যাওয়ার জন্য । গতবছর ওই গরীবদের মধ্যেও দেখা দিয়ে ছিল এই বিপদ । জঙ্গল ঘেরা ওই আদিবাসীদের সঙ্গে কোথা থেকে এসে জুটল একদল লোক । তাদের কাঁধে সবসময় ঝোলানো থাকত বন্দুক । তারা প্রায়ই গরীব-সরল ওরাংদের রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বেলে আকারে ইঙ্গিতে নানা কথা বোঝাতো । কথা শুনতে শুনতে গরীব মানুষগুলোর চোখ চকচক করে উঠত । রাতের ঘন আঁধারেই কুড়ল কাঁধে ভিন দেশীদের সাথে ঢুকে পরত অরণ্যের গহ্বরে ।
মানু শারীরিক ভাবে বেশ দুর্বল । মাঝে মধ্যেই ভয়ঙ্কর জ্বরে প্রায়শই দুর্বল হয়ে পরে । মা মরা মেয়েটাকে দু’বেলা খেতে দেওয়াই ছিল দুঃস্বপ্নের মত মানুর বাবার কাছে । কিন্তু এখন , মানুর জন্য এটা ওটা খাবার নিয়ে আসে । মানু ভাবে , এত টাকা পায় কীভাবে ? বাবাকে জিজ্ঞেস করলেই এক ধমক খায় ।
অন্য দিনের মত সেদিন রাতেও আলোর চারপাশে একদল লোক গোল করে বসে কিছু কথা বলে যাচ্ছে । সেদিন রাতে মনে সাহস এনে মানু তার বাবার পিছু নেয় । বাবা ওদের সাথে যখন কথাবার্তায় মশগুল ঠিক তখন মানু পা টিপে টিপে খানিক এগিয়ে যেতেই কিছু ফিসফিসে কথা শুনতে পারল । সব কথা না বুঝলেও , এটা ঠিক বুঝল যে জঙ্গল নিয়ে কিছু কথা চলছে ।
জ্বর থেকে সদ্য ভাল হয়েছে । তাই মানু চলল তার সেই বন্ধুদের কাছে । জঙ্গলের পথে কিছুটা যেতেই অবাক হওয়ার পালা । কিছুদিন আগেও যেখানে যে বড় শাল গাছটা সাদা ফুল ছড়িয়ে রাখত তার জন্য , সে গাছ উধাও । দুর্বল শরীরে গুটিগুটি পায়ে যখন সে তার বন্ধুদের কাছে হাজির হল তখন মুখ থেকে বাক্য আর সরে না ।
লম্বা তাল গাছ শুকনো গলায় বলল – “ বন্ধু তুমি এতদিন পর এলে ? দেখছ তো আমাদের আর সব বন্ধুদের কী অবস্থা !”
মানু ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে –“ আমার বন্ধুদের এ হাল কে করল তুমি একটিবার বলো তাল গাছ ।”
আম-কাঁঠাল-বেল গাছের অর্ধেকের বেশী ডালপালা কাটা । তাদের গায়ে লেগে রয়েছে শুকনো রক্তের দাগ , সারা শরীরে কুড়ল, কাটারী , করাতের গভীর কোপ । ওদের শরীরে ধুকপুক করছে একটুখানি প্রান ।
আম গাছ কোনমতে জবাব দিল – “ বন্ধু মানুষের লোভ... সবাই কী আর তোমার মত হয় ।”
মানু বুদ্ধিমতী । সে এ সব দেখে ও তাদের কিছু কথা শুনে বুঝতে পারল অতি প্রিয় অরণ্যের এ হালের জন্য কে বা কারা দায়ী । রাগে তার চোখ হিংস্র বাঘিনীর মত দপ করে জ্বলে উঠল ।
বন্ধুদের উদ্দেশ্যে শুধু বলল- “ বন্ধুরা , আমার সাথে থাকো আর যেমনটি বলব তা করো ।”
এ বলেই মানু , দুর্বল শরীরে যতটা সম্ভব দ্রুত বাড়ী ফেরার রাস্তা ধরল ।

উত্তরের এই জঙ্গলে আর একটি মানুষ এই ওরাং মেয়েটিকে পরম স্নেহ করত । কারন , মানু তাঁকে অনেক সময় কিছু কাজে উপকার করেছে । ফরেস্ট রেঞ্জার রাকেশ কর্মঠ মানুষ । রাকেশবাবু জঙ্গল , পশুপাখিদের মন দিয়ে ভালোবাসেন ।
যাইহোক , সেদিন জঙ্গল থেকে তাঁর গাছ বন্ধুদের সাথে গোপন শলা সেরে মানু কিন্তু বাড়ী ফেরে নি । হাজির হয়েছিল রাকেশের কাছে । সব কথা শুনে রাকেশবাবুর মুখ রাগে থম মেরে যায় । খানিক বাদে মানুর মাথায় হাত রেখে বলেন –“ চিন্তা করিস না এই চোরা কাঠুরেদেরকে আজ রাতেই ধরব ।” মানুকে বাড়ী যেতে বলে নানা কথা চিন্তা করতে করতে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে কাকে যে বললেন “ রাকেশ বলছি , তুই একটু হেল্প করতে পারবি আজ রাতে ...।?”
সেদিন আকাশে একথাল চাঁদ । বন্য পথ বেয়ে টর্চের আলো নিভিয়ে , কখনও বা জ্বালিয়ে একদল লোক ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে । পথটা আর স্থানটা আজ সকালে ঠিক করে এসেছে চোরা কাঠুরের দল । তারা এতটাই মশগুল যে খেয়াল করে নি ঠিক তাদের পিছনে ছোট্ট একটা ছায়া অনুসরণ করে চলেছে ।
মানু ঠিক করেই ছিল কারো সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার থেকে নিজেকেই কিছু করতে হবে , তার বন্ধুদের রক্ষা করতেই হবে ।পূর্ণিমার আলোর সাথে মাঝে মধ্যে শেয়াল ক্যা-হুয়া ক্যা-হুয়া করে হাঁক পেরে রাতের গভীরতা ঘোষণা করে যাচ্ছে । আকস্মিক চোরা কাঠুরেদের মধ্যে কয়েকজন “ বাবা গো ” “ মা গো ” “ মরে গেলুম গো ” চীৎকার করতেই গোটা দলটাই কী হল বোঝার জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ।
তাদের মধ্যে কয়েকজন মাথা নীচু করে যেই না তাদের সঙ্গীর হাল দেখতে গেল অমনি তাদের কানের পাশে , মুখে বাঁই বাঁই করে শক্ত শক্ত ঢেলা আর মোটা গোছের কী যেন এসে সজোরে পড়লো । মুখ দিয়ে শুধুমাত্র গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরলো আর মাটিতে সপাটে কাটা গাছের মত চিৎপটাং । এ হাল দেখে গোটা দলটাই ভ্যাবাচ্যাকা । দৌড়ে গিয়ে বাকী সাথীরা আহতদের তুলতে গেল কিন্তু যায় কোথায় , তাদের পায়ে চটচটে আঠার মত কি যেন লেগে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল । এমন ভুতুরে কান্ড তাদের ইতিপুর্বে ঘটে নি । তবে স্থানীয় ওরাং আদিবাসী যারা ভীনদেশীদের সাথে অরণ্য নিধনে লোভে জড়িয়ে পরেছিল তারা কী বুঝে সব অস্ত্র ফেলে লাগালো দৌড় । এদের মধ্যে ছিল মানুর বাবাও । সে দৌড়াতে দৌড়াতে একবার শুধু ভীনদেশীদের বলে গেল – “ বা-বুউউউ পা-লা-ও এ হল জ-ঙ্গ-লে-ররর অ-ভি-শা-পপপ ।”
কিন্তু কে কার কথা শোনে । অতি চালাকের গলায় দড়ি । ভিনদেশীদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে রুক্ষ গলায় বলল – “ কার এত সাহস কাছে আয় নয়তো গুলি করব ।”
সাথীদের কাতর আওয়াজ আর বন্য জন্তুদের শব্দ ছাড়া সারা জঙ্গল নিস্তব্ধ । যে চেঁচিয়ে ছিল সে আর থাকতে না পেরে বন্দুকটা উপরে তুলে একটা ফায়ার করতেই “ আঁ আঁ আঁ ” শব্দে সোজা মাটিতে পরে গেল ।পূর্ণিমার মিঠে আলোতে দেখা গেল পাশে পড়ে আছে একটা নয় দু-দুটো পাকা তাল ।
এদের এহেন অবস্থা দেখে মানুর মুখে আর হাসি থামে না । এরই মধ্যে জঙ্গলের বুক চী্রে টর্চের জড়ালো আলো আর ঘন ঘন হুইসেলের শব্দে মানুও চমকে গেল । তারা উচ্চস্বরে বলছে – “ যে যেখানে আছো অস্ত্র ফেল ।”
আরে এত রাকেশবাবুর গলা । মানু ছুটে গেল তার প্রিয় রাকেশ আঙ্কেলের দিকে । ইতিমধ্যে পুলিশের লোকজন কোমরে দড়ি পড়াতে শুরু করেছে যে ক’জন দুষ্টু চোরা কাঠুরে মাটিতে পরে আছে । রাকেশবাবু ও তাঁর পুলিশ বন্ধু মানুর মত পুঁচকে মেয়েকে এত রাতে এখানে দেখে তো অবাক ।
মানু কী করেছিল সে ঘটনা তার প্রিয় কাকুকে বলতেই রাকেশবাবুর চক্ষু চড়ক গাছ । মানুকে পুরষ্কার দেওয়ার দিন আমিও জানতে পারলাম ওর মুখ থেকে পুরো বিষয়টা । মাইকের সামনে ছোট্ট মেয়েটি বলেছিল – “ দুষ্টু লোকদের ধরতে আমার চার বন্ধু সাহায্য করেছিল । বেল গাছ তার লম্বা লম্বা কাঁটা মাটিতে ফেলে রাখতে বলেছিল ,তাই দুষ্টু লোকগুলি ওখানে পা ফেলতেই কেল্লা ফতে ।”
খানিক থেমে আরও বলে , “ শুধু তাই নয় , ওই লোকগুলির মাথায় পড়ে শক্ত বেল ফল , আমের মোটা ডাল । কাঁঠাল গাছের আঠায় জড়িয়ে যায় ওদের পা আর শেষে বন্দুকের গুলি তালগাছে লাগতেই পরিকল্পনা মত মাথায় এসে পরে গোটা দুই মোটাসোটা তাল ।”
আমি ওর কথা শুনে অবাক , এমনটা হয় নাকি ! আমি কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম , “ তোমার গাছ বন্ধুরা কথা বলে নাকী ?”
ও মিষ্টি হেসে জবাব দিল-“ আমার বন্ধুরা সকলের সাথে কথা বলতে চায় কিন্তু কেউ যে শোনে না ওদের কথা । তুমি শুনবে ?”
এর উত্তর আমার কাছে নেই । তবে বিশ্বাস করি , ভালবাসার ভাষা সকলেই বোঝে । আর হ্যাঁ , ওরাং সম্প্রদায়ের লোকেরা এখন আর আগের মত ভুল করে না । লোক দেখানো পূজার পরিবর্তে অরণ্যের ভাষা বোঝার চেষ্টা করে , অরণ্যকে করে সম্মান ।।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৬৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০৫/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast