বিষাক্ত বিবেক
।। বিষাক্ত বিবেক।।
-মহাদেব দাশ
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। গ্রামের বাড়ী, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নি:স্তদ্ধ রাত। ফজর আলী শুধু এপাশ ওপাশ করছে, অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবেই ঘুম আসছে না। নিদ্রাদেবি আজ ফজর আলীর চোখের ঘুম মনে হয় কেড়ে নিয়েছে, একবার মনে মনে ভাবছে যে, উঠে একটু ঘুরে আসি কিন্তু পরক্ষনে কি যেন মনে করে আবার শুয়ে পড়লো। ফজর আলীর মাথায় অনেক চিন্তা, অভাবের সংসার, সারাদিন পরের ক্ষেতে মজুর দিয়ে যে কয়টা টাকা পায়, তা দিয়ে তিন তিনটে বাচ্চা সহ পাঁচ জনের লোকের সংসারের ভালো মন্দ তো দুরে থাক, চাল ডাল তেল নুন কিনতেই টাকাটা ফুরায়ে যায়। তার উপর বড় মেয়েটা বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠেছে। কোনভাবেই হিসেব মিলতে চাই না ফজর আলীর। ছোট মেয়েটার জন্যে একটু খাবার কিনবে তাও আবার সবদিন সম্ভব হয়ে হয়ে উঠে না। আজ কয়েকদিন হলো ফজর আলীর শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, শরীরটা আর চলছে না। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিন সকালে উঠে পরের জমিতে কাজে যেতে হয়। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বেশ কয়েকদিন ধরে তার বউ জমিলাও বলতেছিল যে, তার এপেনডিক্সের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে, মাসখানেক আগে রাতে একদিন ঐ রকম খুব ব্যথা উঠেছিল। কি আর করা, সেই রাতে উত্তর পাড়ার সামাদ ডাক্তারকে বাড়ীতে ডেকে এনে দু তিনটে ছুঁই ফোটালো আর সপ্তাহখানেক ধরে তিন চার রকমের বড়ি খাওয়ানোর ফলে আজ কয়েয়টা দিন আপাতত: ভালো। কিন্তু সামাদ ডাক্তার বলেছিল-রেডি থাকতে, যে কোন মুর্হুতে জমিলার অপারেশন করতে হতে পারে। সামাদ ডাক্তারের সেদিনকার সেই টাকাটা আজও শোধ করতে পারেনি ফজর আলী। ফজর আলীর বউ জমিলার বয়স প্রায় বছর তিরেশেক হবে কিন্তু দেখে মনে হয় বয়সের ছাপে প্রায় বুড়ি হয়ে গেছে। একতো নানাবিধ রোগ লেগে আছে তার উপর তিনবেলা ঠিকমতো না খেয়ে খেয়ে এমনটাই হয়েছে। জমিলাও কিন্তু সংসারের জন্য কম করে না। সেই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই চলে যায় পশ্চিম পাড়ার মাতব্বরের বাড়ীতে কাজ করতে। মাস গেলে সামান্য কয়টা টাকা বেতন পায় তা তো এনেই ফজর আলীর হাতে তুলে দেয় জমিলা। তাছাড়া মাতব্বর বাড়ী থেকে প্রতিদিন কিছু বাসি পান্তা খাবার নিয়ে এসে তাতেই প্রায় একজনের খাবার হয়ে যায়। এমন বিভিন্ন ধররেনর চিন্তা করতে করতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে, ফজর আলী মোটেও টের পায়নি। পাশে শুয়ে থাকা জমিলার নিরব নিথর দেহখানি দেখলে ফজর আলীর মায়া লাগে, মনে মনে বলে- আহ্ বেচারা, আমার সাথে সংসার করতে এসে আজ তোর এ অবস্থা, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস্, আমি তোর হতভাগা স্বামী। কি সুন্দর টকটকে চেহারা ছিল জমিলার ? প্রথম যেদিন আমার বাড়ীতে বউ সেজে এসেছিলো, সেদিন পাশের ২/৩ গ্রামের লোক এসেছিলো জমিলাকে দেখতে। কত লোকে বলছে- ফজর আলী একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে গো। হঠাৎ পাশ খেকে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো ফজর আলী। জমিলা বলছে- কিগো এখনো ঘুমাওনি ? এতরাত ধরে জেগে আছো কেন ? কাল সকালে কাজে যাবে না ? রাত জাগলে তো শরীর খারাপ করবে তোমার ? ফজর আলী বড় করে একটা নি:ম্বাস ছেড়ে বলল -আর আমার শরীর, বাদ দে তো।
-কি হয়েছে তাই বলো।
- আচ্ছা, তোমার মেয়ে তো বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে না ?
- দিতে তো হবেই কিন্তুু বিয়ে দিতে তো অনেক টাকা লাগে, কই পাবো এত টাকা ?
- তা জানিনা, তবে যত তাড়াতাড়ি পারো, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও, খুব তাড়াতাড়ি।
- কি ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি করছিস কেন, কি হয়েছে, কোন সমস্যা ?
- তা জানিনা, তবে মেয়ের চলাফেরার ভাব আমার একদমই ভালো লাগছে না, আজকাল ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না, কোনকিছু খাতি গেলি শুধুই অক তোলে, স্কুলেও ঠিকমতো যাচ্ছে না, সারাদিন বসে বসে কি যেন ভাবে।
-এই ব্যাপার, আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিকমতো খাতি পারে না তো, সেজন্যি গ্যাস ট্যাস হতি পারে। তুই কোন চিন্তা করিস না তো ? আমি নিজে কাল বেয়ানবেলা ওর সাথে কথা বলবো, আমার মেয়েডা একটা লক্ষী পিত্তিমার মতো। আমার মেয়েডার নামে কোন বাজে কথা বলবি না। অনেক রাত হলো, এখন ঘুমিয়ে পড়।
-তুমি যতই বলো, আমার মনডা কিন্তু ভালো লাগতিছে না।
-আরে না, আল্লাহ আমাদের কোন খেতি করবি না। আচ্ছা, তুই রেশমার সাথে একবার কথা বলে দেখ তো।
-কথা তো বলেছি। ও তো বলছে- কিছু না।
- তাহলে তো সমস্যা কি ? তুই তো জানিস, আমাগি মায়েডা তো মিথ্যে কথা বলে না।
২/৩ দিন পর হঠাৎ একদিন রাত দশটার দিকে রেশমার পেটে তীব্র ব্যথা সেই সাথে বমি করতে লাগলো। কোনকিছু খেতে গেলেই বমি বমি লাগে। কিছুতেই কমছে না। জমিলা বেগম কাঁদতে লাগলো, একি হলো আমার মেয়েটার ? তোমরা আমার মেয়েটাকে বাঁচাও। ফজর আলীও খুব চিন্তাই পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আবারো সামাদ ডাক্তার কে ডেকে আনলো। সামাদ ডাক্তার মেয়েটাকে ভালো করে দেখেশুনে সামান্য কিছু ওষধপত্র দিয়ে ফজর আলী কে আলাদাভাবে ডেকে বলল- তোমার মেয়ের বাচ্ছা হবে। এ কথা শুনে ফজর আলীর মাথায় যেন বাজ পড়ল, সাথে সাথেই মাটিতে বসে পড়ল। ডাক্তার কে বলছে- না না এ হতে পারে না, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে ডাক্তার। আল্লাহ আমারে এতবড় সর্বনাশ করতে পারে না। ফজর আলী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
ফজর আলী জমিলাকে ডেকে বলল- তোর মায়েডা তো পোয়াতি হইছে, তুই দেখোস না, তুই ওর মা। সারাদিন বাড়ী বসি কি করিস ? আমি সবার সামনে মুখ দেখাবো কি করে ?
-তুমি বলছো কি ? আমার মেয়ে পোয়াতি ? আরে না না, এ হতেই পারে না।
-কোন শালার পো আমার মায়েডার সর্বনাশ করলো গো ? আমি এখন কোথায় যাবো গো ?
ফজর আলী কাঁদতে কাঁদতে প্রলাপ বকতে শুরু করলো, বলছে- আমি আর এ জীবন রাখবো না, কখনো কখনো বলছে গলায় দড়ি দেবে। কখনো কখনো বলছে- আল্লা আমার মরন দাও।
জমিলা বেগম রেশমার কাছে যেয়ে বলছে- কেন এমন কাজ করলি মুখপুড়ি ? একটুও মান সন্মান নেই তোর ? গলায় দড়ি দিয়ে মরলি না কেন ?
রেশমা কোন কথাই বলছে না, শুধুই কাঁদছে। লজ্জায় অপমানে নিজেকে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কি করবে এখন রেশমা-----
রেশমার মা বলছে- কি রে, কথা বলতিছিস না কেন ? না-কি তোর জন্য আমরা সবাই গলায় দড়ি দেব, নাকি বিষ খেয়ে মরবো ?
রেশমা তবুও নি:শ্চুপ।
পরদিন খুব সকালে ফজর আলী ও রেশমার মা দুজনে মিলে মাতব্বর বাড়ীতে গেল। রেশমার সমস্ত কথা খুলে বললো। কিন্তু , তাতে কি হবে ? চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। মাতব্বর তো কোন কথাই শুনলোই না, বরং উল্টো ফজর আলীর মেয়ের দোষ দিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দিল। মাতব্বর আরও শাসিয়ে দিল যে- ফের যদি আমার হিরের টুকরো ছেলে সর্ম্পকে বাজে কোন কথা বলেছো, তবে ফজর আলীর শুধু ভিটেছাড়াই নয়, এ গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেবে। হায়রে নিষ্ঠুর নিয়তি ? কি হতে কি হয়ে গেল। ফজর আলী কোথায় যাবে, কার কাছে জানাবে এ দু:খের কথা। আল্লা যেন এর বিচার করে এ কথা বলতে বলতে ফজর আলী মাতব্বরের বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল।
এরপর ফজর আলী এলাকার মেম্বর চেয়ারম্যানের কাছে গেল। সারাটা দিন বসে থেকে শেষমেষ চেয়ারম্যানের কাছে সব কিছু খুলে বললো। চেয়ারম্যান সবকিছু শুনে বুঝে ফজর আলীকে কিছুটা সঠিক বিচারের আশ্বাস দিল বটে কিন্তু তাতে ফজর আলীর মনে সায় দিচ্ছে না। অত:পর পড়ন্ত বেলায় হাটতে হাটতে বাড়ীতে আসলো।
রেশমা সারাটা দিন ঘরে বসে বসে চিন্তা করছে- কি করবে এখন, গ্রামের মানুষের সামনে এ মুখ দেখাবে কি করে ? না-কি সে আত্মহত্যা করবে ? কিন্তু যে আসছে- তার তো কোন দোষ নেই ? মাতব্বরের পোলা তো কোরান শরীফ ছুয়ে আল্লাহ কে স্বাক্ষী রেখে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা হলে কি সব তার অভিনয় ? লাল কাপড়ে মোড়ানো ঐ বইটা কি কোরান শরীফের বদলে অন্য কোন বই ছিল ? এমন অনেক ধরনের প্রশ্ন রেশমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে । তার আব্বা আম্মা সমাজে মুখ দেখাবে কি করে ?
লোকমুখে শুনেছে আত্মহত্যা নাকি মহা গুনাহর কাজ। রেশমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বাড়ী থেকে অজানার উদ্দ্যেশে বের হয়ে গেল।
-মহাদেব দাশ
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। গ্রামের বাড়ী, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নি:স্তদ্ধ রাত। ফজর আলী শুধু এপাশ ওপাশ করছে, অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবেই ঘুম আসছে না। নিদ্রাদেবি আজ ফজর আলীর চোখের ঘুম মনে হয় কেড়ে নিয়েছে, একবার মনে মনে ভাবছে যে, উঠে একটু ঘুরে আসি কিন্তু পরক্ষনে কি যেন মনে করে আবার শুয়ে পড়লো। ফজর আলীর মাথায় অনেক চিন্তা, অভাবের সংসার, সারাদিন পরের ক্ষেতে মজুর দিয়ে যে কয়টা টাকা পায়, তা দিয়ে তিন তিনটে বাচ্চা সহ পাঁচ জনের লোকের সংসারের ভালো মন্দ তো দুরে থাক, চাল ডাল তেল নুন কিনতেই টাকাটা ফুরায়ে যায়। তার উপর বড় মেয়েটা বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠেছে। কোনভাবেই হিসেব মিলতে চাই না ফজর আলীর। ছোট মেয়েটার জন্যে একটু খাবার কিনবে তাও আবার সবদিন সম্ভব হয়ে হয়ে উঠে না। আজ কয়েকদিন হলো ফজর আলীর শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, শরীরটা আর চলছে না। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিন সকালে উঠে পরের জমিতে কাজে যেতে হয়। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বেশ কয়েকদিন ধরে তার বউ জমিলাও বলতেছিল যে, তার এপেনডিক্সের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে, মাসখানেক আগে রাতে একদিন ঐ রকম খুব ব্যথা উঠেছিল। কি আর করা, সেই রাতে উত্তর পাড়ার সামাদ ডাক্তারকে বাড়ীতে ডেকে এনে দু তিনটে ছুঁই ফোটালো আর সপ্তাহখানেক ধরে তিন চার রকমের বড়ি খাওয়ানোর ফলে আজ কয়েয়টা দিন আপাতত: ভালো। কিন্তু সামাদ ডাক্তার বলেছিল-রেডি থাকতে, যে কোন মুর্হুতে জমিলার অপারেশন করতে হতে পারে। সামাদ ডাক্তারের সেদিনকার সেই টাকাটা আজও শোধ করতে পারেনি ফজর আলী। ফজর আলীর বউ জমিলার বয়স প্রায় বছর তিরেশেক হবে কিন্তু দেখে মনে হয় বয়সের ছাপে প্রায় বুড়ি হয়ে গেছে। একতো নানাবিধ রোগ লেগে আছে তার উপর তিনবেলা ঠিকমতো না খেয়ে খেয়ে এমনটাই হয়েছে। জমিলাও কিন্তু সংসারের জন্য কম করে না। সেই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই চলে যায় পশ্চিম পাড়ার মাতব্বরের বাড়ীতে কাজ করতে। মাস গেলে সামান্য কয়টা টাকা বেতন পায় তা তো এনেই ফজর আলীর হাতে তুলে দেয় জমিলা। তাছাড়া মাতব্বর বাড়ী থেকে প্রতিদিন কিছু বাসি পান্তা খাবার নিয়ে এসে তাতেই প্রায় একজনের খাবার হয়ে যায়। এমন বিভিন্ন ধররেনর চিন্তা করতে করতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে, ফজর আলী মোটেও টের পায়নি। পাশে শুয়ে থাকা জমিলার নিরব নিথর দেহখানি দেখলে ফজর আলীর মায়া লাগে, মনে মনে বলে- আহ্ বেচারা, আমার সাথে সংসার করতে এসে আজ তোর এ অবস্থা, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস্, আমি তোর হতভাগা স্বামী। কি সুন্দর টকটকে চেহারা ছিল জমিলার ? প্রথম যেদিন আমার বাড়ীতে বউ সেজে এসেছিলো, সেদিন পাশের ২/৩ গ্রামের লোক এসেছিলো জমিলাকে দেখতে। কত লোকে বলছে- ফজর আলী একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে গো। হঠাৎ পাশ খেকে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো ফজর আলী। জমিলা বলছে- কিগো এখনো ঘুমাওনি ? এতরাত ধরে জেগে আছো কেন ? কাল সকালে কাজে যাবে না ? রাত জাগলে তো শরীর খারাপ করবে তোমার ? ফজর আলী বড় করে একটা নি:ম্বাস ছেড়ে বলল -আর আমার শরীর, বাদ দে তো।
-কি হয়েছে তাই বলো।
- আচ্ছা, তোমার মেয়ে তো বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে না ?
- দিতে তো হবেই কিন্তুু বিয়ে দিতে তো অনেক টাকা লাগে, কই পাবো এত টাকা ?
- তা জানিনা, তবে যত তাড়াতাড়ি পারো, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও, খুব তাড়াতাড়ি।
- কি ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি করছিস কেন, কি হয়েছে, কোন সমস্যা ?
- তা জানিনা, তবে মেয়ের চলাফেরার ভাব আমার একদমই ভালো লাগছে না, আজকাল ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না, কোনকিছু খাতি গেলি শুধুই অক তোলে, স্কুলেও ঠিকমতো যাচ্ছে না, সারাদিন বসে বসে কি যেন ভাবে।
-এই ব্যাপার, আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিকমতো খাতি পারে না তো, সেজন্যি গ্যাস ট্যাস হতি পারে। তুই কোন চিন্তা করিস না তো ? আমি নিজে কাল বেয়ানবেলা ওর সাথে কথা বলবো, আমার মেয়েডা একটা লক্ষী পিত্তিমার মতো। আমার মেয়েডার নামে কোন বাজে কথা বলবি না। অনেক রাত হলো, এখন ঘুমিয়ে পড়।
-তুমি যতই বলো, আমার মনডা কিন্তু ভালো লাগতিছে না।
-আরে না, আল্লাহ আমাদের কোন খেতি করবি না। আচ্ছা, তুই রেশমার সাথে একবার কথা বলে দেখ তো।
-কথা তো বলেছি। ও তো বলছে- কিছু না।
- তাহলে তো সমস্যা কি ? তুই তো জানিস, আমাগি মায়েডা তো মিথ্যে কথা বলে না।
২/৩ দিন পর হঠাৎ একদিন রাত দশটার দিকে রেশমার পেটে তীব্র ব্যথা সেই সাথে বমি করতে লাগলো। কোনকিছু খেতে গেলেই বমি বমি লাগে। কিছুতেই কমছে না। জমিলা বেগম কাঁদতে লাগলো, একি হলো আমার মেয়েটার ? তোমরা আমার মেয়েটাকে বাঁচাও। ফজর আলীও খুব চিন্তাই পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আবারো সামাদ ডাক্তার কে ডেকে আনলো। সামাদ ডাক্তার মেয়েটাকে ভালো করে দেখেশুনে সামান্য কিছু ওষধপত্র দিয়ে ফজর আলী কে আলাদাভাবে ডেকে বলল- তোমার মেয়ের বাচ্ছা হবে। এ কথা শুনে ফজর আলীর মাথায় যেন বাজ পড়ল, সাথে সাথেই মাটিতে বসে পড়ল। ডাক্তার কে বলছে- না না এ হতে পারে না, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে ডাক্তার। আল্লাহ আমারে এতবড় সর্বনাশ করতে পারে না। ফজর আলী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
ফজর আলী জমিলাকে ডেকে বলল- তোর মায়েডা তো পোয়াতি হইছে, তুই দেখোস না, তুই ওর মা। সারাদিন বাড়ী বসি কি করিস ? আমি সবার সামনে মুখ দেখাবো কি করে ?
-তুমি বলছো কি ? আমার মেয়ে পোয়াতি ? আরে না না, এ হতেই পারে না।
-কোন শালার পো আমার মায়েডার সর্বনাশ করলো গো ? আমি এখন কোথায় যাবো গো ?
ফজর আলী কাঁদতে কাঁদতে প্রলাপ বকতে শুরু করলো, বলছে- আমি আর এ জীবন রাখবো না, কখনো কখনো বলছে গলায় দড়ি দেবে। কখনো কখনো বলছে- আল্লা আমার মরন দাও।
জমিলা বেগম রেশমার কাছে যেয়ে বলছে- কেন এমন কাজ করলি মুখপুড়ি ? একটুও মান সন্মান নেই তোর ? গলায় দড়ি দিয়ে মরলি না কেন ?
রেশমা কোন কথাই বলছে না, শুধুই কাঁদছে। লজ্জায় অপমানে নিজেকে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কি করবে এখন রেশমা-----
রেশমার মা বলছে- কি রে, কথা বলতিছিস না কেন ? না-কি তোর জন্য আমরা সবাই গলায় দড়ি দেব, নাকি বিষ খেয়ে মরবো ?
রেশমা তবুও নি:শ্চুপ।
পরদিন খুব সকালে ফজর আলী ও রেশমার মা দুজনে মিলে মাতব্বর বাড়ীতে গেল। রেশমার সমস্ত কথা খুলে বললো। কিন্তু , তাতে কি হবে ? চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। মাতব্বর তো কোন কথাই শুনলোই না, বরং উল্টো ফজর আলীর মেয়ের দোষ দিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দিল। মাতব্বর আরও শাসিয়ে দিল যে- ফের যদি আমার হিরের টুকরো ছেলে সর্ম্পকে বাজে কোন কথা বলেছো, তবে ফজর আলীর শুধু ভিটেছাড়াই নয়, এ গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেবে। হায়রে নিষ্ঠুর নিয়তি ? কি হতে কি হয়ে গেল। ফজর আলী কোথায় যাবে, কার কাছে জানাবে এ দু:খের কথা। আল্লা যেন এর বিচার করে এ কথা বলতে বলতে ফজর আলী মাতব্বরের বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল।
এরপর ফজর আলী এলাকার মেম্বর চেয়ারম্যানের কাছে গেল। সারাটা দিন বসে থেকে শেষমেষ চেয়ারম্যানের কাছে সব কিছু খুলে বললো। চেয়ারম্যান সবকিছু শুনে বুঝে ফজর আলীকে কিছুটা সঠিক বিচারের আশ্বাস দিল বটে কিন্তু তাতে ফজর আলীর মনে সায় দিচ্ছে না। অত:পর পড়ন্ত বেলায় হাটতে হাটতে বাড়ীতে আসলো।
রেশমা সারাটা দিন ঘরে বসে বসে চিন্তা করছে- কি করবে এখন, গ্রামের মানুষের সামনে এ মুখ দেখাবে কি করে ? না-কি সে আত্মহত্যা করবে ? কিন্তু যে আসছে- তার তো কোন দোষ নেই ? মাতব্বরের পোলা তো কোরান শরীফ ছুয়ে আল্লাহ কে স্বাক্ষী রেখে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা হলে কি সব তার অভিনয় ? লাল কাপড়ে মোড়ানো ঐ বইটা কি কোরান শরীফের বদলে অন্য কোন বই ছিল ? এমন অনেক ধরনের প্রশ্ন রেশমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে । তার আব্বা আম্মা সমাজে মুখ দেখাবে কি করে ?
লোকমুখে শুনেছে আত্মহত্যা নাকি মহা গুনাহর কাজ। রেশমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বাড়ী থেকে অজানার উদ্দ্যেশে বের হয়ে গেল।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
হুসাইন দিলাওয়ার ১৮/১০/২০১৮সুন্দর