www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে প্রোপাগাণ্ডার প্রয়োজন আছে কী

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিহত হওয়ার ঘটনাটি বেশ গুরুত্বের সাথে মুদ্রিত হয়েছে সংবাদপত্রে। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশেই আলোচনা হচ্ছে। এমপি’র নিজ বাড়িতে ঢুকে দুর্র্বৃত্তরা যে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডটি ঘটালো তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কেমন করে? আমাদের সমাজে একজন এমপির যখন এই অবস্থা তখন সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভাববে কেমন করে? নতুন বছরে আমরা যখন অতীতের দুঃখ-বেদনা, হিংসা-বিদ্বেষ ও গ্লানি ভুলে সুন্দর জীবনের আশাবাদ ব্যক্ত করছি; তখন এমন নৃশংসা ঘটনায় আমরা হোঁচট খাই বৈকি! প্রশ্ন জাগে, কোথায় আমাদের ত্রুটি, আমরা কি এগিয়ে চলার সঠিক রোডম্যাপটি তৈরি করতে পারিনি?
আমরা নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত ও সুবিচার চাই। অপরাধী যেই হোক তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। অনুরাগ কিংবা বিরাগের অপরাজনীতি যেন এ ক্ষেত্রে প্রশ্রয় না পায়। কারণ কোন সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন না হলে ওই সমাজ আর মানুষের বসবাসযোগ্য থাকে না। তাই আমরা আশা করবো আমাদের প্রশাসন এবং রাজনীতিবিদরা এমন ভূমিকা পালন করবেন যাতে আমাদের সমাজ দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য বসবাস উপযোগী থাকে। তবে প্রসঙ্গত এখানে  দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হয়, ঘটনার পরপরই অনুসন্ধান ও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই শাসকদলের নেতারা যেভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অভিযুক্ত করে চলেছেন, তাতে গুরুতর বিষয়টিকে তারা হাল্কা করে ফেলছেন। এমন কাজে মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তিরাও জড়িয়ে গেছেন। তাদের জন্য বলা প্রয়োজন যে, ব্লেমগেম কখনো সত্য ও সুবিচারের সহায়ক হতে পারে না। বরং এতে প্রকৃত অপরাধীরা নিরাপদ থাকার সুযোগ পেয়ে যায়।
এমপি নিহত হওয়ার ঘাটনায় সুন্দরগঞ্জে বিক্ষোভ হয়, হরতাল হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুরো উপজেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে র‌্যাব ও বিজিবি। এ ঘটনায় অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতরা উগ্রবাদী, জামায়াত নাকি দলীয়, পারিবারিক, আর্থিক না ব্যক্তিগত বিরোধের সাথে সম্পৃক্ত তা খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অথচ এমন অবস্থায় শাসকদলের নেতারা ঘটনার জন্য দায়ী করে চলেছেন জামায়াতকে, কখনো বিএনপি-জামায়াতকে, কখনো চিহ্নিত মৌলবাদীদের। এমন প্রবণতা আইনের শাসন কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য সহায়ক হতে পারে না। এদিকে এমপি খুন হওয়ার ঘটনায় গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাট থেকে জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, খুনীদের আড়াল করার হীনউদ্দেশ্যে গণগ্রেফতার চালানো হচ্ছে। তিনি ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। আমরাও মনে করি ন্যায়বিচারের স্বার্থে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন। কারণ, ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন সম্ভব। আর এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়ারও যৌক্তিক ভূমিকা পালন প্রয়োজন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এমপি হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক প্রোপাগাণ্ডার মাধ্যমে একটি দলকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রোপাগাণ্ডা কি কোনো যৌক্তিক বিষয় হতে পারে? প্রসঙ্গত এখানে ৪ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত একটি রিপোর্টের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সাংসদের এভাবে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া, সব গৃহকর্মীর ব্যস্ত থাকা, ঘটনার বর্ণনায় গরমিল- এসব নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ‘ঘরের কেউ’ জড়িত কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাংসদের সম্বন্ধী বেদারুল আহসান বেতারের ভূমিকা খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন মনজুরুলের বড় বোন আফরোজা বারী। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকেরা যেভাবে জামায়াতকেই ঘটনার জন্য দায়ী করছেন, তাতে স্বাধীনভাবে তদন্ত কাজ করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।” এখানে যে বার্তা রয়েছে তা সংশ্লিষ্টরা কতটা উপলব্ধি করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমরা যেকোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুধী। গুম, অপহরণ এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না। এমন লক্ষ্যে সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে নিরাপত্তা রাষ্ট্রের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী মতের মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। গুম ও অপহরণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকার গ্রুপ ও গুম হওয়া পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হতে পারে। কিন্তু তাদের পরিবার জানে না তাদের অবস্থান কিংবা তারা জীবিত না মৃত। গেল ৫ বছরে শত শত বাংলাদেশী বিশেষ করে বিরোধী মতের মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছে বলে তাদের স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে যাদের মৃত্যু হয়েছে অথবা জেলে আছেন, তাদের পরিবার এখন নজরদারিতে রয়েছেন বলে ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর ফরেন পলিসিতে মুদ্রিত ‘বাংলাদেশে কি বিরোধী মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন সাদা পোশাকধারী পুলিশ মীর আহমেদ বিন কাসেমের কাছে আসলো, তখন তাকে জুতা পরার সময়ও দেয়া হয়নি। তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, ৯ আগস্ট রাত ১১টায় তাদের ঢাকাস্থ এ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাকে তুলে নেয়া হয়। এ সময় তাদের দুই মেয়ে চিৎকার করে দৌড়াচ্ছিল। এর ৫ দিন আগে হুম্মাম কাদেরকে তার মায়ের সাথে আদালতে শুনানিতে যাওয়ার সময় একদল মানুষ তাদের গাড়ি আটকে অন্য একটি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। সমসাময়িক সময়েই অন্তত ৩০ জন সাদা পোশাকধারী লোক সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান আযমীর বাসায় যায় এবং ওই দুইজনের মতই তাকে গুম করে। তার ভাই সালমান আল আযমীর ভাষ্যমতে, অস্ত্রের মুখে তার ভাইকে এপার্টমেন্ট থেকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘এ সময় তারা জানিয়েছিল, তারা পুলিশের একটি বিশেষ বিভাগ থেকে এসেছে।’ প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, এই তিন ব্যক্তিই বিরোধী দলের তিনজন সিনিয়র নেতার সন্তান। তাদের ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের তুলে নিয়ে যায়। যদিও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছে।
ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা ভেবে দেখার মতো। আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ। গণতান্ত্রিক চেতনায় ন্যায়, সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এ দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে, এটাই তো জনগণের আকাক্সক্ষা। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে দেশ অনেক অগ্রসর হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এরপরেও কিছু বিষয় আমাদের এইসব অহঙ্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। পত্র-পত্রিকায় হত্যা, গুম ও অপহরণের যে চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। হয়তো এই কারণেই ফরেন পলিসি শিরোনাম করেছে, ‘বাংলাদেশে কি বিরোধী মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে?’ আমরা জানি বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐতিহ্যেপুষ্ট একটি দেশ। বর্তমান সরকারও গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝেন বলে আমরা জানি। এই সরকারের শীর্ষ নেতারাও বহুবার বলেছেন, তারা গুম, অপহরণ ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরোধী। তাই এসব ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো এখন উঠেছে, তার ন্যায়ভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। আমরা মনে করি, গুম-অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ন্যায়ভিত্তিক বিধিবিধানের আলোকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিলে সরকারের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। সময়ের দাবি পূরণে যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার কতটা এগিয়ে আসে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৯০৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast