রাজনীতি নতুন ধর্মের নাম
ফ্রিডরিখ নিটশে তাঁর The Gay Science (১৮৮২) বইতে বলেছিলেন,
“God is dead. God remains dead. And we have killed him.”
তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে আধুনিক বিশ্বের মানুষজন ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করলেও ঈশ্বরবোধ হারায়নি। আর, প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভবও না। মানুষ সৃষ্টিকর্তার শূন্যস্থান পূরণ করে নতুন উপাস্য কিংবা দেবতা সৃষ্টি করে। আর সেগুলো হলো- মতাদর্শ, রাজনীতি, দল, নেতা, পতাকা। আজকের পৃথিবীতে ‘রাজনৈতিক আদর্শ’ সেই ঈশ্বরের জায়গা দখল করেছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন সম্রাট ভাই তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে এই ধারণার চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন, আগ্রহীরা সেটা দেখে আসতে পারেন।
আমি একটু অন্যভাবে কিছু কথা বলি। এইযে ধরেন, লোকগুলা রাস্তা আটকে মিছিল, সমাবেশ, নেতার শোডাউন, কান ঝালাপালা করে দেয়ার মতো বাইকের সাউন্ড, স্লোগান, সাধারণ মানুষকে তাচ্ছিল্য করে নিজেদের বিশেষ শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটায়।
আবার ধরেন, গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে, ককটেল-পেট্রোল বোমায় মানুষকে হত্যাচেষ্টা এবং হত্যা, দুনিয়া থেকে নাই করে দেয়া, কিংবা ধরেন, ‘'রাজাকার’’ ট্যাগ দিয়ে হাজারটা মানুষ মেরে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করা এসবকিছুতেই একধরনের নোংরা পরিতৃপ্তি পাওয়া,
আবার, পালিয়ে যাওয়ার পরও নির্দ্বিধায়, নির্লজ্জের মতো কর্মীদের নানান নির্দেশনা দেয়াও কিন্তু একটা অশ্লীল আর্ট।
এত এত অপকর্মের পরে নিজেদের ‘সেন্স’ কে নিতম্বে রেখে দেয়াও এক ধরনের অলৌকিক শয়তানি।
এদের ‘'ঈশ্বরদের’’ মতো এদের সমর্থক, কর্মী আর এধরনের আইডিওলজিতে ‘'বিশ্বাসী’ দেরও কোনো “অনুশোচনা”, ‘'অনুতাপ’’, “ভুল” থাকে না, এরা নির্লিপ্তভাবে অন্যকে ছোট-হেয়-নির্যাতন করে, তাদের ‘'ঈশ্বরের’ ইবাদত করে এবং অন্য মতাদর্শের কিংবা হিসেবের বাইরের (যাদের নির্ধারিত কোনো রাজনৈতিক ধর্মবিশ্বাস নাই) মানুষদের হত্যা করে, ভয় দেখায়, জুলুম করে। এই জুলুম করা আবার তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব, ইবাদতের অংশ। তাদের সর্বোচ্চ মাকাম হলো তাদের দলের সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীদের অন্ধ অনুকরণ করে দলীয় কোনো পদ-পদবি পাওয়া। তার জন্য শু*** বাচ্চাগুলা যাচ্ছেতাই করে।
প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদেরকে যারা উৎখাত করে কিংবা প্রতিবাদ করে, তাদের ১৪ গোষ্ঠীকে এরা উদ্ধার করে, অথচ, নিজেদের এমন পরিণতির কারণ ভাবতে চায় না। অনুভূতিহীন, ভোঁতা, অমানবিক একেকটা প্রাণী। কিন্তু, একটা ক্ষেত্রে তাদের চেতনাদন্ড ঠিকই দাঁড়িয়ে যায়, আর সেটা হলো তাদের নেতা কিংবা দলীয় তথাকথিত অসম্পূর্ণ ধর্মীয় নিয়মকানুনের প্রতি ‘আদব’। কিয়ামত হয়ে গেলেও তারা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে পিছপা হবে না, মৃত্যুর সময়ও তারা সেই আদর্শ নিয়েই মরতে চায়। এটা হয়ই, আইডিওলজি আপনাকে এমন ‘ডেসপিকেবল হারামজাদা’ তৈরি করবেই, অন্তত পলিটিকাল আইডিওলজি।
যে আমাদের সঙ্গে নেই, সে শত্রু। যে প্রশ্ন করে, সে “দ্রোহী”, “জঙ্গী”, “রাজাকার”। রাজনৈতিক আনুগত্যই এখন ঈমান, আর বিরোধিতা মানেই কুফর। ধর্মের মূল শিক্ষা মানবপ্রেম, ন্যায়ের চর্চা, সহনশীলতা। কিন্তু, প্রচলিত রাজনীতি শেখায় বিভাজন, হিংসা ও আধিপত্য।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,,
“যে এক জনকে হত্যা করে—অন্যায়ভাবে বা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর জন্য নয়—সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।”
(সূরা আল-মায়িদা ৫:৩২)
কিংবা, “আর তোমরা অত্যাচার করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালোবাসেন না।”
(সূরা আশ-শুআরা ২৬:১৫২–১৫৩)
বাইবেল বলছে,
“তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।” (ম্যাথিউ ২২:৩৯) কিংবা, “যে তার ভাইয়ের উপর ক্রোধ ধরে রাখে, সে হত্যাকারীর সমান।” কিংবা, “অন্যের প্রতি সেই আচরণ করো, যা তুমি চাও তারা তোমার প্রতি করুক।”
গীতা বলছে,
“অহিংসাই পরম ধর্ম।”
(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ১১৩:১২)
ধর্ম মানুষকে শিখিয়েছে ভালোবাসা, ক্ষমা ও করুণা। কিন্তু, প্রচলিত রাজনীতি এই তিনটিরই বিপরীত পথে হাঁটে।
রাস্তায় মিছিল হয়, শহর বন্ধ হয়ে যায়, অসুস্থ রোগী এম্বুলেন্সে আটকে থাকে, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। যারা এই দুর্দশা তৈরি করে, তারা নিতান্ত মিথ্যা জেনেও দাবি করে-’এটাই জনগণের রাজনীতি।’ অর্থাৎ, জনগণের পিছনে বাঁশ দিয়ে নিজেদের অর্গাজম আদায় করাই এদের রাজনীতি। মাদক, গ্যাঙ, সন্ত্রাস এদের ধর্মীয় ইবাদতের উপকরণ। এই হারামজাদাগুলোই আবার ভোটের আগে জনগণকে লোকদেখানো ফেইক ‘পূজা’ শুরু করে, পারলে ভোট কিনে নেয়, নাহলে আঙুল বাঁকা করে হুমকি দেয়- সুযোগ পাইলে মাইর দেয়, কিংবা অটোভোট নিয়ে নেয়। আর নির্বাচন না করে অটোমেটিক ক্ষমতা দখল কিংবা ভাগ-বাটোয়ারা এদের কাছে ‘'নফল” ইবাদত। এখানে মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে দলীয় গৌরব। প্রচলিত রাজনীতি এখন কেবল ক্ষমতার ধর্ম।
একবার ভাবুন তো, শিশুরা বড় হচ্ছে, “জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, ভেঙে দাও।” শোনে শোনে, তারা ছোট থেকেই পথে-ঘাটে, গণমাধ্যমে দেখছে যে জোর যার মুল্লুক তার, রাজনৈতিক ক্ষমতা যার কাছে আছে, এই দুনিয়াতে সে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। তারা শিখছে, প্রতিবাদ মানে ধ্বংস, নেতৃত্ব মানে ভয়। তারা স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার শিক্ষা পাচ্ছে না, সাহস পাচ্ছে না, ‘মানবিক’ পরিবেশে প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগটাই পাচ্ছে না। কেউ কেউ একসময় ‘বড়দের’ মতোই হয়ে উঠছে। এটাই স্বাভাবিক, আপনি তো হাজারটা শু*** এর ভিড়ে নিজেকে আলাদা করতে পারবেন না।
সুকান্ত ভট্টাচার্য এই দ্রোহ অনুভব করেই হয়তো লিখেছিলেন,
“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।”
তবে, নিজেকে ‘আলাদা’ করতে চাইলে, ‘'ইতিহাস” হতে চাইলে, প্রতিবাদ করলে, বিপ্লব করলে, পতিত শয়তানি শক্তি আপনার পেছনে ধেয়ে আসবে৷ কিছুদিন পর দেখবেন আপনার পেছনে কেউ নাই, বিপ্লবের সাথীগুলার চেহারাও চেইঞ্জ হয়ে গেছে। তখন সিস্টেমকে দোষ দিয়ে নিজেকে আলাদা ‘'মানুষ” হিসেবে সরিয়ে ফেলতে চাইবেন।
ইমাম আবু হানিফা খলিফা আল মনসুরের সময় বিচারপতির দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন ন্যায়বিচারের বদলে অন্যায়ের হাতিয়ার হয়, তখন সেই ক্ষমতার অংশ হওয়া মানে অন্যায়কে বৈধতা দেওয়া।
(তাবাকাত ইবনে সা’দ, খণ্ড ৬)
সুফি দার্শনিক আবদুল কাদের জিলানি তাঁর Futuh al-Ghaib-এ বলেছেন, “যে শাসক জালিম, তার কাছে যাওয়া অন্যায়। সত্য ভাষা লুকানো তার চেয়েও বড় অপরাধ।”
তবে, আমরা প্রতিনিয়তই ‘'রাজনৈতিক ধর্মে” বিশ্বাসী হয়ে ধার্মিকতার গভীর প্রদর্শনী করছি, জালিমকে সমর্থন করছি, জুলুমকে প্রতিষ্ঠিত করছি।
অন্যদিকে জালালুদ্দিন রুমি লিখেছিলেন, “তুমি যদি আল্লাহকে খুঁজো, মানুষের মুখের দিকে তাকাও।” মানুষ স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আশরাফুল মাখলুকাত। সুফিবাদীরা বলেন, মানুষের হৃদয়েই আল্লাহ তায়ালার কুরসি। কিন্তু, প্রচলিত রাজনীতি মানুষকে পতঙ্গ মনে করে কিংবা আরও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে অনস্তিত্বসূচক কিছু একটা ভাবে। কোনো কালেই (আইয়ামে জাহেলিয়াতেও) মানুষের মর্যাদার এত অধপতন বোধহয় ঘটে নি।
আজ রাজনীতি মানুষের মুখে কেবল ভয়ের রেখা এঁকে দিয়েছে। মানুষকে দেখলেই বোঝা যায় তারা আতঙ্কিত, চিন্তিত, ভীত, দ্বিধান্বিত, বিভাজিত। হয় কোনো রাজনৈতিক আদর্শ তাদেরকে তার বান্দা হিসেবে দলে ভিড়িয়েছে, না-হয়, তারা তা দ্বারা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত আর নিপীড়িত।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে এই চিত্র স্পষ্ট। কখনো রাস্তায় আগুন, কখনো বুলেট, কখনো গুম। ক্ষমতার জন্য রাজনীতির নামেই মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। সবই এক দেবতার নামে, যিনি ‘'আদর্শ’ নামের ঈশ্বর। গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে গুম, খুন, নজরদারি, সবই সেই ঈশ্বরের আরাধনা। যে রাজনীতি মানুষের ওপর দাঁড়িয়ে চলে,
সে শেষ পর্যন্ত মানুষকেই মেরে ফেলে।
এরিখ ফ্রম Escape from Freedom (১৯৪১)-এ বলেছিলেন,
“মানুষ স্বাধীনতার ভয় পায়, তাই সে নিজেই কোনো শক্তির দাসে পরিণত হয়।”
আসলে, আমরা আজ সেই দাসত্বেই আছি। দলীয় পতাকা এখন আমাদের তাবিজ, নেতার মুখ আমাদের কিবলা।
কার্ল পপার The Open Society and Its Enemies (১৯৪৫)-এ সতর্ক করেছিলেন,
“যে মুহূর্তে তুমি তোমার নেতাকে প্রশ্ন করা বন্ধ করো, সেই মুহূর্তেই তুমি স্বৈরাচারের পথে হাঁটা শুরু করো।”
আমরা সেই পথের অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
“যেখানে মানুষের ভয়, সেখানেই ধর্মের মৃত্যু।”
(ধর্ম ও নৈতিকতা, ১৯০৮)
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,
“মানুষের উপরে মানুষ সত্য নয়, সত্যের উপরে কিছুই নয়।”
(সত্যের পথে, ১৯২৫)
কিন্তু আজকের রাজনীতিতে মানুষ আর সত্য-দুটিই অবমানিত, অনুপস্থিত আর নির্যাতিত।
সত্যকে হত্যা করা হয় বক্তৃতার মঞ্চে,
মানুষকে হত্যা করা হয় রাস্তায়।
রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণে না আসে,
তবে সেটি ‘আদর্শ’’ তো নয়ই, বরং, এক নিষ্ঠুর অন্ধ উপাসনা।
আমরা সেই উপাসনায় প্রতিদিন অংশ নিচ্ছি,
নিজের অজান্তে, নিজের ‘'রাজনৈতিক'’ ধর্মের পতাকার নিচে,
নিজেকেই বলি দিচ্ছি আমাদের নির্মিত নতুন ‘ঈশ্বরের’ পায়ে।
মো. রিদওয়ান আল হাসান
ধানমন্ডি, ঢাকা
১৩ নভেম্বর ২০২৫
“God is dead. God remains dead. And we have killed him.”
তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে আধুনিক বিশ্বের মানুষজন ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করলেও ঈশ্বরবোধ হারায়নি। আর, প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভবও না। মানুষ সৃষ্টিকর্তার শূন্যস্থান পূরণ করে নতুন উপাস্য কিংবা দেবতা সৃষ্টি করে। আর সেগুলো হলো- মতাদর্শ, রাজনীতি, দল, নেতা, পতাকা। আজকের পৃথিবীতে ‘রাজনৈতিক আদর্শ’ সেই ঈশ্বরের জায়গা দখল করেছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন সম্রাট ভাই তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে এই ধারণার চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন, আগ্রহীরা সেটা দেখে আসতে পারেন।
আমি একটু অন্যভাবে কিছু কথা বলি। এইযে ধরেন, লোকগুলা রাস্তা আটকে মিছিল, সমাবেশ, নেতার শোডাউন, কান ঝালাপালা করে দেয়ার মতো বাইকের সাউন্ড, স্লোগান, সাধারণ মানুষকে তাচ্ছিল্য করে নিজেদের বিশেষ শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটায়।
আবার ধরেন, গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে, ককটেল-পেট্রোল বোমায় মানুষকে হত্যাচেষ্টা এবং হত্যা, দুনিয়া থেকে নাই করে দেয়া, কিংবা ধরেন, ‘'রাজাকার’’ ট্যাগ দিয়ে হাজারটা মানুষ মেরে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করা এসবকিছুতেই একধরনের নোংরা পরিতৃপ্তি পাওয়া,
আবার, পালিয়ে যাওয়ার পরও নির্দ্বিধায়, নির্লজ্জের মতো কর্মীদের নানান নির্দেশনা দেয়াও কিন্তু একটা অশ্লীল আর্ট।
এত এত অপকর্মের পরে নিজেদের ‘সেন্স’ কে নিতম্বে রেখে দেয়াও এক ধরনের অলৌকিক শয়তানি।
এদের ‘'ঈশ্বরদের’’ মতো এদের সমর্থক, কর্মী আর এধরনের আইডিওলজিতে ‘'বিশ্বাসী’ দেরও কোনো “অনুশোচনা”, ‘'অনুতাপ’’, “ভুল” থাকে না, এরা নির্লিপ্তভাবে অন্যকে ছোট-হেয়-নির্যাতন করে, তাদের ‘'ঈশ্বরের’ ইবাদত করে এবং অন্য মতাদর্শের কিংবা হিসেবের বাইরের (যাদের নির্ধারিত কোনো রাজনৈতিক ধর্মবিশ্বাস নাই) মানুষদের হত্যা করে, ভয় দেখায়, জুলুম করে। এই জুলুম করা আবার তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব, ইবাদতের অংশ। তাদের সর্বোচ্চ মাকাম হলো তাদের দলের সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীদের অন্ধ অনুকরণ করে দলীয় কোনো পদ-পদবি পাওয়া। তার জন্য শু*** বাচ্চাগুলা যাচ্ছেতাই করে।
প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদেরকে যারা উৎখাত করে কিংবা প্রতিবাদ করে, তাদের ১৪ গোষ্ঠীকে এরা উদ্ধার করে, অথচ, নিজেদের এমন পরিণতির কারণ ভাবতে চায় না। অনুভূতিহীন, ভোঁতা, অমানবিক একেকটা প্রাণী। কিন্তু, একটা ক্ষেত্রে তাদের চেতনাদন্ড ঠিকই দাঁড়িয়ে যায়, আর সেটা হলো তাদের নেতা কিংবা দলীয় তথাকথিত অসম্পূর্ণ ধর্মীয় নিয়মকানুনের প্রতি ‘আদব’। কিয়ামত হয়ে গেলেও তারা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে পিছপা হবে না, মৃত্যুর সময়ও তারা সেই আদর্শ নিয়েই মরতে চায়। এটা হয়ই, আইডিওলজি আপনাকে এমন ‘ডেসপিকেবল হারামজাদা’ তৈরি করবেই, অন্তত পলিটিকাল আইডিওলজি।
যে আমাদের সঙ্গে নেই, সে শত্রু। যে প্রশ্ন করে, সে “দ্রোহী”, “জঙ্গী”, “রাজাকার”। রাজনৈতিক আনুগত্যই এখন ঈমান, আর বিরোধিতা মানেই কুফর। ধর্মের মূল শিক্ষা মানবপ্রেম, ন্যায়ের চর্চা, সহনশীলতা। কিন্তু, প্রচলিত রাজনীতি শেখায় বিভাজন, হিংসা ও আধিপত্য।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,,
“যে এক জনকে হত্যা করে—অন্যায়ভাবে বা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর জন্য নয়—সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।”
(সূরা আল-মায়িদা ৫:৩২)
কিংবা, “আর তোমরা অত্যাচার করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালোবাসেন না।”
(সূরা আশ-শুআরা ২৬:১৫২–১৫৩)
বাইবেল বলছে,
“তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।” (ম্যাথিউ ২২:৩৯) কিংবা, “যে তার ভাইয়ের উপর ক্রোধ ধরে রাখে, সে হত্যাকারীর সমান।” কিংবা, “অন্যের প্রতি সেই আচরণ করো, যা তুমি চাও তারা তোমার প্রতি করুক।”
গীতা বলছে,
“অহিংসাই পরম ধর্ম।”
(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ১১৩:১২)
ধর্ম মানুষকে শিখিয়েছে ভালোবাসা, ক্ষমা ও করুণা। কিন্তু, প্রচলিত রাজনীতি এই তিনটিরই বিপরীত পথে হাঁটে।
রাস্তায় মিছিল হয়, শহর বন্ধ হয়ে যায়, অসুস্থ রোগী এম্বুলেন্সে আটকে থাকে, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। যারা এই দুর্দশা তৈরি করে, তারা নিতান্ত মিথ্যা জেনেও দাবি করে-’এটাই জনগণের রাজনীতি।’ অর্থাৎ, জনগণের পিছনে বাঁশ দিয়ে নিজেদের অর্গাজম আদায় করাই এদের রাজনীতি। মাদক, গ্যাঙ, সন্ত্রাস এদের ধর্মীয় ইবাদতের উপকরণ। এই হারামজাদাগুলোই আবার ভোটের আগে জনগণকে লোকদেখানো ফেইক ‘পূজা’ শুরু করে, পারলে ভোট কিনে নেয়, নাহলে আঙুল বাঁকা করে হুমকি দেয়- সুযোগ পাইলে মাইর দেয়, কিংবা অটোভোট নিয়ে নেয়। আর নির্বাচন না করে অটোমেটিক ক্ষমতা দখল কিংবা ভাগ-বাটোয়ারা এদের কাছে ‘'নফল” ইবাদত। এখানে মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে দলীয় গৌরব। প্রচলিত রাজনীতি এখন কেবল ক্ষমতার ধর্ম।
একবার ভাবুন তো, শিশুরা বড় হচ্ছে, “জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, ভেঙে দাও।” শোনে শোনে, তারা ছোট থেকেই পথে-ঘাটে, গণমাধ্যমে দেখছে যে জোর যার মুল্লুক তার, রাজনৈতিক ক্ষমতা যার কাছে আছে, এই দুনিয়াতে সে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। তারা শিখছে, প্রতিবাদ মানে ধ্বংস, নেতৃত্ব মানে ভয়। তারা স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার শিক্ষা পাচ্ছে না, সাহস পাচ্ছে না, ‘মানবিক’ পরিবেশে প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগটাই পাচ্ছে না। কেউ কেউ একসময় ‘বড়দের’ মতোই হয়ে উঠছে। এটাই স্বাভাবিক, আপনি তো হাজারটা শু*** এর ভিড়ে নিজেকে আলাদা করতে পারবেন না।
সুকান্ত ভট্টাচার্য এই দ্রোহ অনুভব করেই হয়তো লিখেছিলেন,
“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।”
তবে, নিজেকে ‘আলাদা’ করতে চাইলে, ‘'ইতিহাস” হতে চাইলে, প্রতিবাদ করলে, বিপ্লব করলে, পতিত শয়তানি শক্তি আপনার পেছনে ধেয়ে আসবে৷ কিছুদিন পর দেখবেন আপনার পেছনে কেউ নাই, বিপ্লবের সাথীগুলার চেহারাও চেইঞ্জ হয়ে গেছে। তখন সিস্টেমকে দোষ দিয়ে নিজেকে আলাদা ‘'মানুষ” হিসেবে সরিয়ে ফেলতে চাইবেন।
ইমাম আবু হানিফা খলিফা আল মনসুরের সময় বিচারপতির দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন ন্যায়বিচারের বদলে অন্যায়ের হাতিয়ার হয়, তখন সেই ক্ষমতার অংশ হওয়া মানে অন্যায়কে বৈধতা দেওয়া।
(তাবাকাত ইবনে সা’দ, খণ্ড ৬)
সুফি দার্শনিক আবদুল কাদের জিলানি তাঁর Futuh al-Ghaib-এ বলেছেন, “যে শাসক জালিম, তার কাছে যাওয়া অন্যায়। সত্য ভাষা লুকানো তার চেয়েও বড় অপরাধ।”
তবে, আমরা প্রতিনিয়তই ‘'রাজনৈতিক ধর্মে” বিশ্বাসী হয়ে ধার্মিকতার গভীর প্রদর্শনী করছি, জালিমকে সমর্থন করছি, জুলুমকে প্রতিষ্ঠিত করছি।
অন্যদিকে জালালুদ্দিন রুমি লিখেছিলেন, “তুমি যদি আল্লাহকে খুঁজো, মানুষের মুখের দিকে তাকাও।” মানুষ স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আশরাফুল মাখলুকাত। সুফিবাদীরা বলেন, মানুষের হৃদয়েই আল্লাহ তায়ালার কুরসি। কিন্তু, প্রচলিত রাজনীতি মানুষকে পতঙ্গ মনে করে কিংবা আরও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে অনস্তিত্বসূচক কিছু একটা ভাবে। কোনো কালেই (আইয়ামে জাহেলিয়াতেও) মানুষের মর্যাদার এত অধপতন বোধহয় ঘটে নি।
আজ রাজনীতি মানুষের মুখে কেবল ভয়ের রেখা এঁকে দিয়েছে। মানুষকে দেখলেই বোঝা যায় তারা আতঙ্কিত, চিন্তিত, ভীত, দ্বিধান্বিত, বিভাজিত। হয় কোনো রাজনৈতিক আদর্শ তাদেরকে তার বান্দা হিসেবে দলে ভিড়িয়েছে, না-হয়, তারা তা দ্বারা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত আর নিপীড়িত।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে এই চিত্র স্পষ্ট। কখনো রাস্তায় আগুন, কখনো বুলেট, কখনো গুম। ক্ষমতার জন্য রাজনীতির নামেই মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। সবই এক দেবতার নামে, যিনি ‘'আদর্শ’ নামের ঈশ্বর। গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে গুম, খুন, নজরদারি, সবই সেই ঈশ্বরের আরাধনা। যে রাজনীতি মানুষের ওপর দাঁড়িয়ে চলে,
সে শেষ পর্যন্ত মানুষকেই মেরে ফেলে।
এরিখ ফ্রম Escape from Freedom (১৯৪১)-এ বলেছিলেন,
“মানুষ স্বাধীনতার ভয় পায়, তাই সে নিজেই কোনো শক্তির দাসে পরিণত হয়।”
আসলে, আমরা আজ সেই দাসত্বেই আছি। দলীয় পতাকা এখন আমাদের তাবিজ, নেতার মুখ আমাদের কিবলা।
কার্ল পপার The Open Society and Its Enemies (১৯৪৫)-এ সতর্ক করেছিলেন,
“যে মুহূর্তে তুমি তোমার নেতাকে প্রশ্ন করা বন্ধ করো, সেই মুহূর্তেই তুমি স্বৈরাচারের পথে হাঁটা শুরু করো।”
আমরা সেই পথের অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
“যেখানে মানুষের ভয়, সেখানেই ধর্মের মৃত্যু।”
(ধর্ম ও নৈতিকতা, ১৯০৮)
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,
“মানুষের উপরে মানুষ সত্য নয়, সত্যের উপরে কিছুই নয়।”
(সত্যের পথে, ১৯২৫)
কিন্তু আজকের রাজনীতিতে মানুষ আর সত্য-দুটিই অবমানিত, অনুপস্থিত আর নির্যাতিত।
সত্যকে হত্যা করা হয় বক্তৃতার মঞ্চে,
মানুষকে হত্যা করা হয় রাস্তায়।
রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণে না আসে,
তবে সেটি ‘আদর্শ’’ তো নয়ই, বরং, এক নিষ্ঠুর অন্ধ উপাসনা।
আমরা সেই উপাসনায় প্রতিদিন অংশ নিচ্ছি,
নিজের অজান্তে, নিজের ‘'রাজনৈতিক'’ ধর্মের পতাকার নিচে,
নিজেকেই বলি দিচ্ছি আমাদের নির্মিত নতুন ‘ঈশ্বরের’ পায়ে।
মো. রিদওয়ান আল হাসান
ধানমন্ডি, ঢাকা
১৩ নভেম্বর ২০২৫
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ১৪/১১/২০২৫চমৎকার উপস্থাপন করেছেন
