www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ক্যামেরার লেন্স

________________________


একজন লেখক প্রতিনিয়ত-ই গল্প খুঁজে বেড়ায়। যদিও নিজেকে এখনো লেখক হিসেবে ভাবি না। তবুও লেখালেখির খাতিরে আমিও গল্প খুঁজি। ঠিক যেন বরশি হাতে বসে থাকা মাছ শিকারী। অথবা ফাঁদ পেতে পাখি ধরা। যেই-না ফাঁদে পা দিল অমনি আটকে গেল। কখনোবা মনে হয় জাল ফেলে মাছ ধরার মতো। জালটাকে ছড়িয়ে দাও, একটু অপেক্ষা তারপর গুটিয়ে নাও। ভাগ্য ভালো হলে জাল ভরে যাবে মাছে। আর মন্দ হলে ফাঁকা। আমারও গল্প ধরার শেষ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার কাহিনীটাই নাহয় শুনলেন আজ।


রাত দশটা, অন্যান্য দিন এই সময়টা আমার জন্য সন্ধ্যা। তবে আজ বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। আচ্ছন্ন বলছি এজন্য কারণ আমি যে অবস্থায় আছি সেটা ঘুমও নয় আবার জাগরণও নয়। সবকিছু বুঝতে পারছি শুনতে পারছি। হাতে ধরে থাকা মোবাইলের ডিসপ্লেতে ফুটে উঠা নাম্বারগুলোও বুঝতে পারছি। কিন্তু কলটা রিসিভ করতে পারছি না। সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে ঝিমঝিম একটা অনুভূতি। এভাবেই ঘুম জাগরণের আবেশে জড়িয়ে থেকে এক সময় স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। শেষ রাত্রে অতিরিক্ত প্রস্রাবের বেগের কারণে ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে বিছানায় বসলাম। গামছাটা তখনো হাতে ধরাই আছে। এভাবে বসা অবস্থায়ই হারিয়ে গেলাম ভাবনার জগতে।


কিরে বসে আছিস কেনো?
মাসুমের প্রশ্নে ঘোর কাটল আমার। মাসুম আমার ফুপাত ভাই।
কিছুনা দুস্ত, হেব্বি একটা স্বপ্ন দেখছি। ওর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলাম আমি।
আগ্রহের সাথে উঠে বসল সে।
কী স্বপ্ন দুস্ত? কী দেখলি?
আরে তেমন কিছুনা, দেখছি কি- আমি ছাদে বসে আছি। পাশের ছাদে কেউ কাপড় শুকাতে আসছে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় কিছু কাপড় সরে যাওয়াতে তাকে দেখতে পেলাম। মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। বাতাসে আঁচল সরে যাওয়ায় তার কোমরটা দেখতে পেয়েছিলাম। তা-ও এক ঝলক। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব সৌন্দর্য সেখানে এসে থেমে গে...
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মাসুম বলে উঠল। ধুর...বাল! তোরে দিয়া কিচ্ছু হবেনা। মেয়েটার মুখটাও তো দেখতে পারলি না।
আচ্ছা দুস্ত, মুখ দেখলে, পা দেখলে, হাত দেখলে তো কতো কিছু হয়। কোমর দেখলে কিছু হয় না?
আমার কথা বুঝতে না পেরে আধা মিনিট হা করে তকিয়ে রইল মাসুম।
কী সব চাইনিজ বলছিস?
আরে বেটা! আমি বলছি যে, স্বপ্নে তো হাত দেখলে, পা দেখলে কতো কিছু পাওয়া যায়। কোমর দেখলে কিছু হয় না??
আমার কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে বই খুঁজতে শুরু করল সে। আমিও বসে বসে তার কান্ড দেখি আর হাসি।


দুই মিনিটের মাথায়ই পেয়ে গেল যা খুঁজছিল। "ইবনে সীরিন রহঃ স্বপ্নের তাবীর" নামক বইটি আমার সামনে এনে রাখল। দুজন মিলে খুঁজতে শুরু করতেই যেন নিজ থেকে চোখের সামনে এসে ধরা দিল স্বপ্নের ব্যাখ্যাটা। এতে বলা হয়েছে সুন্দরী রমনীদের কোমর দেখলে স্বপ্নদ্রষ্টা সেই মহিলাকে বিয়ে করবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেখে মনে হলো চাতকের ঠোঁটে বৃষ্টির পানির ছোঁয়া লাগলো। বেশ ভালো একটা মোড নিয়ে নামাজ পড়তে বের হলাম।

ফেরার পথে মাসুম গতরাতের কলের ব্যাপারে বলল। সৈকত কল করেছিল। আজ নাকি তারা ঘুরতে যাবে। কিশোরগঞ্জ হাওর এলাকায় যাওয়া হবে। বাজিতপুর বা নিকলি যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নয়টার দিকে জাহিদ আসবে আমাকে পিক করতে। বাড়ি ফিরে ছোট একটা ঘুম দিলাম।

যেখানে দশটায় বের হওয়ার কথা ছিল। সেখানে এখন বাজছে বারোটা সাত। সবে মাওনা থেকে বেরিয়েছি আমরা। বরমী হয়ে বেরিয়ে পাকুন্দিয়া বা কটিয়াদি দিয়ে ঢুকব কিশোরগঞ্জে। যদি বাজিতপুর যাওয়া হয় তাহলে কটিয়াদি দিয়েই ঢুকতে হবে। পাকুন্দিয়া দিয়ে কিছুটা ঘুরপথ হয়ে যায়। যাইহোক আমাদের প্রিমিয়ো গাড়িটা ছুটে চলছে গন্তব্যে। আর আমার চোখ চারপাশ গিলছে গল্পের খোঁজে।

বাজিতপুর যেখানে যাওয়ার কথা ছিল সে যায়গাটা পানিতে তলিয়ে গেছে। নিকলি ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। করোনা পরিস্থিতির কারণে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তাই সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে মনমরা হয়ে ফিরে আসছি। একটু আসতেই একটা যায়গা দেখে পছন্দ হয়ে গেল। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম সবাই। জায়গাটা ছায়াঢাকা, সুন্দর। বিশাল এক বটগাছ ছায়া দিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘকাল যাবত। সেটা গাছটাকে দেখলেই বুঝা যায়। অনেক গল্পের সাক্ষী এই গাছটা। নিরব দর্শক হয়ে দেখে গেছে জীবনের শত উত্থান-পতন। গাছটার দিকে তাকালেই কেমন যেন করে উঠে বুকটা। মনে হয় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। অন্যরা তখন কাপড় পালটে পানিতে নেমে গেছে। আমি ক্যামেরা হাতে গাছটার বিশাল শিকড়ের উপর বসলাম। এখানটা ছোট্ট একটা ঘাটের মতো। মানুষের আনাগোনা আছে। নৌকা ভিড়ছে, আবার ছেড়ে যাচ্ছে। পালের নৌকা, ইঞ্জিনের নৌকা। আমি সোৎসাহে ছবি তোলেই যাচ্ছি।

ক্যামেরার জুম লেন্সে ধরা পড়ল বিষয়টা। বাচ্চা একটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে। কতো আর বয়স হবে? সর্বোচ্চ বারো কি তেরো। একটা ধাক্কার মতো লাগল। এগিয়ে গেলাম তার কাছে। এত অল্প বয়সেই সিগারেট খাচ্ছে কেনো জিজ্ঞেস করতেই তার উত্তর ছিল, "আপনের টেকা দিয়া খাইছি?" কিছু না বলে ওর পাশেই বসে পড়লাম। গল্প শুরু করলাম অন্য বিষয় নিয়ে। আধাঘণ্টা পর সে তার পরনের শার্ট খুলে দেখালো সেখানে পোড়া দাগ, মারের দাগ, কাটার দাগে ভর্তি। এই টুকু বয়সের একটা ছেলেকে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা ভাবতেই ভয় হচ্ছে আমার।

তার নাম ফরিদ, বছর খানেক আগে তার মা অন্য এক পুরুষের হাত ধরে চলে গেছে। তার বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। অত্যাচার বাবা আর সৎ-মা দুজন মিলেই করেছে। সহ্য করতে না পেরে এখন সে অন্যের বাড়িতে থাকে আর তাদের কাজ করে। একহাজার হাঁস দেখাশুনা করে ফরিদ। সে যখন তার কথা শেষ করল আমি কিছু না বলেই সেখান থেক চলে আসলাম। গাড়িতে উঠতেই মনে হলো গাল বেয়ে কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। মোডটাই খারাপ করে দিল ছেলেটা। কোথায় ঘুরতে এসেছি মজা করতে এসেছি, গল্প খুঁজতে এসেছি। সেগুলো তো কিছুই হলো না মাঝখান থেকে মুড অফ হয়ে গেলো। আজ গল্প ধরার অভিযান ব্যর্থ।

সানগ্লাসটা খুঁজে পেয়েছি, চোখ দুটো ঢেকে রাখা দরকার। কী যেন হয়েছে চোখ দুটোতে, আজকাল অল্পতেই ভিজে উঠে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৯৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/১১/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast