www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মিষ্টিভরা সিকিম গ্যংটক (1)


সর্পিল রাস্তা বেয়ে উপরে উঠে ক্লিক

শিলিগুড়ি স্টেশনে ট্রেন পৌঁছুতে পৌঁছুতে সকাল সাড়ে ৮টা বেজে গেল। আসামের কোঁকড়াঝার থেকে রাত তিনটেই ট্রেনে উঠেছিলাম। ট্রেন ধরার টেনশনে বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি। বসে বসেই যা মৃদু তন্দ্রা বা ঘুমের মতো হয় তাই দিয়ে বাকি রাত পার হলো ট্রেনের সিটে দুলদে দুলতে। সাথে আছে আমার বন্ধু সানজিৎ আর তার ছোট বোন ঝিমলী। প্রথমে সানজিৎ আমি দুজনেই যাচ্ছিলাম শুধু। রাতেই জানা গেল ঝিমলীও যাচ্ছে, মায়ের অনুমতি মিলেছে। ঝিমলীর সাথে বাড়ি থেকে ট্রেন স্টেশনের মাঝ রাস্তায় টমটমে দেখা।
প্লাটফর্ম থেকে নেমে আসতেই অটো, টেম্পু, অটো রিকসা ড্রাইভারদের হাঁক ডাকে বিভ্রান্ত হলাম না। বন্ধুরা বলে আসুন টেম্পুতেই যাওয়া যাক। লাগেজ টানতে টানতে চললাম আরো একটু সামনে। একটি টেম্পু প্রায়ই ভরে এসেছে আমাদের দেখে যাই যাই করছে। উঠে পরলাম সবাই কোলে যার যার ব্যাগ নিয়ে। সদ্য জাগা শহরটা দেখতে দেখতে চললাম সিকিম গাড়ি স্টেশনের দিকে।
৯টা বাজার কিছু আগেই পৌছুলাম স্টেশন। দেখি পরিষ্কার পরিছন্ন এসি বাস দাড়িয়ে। কিন্তু টিকেট বিক্রি শেষ। পরবর্তী বাস ছাড়বে আরো দুঘন্টা পর। ভাবলাম দু ঘন্টা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সকালের ব্রেকফাস্ট করে নিলাম নেপালী মেয়েদের হোটেলে। ১০০ রুপিতেই হয়ে গেল তিনজনের ডিম-সবজি পরটা। লোকাল একটি সুমো মিলে গেল। মাথা প্রতি ৩৫০ রুপি ভাড়া। মোট দশজন যাত্রী। ওরা ভাইবোন বসল পেছনে । আমি সামনের বাঁ পাশে জানলার ধারে বসে গেলাম। সব যাত্রী সিটে বসে পড়তেই ড্রাইভার র্স্টাট দিল গাড়ির ইঞ্জিন।
শিলিগুড়ি পশ্চিম বাংলার ২য় বৃহত্তম শহর। গাড়ি চলছে ধীরে সুস্থে। বাইরে তাকিয়ে দেখি একটির পর একটি সামরিক বাহিনীর অফিস। আসলে শিলিগুড়ি ভৌগলিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই শহরের কাছেই চিকেন নেক বা মুরগীগলা কোরিডোর যা উত্তরপূর্ব ভারতেকে মূল ভারতের সাথে একত্র করেছে। চীন কিংবা অন্য কোন দেশে যদি ভারতকে আক্রমন করতে আসে তবে এই চিকেন নেক দখল করতে চাইবে অবশ্যই। তাই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এখানে সামরিক উপস্থিতি বেশী।
কিছুক্ষনের মধ্যে সুমো প্রবেশ করলো একটি বনের মাঝখান দিয়ে। ভাবলাম কোথা দিয়ে যাচ্ছি। গোগল ম্যাপ কিছুতেই ডাউনলোড হলো না। নেট এখানে খুব স্লো। পরে দেখলাম বনটি ছিল বেঙ্গল সাফারী। উচু উচু নাম না জানা নানা জাতের বয়স্ক গাছ। মাঝে মাঝে কিছু পর্যটক স্পটও দেখা গেল। বুঝলাম এখানেও কেউ বেড়াতে চাইলে বেড়ানো যাবে।
সুমোর গতি বেড়েছে, তীব্র গতিতে পৌঁছে গেলাম একটি নদীর পার। রেল লাইন পার হতে হল। নদীটি বড়, পাথুরে, আর গতিময় । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নীল জল তীব্র স্রোতে বয়ে চলেছে। নদীর উপর দিয়ে বয়ে চলেছে রেল সেতু। কোথায় গেছে জানা নেই। মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলাম কোন নদী গো? উত্তর আসল পেছন থেকে, তিস্তা। কি? তিস্তা। ও, তাহলে এই সেই তিস্তা, যার জন্য আমাদের বাংলাদেশীদের এত অপেক্ষা- প্রতিক্ষা। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঝুলে আছে এই নদীর জলে! মনে ভাসলো রংপুর বেড়ানোর স্মৃতি। নদীতে পানি নেই বলে যাওয়া হয়নি তিস্তা ব্যারেজ।

বয়ে চলেছে তিস্তা

তিস্তার পার ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে চলেছে সুমো, ছোট দুই লেনের রাস্তা ধরে। তবে যতই বাঁক থাকুক না কেন, গাড়ির কোন অভাব নেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্যামে আটকে গেলাম। একটি বড় গাড়ি ধীরে এগিয়ে আসছে। পেছন পেছন এগিয়ে আসছে আরো অনেক পরিবহন। আমরাও বাস, গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে শম্ভুক গতিতে এগিয়ে চললাম। ২-৩ ঘন্টা চলার পরও দেখি নদীর শেষ নেই। আমাদের পাশে পাশে সেও চলছে আমাদের সাথি হয়ে। এর মধ্যে পেরিয়ে এসেছি বেশ কয়েকটি বাঁধ। সেখানে জল জমে লেকের মতো হয়ে গেছে। বুঝলাম এই বাঁধগুলোর কারনেই শীত কালে নদীতে জল থাকে না। কিন্তু জলের কারনেই জায়গাটা আরো সুন্দর ফুটফুটে হয়ে উঠেছে।
উচু পাহাড়ের সারি, সবুজ বন-বনানী, বুনো ফুল, পাহাড়ের মানুষ, পাহাড়ে গায়ে লেপ্টে থাকা তাদের ঘর দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় ৪ ঘন্টার মতো। গ্যংটকের দেখা নেই! তবে পাহাড়ের উচ্চতা বাড়তে লাগল আরো। এমন উচু পাহাড়কেই বোধয় বলে পর্বত, গলা বাড়িয়ে দেখতে হয় চূড়া। আর কতদূর গ্যংকটক! সিকিমের কয়েকটি ছোট উপশহর ফেলে এলাম। তিস্তা ইতোমধ্যে কয়েকভাগে ভাগ হয়ে ছোট হয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর তিস্তা নদী ক্রস করা হলো। কিন্তু খেয়াল করলাম সুমো যে পর্বত উঠেই চলেছে আর নামছে নাতো। কেবল উঠেই চলেছে, রাস্তার একপাশ পাহাড়, অন্যপাশ গভীর খাদ দেখাও যায় না তার শেষ কোথায়। আস্তে আস্তে বাড়ি ঘর দোকান পাট বেড়ে যেতে লাগল আর বেশ সুন্দরও। পাহাড়ের গায়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দাড়িয়ে আছে সারি সারি বিল্ডিং। সুমো উঠে চলেছে আরো প্রায় ঘন্টার কাছাকাছি উঠেই তবে গ্যাংটক। রাস্তা চিপা কিন্তু পরিচ্ছন্ন গোছানো। দুপাশে পথিকের হেটে চলার ফুথপাথ। উপরে তাকালে কেবল বিল্ডিং দেখা যায়, পর্বতের চূড়ার দেখা নেই। আমি শিলংএর পাহাড় মাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু সিকিম আরো উচু, যেন আকাশের কাছাকাছি। সত্যিই তুমি হিমালয়েরই প্রতিবেশী।
সুমো থেকে নামলাম এমজি (মহাত্মা গান্ধী) মার্গ এর সামনে। গোগল ম্যাপ দেখে নিলাম কোথাই আছি। সময় কম, হোটেলে উঠে, বেরিয়ে পরতে হবে। এমজি মার্গের রাস্তার পাশে হোটেলগুলো মনে হলো একটু যেন দাম বেশী। পরে একটু পাহাড় নেমে একটি হোটেল পাওয়া গেল। ১০০০ রুপি এক রুম। দুটি রুম নেয়া হল। হোটেলে পরিচয় পত্র অবশ্যই দিতে হয়। আমি আমার আইডি কার্ড দিলাম, পাসপোর্ট লাগল না। ঝিমলী গেল এক রুমে আমি সানজিৎ অন্য রুমে। ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল। খাবার খাওয়া হয়েছে আসার পথে রাস্তার ধারে। তাই খাবার ঝামেলা নেই । কেবল স্নান-গোসল ছেড়ে বেরিয়ে পরতে হবে।
নেটে দেখলাম সাড়ে ৪ টা বাজে রোপওয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। সানজিৎতে বললাম ঝিমলীকে বল, চারটেয় অবশ্যই বেরিয়ে পরতে হবে। রোপওয়ে হচ্ছে ট্যুরিস্টদের অন্যতম আর্কষন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের যাতায়াত ব্যবস্থা। ভাবলাম অটো নেব কিন্তু কোন অটো গ্যাংটকে চলে না। এত খাড়া পাহাড়ি পথ, তিন চাকার পরিবহন চলতে পারে না। চারচাকার অটো রয়েছে, ভাড়া গুনতে হয় মিনিমাম ১৫০-২০০ রুপি। ম্যাপ দেখাল ১৫ মিনিট হাটা পথ। আমরা উচু পথ ধরে গোগল ম্যাপের পথে হাটতে লাগলাম। কেবল উপরের দিকে উঠা, ঘেমে গেলাম এক সময়। অবশেষে কুড়ি মিনিট হেঁটে পৌছলাম রোপওয়ের গোড়ায়। দেখি নোটিশ ঝুলছে রিপেয়ারিং কাজ চলছে। আগামী এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হল! তবু আমরা হেসে উঠলাম। এত পথ মারিয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগার হয়েছিল যে জন্য তাকে কি সহজে ছাড়া যায়? ছবি তুলতে লাগলাম রোপ্ওয়ের রোপ ফ্রেমে বন্দি করে। ম্যাপ দেখলাম কাছেই রয়েছে এক পার্ক, কি আর করা পার্কই ঘুরে যাই, এলাম যখন। আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। যা দেখি তাই ভালো লাগে । অচেনা শহর, অচেনা রাস্তার মোড়। ভালো লাগে আমাদের অদেখা পরিচ্ছন্ন এ শহর। আমরা পার্ক এ প্রবেশ করলাম। নানা জাতের কিছু গাছ-গাছালীর ছোট্ট বাগান। কাছে-দূরে দেখা যায় আরো অন্য পর্বত শ্রেণী। গভীর খাদে ছোট্ট নদী। কাছে কোথাও ঝর্নার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু ঝর্নার সৌন্দর্য দেখা যায় না পার্ক থেকে। কয়েকটি কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে আড্ডায় মসগুল, সাথে ঝালমুড়ি। আমরা বেশ কিছু ছবি তুলে নিজেদের প্রশ্ন করলাম কি করা যায় দিন তো শেষ। কালকের জন্য তো প্লান করা আছে। আজকে এই বিকেলে আর কোথায় যাবো? সানজিৎ বলে, চলো কোন মনস্ট্রি ঘুরে আসি। কিন্তু কাছাকাছি মনস্ট্রি খুঁজে পা্ওয়া গেল না। আমি বলি, হেঁটে দেখতে দেখতে এমজি মার্গ যাই। তাই হলো।

(To be continued)
বিষয়শ্রেণী: ফটোব্লগ
ব্লগটি ১৩৬৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast