www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মিথ্যাবাদী

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ‘জাতিগত নিধন’ শুরু হওয়ার ২৪ দিন পর মুখ খুলেছেন মিয়ানমারের অঘোষিত সরকার প্রধান এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি। তবে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচ- নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তথাকথিত শান্তির নেত্রী এ বিষয়ে এড়িয়ে গেছেন। তার এ বক্তব্য বিশ্বব্যাপী প্রচ- নিন্দাবাদ কুড়িয়েছে।

জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন ভাষণে তিনি যা বললেন, তাতে বাগাড়ম্বরতা আছে বাস্তবতার লেশমাত্র নেই। ৩০ মিনিটের ভাষণে সু চি ‘পরস্পর বিরোধী তথ্য’ দিয়ে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার এবং বোকা বানানোর প্রয়াস চালিয়েছেন।

রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার প্রেক্ষিতে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই রোহিঙ্গা নিধনে মানবাধিকার সংগঠনসহ বিশ্বব্যাপী প্রচ- সমালোচনা ও ধিক্কার শুরু হলেও তথাকথিত ‘শান্তির নেত্রী’ বালুতে মুখ গুঁজে থাকার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের বজ্জাত ডাইনি নেত্রী বিশ্বের আর কোন দেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই।

কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, কসোভো প্রভৃতি দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতন হলেও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নির্মম, নিষ্ঠুর নিধনযজ্ঞ সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে।

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার ছবি প্রকাশ করেছে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিগুলো প্রকাশ করে এ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিতাড়নের চেষ্টা করছে, এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। গত তিন সপ্তাহ ধরে সেখানে সুপরিকল্পিতভাবে একটি নির্দিষ্ট ছকে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার ছবি এতে উঠে এসেছে।

এ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যেই যে গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, এগুলো তার অকাট্য প্রমাণ। এটা জাতিগত নির্মূল অভিযান, এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। রাখাইন রাজ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ রোহিঙ্গা গ্রাম এখন সম্পূর্ণ খালি, খোদ মিয়ানমার সরকার এ তথ্য দিয়েছে বলে জানায় বিবিসি।

রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হামলার বর্ণনায় এ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক একটি গ্রাম প্রথমে ঘিরে ফেলছে, পলায়নরত গ্রামবাসীর উপর নির্বিচারে গুলি ছুঁড়ছে এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এটা নিশ্চিতভাবেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

স্যাটেলাইট ছবিতে ২৫ আগস্টের পর লোকবসতি আছে এমন অন্তত ৮০ স্থানে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড সনাক্ত হয়েছে বলে জানায় এ্যামনেস্টি।

গত ২৪ আগস্ট রাতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) রাখাইন রাজ্যে এক সঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালায়। হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার পর থেকে রাখাইনে সেনা অভিযান চলছে।

সেনাবাহিনী কিভাবে গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলী চালিয়ে মানুষ মারছে, ঘরের ভেতর আটকে রেখে কিভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, লুটপাট চালিয়ে কিভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথায়। রাখাইনে জঙ্গি দমন অভিযান চালাচ্ছে এবং বেসামরিক নাগরিক তাদের লক্ষ্য নয়।

সেনা অভিযান শুরুর পর প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন এখন মিয়ানমারের কড়া সমালোচনায় মুখর।

বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেন, ‘আমি মনে করি, এই জনগোষ্ঠীর পাশে এখন বিশ্ববাসীকে দাঁড়াতে হবে। একটি জাতি-গোষ্ঠী হিসেবে তাদের সঙ্গে কি আচরণ করা উচিত, সেকথা বলতে হবে। এই সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, এই নির্মমতা বন্ধ করতেই হবে।

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ায় মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। রাখাইনে সেনা অভিযান স্থগিত এবং রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক পরিস্থিতি বিপজ্জনক অবস্থানে পৌঁছেছে।

দেশান্তরী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে তিনি সবদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

মিয়ানমারে চলছে মন্থর গণহত্যা:

মিয়ানমারের কথিত রাষ্ট্রীয় অপরাধ সংঘটনের বিচারের জন্য কুয়ালালামপুরে গঠিত আন্তর্জাতিক গণআদালতে (পার্মানেন্ট পিপ্লস ট্রাইব্যুনাল) মঙ্গলবার মিয়ানমারের একজন বৌদ্ধ মানবাধিকার কর্মী জবানবন্দী দিয়েছেন। বৃটেন প্রবাসী ড. মং জার্নি তথ্য দেন যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকার ১৯৭৮ সালে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে অস্ত্র সরবরাহের হুমকি দিয়েছিল। এর চারদিন পর জেনারেল নে উইন সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের দেয়া ওই হুমকিকে অবমাননাকর উল্লেখ করে তখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বদলা নেয়ার। এর মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন করে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন করেছিলেন নে উইন।

জবানবন্দীতে ড. মং বলেন, আমার বাড়ি মিয়ানমারের মান্দালয় এলাকায়। জার্মানিতে হিটলার বলেছিলেন, ইহুদীরা জার্মান নয়। কিন্তু ইহুদী হিসেবেই তাদের হত্যা করা হয়েছিল। সেদিক থেকে রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। সামরিক বাহিনী তাদের রোহিঙ্গা পরিচয়ে হত্যা করতেও রাজি নয়। তিনি বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ছিল। কিন্তু নে উইন ’৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয়ার পরই রোহিঙ্গারা স্লো জেনোসাইড বা মন্থর গণহত্যার শিকার হয়ে পড়ে।

গত ২৫ আগস্টের কথিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হামলা বা এর আগের হামলার কারণে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী সন্ত্রাস দমনের অংশ হিসেবে সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে বলে যে ধারণা মিয়ানমার বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে, তিনি তা জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, শুধু জাতিগত পরিচয়ের কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানরা পদ্ধতিগতভাবে গণহত্যার শিকার হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, তাদের রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়া এবং তাদের সবধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সঙ্গে মিয়ানমারে গণতন্ত্র আসা না আসা কিংবা আরসা গত ২৫ আগস্ট বা তার আগে-পরে কি করেছে বা করেনি বা অন্য কোন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিপথগামী কোন রোহিঙ্গা গোষ্ঠী হাত মিলিয়েছে কি মেলায়নি, তার সঙ্গে রোহিঙ্গা জাতিগত নির্মূল অভিযানের কোন সম্পর্ক নেই।

ড. মং জার্নি আন্তর্জাতিক আইনে ‘স্লো জেনোসাইড’ বা মন্থর গণহত্যার ধারণা প্রচার করেন। এটা ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও রোহিঙ্গা প্রশ্নে মন্থর গণহত্যার ধারণা সমর্থন করেছেন। ড. মং ফ্রি বার্মা কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গবেষণা সহযোগী ছিলেন। মি. মং জার্নিকে মিয়ানমারের সরকারী মহল রোহিঙ্গা সমর্থক হিসেবে সন্দেহের চোখে দেখে।

২০১২ সালে অং সান সু চি যখন প্রথম লন্ডন সফরে গিয়ে ২৪ বছরের মধ্যে প্রথম জনসমক্ষে ভাষণ দেন লন্ডন স্কুল অব ইকনকিমস্্ আয়োজিত অনুষ্ঠানে তখন সেখানে ড. মংও বক্তব্য দেন।

ড. মং জার্নি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অন্যতম নৃ-গোষ্ঠী উল্লেখ করে বলেন, প্রখ্যাত স্কটিশ ভূগোলবিদ ফ্রান্সিস বুকানন ১৭৭৮ সালেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আরাকানের ‘নেটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সুতরাং ঐতিহাসিক, নৃতাত্বিকসহ সব বিবেচনায় তারা আরাকানের নাগরিক। তিনি নে উইন সরকারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড পরিচালনার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন।

সু চির ভাষণের পর্যালোচনা

রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হওয়ার ২৪ দিন পর জাতির উদ্দেশে দেয়া মিয়ানমারের অঘোষিত নেত্রী অং সান সু চি’র ভাষণ বাগাড়ম্বড়ে ভরপুর, বাস্তবতার কোন মিল নেই। ৩০ মিনিটের ভাষণে সু চি ‘পরস্পর বিরোধী তথ্য’ দিয়ে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান নৃশংসতার কথা সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে তুলে ধরা হলেও সু চি সেটি স্বীকার না করে বলেছেন, রাখাইন থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে তার সরকার সেটি অনুসন্ধান করতে চায়। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার ভীত নয়।

সু চি’র এই ভাষণের পর পরই এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, আজকের ভাষণে সু চি স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি ও তার সরকার রাখাইনের সহিংসতা বিষয়ে বালুতে মাথা গুঁজে রেখেছেন। তিনি বরং তার বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের তিনি দোষারোপ করেছেন।

মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোর সিটি হলে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সু চি বলেন, রাখাইন থেকে মুসলমানদের পালিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার খবরে সরকার উদ্বিগ্ন। সব ধরনের মানবাধিকার লংঘনের নিন্দা জানাই। রাখাইন সহিংসতায় সব মানুষের দুর্ভোগ গভীরভাবে অনুভব করি। রাখাইন থেকে মুসলমানরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চাই।’

সু চি বলেন, আমরা শান্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা রাখাইনে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা শান্তি চাই, ঐক্য চাই, যুদ্ধ চাই না।’

অন্যকে দোষারোপ করা বা দায়িত্ব এড়ানো মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য নয় উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী সু চি বলেন, আমরা সবধরনের মানবাধিকার লংঘন ও বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই।

রাখাইন সংকট প্রসঙ্গে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর বলেন, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আছে। তাদের সব কথাই শুনতে হবে। কোন ব্যবস্থা নেয়ার আগে অভিযোগগুলো যে তথ্য-প্রমাণনির্ভর, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি পরিস্থিতি দেখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন পরিদর্শনের আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে বলেছেন, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তার সরকার কাজ করবে।

সু চি’র এই ভাষণ দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান বলেন, রাখাইনে যেসব সহিংসতার অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা খতিয়ে দেখতে হলে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন দেশটিতে পরিপূর্ণভাবে অবাধে প্রবেশের নিশ্চয়তা। এই সংকটের বিষয়ে দ্রুত দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর ভাষণ

সু চির বক্তৃতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দৈনিক প্রথম আলোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বক্তব্য প্রকাশ করেছে। ঐ কর্মকর্তা বলেন, অং সান সু চি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মাথায় রেখে ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে বোকা বানানোর অপচেষ্টা করেছেন। তার বক্তৃতার নানা অংশ বিভ্রান্তিতে ভরপুর। তিনি মুসলমানদের রাখাইন থেকে পালানোর কারণ খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র প্রতিবেদন, দেশী ও বিদেশী গণমাধ্যমে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আসা লোকজনের ভাষ্য কি তাদের পালিয়ে আসার কারণ তুলে ধরতে যথেষ্ট নয়?

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি রাখাইনে নেয়ার কথা বলেছেন। রাখাইনে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে তিনি বলেননি। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তার সরকার কিভাবে কাজ করবে? ১৫ সদস্যের সরকারী কমিটি দিয়ে আনান কমিশন আর বিতর্কিত সরকারী তদন্ত কমিশনের সুপারিশ একসঙ্গে বাস্তবায়ন করবেন?

আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের যেখানে মিয়ানমারের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্তির কথা বলছে, সরকারী কমিশন সেখানে রোহিঙ্গাদের মূলধারা থেকে বাইরে রাখার পক্ষে। কাজেই এ বিষয়ে তিনি বিভ্রান্তি দূর করেননি। বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক বলেছেন, যথারীতি বাকপটু সু চি পুরো বক্তৃতায় বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। রাখাইনের লোকজনকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পরস্পর বিরোধী অবস্থান প্রকাশ করেছেন। একদিকে তিনি মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এই আলোচনায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্পষ্ট করেই বলেছেন, যেসব রোহিঙ্গার জাতীয়তা নিশ্চিত হবে, শুধু তাদেরকেই ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। অন্যদিকে রাখাইনের মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে ১৯৯২ সালের দুই দেশের সই করা চুক্তির উল্লেখ করেছেন। ঐ চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার সময় শরণার্থী নিবন্ধন কার্ডধারী যাদেরই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব সনদ বা জাতীয় নিবন্ধনপত্র থাকবে, তাদের সবাইকে ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেয়া হবে। চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সমাজের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি উপেক্ষা

বাংলাদেশের অপর একজন কূটনীতিক বলেছেন, মিয়ানমার নেত্রী আইনের শাসন, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু রাখাইনে মুসলমানদের উপর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ, হত্যাসহ তাদের ওপর নৃশংসতা, তাদের বাড়িঘর ও সম্পদ পুড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনীরুজ্জামান দৈনিক প্রথম আলোর এক সাংবাদিকের সাথে আলাপচারিতায় বলেন, ‘সু চির বক্তৃতায় রোহিঙ্গা ব্যাপারে তার কঠোর মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। মানবাধিকার প্রশ্নে তার আগের অবস্থানের সঙ্গে এই বক্তৃতা খাপ খায় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করার কথাও আছে তার ভাষণে। খুব সহজেই এই অবস্থান থেকে তিনি সরবেন বলে মনে হয় না। ফলে সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে আসছে।’

সু চির ভাষণ খ-ন করতে গিয়ে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন এদেশের একজন কূটনীতিক। তিনি সম্প্রতি বলেন, সু চি তার বক্তৃতায় বলেছেন, রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ হয়েছে ৫ই সেপ্টেম্বর। অথচ ১৩ সেপ্টেম্বর ৪০ জনের বেশি রাষ্ট্রদূতকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখানোর জন্য কক্সবাজারে নেয়া হলে তারা নিজেদের চোখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে আগুন ও ধোঁয়া উড়তে দেখেছেন। অভিযান বন্ধ হলে আগুন ও ধোঁয়া এলো কোথা থেকে?

রাখাইনে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সব নাগরিক একই ধরনের সুবিধা পান বলেছেন সু চি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১২ সালের পর থেকে রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা যথেষ্ট সীমিত করা হয়েছে।

মিয়ানমারে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ওই সিনিয়র কূটনীতিক বলেন, রাখাইন থেকে ৫০ শতাংশ মুসলিম পালিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন সু চি। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ৮ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। সুু চি’র তথ্য মেনে নিলে রোহিঙ্গার সংখ্যা হওয়া উচিত ১৬ লাখ। অথচ মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে বলে থাকে দেশটিতে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এভাবে বিশ্ববাসীকে প্রতারিত করার অং সান সু চি’র প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৭৪৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/১০/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast