www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শ্রী ভাবনা ছাত্রীনিবাস (অনুবাদ)

[বাংলা পাঠকদের জন্য Thingnam Anjulika Samom (২০১৯) সম্পাদিত ইংরেজী বই Crafting the word, থেকে অনুবাদ করেছি্। পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর সৃষ্ট আশ্রম, শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী কিভাবে বেঁচে রয়েছে মানুষের জীবনে, এই ছোট গল্পে তা সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে]

কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫ তম জন্মবার্ষীকী উৎযাপন হতে চলেছে এ বছর । আমি ভাবছি কি করব। তাঁর সাহিত্য, তারঁ গান, তাঁর আশ্রম সবই আমার হৃদয়ের খুব কাছে। আজ বার বার মনে পড়ছে আমাদের ছাত্রীনিবাস, যার নাম ছিল শ্রী ভাবনা। বিল্ডিংটি বিশেষ বড় ছিল না, মাত্র দুটি ফ্লোর। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট-এর মেয়েরা থাকত সেখানে। সেই ছিল আমার জীবনের প্রথম কোন হোস্টেলে থাকা। আশ্রমে ভর্তির পর প্রথমে ছয়জন মেয়ে থাকার একটি রুমে জায়গা পেলাম। আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সবাইকে চিনে গেলাম। অনেকে হয়ে উঠল খুব ঘনিষ্ট বন্ধু।
আমি প্রতি সকালে বৈতালীকে অংশ নিতাম, যেখানে সমবেত সংগীত গাওয়া হতো। হারমনিয়াম, তবলা, ঢোল, মন্দিরা, ঘন্টা হাতে আমরা গানে সংগ দিতাম। আমার খুব ভাল লাগত সেখানকার পরিবেশ। পুরো গানের মানে বুঝি বা না বুঝি, আমরা সবে গেয়ে যেতাম উচু গলায়—
জয় হোক
নব অরুনোদয়, জয় জয়
নব সুর্য আলোয় ভরে উঠুক সব
জয় হোক জয়।

গানেগানে সুন্দরভাবে শুরু হতো প্রতিটি দিন। আমরা নিজেদের যেন খুঁজে পেতাম গুরুদেবের গানে, আমের মূকুলের মাঝে কিংবা শরতের হলুদ পত্রপল্লবে। তার গান থেকে আমরা শিখতাম ভালবাসা, অনুভব করতাম অন্যের প্রতি ভালবাসা। কেউ হয়তো কখনো গেয়ে উঠে—
আমি তোমারও সংগে বেধেঁছি আমার প্রাণ
সুরেরও বাঁধনে,
তুমি জান না,
আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে
আমি তোমারও সংগে বেধেঁছি আমার প্রাণ।।

ক্রমে আমরা আরো বেশী ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম, কেউ অন্য গ্রূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমরা চার জনের একটি গ্রুপ হয়ে গেলাম। চারজনই চারটি জায়গার, চারটি ভিন্ন ভাষাভাষী এবং চার রকম দেখতে। একজন মালায়ালী (কেরালা), উড়িষ্যা থেকে একজন, একজন আসামের আর আমি মনিপুরী। আমরা সবাই ছিলাম কলাভবনের ছাত্রী। আমরা শিখছিলাম আর্ট আর ভাস্কর্য । পিঠে ব্যাগ ভরতি অংকন সামগ্রী নিয়ে আমরা ক্যম্পাস জুড়ে ঘুরে বেড়াতাম। আঁকার খাতায় নকশা করতাম যেখানে ইচ্ছে হতো। আমরা মাটি মর্দন করে মুর্তি গড়তাম। সুই-সুতা, লতাপাতা, ফুল দিয়ে আমরা ফুলের মালা, তোড়া, হাতের কাঁকন বানাতেও শিখেছিলাম।
আমাদের মধ্যে আমরা সবচেয়ে ভালবাসতাম মালায়ালী মেয়েটিকে। সে ছিল সবার চেয়ে বয়সে একটু বড়। আমাদের মধ্যে সে সবার আগে সেখানে গিয়েছিল। সবাই বলতো তাকে কস্তুরবা গান্ধী (মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী) ট্রাস্ট থেকে পড়ানো হতো। সে ছিল কর্নাটকা সংগীতেরও একজন পন্ডিত। আমাদের মতো সে কোন সাধারন মেয়ে ছিল না। সে মনেপ্রাণে ছিল আশ্রমের উপযুক্তা কন্যা। আমরা তাই গোপনে তাকে বলতাম, শকুন্তলা!
প্রতি সকালে সে স্নান সেরে কোমড় সমান খোলা চুলে মাস্টার নন্দলাল বোস-এর স্টুডিও গোছাত। সে একটি বা দুটি ফোটা ফুলের পাপড়ি জলদানীতে রাখত। যে সুগন্ধি জল ব্যবহার করত আবার ছবি আঁকতে। কখনো বকুল, কখনো চাঁপা, সময়ে যা যেতো পাওয়া।
আমি আজ তাকেই ভাবছি খুব। কেমন সোহাগী ছিল সে সুশ্রী বিষন্ন মেয়েটি। সে সবার থেকে আলাদা, আমাদের মতো ছিল না। কখনো সে আমাদের থেকে দূরে গিয়ে ছবি আঁকতো। আমরা সবাই হয়তো লবন মাখিয়ে কাঁচা আম বা আমলকি খাচ্ছি, সে তার ভাগের টুকরোগুলো রোদ্রে শুকাতো জানলার পাশে। আচার বানিয়ে হয়তো রাখতো বয়ামে। আমরা চুপি চুপি কখনো খেয়ে নিয়েছি তার আচার। সে বুঝতে পারলেও কখনো কিছু বলতো না, যেন কিছুই হয়নি।
শকুন্তলা কেরেলা থেকে আনা নজরকারা কাপড় পড়তো খুব সুন্দর সুশীল ভাবে। তার ভূষন ছিল পবিত্রতায়, সুন্দর রংঙে নয়। পিঠে কালো চুলের বেণী দিত দুলিয়ে। তার একটি সোনালী পার দেয়া সাদা উত্তরীয় ছিল যা প্রায়ই সে পড়ত। আমারও কেন জানি সেই ড্রেসটি খুব পছন্দ হলো। আমি তার কাছে ধার করে পরতাম সে সোনালী পার। পরে এমন হয়ে গেল আমি ভুলে যেতে লাগলাম তা ফেরত দিতে। আমার ওয়াডরোবেই রেখে দিতাম যতক্ষন না ফেরত চায়। আমার মনে হতো তার সেই ড্রেসেই আমাকে আকর্ষনিয়া লাগতো। আমি মনিপুরী ড্রেস ডোরাকাটা ফানেক-এর সাথে তা পড়তাম।
একদিন সমাবর্তনের দিন বিশ্ব ভারতী এলেন সরোজিনী নাইডু (ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী)। বড় করে আয়োজন হচ্ছিল। আমাদের নিবাসে চিঠি এল—কিছু মেয়ে পাঠান নাইডুকে বরন করার জন্য। এবং সেই মনিপুরী মেয়েটিকে রাখবেন। তাকে তার জাতীয় পরিধান পড়তে হবে, আরো নানা কিছু। আমি ভাবি তাদের আমাদের ফানেক খুব মনে ধরেছে বোধ করি।
সমাবর্তনের দিন আমি ফানেকের সাথে পড়লাম সেই সাদা-সোনালীপার উত্তরিয়। আরো কয়েকটি মেয়ে একসাথে ফুল দিয়ে বরন করে নিলাম বিপ্লবী নেত্রীকে। আমি ভাবি কেমন দেখতে লেগেছিল আমাকে সে দিন? আপন মনে এখনো ভাবি!... কিন্তু হায়! চুরি গেল আমার সেই পোশাকটি। আর একদিন অন্য অচেনা একটি মেয়ের গায়ে শোভা দিতে লাগল আমার পোশাক।
আমাদের হৃদয় ভেঙে একদিন হঠাৎ করেই চলে গেল শকুন্তলা। ঘটনাটি ছিল একদম তার ব্যক্তিগত। আমারা মনঃক্ষুন্ন হলাম আর উচু গলায় কাঁদতে পারলাম না, কেননা সেটি দেখতে ভালো লাগতো না। আমাদের মনে হলো আমরা গেয়ে উঠিঃ-
কেন তুমি চলে গেলে
আমাদের ছেড়ে
বসন্তের গান ফেলে…

শান্তিনিকেতনে রবিবার মানে ছুটির দিন নয়। প্রতি বুধবার সেখানে আলোচনার সাথে গান ও প্রার্থনা হত। আশ্রমের সবাই উপস্তিত থাকত। শকুন্তলা সেখানে একক সংগীত পরিবেশন করতো। অনুষ্ঠান শেষে আমরা চারটি মেয়ে একসাথে রুমে ফিরতাম। আবার কখনো সে নিজের মতো করে ফিরতো। আমরা কখনো তাকে জিজ্ঞেস করিনি বা মনেই করিনি সে কেন মাঝে মাঝে একা ফিরতো। একদিন আমি শুনলাম, সে নাকি আমাদের এক প্রফেসরের দুসায়ন্তর সাথে গভীর প্রেমে আবদ্ধ হয়েছে।
কি যেন ঘটনা হলো একদিন। দেখি শকুন্তলার রুমে একঝাঁক লোক গাদাগাদি করছে। তারা আসলে ডাক্তার, নার্স আর আমাদের ম্যাডামরা। আমাদের কেউকে ভেতরে যেতে দেয়া হলো না। কিন্তু আমি শুনলাম সে ফুপিয়ে কাদঁছিল। বুঝতে পারলাম প্রফেসর তাকে প্রতারনা করেছে বা অপমান করছে।
ব্যাপারটি এক সময় ঠান্ডা হয়ে গেল। আর একদিন আমি তার রুমে গেলাম। দেখলাম সে খোলা চুলে নরম সুরে বীনা বাজাচ্ছে আর গাইছে নরম সুরে। আমাকে দেখে সে একটু হাসল, বলল, এখন আমি ঠিক আছি। কিন্তু তারুন্যের আবেগে আমি চিৎকার করে উঠলাম বললাম, I will kill him ! সে আমাকে শান্ত করল। একটু হেসে আমায় জড়িয়ে ধরল।
শকুন্তলা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। প্রায় তিন মাস পর আমাদের তিনজনকে সে চিঠি লিখল। তার চিঠি খুলে আমরা সবাই অবাক! …একেবারে নতুন সুর! সে লিখেছে “ আমি একজনকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি! আমি খুব খুশি…” আমরা হাসলাম, বললাম, What a love addict! পরক্ষনেই মনে হল, ভাঙা প্রেম জোড়া লাগেনিতো! পরে মনে হলো না তেমনটা হবার নয়। কেননা দুসায়ন্তকে আমাদের সাথে কথা বলার জন্য আমাদের পেছন ঘুরতে দেখেছি। আমরা কোন দিন তাকে শকুন্তলার খবর দিইনি।
তারপর কয়েক বছর পর তার বিয়ের নিমন্ত্রন কার্ড পেলাম। তারও কিছু বছর পর তার চিঠি পেলাম, লিখেছে আমার একটি ছেলে হয়েছে। তার নাম কি দিয়েছি জান?..তাকে দিয়েছি তোমারই নাম!... বিনোদ। বিনোদ! আমি পুলকিত হলাম। আমারই নামে নতুন শিশু। কিন্তু শকুন্তলা বেশীদিন পৃথিবীতে রইল না। সত্যি, সে ছিল স্বর্গের পরি, স্বর্গেই সে ফিরে গেল খুব তাড়াতাড়ি।
মনিপুরে একজন অফিসারের কাছ থেকে খবর পেলাম তার ক্যনসার হয়েছিল। আফসারটি বলল, খবর পাননি? সংবাদ পত্রে খবর ছাপা হয়েছিল তো!
কিন্তু শকুন্তলা আমাদের হৃদয়ে এখনো বেচেঁ আছে। আমি ভাবি বিনোদ এখন কত বড় হয়েছে? সেও কি মায়ের মতোই শান্ত- সুশীল?
কিন্তু বিনোদ … আমার বাছা, তুমি হয়তো জানো না দূর পাহাড়ের দেশে তোর মায়ের এক বন্ধু বসবাস করে যার নাম বিনোদিনী। যার নাম তুমিই আজ ধারন করেছ!
-:-

[মূল গল্প লেখক, মনিপুর মহারাজকুমারী বিনোদিনী দেবী। যিনি ছিলেন নাট্যকার, ছোটগল্পলেখক ও উপন্যাসিক। তিনি পদ্মশ্রী পুরষ্কারে ভূষিত হন ১৯৭৬ সালে । জন্ম: ১৯২২,মৃত্যু: ১৯১১।]
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৮৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অভিজিৎ জানা ০৩/০৭/২০২০
    খুব সুন্দর অনুবাদ হয়েছে!
  • ফয়জুল মহী ০১/০৭/২০২০
    Very good post
 
Quantcast