www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আজাবের এক রাত

নিশার বাসা থেকে আমার বাসার দূরত্ব খুব একটা বেশি না।বড়জোর দু মিনিটের পথ।কিন্তু এখন এই পথটুকু যেতেও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে।পা যেনো চলছেই না।ভারী হয়ে আসছে।

গত দুদিন ধরেই নিশা আমার সাথে মিসবিহেভ করে যাচ্ছে।নিজে থেকে আমাকে কল করেনি।ফোনকল করলেও রিসিভ করেনি।পথে একবার দেখা হলে "সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরো কেন?কোনো কাজ নেই?"বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
বেশ কদিন যাবৎ রিয়াদের সাথে নিশার ঘনিষ্ঠতা অনেকখানি বেড়ে গেছে। এই বিষয়টি আমি বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছি।আমি জানি যে রিয়াদ নিশার খুব ভালো একজন বন্ধু।একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে।এই নিয়ে আমার মনে কোনোরকম মন্দ ধারণা ছিলনা।আমি সবকিছু সহজভাবেই নিয়েছিলাম।
গতকাল বিকেলে দেখি নিশা রিয়াদের পাশে বসে রিকশা করে পার্কের পথ ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে।আমি তবুও কোনো প্রশ্ন করিনি নিশাকে।হয়তো ছেলে বন্ধুকে নিয়ে রিকশা করে কোথাও ঘুরতে যাওয়া আজকাল কোনো মেয়ের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আমি চারবছরের সম্পর্ককে অনেক বড় করে দেখতাম।এক মুহূর্তেই বিনা মেঘে বজ্রপাতে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে তা ভাবিনি।আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ নিশা টেক্সটে লিখলো-
আমাকে তুমি ক্ষমা করো।তুমি অনেক ভালো ছেলে।কিন্তু আমার কিচ্ছুই করার নেই।রিয়াদ আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।জানো,ও ফুল নিয়ে প্রতিদিন আমার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে থাকে।পাগলামি করে।সবাইকে বলে বেড়ায় আমাকে না পেলে নাকি মরে যাবে।আমি ওর চোখে আমার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি।তোমার কাছে তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।আমি ওকে ফেরাতে পারবোনা।তুমি প্লিজ আজ রাতে এসে আমাকে দেয়া আংটিটা ফেরত নিয়ে যেয়ো।এইটা অন্য কাউকে দিয়ো।আমি সত্যিই সরি।রিয়েলি সরি।

আমি তাকে দেওয়া সেই আংটিটা ফেরত নিতেই রওয়ানা হয়েছি।বিষাদ,ক্লেশ আর অন্ধ অভিমানে আমার মন প্রচন্ডরকমের খারাপ হয়ে আছে।মনের বিষাদ দেহকেও অবরুদ্ধ করে ফেলেছে।মাঝপথে এসে থেমে গেছি।দেখি আফজাল সাহেব দ্রুত পায়ে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আমাদের বাসার দিকেই ছুটে আসছেন।তাকে বেশ আতঙ্কিত,ভীত আর একই সাথে উত্তেজিত মনে হচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
-আঙ্কেল,কি হয়েছে?
-হাসান,আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
-কি হয়েছে?বলবেন তো।
-সন্ত্রাসী মাহিনের এক চেলা রিয়াদ।সে আমার দোকানে হামলা করেছে।অনেক মালামাল ভাঙচুর করেছে।টাকা পয়সা লুট করেছে।তুমি কিছু একটা করো,বাবা।আমি কি করবো বুঝতে পাচ্ছিনা।পুলিশকে খবর দিয়েছি।কিন্তু,এখন আর কি কি করতে হবে?
আমি কিছুই বললাম না।আমি কোনো ঝামেলায় জড়ানোর ছেলে না।আফজাল সাহেবকে ইশারায় চলে যেতে বললাম।

আমি উলটোপথে হেঁটে পার্কের পথে যেতে লাগলাম।রাতে বেলা তাই রাস্তা প্রায় ফাঁকা,খুব বেশি জনমানব বা রিকশা-গাড়ি নেই।পার্কের প্রবেশপথে রিয়াদ দাঁড়িয়ে।আমি হকচকিয়ে গেলাম তাকে দেখে।আমাকে দেখে রিয়াদ বললো
-হাসান ভাই,তুমি?
-হ্যা,তুমি নাকি দোকান ভাঙচুর করে আসছ আফজাল চাচার?
-জি,ভাই।শালা একটা বাটপার।ডেট এক্সপায়ার্ড জিনিসপত্র বিক্রি করে।আরো অনেক উল্টাপাল্টা করে।কাস্টমারদের সাথে মিসবিহেভ করে।
-পুলিশ তো তোমাকে খুঁজতেছে এখন।
-ভাই,আজকে পার্কেই ঘাপটি মেরে থাকমু।খুঁজে পাবেনা কেউ।
এমন সময় আমার ফোনে কল এলো।নিশা কল করেছে।
-কি ব্যাপার,তুমি আসছোনা কেনো?তোমার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।আংটিটা ফেরত নিবেনা?আমি তোমাকে কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবোনা।যা হয়েছে ভুল হয়েছে।আমি তো ক্ষমা চেয়েছিই।আর আমি রিয়াদকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।যদিও ওকে বলিনি,তবে শীঘ্রয়ই বলবো।তুমি প্লিজ আংটিটা নিয়ে যাও।তোমার কোনো স্মৃতি আমার কাছে রাখতে চাইনা।

আমি কল কেটে ফোনটা পকেটে রেখে আকাশের দিকে তাকালাম।একটা লম্বা শ্বাস নিলাম।রিয়াদ এখনো পাশে দাঁড়িয়ে আছে।আমি বললাম
-রিয়াদ,তুমি কি জানো?জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টি কি?
-না তো ভাই।কি?
-নিজের কাছে হেরে যাওয়া।
পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যাচ্ছে।হয়তো তারা রিয়াদকে খুঁজছে অথবা রাতের টহল দিচ্ছে।
আমি রিয়াদকে পার্কের পেছনের দিকের পথটা দিয়ে পালিয়ে যেতে বললাম।রিয়াদ চলে গেলো।পকেট থেকে সিগারেট বের করে হাতে নিলাম।আমি সিগারেট খাইনা।আজকেই প্রথমবার কিনেছি।কিভাবে খেতে হয় সেটাও জানিনা।নিশা অদ্ভুতভাবে আমার সাথে ব্রেকাপ করার পরপরই কিনেছি।ভাবলাম একটু টেনে দেখি,কেমন লাগে।কিন্তু সঙ্গে ম্যাচ নেই।কিভাবে ধরাবো!কি বোকাই না আমি!সিগারেট কিনেছি অথচ ম্যাচ কিনিনি!

পুলিশের গাড়ি আমার সামনে এসে থামলো।বাম পাশ থেকে একজন নামলেন।দেখে মনে হলো এসআই বা দারোগা টাইপের কেউ হবেন।আমি তাকে চিনতে পারি।আমার দিকে টর্চের আলো ফেললেন।
আমার কাছে এসে ভয়ংকরভাবে প্রশ্ন করলেন
-কি ব্যাপার,এই রাত্রিবেলায় পার্কে কি করেন?
-স্যার,ম্যাচ আছে সাথে?সিগারেট ধরাবো।
-কি বললেন?ফাজলামো হচ্ছে!
-স্যার,ফাজলামো কেন করবো!আমার বাবা বলেন,"পুলিশ হলো ফেরেশতার মতোন।তাদের সাথে দুষ্টামি,ফাজলামো করতে নেই কখনো।"
এসআই সাহেব কন্সটেবলকে ডেকে আমাকে গাড়িতে তুললেন।পথিমধ্যে জানতে পারলেন আমি তার ছেলের বন্ধু।আমিই তাকে এই তথ্য দিয়েছি।আমাকে থানায় নেওয়া হলো না।নিউমার্কেটের সামনে ছেড়ে দিলেন।
নিশা আবার ফোন করেছে।
-কি হলো!তুমি আসবানা?আর তখন কল কেটে দিলা কেন?
-আংটি ফেলে দাও।আমি আনতে যাবোনা।

আমি ফোন সুইচড অফ করে সিম খুলে ফেলে দিলাম।কাল একটা নতুন সিম কিনে নিবো।রাত প্রায় বারোটা বাজে।দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে।আমি রাস্তায় হাটতে লাগলাম।সমস্ত স্মৃতি মনে পড়ছে।এই চার বছর একসাথে কত সময় কাটিয়েছি!কত মেসেজিং করেছি!কত ভালোবাসার কথা বলেছি!কত ঝগড়া করেছি!কত সময় ব্যয় করেছি নিশার পেছনে!নিজের আবেগ-উৎকন্ঠা ওর পেছনে ইনভেস্ট করেছি।আর কত স্বপ্ন!কত আশা!আর ও কি না এক মুহূর্তেই সব কিছু ভুলে গেলো!
আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পাচ্ছিনা।হাটতে হাটতে আমি সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক নেতা মাহিনের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম।তার গেইটে নক করলাম।
গেইট খোলা হলো।মাহিন নামের সেই কথিত ক্যাডার আসলো।
আমি বললাম
-ভাইজান,আমি হাসান।আপনি বোধহয় চিনবেননা।
-আমার কাছে কেন আইছ?
-নালিশ দিতে আসছি ভাইজান।
-কিসের নালিশ?কার বিরুদ্ধে?
-আপনার বিরুদ্ধে ভাইজান।
-কি!এত বড় কইলজা!এই তোরা কই!আমার বিরুদ্ধে নালিশ আবার আমার কাছেই!
-ভাইজান,আপনি একটা ব…..।সেটা আপনি জানেন?
মাহিন মিয়ার লোকজন আমার কাছে এগিয়ে এলো।সবার কাছেই কোনো না কোনো অস্ত্র আছে।
আমি আচমকা বলে উঠলাম
-এই খবরদার,এক পা ও সামনে এগুবিনা কেউ।ডিবির লোক আমি।
পকেট থেকে ন্যাশনাল আইডি কার্ডটা বের করে দেখালাম।এটাকেই মাহিন মিয়া আর তার দল পুলিশ বিভাগের আইডি কার্ড ভেবেছে।

-স্যার,আপনি!আগে বলবেননা।এই তোরা যা স্যারের আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর।
-না।আমি চলে যাবো।আমাকে খুশি করে দাও।আমিও খুশিমনে চলে যাই।
মাহিন মিয়া সঙ্গে সঙ্গেই টাকার বান্ডেল আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।গুনে দেখি,দুই লক্ষ্য টাকা।

আমি দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম।জনমানবহীন নিরব রাস্তায় একাকি হাটতে মোটেও ভালো লাগছেনা।দোকানপাট দু একটা খোলা থাকলেও শহরটা বেশ ফাকা ফাকা লাগছে।মনে হচ্ছে গোরস্থানে পরিনত হয়েছে সারা শহর।আয়োজন নেই,আলোড়ন নেই,আনন্দ নেই,গান নেই,শব্দ নেই।

আমি আফজাল মিয়াকে দুলাখ টাকা দিয়ে বললাম
-কাল গিয়েই নতুন পন্য আর মালামাল কিনে আইনেন।
তিনি বেশ অবাক হয়েছেন।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

পরেরদিন সকালে খবর পেলাম নিশা রিয়াদকে নিয়ে পালিয়েছে।তারা হয়তো তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে।আমার আংটিটা সম্ভবত নিশা ফেলেই দিছে।
কিন্তু নিশার সাথে কি ঘটবে এরপর তা ভেবে মন খারাপ হলো।আমি জানি,রিয়াদ মোটেও ভালো ছেলে না।শত হলেও মাফিয়া গ্রুপের সদস্য সে।নিশা কি কিছুই জানতোনা।রিয়াদের স্মার্টনেস,বাইক আর বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখেই ও ফিদা হয়ে গেলো!

আচ্ছা,নিশা কি সত্যিই আংটিটা ফেলে দিয়েছে?নাকি এখনো পরে আছে!আংটিটার দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছুক্ষণ আমার কথাই ভেবেছে।আমার চোখ ছিল ওর খুব পছন্দের।বিড়াল চোখ।ও কি এখন আমার চোখের কথাই ভেবেছে?এমন সময় হয়তো রিয়াদ ওকে বলেছে-
কি দেখো কখন থেকে এই আংটিটার দিকে?কে দিয়েছিল এই আংটি!ও হাসান ভাই?তোমার সাবেক প্রেমিক?একটা গর্দভ!মিচকা শয়তান একটা!তার স্মৃতি রেখে দিয়েছ কেন?এখনি ফেলে দাও।
নিশা হয়তো তৎক্ষণাৎ আংটিটা খুলে চলন্ত বাস কিংবা ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।কেননা,তারা নতুন শহরে যাচ্ছে।নতুন পথে,নতুন গন্তব্যে।অনেক দূরের পথে।

দুদিন পর নিশার বাবাকে পাগলের মতো প্রলাপ করতে শোনা গেলো।এইটুকু বোঝা গেলো নিশাকে একদল পিশাচ পৈশাচিকভাবে ধর্ষণ করেছে।নিশা রেললাইনে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যা করেছে,যদিও নিশার জানা ছিল আত্মহত্যা মহাপাপ।

মাগরেবের পর নিশার জানাজা হয়েছে।আমি নিশার জানাজা পড়ে ওর কবর দেওয়ার পর ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করলাম
-হুজুর,আজ রাতে নিশার কবরে জাহান্নামের আজাব হবে,তাই না?
ইমাম সাহেব কিছু বল্লেন না।চুপ করে রইলেন।তবে কিছুক্ষণ পর টের পেলাম ফোটা ফোটা পানি তাঁর লাল দাড়ি বেয়ে টপ টপ করে মাটিতে পড়ছে।

আমি অনেক্ষণ ধরে নিশার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম।আমার বুকে তীব্র হাহাকার,গোপন দুর্বোধ্য আক্ষেপ কিংবা জটিল কোনো কষ্টের মতোন ঢেউয়ের জোয়ার যেন ঝরের বেগে ছড়িয়ে পড়লো।আমার সমস্ত শরীর অসাড় হতে শুরু করলো।মনে হলো আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়ছি।এই আগুনের উত্তাপ দুনিয়ার আগুনের চেয়ে সত্তর গুন বেশী।আমি হাবিয়ার লেলিহান শিখায় পুড়ছি।

মসজিদ থেকে আজানের এশার আযানের মধুর সুর ভেসে আসছে।আল্লাহর বান্দাদের আহ্বান করা হচ্ছে।"হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল।তোমরা কল্যানের দিকে আসো,তোমরা সফলতার দিকে আসো।"
আমি চোখ বন্ধ করে গোরস্তানেই বসে আছি।হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো আমিও কবরে শুয়ে আছি।চারিদিকে অন্ধকার।কেউ নেই।আলো নেই।নিশা আমার পাশেই শুয়ে আছে।তবে ওর আজাব হচ্ছেনা।আহ!একটা প্রশান্তির শ্রোত বয়ে গেলো মন জুড়ে।আবার খানিকক্ষন বাদেই তীব্র ভয় আচ্ছন্ন করে ফেল্ল।আমার আজাব হচ্ছে যেনো।তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে শরীর জুড়ে।দুই ফেরেশতা লোহার মুগুর নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আমি জ্ঞান হারালাম।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০৭/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast