www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

যখন বসন্ত এলো (অনুবাদ)

-তুমি কখন ফিরে আসছো?
-আমি নিশ্চিত না, কেন?
-তুমি চলে যাবার পরে, আর সাধারণত ফিরে আস না। দয়া করে এবারও এটা করো না.
-আমি দঃখিত। অফিসে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে যে আমি শুধু শুধু এগুলো ছেড়ে চলে আসতে পারি না।
-বাড়ি থেকে দূরে পোস্টিং পেলেও প্রত্যেকে তোমার মতো আচরণ করে না। আমি এই বিচ্ছিন্ন বাড়িতে কেবল তিন সন্তানের সাথে একা থাকতে অস্বস্তি বোধ করি।
-আমি কি টয়ইমাকে তোমার প্রয়োজন দেখাশোনা করতে বলি না? সে বাচ্চাদের পড়াশোনা করায় ও মাঝে মাঝে সাহায্য করতে আসে, তাই না? তুমি কেন এত ভয় পাও?
আমি যখনই আমার বেতন পাই আমিওতো আসি। সে কিছুটা আওয়াজ তুলল।

আমি জানতাম যদি আমি চালিয়ে যাই তবে সে আমাকে আরো আঘাত দেবে। তাই আমি কিছুই বললাম না। আমি যদিও দু:খিত ছিলাম। আমার বলার মতো আরও অনেক কিছু ছিল তবে তিনি আমার কথায় কখনও মনোযোগ দেন নি, তাই চেষ্টা করারও কোন মানে ছিল না। যখন সে চলে যাচ্ছিল তখন আমি লড়াই শুরু করতে চাইনি। সে গত মাসে সামান্য যে কিছু অর্থ দিয়েছিল তা দিয়ে কেউ কত দিনই বা চালাতে পারে? খাবার বাদেওতো সংসারে আরো অনেক খরচ আছে! আমি কি আমার বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবছিলাম না? এমনকি আমি যদি দাসও হয়ে যাই, তবেও আমি চাইতাম আমার বাচ্চারা সফল হোক।
যদিও আমি তখন বয়সে কম ছিলাম, তবুও আমি কিছু আয় করতে আমার রান্নাঘরের ক্ষেত থেকে বাজারে সবজি বিক্রি করা শুরু করলাম। আমার বয়সি বন্ধুরা তখন জীবনকে উপভোগ করেছে। আমি লজ্জা বা ভয় উপেক্ষা করে কেবল মাত্র আমার বাচ্চাদের ভবিষৎ ভেবে সে কাজে লিপ্ত হলাম। আমার সাথি তখন শুধু মধ্যবয়সী রমনীরা যারা সবাই বাজারে সংগ্রাম করছিলাম। আমার বড় মেয়ে তার ছোট ভাই-বোনদের দেখতো যখন আমি বাজারে থাকতাম। কখনো বাড়ি ফিরে হয়তো দেখলাম টয়ইমা আমার বাচ্চাদের পড়াতে বসেছে। আমি যদি বাজার থেকে মাছ নিয়ে যেতাম তাকেও খাবার জন্য অনুরোধ করতাম। তার বাড়ি ছিল কাছেই, আর সে ছিল বাচ্চাদের বাবার আত্নিয়। আমি তাকে বড় ভাই হিসেবে দেখতাম, ডাকতাম দাদা বলে। আমি সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে সবজি ফলাতাম। বিকালে বাজারে যেতাম ওগুলো বিক্রি করতে। বাজারটি ছিল খুব ছোট, কেবল বিকালেই বসতো। আগে ভাগেই বাজারে পৌঁছতে হতো, না হলে সব সবজিগুলো বিক্রি করতে না পারলে আবার সেগুলো ফেরৎ নিয়ে আসতে হতো যা ছিল ঝামেলার। তাছাড়া আমাকে জলদি ফিরতে হতো কারন বাচ্চারা রয়েছে সব সময় দুঃচিন্তা থাকতো। বাবা থেকেও যেন তাদের বাবা নেই!
একদিন বাজারে আমার বয়সে বড় বাজারি বন্ধু ইছেছবি আমাকে বলল, কিছু মনো করো না, আমারতো মনে হচ্ছে টয়বা (আমার স্বামী) বিয়ে করে ফেলেছে। আমি শুনেছি তারা একমাস হয়ে গেল সংসার করছে। তুমি কি কিছু শোননি?
আমি কিছু বলি না। জানি আমার স্বামীর কিছুর সমস্যা আছে। সে কোথায় তার বেতনের টাকা খরচ করে। সে কেন বাড়িতে আসতে চায় না। আমি বুঝি সে বাড়িতে আসলে কেন আমার গায়ে হাত তোলে। তবে আমার বিশ্বাস আছে আমি ঠিক থাকলে সেও ঠিক হবে।
ইছেছবি আরো বলে, তার কাছে যাও, আর কিছু দিন থেকে এসো। মেয়েদের উচিত তাদের স্বামীদের আগলে রাখা। দরকার হলে বৈদ্য-ওঝার কাছে যাও, মন্ত্র-তাবিজ পরাও। এখানে সবজি বেচে কিছু হবে না তোমার। সেই বেহায়া মেয়েটার চুল ছিড়ে আসো !
পরে আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি যাবো সেখানে।
-কালকেই যাও। একটা দিনও নষ্ট হতে দিও না।
-আমি আবার বললাম, ঠিক আছে, আমি যাবো
-সে কি ভেবেছে, যা ইচ্ছে সে করতে পারে? তাকে তো একটা শিক্ষা পেতে হবে। সে রেগে বলে উঠল। পরে তার সবজির ঝুড়ি নিয়ে চলে গেল। আমি জানি সে আমাকে ভালোবাসে বলে এতসব বলল।
আমি আমার স্বামী টয়বার কাছে পরদির সকালেই চলে গেলাম। তখন সে বেহায়া মেয়েটি সেখানে ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারলাম যা রটেছে তার কিছুতো বটে! সে আমার উপর ক্রুদ্ধ হলো, রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমি একরাত সেখানে ছিলাম। পরে একজনকে দিয়ে খোঁজ নিলাম কোথায় গেছে সে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। আমি পরদির সকালে বাচ্চাদের কাছে ফিরে আসলাম।
আমি যখন বাড়িতে থাকি না তখন টয়ইমা আমার বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। সে আমাকে শক্ত থাকতে সাহস জোগায়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই লোকে কানাঘুষা শুরু করলো। আমার কানেও এলো যা আমরা মোটও ভালো লাগে নি। আরো বেশী খারাপ অবস্থা না হতে আমি তাকে একদিন বললাম, টায়ইমা, আপনার এখানে আসা লোকেরা ভালো চোখে দেখছে না। আপনার বৌও বিষয়গুলো ভালো বলবে না। আমি কারো সমস্যা হতো চাই না। সে কিছু বললো না কিন্তু বুঝতে পারলো আমি কি বলতে চেয়েছি। সে চলে গেল আর আমিও তাতে বাধা দিলাম না।

পরদিন থেকে অনেকদিন সে আর আসে না। একদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি রাতের খাবার তৈরীর কথা ভাবছিলাম। বাচ্চারা পড়াশুনা করছে। হঠাৎ তাকে দেখি বাড়িতে ধুকছে, বৃষ্টি ভেজা। আমি একটি গামছা এগিয়ে দিলাম। সে মুখ মুছে বলল, ইবেমনুংশী, আমি ভিজে যাচ্ছিলাম তাই শুধু একটু আশ্রয়ের জন্য এসেছি। বৃষ্টি থামলে বেরিয়ে যাবো।
আমি চুলায় আগুন ধরালাম। তাকে বললাম, একটু আগুনের কাছে বসো। কাপড়গুলো শুকিয়ে যাক। আমার মনে হলো তার মুখে মদের গন্ধ। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যেতে বলতে পারলাম না। সে বলল-
-টয়বা কি এ মাসে আসে নি?
-না, টয়ইমা।
-সে কি ওখানে অন্য মেয়ের সংসার করছে?
-আমি জানি না।
-এটা খুব খারাপ হচ্ছে, তোমার কি হবে, বাচ্চাদেরই বা কি হবে!?
-আমি মনে হয় খুব অভাগা। এমনি করেই বোধয় আমার জীবন কাটবে!
-তা বলো না। ভালো দিন আসবে কোন সময়।
-টয়ইমা, জানি না আগামিতে আমার কি হবে...
-হঠাৎ সে বলে, কিছু শুনতে পাচ্ছো? দূরের কিছু কোলাহল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই কোলাহলটা আমার বাড়ির দরজায় পৌঁছল। বাইরে থেকে কড়া নাড়ার আওয়াজ এল। সাথে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি, দরজা খোল! দরজা খোল!
আমি গিয়ে দরজা খুলতেই এক ঝাঁক ক্লাবের ছেলেপেলে বাড়িতে ধুকে পড়ল, সাথে গ্রামের এক মুরুব্বি। কয়েকজন ভেতরে ধুকে গেল, রান্নাঘরে টয়ইমাকে পেয়ে বলল, এই যে এখানে, এখানে চোর! আমরা ধরে ফেলেছি! মুরুব্বি বলল ছি! ছি! ছি! তুমি একটা বেহায়া মেয়ে, স্বামী না আসার সুযোগে নষ্টামী করছ ?!...ইত্যাদি। আমরা দু’জনেই বলার চেষ্টা করলাম, বৃষ্টি পড়ছিল তাই... কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাদের কেউ বলল, এদের মাথা মুড়িয়ে, মাথায় লেবু আর হলুদ মাখিয়ে দাও। কেউ বলে শুধু তা হবে না, এদের গ্রাম থেকে বের করে দাও। গ্রামটাকে গোল্লায় নিয়ে গেল এরা... আরো নানা অশ্রাব্য গালি। আমার বাচ্চারা আমাকে ঘিরে কান্নাকাটি করতে লাগল।

সে রাতে তারা আমাদের দুজনকে চোর ধরেছি, চোর ধরেছি চিৎকার করতে করতে গ্রামের প্রধানের বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে বিয়ের পুরুত ডেকে বিয়ের মতো ব্যবস্থা করল এবং সে রাতেই জোড় করে বিয়ে দেয়া হল আমাদের।
কী করবো ? কীই করার ছিল আমার? আমি তিন বাচ্চার মা আর একজনের বৌ, তাকে বিয়ে দেয়া হলো অন্য এক বিবাহিত পুরুষের সাথে !
সব কিছু মিটে যাবার পর, সে রাতে আমি ভাবলাম আমি কি এখন বাচ্চাদের কাছে ফিরে যাবো? নাকি গাছে উঠে গলায় ফাঁস দেব!? কি করবো এত বড় অপমান কি করে সইবো আমি? বাইরে রাস্তার পাশে বসে অনেকক্ষন ভাবলাম। পরে মনে হলো না, না আমি কেন আত্মঘাতী হবো? তা হলে তো তারা যা বলেছে সেটাই সত্যি হয়ে যাবে! না, না, আমাকে বাচ্চাদের কাছে ফিরে যেতে হবে। তারাই আমার ভরসা, ওদের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। তাদের বাবা গেছে, যাক! আমি মা তো তাদের জন্ম দিয়েছি।
বাড়িতে এসে দেখি ইছেছবি আমার বাচ্চাদের সাথে রয়েছে। সে আমার দিকে চোখ জ্বলজ্বল করে তাকালো যেন, আমিই দোষী। কিন্তু সেই সব জানে আমার কষ্ট, ‍আমার সংগ্রাম। আমি সহজে ভেঙে পরার মানুষ নই। কিন্তু সে রাতে সারারাত আমি চোখের জলে বুক ভাসালাম। এত বড় অপমানের পর আমি কীই বা করতে পারতাম!

পরদিন বিকালে তাদের বাবা আসলো ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে। সে আমার কোন কথা শুনতে চাইল না। আমার চুলের মুঠি ধরে সোজা কোন পশুর মত টেনে হিঁচড়েঁ বাড়ির বাইরে বের করে দিল। আমি ভাবলাম আমাকে সে মেরেই ফেলবে। কিন্তু না প্রাণে সে আমায় মারতে পারলো না।
আমি রাস্তায় বসে ভাবলাম যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব। কিন্তু বাড়ি মুখো আর হব না। বাচ্চারা তাদের বাবাকে পেয়েছে, এখন আমি নিশ্চিত। আমার ভগবান যেখানে নিয়ে যায় আমি সেদিকে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলাম। খারাপটা বাতাসের আগে যায়, এতক্ষনে বাবা-মার কাছে খবর পৌঁছে গেছে। তাদের আমি অপমান করতে পারবো না। কোন আত্নীয় আমাকে বাড়িতে তুলে অপমানিত হতে চাইবেন না। আমি দিকভ্রান্ত পথিকের মত হাঁটতে হাঁটতে পৌছলাম এক হোটেলে। হোটেল মালিককে বললাম কিছু দিনের মধ্যে তার বকেয়া আমি পরিশোধ করে দেব। সে যেন কয়েকটি দিন আমাকে থাকতে দেয়। দয়া করে সে থাকতে দিল। খাবার কেনার পয়সা নেই জল খেয়ে দুদিন কেটে গেল। পরিশেষে হোটল মালিক খাবারও দিলেন। আরো কিছু দিন কাটল।

একদিন রাতে আমার রুমে ঠক্ঠক্ আওয়াজ শুনলাম। মালিক এসেছে ভেবে দরজা খুলতেই দুজন আমার মুখ চাপা দিয়ে রুমে প্রবেশ করল। আমি কিছু বলতে পারলাম না। সে রাতে আমি আমার সম্মান হারালাম। তারা আমার মুখ বন্ধ করতে কিছু টাকা দিয়ে গেল।

ভাবলাম আর হারানোর কিই বা ছিল আমার। যা বাকি ছিল তাও গেল, আর তো কিছু বাকি নেই! যাক!...এমনি করে হোটল দেনা শোধ ও ব্যবসা করার কিছু পয়সা জমলে আমি একদিন প্লান মত হোটেল ছেড়ে পালিয়ে আসলাম।

অন্য আর একটি জায়গায় চলে গেলাম। আমি সেখানে রাস্তায় বসে হরেকরম মালের ব্যবসা শুরু করলাম। কিছু দিন পর হাতে পয়সা জমলে একটি দোকান ভাড়া নিলাম আর ব্যবসাটা একটু বড়ও হলো। কিন্তু আমি টাকা দিয়ে কি করবো? কার জন্য এসব করবো? এসব ভাবলেই আমার চোখের জলে বন্যা বয়ে যেত। মনের গভীর থেকে কেউ যেন নির্লিপ্তভাবে বলে উঠত, জীবন এমনই!

দেখতে দেখতে কেটে গেল দশটি বছর। সময়ের প্রবাহে আমার কালির কলঙ্ক মুছে গেল। লোকজন বুঝতে পারল কিভাবে সে আমাদের ফেলে চলে গিয়েছিল, আমি সবজি বেঁচে কিভাবে বাচ্চাদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছিলাম। আমার কানে আসতে লাগল তোমার স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরেছে। আমার বাচ্চারা কখনোই তাদের মাকে ভুলতে পারেনি। আমার ছেলে মেয়েদের কথা মনে পড়লে বুকের গভীরে মোচড় দিয়ে উঠে। আমি ভাবি আমি তাহলে কার জন্য রোজগার করব? কবে আমি বাড়িতে ফিরব সেই প্রশ্ন আসতে লাগল। কিন্তু আমি কেন নিজে থেকে ফিরব? আমিও তো মানুষ!
একদিন অনাকাঙ্খিতভাবে বসন্ত এলো। হঠাৎ আমি তার কন্ঠ দু-কানে শুনলাম, ইবেমনুংশী, চলো, আমি তোমাকে নিতে এসেছি!

[মূল লেখিকা: ক্ষেত্রিমাউম সুবদনী, ২০০০ সালে প্রথম মুনিপুরী ভাষায় ইমফলে প্রকাশিত হয়। ইংরেজীতে অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে Thingnam Anjulika Samom সম্পাদিত ইংরেজী বই Crafting the word এ।]
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪০৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast