www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পামওয়েল এবং ইন্দোনেশিয়া

বর্তমান সময়টা বেশ খারাপ। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সারা পৃথিবীর দেশগুলো কিভাবে সামাল দিবে তা নিয়ে যখন সবাই উৎকণ্ঠায় তখন শুরু হল ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ । আমারা যদি অনেক কিছু বাদ দিয়ে শুধু খাদ্য ঘাটতির বিষয় নিয়ে বসি, তবে দেখা যাবে সামনে এমন একটা সময় যুদ্ধটা হচ্ছে যখন নতুন গম, সরিষা, আর সূর্যমুখী তেলের আবাদ শুরু করার সময়। আর পুরোদমে যুদ্ধ চলা দেশ দুটিতে এখন সবই বন্ধ। একা ইউক্রেনই যদি ইউরোপের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ করে খাদ্যের ঝুড়ি বা ব্রেড বাস্কেট নামে খ্যাত হয়, তবে রাশিয়ার অবদানও কম নয়। শস্য রোপনের সময় চলছে যুদ্ধ। পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর একটা ব্যবস্থা হয়তো হবে, কিন্তু পিছিয়ে থাকা এশিয়া-আফ্রিকা অথবা নর্থ আমেরিকা? এদের কি হবে। কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত হবে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। এটা শতভাগ সত্য।
নতুন সমস্যা ইন্দোনেশিয়ার হঠাৎ করে পামওয়েল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ‌। ২২ এপ্রিল ২০২২ ব্লুমবার্গ (Bloomberg)এর তথ্য মতে পৃথিবীর সবচাইতে বড় পামওয়েল রপ্তানিকারক দেশ, এই তেল আপাতত আর রপ্তানি করবে না। বেশ কয়েক সপ্তাহ জুড়েই এই আলোচনা ইন্দোনেশিয়া থেকে নানা রকম সংবাদ আসতে থাকে।
আর এতে নিজ দেশেই শুরু হয় ভোজ্য তেলের সংকট। তেলের উচ্চ দাম এবং বাজারের স্বল্পতা খোদ জাকার্তা জুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। এর কারণটা কি? মোটাদাগে যদি দুই তিনটা কারণ দেখি তবে বাজারেএ পণ্য ঘাটতির মূল কারণ সরবরাহের জটিলতা, প্রকৃতিগত অথবা মানব সৃষ্ট। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মানব সৃষ্ট। যার কারণে মার্কেট শেয়ার অর্থাৎ ৮০% সূর্যমুখী তেল যা এই দুই দেশ থেকে আসতো তা বন্ধের পথে।
উল্লেখ্য শুধু ইন্দোনেশিয়া আর মালায়েশিয়া মিলে পামওয়েল এর মার্কেট প্রায় ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বা বাজারে আধিপত্য রাখছে। শুধু ইন্দোনেশিয়া ২৯ মেট্রিক টন এবং মালয়েশিয়া ১৬.২২ মেট্রিকটন রপ্তানির মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম এবং দ্বিতীয় উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক ।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাপের কারণে ইন্দোনেশিয়ার সরকার রপ্তানি স্বল্প পরিসরে চালু রাখার সিদ্ধান্ত চিন্তাভাবনা করছে কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হবে উচ্চ শুল্ক যেমন ১৭৫ থেকে ৩৭৫ মার্কিন ডলার প্রতি টন।

সরকারি সিদ্ধান্ত মতে এই পামওয়েল ভোজ্য তেল হিসেবে ব্যবহার না করে বায়ো ডিজেল প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা হবে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবে পামওয়েল মার্কেট অস্থিতিশীল, কালোবাজারি এবং সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজদের খেলাধুলা শুরু হয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ার সরকার নিজেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কয়েকদিন আগে অবৈধ মজুদকারীদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের আন্দোলনের চাপে উচ্চ ক্ষমতাধর সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন, সঙ্গে বড় মাপের ট্রেডার কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে পরিস্থিতি কিছুটা সামলে আনে। এবং নিজের মার্কেট কে স্থিতিশীল রাখতে এবং কালোবাজারি বন্ধ করতে সরকারের শক্ত পদক্ষেপের পাশাপাশি আরো জোরালো ভাবে ঘোষনা দেওয়া হয়।সব ধরনের পামওয়েল আগামী ২৮ শে এপ্রিল ২০২২ এর মধ্যে রপ্তানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর মধ্যে ভোজ্য তেল তার বিভিন্ন উপাদান। নিজ দেশের প্রয়োজনে উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জেকো ইউডোডো (Joko Widodo) গত শুক্রবার নিজেই প্রজ্ঞাপনটি বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেন, একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। উনি আরও বলেন তার নিজ দেশে ভোজ্য তেলের মূল্য এবং সরবরাহ যেন ঠিক থাকে তা কঠোরভাবে তিনি নিজে স্বয়ং এটাকে পর্যবেক্ষণে রাখবেন।
কিন্তু অন্যান্য দেশ কি করবে? বিশেষ করে বাংলাদেশে পামওয়েলের উপর নির্ভরশীল। যখন পামওয়েল স্বাভাবিকভাবে বাজারে থাকবেনা অন্যান্য ভোজ্য তেল কি হবে। স্বাভাবিক ভাবেই তার মূল্য আকাশ ছুতে চাইবে। সূর্যমুখীর বড় উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া আর ইউক্রেন এ বছর উৎপাদনে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাহলে এটারও বড় ঘাটতি থাকবে।
সয়াবিন তেলের বাজার গরম হওয়া শুরু হয়ে গেছে এ সপ্তাহ থেকেই। প্রতি ঘন্টায় বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। শুধু শিকাগোতেই হাইক দেখা গেছে একদিনে ৩.৫ শতাংশ ।

অন্যদিকে উত্তর আমেরিকার বড় সয়াবিন প্রস্তুতকারক দেশ গুলোতে সাম্প্রতিক শুরু হয়েছে তীব্র খরা, যার কারণে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ২০২১ - ২০২২ এ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে প্রায় ৯.৪ শতাংশ। গত ছয় বৎসরের মধ্যে সর্বোনিম্ন।
রাশিয়া ইউক্রেনের সূর্যমুখী তেলের স্বল্পতা আর উত্তর আমেরিকার সয়াবিন স্বল্পতার পুরো চাপ এসে পড়ে এই পামওয়েলের এর উপর । তার ওপর অপরিশোধিত খনিজ তেল অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ইন্দোনেশিয়ার সরকার পামওয়েল কে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে যে মার্কিন ডলারের বৈদেশিক রিজার্ভ কে কন্ট্রোলে রাখতে এই বায়ো ডিজেল প্রকল্পের পরিকল্পনা। অর্থাৎ অল্প টাকার পামওয়েল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সঙ্গে সংমিশ্রণ করলে তেল আমদানি কম করতে হবে, বায়ুদূষণও কম হবে। ২০২০ থেকে ইন্দোনেশিয়ান সরকার ৩০% পামওয়েল, ডিজেলের সঙ্গে মিশ্রন করা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য বর্তমান অপরিশোধিত তেল প্রতি ব্যারেল ১০০ মার্কিন ডলার। ভবিষ্যতে এই মিশ্রণের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে, যা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।

চায়না, ব্রাজিল বড় সোয়াবিন উৎপাদক দেশ হলেও তারা পামওয়েল আর সূর্যমুখী তেল এর বর্তমান প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক মুনাফার দিকে ঝুঁকবে যেটা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এর নীতিমালা কতটুক আটকে রাখতে পারবে এই ইনফ্লুয়েন্সকে তার ধারণা করা মুশকিল। বর্তমানে চায়না পৃথিবীর ২৭ শতাংশ, আমেরিকা ১৯ আর্জেন্টিনা ১৫ ব্রাজিল ১৫ সমস্ত ইউরোপ মিলে মাত্র ৫ শতাংশ গ্লোবাল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। এবছর জলবায়ু পরিবর্তনে সয়াবিন উৎপাদনেও ঘাটতি তো আছেই উত্তর আমেরিকার উৎপাদকদের কাছ থেকে।
অন্যান্য বিজ থেকে উৎপাদিত তেল এ প্রসঙ্গে নাই আনলাম কারন বাদাম, সরিষা এবং অলিভ অয়েল আমাদের ভোজ্য তেলের খুবই কম অংশে প্রভাব ফেলে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে প্রভাব ফেলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত জনসংখ্যার উপর। ২০১৯- ২০ অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে আমদানি ভোজ্যতেলের প্রায় ২৮ লক্ষ টন , যার বাজারমূল্য ২.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত পাঁচ বছরে ২০ % এর বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে পামওয়েল শুধু ভোজ্যতেল বা রান্নার তেল হিসেবে ব্যবহার হয়না, এটা বিভিন্ন রকম প্রসাধনী সামগ্রী, সাবান, খাদ্যদ্রব্য যেমন চকলেট, আইসক্রিম এসব নানা পণ্যেও ব্যবহার হয় যার ফলে এই সব শিল্পও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এখনি এর জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে একটি সক্ষম সমাধান বের করে আনতে হবে, অথবা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অধিক মূল্য আমদানি ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এ চাপ পরতে পারে।

কে. এন. এন. লিংকু
লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৩৬৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/০৪/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast