www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অবরুদ্ধ মানব

সন্ধ্যে হলেও নগরী নিরব হয়না।পাখিরা কুলায় ফিরলেও মানুষের ঘরেফেরার সময় হয়না।হোসেন সাহেবের প্রয়োজন নিরবতা।তার অন্তরের গভীরতম বোধগুলি নিয়ে একবার ভাবতে নিঃসঙ্গ নিরল কিছু মুহূর্তের প্রয়োজন।এখানে তা হবার নয়।চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা,রাস্তার দুপাশের গাছগুলোর পাতার নিস্পন্দতা বাড়লেও চারপাশের মানুষের কোলাহল কমছেনা।হোসেন সাহেব পার্কের পথ ধরে হেঁটে চলেছেন।তার ছেলে নিলয়ের ছয় হাজার টাকা প্রয়োজন।তিনি হাঁটতে হাঁটতে টাকাটা জোগাড় করার পথ খুঁজছেন।বাইরে থেকে দেখে অবশ্যি বোঝার উপায় নেই যে তিনি টাকার অভাবে ভুগছেন।তা-ও মাত্র ছয় হাজার!স্যুট পরা মুরব্বি গোছের এই ভদ্রলোককে দেখে লোকে ধরেই নেয় একজন শিক্ষিত এবং ধনাঢ্য চাকরিজীবী।শিক্ষার বিষয়টা সঠিক হলেও অর্থের বিষয়টা ডাহা আন্দাজ লোকের।অর্থাৎ,স্যুট পরা মানুষেরা ভালো টাকা কামান এই ধারণাটা অনেকটাই ইলিউশন।

হোসেন সাহেবের ফোনে নিলয়ের কল এলো।তিনি অনেকটা লজ্জিত কন্ঠেই তার ছেলের কাছ থেকে একটু সময় চেয়ে নিলেন।অথচ,এই লজ্জাবোধের কোনো প্রয়োজন ছিলোনা।তার ছেলে তার এই গভীরতম সূক্ষ্ম স্নেহের বিষয়টি ধরতে পারে কি?ধরতে পারলেও হয়তো প্রকাশ করেনা!ছেলের চাকরি হচ্ছেনা শত চেষ্টার পরও।এই নিয়ে হাসান সাহেব ও তার স্ত্রীর মাঝে প্রায় প্রতি রাতেই দুঃখবিলাসী কথপোকথন হয়।তিনি অবশ্য ছেলেকে কখনোই দায়ী করেননা।ছেলে পড়াশোনা করেছে,স্মার্ট,চেষ্টায়ও কমতি নেই।তিনি মেনে নিয়েছেন যে ছেলের চাকরির জন্য কোথাও ঘুষ দেয়ার সামর্থ্য তার নেই।

হোসেন সাহেব বাসে চেপে উত্তরায় এলেন।এখানে রোকেয়া বেগমের বাসা।রোকেয়া হোসেনের বোন।দীর্ঘ বাইশ বছর আগে শাহাদাৎ আলীর সাথে হোসেন নিজেই তার বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন।শাহাদাৎ আলী উত্তরার স্থানীয়।হাইকোর্টের আইনজীবী।বিয়ের প্রথম দিককার কথা।মাস শেষের নয়,শাহাদাৎ আলীর প্রতিদিনকার আয়ের হিসেব রাখার জন্য তার মুহুরিকে বেশ বেগ পেতে হয়-লোকমুখে এমন কথাও শোনা যায়।অর্থাৎ,অর্থ আর বিত্তের প্রাচুর্যতায় রোকেয়া বেশ সুখে থাকবেন বলেই ধারণা করে নেন হোসেন সাহেব।অথচ দুমাস না পেরোতেই তিনি জানতে পারেন যে শাহাদাৎ আলি মানুষ হিসেবে মোটেও ভালো নন।অর্থবান হলেও মানুষের যেসব গুণাবলির জন্য সে পশু থেকে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছে সেসব গুণাবলির অধিকাংশই শাহাদাৎ আলীর মধ্যে অনুপস্থিত।রোকেয়া বেগম অনেকবার ডিভোর্সের কথা ভাবলেও কোনো একটা মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আর পারেননি।মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম।সবার সেটা থাকেনা।রোকেয়া বেগমের হয়তো সে ক্ষমতাটা আছে।
হোসেন সাহেব কলিং বেল চাপলেন।রোকেয়া বেগম দরোজা খুললেন।
-ভাইজান,কেমন আছেন?আসেন,ভাইজান।
-রোকেয়া,তোর কাছে একটা দরকারে এসেছি।
-আগে বসেন ভাইজান।আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।ঠান্ডা পানি আনি আপনার জন্যে।

সোফায় বসে হোসেন সাহেব শুনতে পেলেন তার ভাতিজা রিয়াদের চেচামেচি।মায়ের সাথে এমন জোরে চেচাচ্ছে যে তার নিজেরই ভয় করছে।ঘর গুছাতে গিয়ে রিয়াদের কোনো একটি জিনিস রোকেয়া বেগম সরিয়ে অন্য কোথাও রেখেছেন।সেটা না পেয়ে রিয়াদের মাথা এমন খারাপ হয়ে গেছে।দু একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে বাইরে।রাত হলে কুকুরগুলো বেশি ডাকাডাকি করে।হোসেন সাহেব অস্বস্তিতে ভোগা শুরু করলেন।

উত্তরার একটা দোকান থেকে ছয় হাজার টাকা ছেলের একাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন হোসেন সাহেব।রোকেয়া বেগম টাকাটা ধার দিলেন,যদিও তিনি জানেন যে তার ভাইজান এই টাকা আর ফেরত দিতে পারবেনা সহজে।স্বামীর মতো স্বভাব হওয়া দুই ছেলেকে নিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই সংসার করে যাচ্ছেন রোকেয়া বেগম।কিন্তু,তার ভাইজানের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা তাকে কাবু করে রাখে সবসময়।মানুষকে সিজদাহ করা জায়েজ থাকলে রোকেয়া বেগম হোসেন সাহবকে সেজদাহ করতেন।তিনি তার ভাইয়ের কষ্টটা বোঝেন তবে নিজেরটা কখনো ভাইকে বুঝতে দেননা।যদিও দুজনই দুজনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানেন।

নিলয় পাঞ্জাবিটা পরল।ছেলেদের পাঞ্জাবির একটা সুবিধা যে অকেশন আর ক্যাসুয়াল দুজায়গাতেই চলে যায়।
-খুব মানিয়েছে তোমায়।একেবারে টিপিকাল প্রেমিকদের মতোন লাগছে।
বলে হেসে উঠলো রিয়া।হাসলে ওকে এত সুন্দর লাগে যে নিজের নজর লাগার ভয়ে নিলয় চোখ সরিয়ে নিলো।
রিয়াই পাঞ্জাবিটা কিনে রেখেছিলো।নিলয়কে সারপ্রাইজ দেয়ার এই অভ্যাস ওর পুরনো।

চাঁদের আলোয় পথ আলোকিত।নীল রঙের পাঞ্জাবিটা পরে রিয়ার সাথে পথ হাঁটতে বেশ লাগছে নিলয়ের।শরতের উষ্ণ আবহাওয়া।নিশুতির গুঞ্জন।প্রকৃতির মায়াবী ছায়াবীথিতে রাতের পথগুলো অলৌকিক কোনো বার্তা দিচ্ছে কে?হালকা কুয়াশার মতো রাতের আভা ভেদ করে গাড়ি চলছে,বড় বড় ট্রাক।এমন সময় মহাজাগতের আদ্যোপান্ত রহস্য চোখের সামনে ভাসতে থাকে।প্রশ্ন জাগে এই পৃথিবীর উৎপত্তি,ক্রমবিকাশ কিভাবে হলো তা নিয়ে।বিশেষ করে মানবজীবন নিয়ে।মানুষের রহস্য,জীবনের গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে।নগরীর এই প্রান্তের সবুজ রঙের গাছগুলোর সাথে মানুষের জীবনের মিল খুঁজে নিতে ইচ্ছে হয়।সৌরজগতের তারকামন্ডলীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে-সত্যিই কি তোমরা খোদার মুখে 'কুন' শুনে জন্ম নিয়েছিলে?নাকি আবহমান মহাজাগতিক রহস্যের নীলিমার ভেদ তোমরাও জানোনা?একটা বাইক ওদের সামনে থামলো হঠাৎ।রিয়া নিলয়ের হাত ধরে ফেললো।এরপর যা ঘটলো তা তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রতিদিনকার ঘটনা।
নিলয় অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।তার চেষ্টাই তার ব্যর্থতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।বাইকে যারা ছিলো,তাদের সাথে নিলয়ের পেরে উঠারও কথা নয়।

হোসেন সাহেব টাকা ধার পাওয়ার সম্ভাব্য সকল জায়গায় অনুরোধ করলেন।কোথাও পেলেননা।রোকেয়া বেগম অবশ্যি তড়িঘড়ি করে তার ছেলেকে দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়েছেন।তার সঞ্চয়ের যতটুকু অবশিষ্ট ছিল।কিন্তু হোসেন সাহেবের আরো প্রয়োজন।কারণ,অল্প টাকার ওপর নির্ভর করে গুরুতর আহত ছেলেকে হাসপাতালে নেয়া যায়না।
হোসেন সাহেব হাঁটতে পাচ্ছেননা।তার ছেলের সমস্ত স্মৃতি তার চোখে ভাসছে।হাইপ্রেশার আর হার্টের অসুখে ভোগা হোসেন সাহেবের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।ছেলের লাশ কাঁধে নেয়ার মতোন যন্ত্রণাদায়ক ভয়ংকর কল্পনা তার মস্তিষ্কে খেলে গেল।তিনি নিজেকে ধমকালেন-ছেলে তো মরে যায়নি,কেনো এসব ভাবছি!সেই কবে ছেলের একটা প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে পারেননি,তা-ই তার মাথায় আসলো এবার-'বাবা,আমাদের গাড়ি নাই কেন?'

নিলয় শব্দ করতে পাচ্ছেনা।ঘুম-জাগরন ও চেতন-অচেতন অবস্থার দোদুল্যমান বিভ্রম তাকে আঁকড়ে ধরেছে।রিয়া অঝোরে কাঁদছে।তবে শব্দ হচ্ছেনা।কাঁদছে আর ড্রাইভারকে বলছে এম্বুলেন্স যেনো একটু দ্রুতগতিতে চালান।
রিয়া ভুলে গেছে আগামীকাল জীবনের প্রথম চাকরিতে জয়েন করার কথা।ভুলে গেছে ছিনতাই হওয়া ফোন,গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টসগুলোর কথা।ওর চোখে শুধু নিলয় আর নিলয়ের গায়ের নীল পাঞ্জাবি।একটু আগেই চাকরি পাওয়া উপলক্ষে নিলয়কে সে উপহারটা দেয়।রিয়া ভুলে গেছে চাকরিটা পেয়েই নিলয়কে বিয়ে করার কথা।নিলয়ের না হোক,ও তো চাকরিটা পেয়েছে!পরিবারের না মানার আর কোনো কারণ তো থাকলোনা।
নিলয়ের নীল পাঞ্জাবিটা লাল রক্তে রক্তিম হয়ে গেছে।লিভারের উপর দিক থেকে স্রোতের মতো রক্ত বেয়ে পড়ছে।মাথার একপাশেও প্রচন্ড জখম।
বাবার কাছ থেকে নেয়া ছয় হাজার টাকা আর তার কাছে নেই।সেই টাকা দিয়ে মায়ের জন্য আর রিয়ার জন্য একটা করে শাড়ি আর বাবার জন্য একটা শার্ট তার কেনা হয়নি।রিয়া তার কাছ থেকে লুকিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চাইলেও সে আগেই জেনে যায় রিয়ার চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটা।ওকে আগে গিফট করলেও নিজের বাবা-মার জন্য এর আগে কখনো কিছু কেনেনি সে।বাবার টাকায় বাবা-মাকেই কিছু কিনে দিলে তাকে গিফট বলে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও হোসেন সাহেবের খুশি হওয়ার ব্যাপারে নিলয়ের মনে কোনো সন্দেহ ছিলনা।রিয়ার চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে সে এতটাই খুশি হয়েছিল যে পুরো পৃথিবীটকেই তার প্রিয় মানুষদের কিনে দেয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল তার।কিন্তু তার সেই সামর্থ্য নেই।

এম্বুলেন্স গ্রিন রোড ধরে এগিয়ে চললো।নামে গ্রিন হলেও আসলে সবুজের ছিটেফোঁটাও নেই এখানটায়।রাত গভীর,মেঘ জমেছে আকাশে।চাঁদটা যেন হঠাৎ কোথাও পালিয়েছে।নিলয়ের মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন।রিয়া কাঁদছে আর নিলয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।সে চোখজোড়া তার দিকে তাকাচ্ছেনা।এম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছে।
নিলয় টের পাচ্ছে তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য কত আয়োজন!সে বুঝতে পারে হোসেন সাহেব তার কাছে নেই।তার বাবা।এই বাবাকে এর আগে কখনো প্রচন্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি।এই মুহূর্তে তার সেই অনুভূতি হচ্ছে।রিয়ার জন্য সে ভাবলোনা।তার মায়ের জন্যও না।তার মনে পড়লো স্কুলে প্রথমদিন ক্লাস শেষে বাবার হাত ধরে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় বাবাকে করা একটি প্রশ্ন।'বাবা,আমাদের গাড়ি নাই কেন?'বাবা কোনো উত্তর দিতে পারেননি।সেই লজ্জিত অর্ধনমিত বাবার অমায়িক চেহারা আর চাহনি নিলয়ের চোখে ভেসে ওঠে।উত্তরটা অবশ্য সে আজ জানে।নিলয়ের চোখের কোনে পানি জমে।তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এমনটা যেন সে নিজেই টের পায়।তার মনে আবারও ঘুরতে থাকে সে একই প্রশ্ন যা সে স্কুলের প্রথমদিন তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল।

বিরোধীদলের অবরোধ কর্মসূচিতে ধাওয়া পালটা ধাওয়ার কবলে পড়ে হাসপাতাল থেকে কিছু দূরে এসে এম্বুলেন্স আটকা পড়ে।চব্বিশ ঘন্টা অবরোধের পাশাপাশি মধ্যরাতের এমন সংঘর্ষ অনেকদিন পর দেখছে দেশবাসী।প্রচলিত রাজনীতি যে কতটা ধ্বংসাত্মক তার একটা চিত্র দেখা যায় সেখানে।নিলয়ের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।রিয়া তার হাত চেপে রেখেছে।নিলয়ের মা অর্ধচেতন মনে প্রার্থনা করছেন।অসহায় মানুষ প্রার্থনা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে!
কাছেই কোথাও একটা ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়।নিলয়ের দেহ একটা ঝংকার দিয়ে উঠে।নিলয়ের মুখটা নড়ে উঠে হালকা।কী বলছে পুরোপুরি বোঝা না গেলেও 'বাবা' বলার সময় মুখটা ঠোঁট দুটা যেরকম ছন্দে উঠানামা করে তেমনটাই দেখা গেলো নিলয়ের ঠোঁটে।এম্বুলেন্স অবরোধের আওতামুক্ত থাকায় ছাড়া পেল কিছুক্ষণ পর।এগিয়ে চললো হাসপাতালের দিকে।তবে সামনে একটা বড় জটলা থাকায় অন্য রোড দিয়ে ঘুরে যাবে কিনা সে ভাবনা ড্রাইভারকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
-০-
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩২৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৫/১০/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast