www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আত্না

ড্রাইভারটা বেশ মোটা । সামনের লম্বা সিটটা একাই দখল করে নিয়েছে । নিয়মানুসারে আমার বাম পা টা বারবার বাইরের দিকে হেলে পড়ছে । কিছুক্ষণ পর সি এন জিটা জ্যামে পড়ল । আমার দিকে লাল চোখ করে ড্রাইভার বলল , '' ভাই পা ভিতরে ঢুকান । ছাল উঠে যেতে পারে । ''
কিছুক্ষণ পর আবার আমার দিকে চাইল । '' ভাই আপনারে কইতেছিনা পা ভিতরে ঢুকান । '' আমি বললাম , '' আপনি গাড়ি থামান । গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে সরুন । তারপর পা ঢুকাতে পারব । আপনার কলাগাছের মতো পায়ের সাথে টেক্কা দিয়ে আমি পা ঢুকাতে পারবনা । আর আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি আমি যতবার পা ঢুকাতে চেষ্টা করলাম দেখলাম আপনার পা আমার দিকে শক্তি প্রয়োগ করছে । শক্ত করে আপনি চেপে বসেছেন । ব্যাপার কি বলুন তো ? আপনার মুখে এক কথা আর পা আরেক কথা বলে কেন । ''
লোকটা লজ্জা পেয়ে যায় । ভাই সরি , মানে দুককিত । আমি কাইল থেইক্যা সামনে প্যাসেনজার নিমুনা । আপনে এখন একটু পেছনে চলে যান । ''
'' আমি কেন পেছনে যাব ? পেছনের ওরা কৈ ? ''
ড্রাইভার বলল , '' আজ্ঞে ওরা শেষ ''
'' ওরা শেষ মানে ! ''
'' শেষ মানে শেষ । ওরা কেটে পড়েছে । ওরা খারাপ কিছু জিনিস লইয়া আইছিল । মদ টাইপের কিছু । এখানে নেমে পড়েছে । ''
আমি জিজ্ঞেস করলাম , ' চিনেন নাকি ওদের ? ''
'' না , ওরা কইছিল , চাচা সামনে যামু । মুখটা চুরের মতো লাগছিল । বুঝলাম মতলব ভালা না । ভালো ভাড়াই দিসে । তা আপনি কই যাবেন ?
'' না আমি তো পুলিশ লাইন রোডে যাইতে চাইছিলাম । ''
ড্রাইভার বলল , '' আইচ্ছা উঠেন ''
গাড়ি চলছে । আমি বুঝতে পারছি আমার কপালটা ঘামছে । শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে ।
শহীদুল আমাকে ফোন দিয়েছে । আহসান ভাই নাকি আবার জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছে । পুলিশ লাইন রোডে একটা ছোট্র বাসায় বাবা-মাকে নিয়ে শহীদুল থাকে । একটা ছোট্র ব্যাংকে চাকরি করে শহীদুল । আমি তার বন্ধু । আহসান নামের ভদ্রলোক হচ্ছেন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা । তিনি শহীদুলকে সন্দেহ করেন একটা বিষয় নিয়ে । সেটি হচ্ছে কয়েকদিন আগে শহীদুলের বাসার বাথরুমে একটা অপরিচিত লাশ পাওয়া যায় । তবে লাশের শরীরে কোনো কাটাকাটি নেই বা গলায় ফাঁসির চিহ্ন নেই । এমনিতেই পাওয়া গেল । আহসান সাহেবের সাথে শহীদুলের ভালো সম্পর্ক ।
শহীদুল কসম খেয়ে বলল , '' ভাই আমি খুনটা করি নাই ।''
আহসান সাহেব চশমাটা আরো একটু ঘেঁটে বললেন , '' তাহলে লাশটা আসল কোথা থেকে ? ''
'' আমি জানি না ভাই ''
'' তুমি জাননা মানে ''
'' ভাই সকালে উঠে দেখি বাথরুমের সামনে লাশটা পড়ে আছে । বাবা মা কেউ কিছু বলছেনা । একে আমরা চিনিনা । কেমন বখাটের মতো দেখতে ছিল । ''
আহসান ভাই বললেন ,'' আচ্ছা বখাটের লাশ এখানে আসল কি করে ! ''
শহীদুল বলল , '' মনে হয় কেউ ফেলে গিয়েছে । ''
'' তোমার বাসায় কে লাশ ফেলতে পারে ? ''
'' সেটাই তো ভাবছি ভাই । ''
আহসান ভাই বললেন , '' আচ্ছা তাহলে এক কাজ কর । তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি খুন কর নাই । আমি গোপনে ময়নাতদন্ত করব । যদি ফলাফল ভালো আসে তবে বাঁচতে পারবে । নইলে শেষ । পরে লাশটা নদীতে ফেলে দিতে হবে , বুঝছ ? ''
'' হ্যা ''
আহসান ভাই ময়নাতদন্ত করে কিছুর চিহ্নই পান নাই । কিন্তু তিনি খুনের সমাধান না করা পর্যন্ত হালছাড়ার পাত্র নন । তাই কয়েকদিন পরপর শহীদুলকে বলেন , '' শহীদুল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা । দেখো তুমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । যা ঘটেছে সত্যি করে বলো । ''
শহীদুল বলে , '' খোদার কসম , ভাই আমি কিছু করি নাই । ওকে চিনিনা জানিনা কেন খুন করতে যাব ! ''
'' তোমার বাবা-মা কিছু বলেননি ? ''
'' তারা তো ভয়ে যার যার বাপের বাড়ি পালিয়েছে । তারা কিছুই করেননি । ''
'' হুম , বুঝতে পারছি । ''
তাই আমি গেলাম শহীদুলের কাছে । আহসান ভাই ওখানে ছিলেন । বসে বসে হুঁকা টানছেন । আমি গিয়ে বসলাম ।
আহসান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম '' ভাই কেমন আছেন । ''
'' ভালো আছি মোটামুটি ''
আমি বললাম , ' আচ্ছা সরাসরি খুনের ঘটনায় যাই । আপনি ওর ডি এন এ টেস্ট করে ওর নাম জেনেছেন ? '
'' হ্যাঁ , জেনেছি । ওর নাম রহিম মিয়া । আর কিছু জানতে পারিনি । বাকি তোমার শহীদুল জানতে পারে । ''
'' আপনি থানায় ফোন করেন । ওর সম্পর্কে কোনো কেসটেস আছে কিনা খোঁজ নিন । ''
আহসান ভাই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে লাগলেন । শান্তিনগরে ডাকাতির ঘটনায় রহিম মিয়া নামের একজন ধরা খেয়েছিলো । আর চেহারার সাথে মিলও আছে ।
আমি বললাম , '' আমার মনে হয় কি জানেন , এই ব্যাটা সেই ডাকাত । শহীদুলের ঘরে ডাকাতি করার জন্য এসেছিলো । তার আজরাঈল ওই সময়ের জন্য নির্ধারণ করা ছিলেন । ডাকাতি করার সময় স্বাভাবিক নিয়মে তার মৃত্যু হয় । মরার আগে মনে হয় পানি খেতে চাইছিলো । তাই বাথরুমের দিকে যাইতেছিলো । আজরাঈল তারে সেই সুযোগ দেন নাই । সেখানেই মরে যায় । তাই ময়নাতদন্ত করে এই অদ্ভুত মরণের কোনো কুল কিনারা পাওয়া যায়নি । ''
আচ্ছা আহসান ভাই , এই রহিম মিয়াকে নিয়ে আমি একটা ঘটনা বলি :
আমার এক চাচার নাম ছিল রহিম মিয়া । বাবার সাথে রাতে প্রচুর তাস খেলতেন । তাও আবার জুয়া ।
একদিন রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায় । চোখে দেখতে পাচ্ছিনা । চশমাটা পরে আরও ঝাপসা লাগছে । তবু সামনে এক ছিঁচকে চুরকে দেখতে পাচ্ছি । আমি তো আর হাজী মহসিন না যে তাঁকে বলব , '' এই নাও কিছু টাকা । আর চুরি করোনা । '' বর্তমান যুগে চোরদের টাকা দিলে পরেরদিন আবার আসবে ।
যদি জিজ্ঞেস কর , '' কি , আবার আসলে কেন ?
বলবে , '' আজ্ঞে মনে শান্তি নাই । আমি কোনো বাড়ি পুরো সাফ না করে স্বস্তি পাইনা । তাই আবার এলাম । গা চুলকানো শুরু হয়ে গিয়েছিলো । ''
আমি উঠেই লাইটটা জ্বাললাম । সারাঘর আলোকিত হয়ে উঠল । উঠে গিয়ে চোরটাকে ঝাপটে ধরলাম । গলা চেপে ধরি । মুখ ঘুরাতেই দেখি আমাদের রহিম চাচা ।
'' চাচা আপনি এখানে কি করছেন ! ''
'' আর বলিসনা , তোর বাবার সাথে তাস খেলতে খেলতে অনেক রাত হয়ে গেছে । তোর বাবা পিশাব করতে গেছে । বলেছে এখানে বসে থাকতে । ''
'' চাচা অন্ধকারে বসে তাস খেলছেন কিভাবে ? ''
'' আর বলিসনা তোর আম্মার ঘর থেকে তাড়া খেয়ে এখানে ঢুকেছি । '
'' চাচা আমার বাবা তো নেই ।
চোখ বিস্ফোরিত হয় চাচার । আমি বললাম , '' চাচা দুই বছর আগে তো আমার বাবা মারা গেল । তুমি এখানে কি করছো বলোতো । ''
চাচা হতভম্ভ হয়ে যান । আগে যেরকম বাবার সাথে তাস খেলত সেই জের ধরে বেঁচে যেতে চাইছিলো ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহিম চাচা বললেন , '' আসলে আমি চুরি করতেই এসেছিলাম ।
আমি অবাক হয়ে বলি , '' চাচা আপনি চুরি করতে এসেছেন মানে ! ''
'' হ্যাঁ ! তোদের ঘরে চুরি করতে এসেছিলাম । ''
'' কেন ? ''
'' খুব অভাবরে বাপ । ঘরে ভাত নাই । তোদের ঘরে চুরি করলে তোরা সন্দেহ করতিনা । তাই চুরি করতে এলাম । তোদের ঘরে তো তোর বাবা থাকতে আসা যাওয়া ছিল । সব চেনা ছিল । তাই তোদের ঘরেই চুরি করতে এলাম । অন্যের ঘরের কিছুই চিনিনা । গেলে হয়তো পিটুনী খেতাম । ''
আমি বললাম , আপনার ছেলেরা কোটি টাকার মালিক । আর আপনি কিনা চুরি করতে এসেছেন ! ''
'' নারে , ওরা কিছুই দেয়না । নিজেরা নিজের মতো চলে । বিড়ি-চা খাওয়ার পয়সাও দেয়না । এই বৃদ্ধবয়সে অবসরটা বিড়ি না ছাড়া চলেনা । ওদের আমি মানুষ করলাম আর ওরা আমাকে এখন খেতে দেয়না । ''
আমি জিজ্ঞেস করলাম , আপনি এখন কি করবেন ভাবছেন ।
চাচা বললেন , কিছুই না । কিছু মুরুব্বি ওদেরকে বলেছিল তবু কাজ হয়নি ।
আমি বললাম , '' আপনারা আমার সাথে থাকবেন । আমরা যা খাব আপনারাও তা খাবেন । ''
পরদিন তারা আমাদের ঘরে এসে উঠলেন । আমি তদের নিয়মিত খাওয়াচ্ছি , পরাচ্ছি । কোনো ভালো জিনিস হয়তো এনেছি সবাই মিলে মজা করে খাচ্ছি । এভাবেই চলতে থাকে । চাচার ধনবান পুত্ররা কোনো খোঁজখবর নেয় না । চাচা-চাচী দুজনেই আমাদের ঘরে উঠেছেন । আমি তাদের সম্পত্তির বা টাকা পয়সা পাওয়ার লোভে তাদেরকে খাওয়াই না । আমি দয়ার পদে প্রার্থী । আমি দেখেছি তিনি যতবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন ততদিন আমি জিতেছি । ততদিন আমার দিন ভালো কেটেছে । তিনি চাচীকে নিয়ে আলাদা ঘরে থাকতেন । আমার মা তাদের বিষয়ে কোনোদিন কিছু বলেননি । তাদের দুজনের দোয়ায় আমি এই উন্নতি লাভ করেছি ।
অবশেষে একদিন রহিম চাচা নিজেই আমার হাতে খুন হন ।
আহসান ভাই আর শহীদুল হতচকিত হন । বলেন , '' কিভাবে ? ''
আমি দেখলাম উনার ছেলেরা উনাকে টাকা খাইয়ে বাজারে সমাবেশ বসিয়েছে । সারা বাজারে আমার গলায় ফাঁসির চিহ্ন দিয়ে লেখা '' ফাঁসি চাই '' আমাকে সভায় ডাকা হলো । রহিম চাচা বললেন , আমি নাকি আমার বাবাকে খুন করেছি । আমার বাবা উনার সাথে জুয়া খেলে সব জমি খুইয়ে দিয়েছে । দখলদার হয়েছেন তিনি । তাই আমার বাবার নষ্টামি আর নির্বুদ্ধিতার কারণে আমি নাকি তাঁকে খুন করি ।
দ্বীতিয় পর্যায়ে রহিম মিয়ার কাছ থেকে জমি আদায়ের জন্য তাকে খাওয়াই । তাকেও খুন করার পরিকল্পনা করছিলাম । অথচ এসবের কোনোটাই সত্য নয় । বরং আমি জেনেছি , জুয়া বা তাস খেলে রহিম মিয়া সব হারিয়েছেন । আমার বাবা মালিক হয়েছেন । তার ছেলেরা এবং তিনি মিলে বুদ্ধি করেছেন । মুরব্বিরা রহিম মিয়ার ছেলেদের কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না । কারণ , তারাও এটা ভেবে নিয়েছেন যে যেহেতু আমি তাদের খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি সেহেতু এই উদ্দেশ্যেই হবে । তাছাড়া তার ছেলেরা জমিজমার জাল দলিল বানিয়ে মুরুব্বিদের সামনে পেশ করল । আমি বুঝতে পারলাম সবটাই একটা ষড়যন্ত্র । তারা প্লান করেছে কিভাবে জমি আদায় করা যায় । তাই উল্টো আমাকে ফাঁসিয়ে দিল যে তাদের কাছে জমি আর আমি সেটা নিতে চাইছি । ফলে আমি নাকি চাচা চাচীদের খাওয়াচ্ছি , তাদের খুন করার পরিকল্পনা করেছি ।
আর তারা আমাকে বলল আমি নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ । গভীর রাত পর্যন্ত ওদের মদ খাওয়া আর তাস খেলা দেখে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছিলো ।
রহিম চাচা হঠাৎ জোরে বলে উঠল , '' এই হারামজাদা কয়েকবার জোর করে আমার টিপসই নিতে চাইছিল । একটা হারামী আর বিশ্বাসঘাতক ও । ''
এইসব ছারখার ঘটনা শুনে গেল মাথা চড়ে । দিলাম বেটাকে ফাঁসিয়ে জন্মের মতো ।
আহসান ভাই বললেন , '' কবে ? ''
আমি বললাম , '' এই তো কয়দিন আগে । তবে এই রহিম সেই রহিম না । এটা কালো কুতকুতা আর ওইটা সুন্দর ছিল । ''
আহসান ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন , '' কেসটেস হয়েছে ? ''
আমি বললাম , '' ফাঁসি হয়ে গেছে ''
'' তাহলে তুই কে ! '' কিছুটা রাগী চোখে বললেন আহসান ভাই ।
'' আমি আর কেউ না , আমি একটা আত্না । ''
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৬৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৬/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • বাহ্ । ভালো লাগলো ।
  • sudipta chowdhury ২৮/১২/২০১৯
    Nothing to say...!!! Only one word comes that is "fear". In human life only soul is the main companion.
 
Quantcast