www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

Bikikini

বিকিকিনি

গড়িয়াহাটে বাজার করার মত মজাদার ব্যপার আর কিছু হতেই পারেনা। কি নেই সে বাজারে, আন্তরিকতা, কৌতুক, সহানুভূতি এবং কিঞ্চিৎ রোমাঞ্চও। বিবাহিতা অল্প বয়সী মহিলাদের দেখলেই বিক্রেতাদের মধুর সম্ভাষণ, "বৌদি, নিয়ে যান না, আরে দাম দেখতে লাগবে না, জলের দর, আপনাকে কি আমি ঠকাবো নাকি? নিয়ে যান , দাদা কিছু বলবেন না"! বৌদি ও লাজুক মুখে এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে দু একটা কিছু কিনে ফ্যালেন। মেন রাস্তার দুপাশে যে sidewalk সেখানেই দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেন। হাঁটাচলা করতে খুবই অসুবিধা হয়, কয়েকবার এদের উচ্ছেদ করার এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও হয়েছিল , কিন্তু মনে হয় ক্রেতারাই এই রাস্তার দু ধারে কেনা বেচা করতে বেশী পছন্দ করেন, আর সেই ক্রেতার সিংহভাগই কিন্তু বিভিন্ন বয়সী মহিলা। বাসন্তী দেবী কলেজ থেকে টুক করে বেরিয়ে একটু ফুচকা খেয়ে নিয়েই ছাত্রীদের এক চক্কর ঘুরে নেওয়া, latest fashion এর দু একটা কুর্তি ও কেনা হয়ে যায়।

এই সমস্ত দিদি ও বৌদিমহল দরদাম করাটাকে মোটামুটি শিল্পের পর্য্যায়ে নিয়ে গেছেন।
"Maxi টা কত দাম? "
"দিন না ১১০ টাকা"
"কি?? অসম্ভব। ৭০ টাকায় হবে তো বলুন, নইলে রাখুন", বৌদি অগ্রসর হওয়ার উপক্রম করেন, রং টা যদিও বেশ ভালই মনে ধরেছিল, ইস, এখন যদি দোকানদার রেগে যায়! কিন্তু নাহ, রাগে নি, অবধারিত ভাবে পেছন থেকে মোলায়েম সুরে আহ্বান, "রাগ করেন কেন, ছোটো ভাই এর ওপর কি রাগ করে নাকি? ও বৌদি, শোনেন না, চলে গেলেই হোলো? আচ্ছা আপনার কথাও রইল আমার কথাও রইলো , ওই ৯০ করে দিন, এ জিনিস সারা গড়িয়াহাট চত্বরে পাবেন না এই বলে দিলাম... আমার বলে এখনো বউনি হয়নি"! বলাই বাহুল্য শেষমেষ ৮৫ তে রফা হয়, এবং কার লাভ বা কার ক্ষতি হয় বোঝা অসম্ভব। কিন্তু দুজনেই খুশী হয়। মনে হয় এই দরাদরি করার অমোঘ আকর্ষণই এই বাজারটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, মলগুলোতে তো আর সে সুযোগ নেই। আর যাকে বলে এরকম "পার্সোনাল টাচ" ও বিরল। আজকাল তো কলকাতায় বাংলা ও শোনা যায়না!

বালিগঞ্জ এ যে ওয়েস্ট সাইড বলে দোকান টা আছে সেখানে তো সব অবাঙালী কর্মচারী, কিছু কিনলে কি না কিনলে কারোর মাথা ব্যাথা নেই, ব্যবহার ও তেমন মধুর নয়, মুখের ভাব অতিরিক্ত শীতল, আর অদ্ভূত ব্যাপার হলো বাংলায় প্রশ্ন করলেও তারা হয় একটা কিরকম খিচুড়ি ইংরিজিতে অথবা হিন্দীতে উত্তর দেয়। মুখের ভাবভঙ্গী যেন বাংলা ভাষা অচ্ছুৎ কন্যা! এক গল্প বিগ বাজারেও, কর্মীরা সব অল্প বয়সী ছেলেপুলে, অবাঙালী বেশী, হয় সেলফোন এ প্রেম করছে নয় এক জায়গায় জড়ো হয়ে গুলতানি মারছে। "ক্রেতা যায় ভাড় মে"! আর এক যন্ত্রণা হলো এই দোকান গুলোর কাছে ক্রেতার সেলফোন নম্বর থাকতেই হবে, নইলে কিছু কেনা প্রায় শিবের অসাধ্য কাজ। আরে মশাই ফ্রী কিছু চাইনা, ডিসকাউন্ট ও না, শুধু আজ এইটা কিনবো, সে টি হবার জো নেই, সেলফোন নম্বর দিতেই হবে।

বেঁচে থাক গড়িয়াহাট, কোনো চাপ নেই, শুধু দরাদরি টা একটু জানলেই হলো। কিন্তু তারই বা খুব দরকার কি? কিই বা এমন বেশী চায়? আর ফ্রী তে কেমন মনোরঞ্জনও হয় ....যেমন ব্লাউজের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শোনা যাবে, "কে বলল আপনার সাইজ ৩৬? বল্লেই হলো? এত বছর আমি বেলাউজ বিককিরি করছি, আমি বলছি, নিয়ে যান ৩৪, আলবাত হবে, না হলে পয়সা ফেরত"! বৌদি চমৎকৃত, একে তো এক সাইজ কমিয়ে একটু স্লিম করে দিল, তারপর যখন এতটাই নিশ্চিত যে টাকা ফেরত দেবে, চলো নিয়েই নি! নকল গয়নার দোকানদার বলছে, "এইতো আয়নাতে দেখুন দিকি কেমন সুন্দর এই দুলের ডিজাইনটা মানিয়েছে আপনাকে, দাদা খুব খুশী হয়ে যাবেন"। নির্ভেজাল বাঙলা বোধহয় আজকাল শুধু এই বাজারেই শুনতে পাওয়া যায়। বিক্রেতাদের কৌতুক প্রবণতা যেন সাড়ে চুয়াত্তর সিনেমা কে চোখের সামনে এনে দেয়, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও মুখে এক চিলতে মুচকি হাসি এসে যায় এদের রসিকতায়।

এই হাঁটাহাঁটির পর পেটে কিছু দিতেই হয়, বেদুঈনের রোল আছে, আসেপাশে অন্যান্য স্ন্যাকস এর দোকানও আছে, আছে মিষ্টি দই, দোসা, চপ কাটলেট, কাঠি আইসক্রিম, আদ্যিকালের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট হাটারি‌ এবং আরো অন্যান্য মুখরোচক খাবার দাবারের দোকান ! ছোটো ছোটো খুচরো বিক্রেতার পাশাপাশি বিদ্যমান বড় বড় প্রাচীন ও অভিজাত দোকান , তাদের মহার্ঘ্য পসরা গুলোতেও এক ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায় যাকে বলে "উইন্ডো শপিং"! এখানে কেনা কাটা না করে যদি আধ ঘণ্টা খানেক হেঁটেও আসা যায় তাহলে সেটাও কোনো টিভি সিরিয়াল এর চাইতে কম মনোরঞ্জক হবেনা, আজকাল আবার বাঙলা সিরিয়ালের যা দুর্দিন!

একটু ঘুরলেই নকল চুল, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, টুলে উবু হয়ে বসে মেহেন্দীর দক্ষ কারিগর,বিভিন্ন সাইজ ও রঙের টিপের পাতা, পেটিকোটের বা পাজামার দড়ি, ঘর সাজাবার খুঁটিনাটি, জুঁই এর মালা এবং ফুচকা ও ঝালমুড়ির সুগন্ধ , নতুন মুভির নকল DVD, হস্ত শিল্প, সব মিলবে এর অলিতে গলিতে!
মহানগরীর ঝাঁ চকচকে জীবনযাত্রার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে পুরো মাত্রায় বাঙালী এক মধ্যবিত্ত বাজার, যেটা আসলে অনেকেরই মুশকিল আসান আর একান্ত আপন।

কল্যাণী ঘোষ
30th December, 2019

#ourgariahat
#bikikini
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩০৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/০৫/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast