www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অকার্যকর প্রশাসনের হাতে ব্যাংকিং কেন

ব্যবসায়ী মহল বলছেন, এটা ভাল নয় যে, একদল স্বার্থান্বেষী একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অত্যন্ত সফল ব্যাংকে-কে এভাবে ধ্বংস করে দেবে। এই ব্যাংকে আমানতকারীর সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। ব্যাংকের বর্তমান সঙ্কটে তারা তাদের আমানত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ১৯৮৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ নিয়ে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকটি প্রতিবছর তার দক্ষতা ও শক্তি বৃদ্ধি করেছে। সর্বশেষ, ব্যাংকটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ হ্যান্ডলিং করেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংক দেশের প্রতি চারটি বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পের একটিতে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবর প্রচারিত হওয়ার পর ইতিমধ্যেই ব্যাংকটির রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৩ শতাংশ কমে গেছে। তবে ব্যবস্থাপনায় এই পরিবর্তন আনার ফলে শিল্পে এই ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়বে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
ইতিমধ্যেই ব্যাংকটিতে ঋণ কেলেঙ্কারি শুরু হয়ে গেছে। নতুন বোর্ড ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপ ইন্ডাস্ট্রিজ নামের নবগঠিত একটি কোম্পানিকে ১৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে। কোম্পানিটি মাত্র এ বছর ফেব্রুয়ারিতে গঠন করা হয়। এটি আরমাডা স্পিনিং মিলস-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। আর আরমাডা চট্টগ্রামের ঐ ‘বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপের’ একটি প্রতিষ্ঠান। ঋণ প্রস্তাবটি আসে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে। আরমাডাও একটি নতুন কোম্পানি। এই কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের দুই শতাংশ শেয়ারের মালিক। ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বোর্ডে আরমাডার প্রতিনিধিত্ব করছেন। ঋণ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইস্পাতের একটি শীট তৈরির কারখানা স্থাপনের জন্য ইনফিনিটি এই ঋণ চেয়েছে। কিন্ত তাতে ইনফিনিটির ব্যাংকিং লেনদেনের কোনো হিসাব সংযুক্ত নেই।
এ রকম আরও উদাহরণ আছে। বোর্ড সম্প্রতি থারমাক্স গ্রুপের সহযোগী সংগঠন ডেনিম কম্পোজিটের ১৩৫ কোটি টাকার ঋণ ২০০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে। এটা করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকি নীতিমালা উপেক্ষা করে। এছাড়া ব্যাংক বোর্ড নাসা গ্রুপের ৬টি কোম্পানিকে ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর কোনো কোনোটা ঋণখেলাপি। কিন্তু বোর্ড সেটা উপেক্ষা করেছে। নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনেরও চেয়ারম্যান।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের ভিন্নমত স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যই ভাইস- চেয়ারম্যান সৈয়দ আহসানুল আলমকে অপসারণ করা হয়েছে। আর তার অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকে দুটি ভাইস চেয়ারম্যানের পদ লুপ্ত করে একটি করা হয়েছে। সে পদে ইউসুফ আবদুল্লাহ আল রাজি বহাল থাকবেন। চেয়ারম্যান আরাস্তু খান অভিযোগ করেছেন যে, আহসানুল আলম ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন। আহসানুল আলম বলেছেন, ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে যদি পরিচালকদের কথা বলার কোনো এখতিয়ারই না থাকে, তবে তাদের পক্ষে দায়িত্ব পালন কিছুতেই সম্ভব হবে না। এ ছাড়া তিনি অভিযোগ করেছেন যে, ব্যাংকের সকল নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে আরাস্তু খান ১০/১২ লক্ষ টাকা করে ঘুষ নিয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছেন যে, অচিরেই ইসলামী ব্যাংকের পরিণতি হবে সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকের মতো। বিক্ষুব্ধ পরিচালকরাও আরাস্তু খানের বিরুদ্ধে নিয়ম ও বিধি লঙ্ঘন করে চট্টগ্রামের ঐ ব্যবসায়িক গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
এদিকে ব্যাংকে এই পরিবর্তনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও কুয়েত-ভিত্তিক আল-রাজি গ্রুপ। আইডিবি আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ব্যাংকে তাদের ১২ কোটি ৮ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৮ কোটি ৭০ লাখ শেয়ার বর্তমান বাজার দরে বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম)। এই সভা ডাকা হয়েছিল সেনানিবাসের ভেতরে গলফ ক্লাবে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সেখানে উপস্থিতিতে আগ্রহ হারায় ও কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। নতুন বোর্ডের সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এজিএম-এ উপস্থিতি ছিল সামান্যই। আল-রাজি গ্রুপও তাদের শেয়ার কমিয়ে ফেলবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান বোর্ডের ওপর আরব বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। উল্লেখ্য অধিকাংশ শেয়ারের মালিক হলেও তাদের না জানিয়েই সরকার ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাতে তারা তাদের ক্ষোভ চেপে রাখেননি। অর্থমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়ে সেকথা জানিয়েছেন। এদিকে চট্টগ্রাম গ্রুপের কথিত ৭টি কোম্পানির একটি এক্সেল ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড ঘোষণা দিয়েছে যে, আগামী ৩০ দিনের মধ্যেই তারা ইসলামী ব্যাংকের ৩২ কোটি চার লাখ শেয়ার কিনে নেবে।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, সঙ্কটাপন্ন ইসলামী ব্যাংক রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করা দরকার। অন্যথায় গোটা ব্যাংকিং খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। গত প্রায় এক বছর ধরে এই ব্যাংকের মালিকানা, বোর্ড, কমিটি ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। আরও ৭ জন পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। ফলে ব্যবসায়ী সমাজ, আমানতকারী ও ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক একেবারেই চুপ করে আছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) গত ২৭ মে বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আছে। তাদের তরফ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এর সঙ্গে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থ জড়িত। ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ব্যাংকটির স্বাভাবিক কাজকর্ম ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো একটি মাত্র ঋণগ্রহীতা-মালিকের হাতে অধিকাংশ শেয়ার চলে যাওয়া। আর একটি থিংক ট্যাংক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেছেন, কিছু অযোগ্য লোককে ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডে নিয়োগ দিয়ে সরকার ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখা উচিত যে, ইসলামী ব্যাংকে ঋণ বিতরণে কী অনিয়ম হচ্ছে।
পরিস্থিতি কী হবে জানি না, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, ব্যাংকটির আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের সামনে ঘোর দুঃসময়।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ১০৪৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩১/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast