www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ৬৭

ছেলেবেলার খেলা
------------
ছেলেবেলায় আমি যেসব খেলা খেলতে পেতাম সেসব খেলায় আমরা শুধুমাত্র ছোটরা একসাথে জড় হয়ে খেলতাম। আমার বয়সী, আমার চেয়ে একটু বড় কিংবা একটু ছোট। সেই খেলায় বড়দের কোন ভূমিকা ছিল না। মানে বড়রা কোনভাবেই নাক গলাত না। আমরা মনের সুখে বিন্দাশ খেলে যেতাম।
ফলে ঠাং গুলি, মার্বেল গুলি, ইটের টুকরো দিয়ে ঘর কেটে কিতকিত, চোর পুলিশ, ছুঁয়াছুঁয়ি, কালার কালার, পাঁচ গুটি, লুকাছুপি ইত্যাদি খেলায় আমাদের হারজিত বা ঠেলাঠেলিতে আমরা ছোটরা নিজেরাই নিজেদেরকে সামলে নিতাম। খুব বড় কিছু ঝগড়াঝাটি মারামারি বা কারো লেগে যাওয়া ইত্যাদি হলে তবেই আমাদের কথা বড়দের কাছ পর্যন্ত যেত। না হলে আমাদের খেলা আমাদের মত শুরু আর আমাদের মত শেষ করে বাড়ি ফিরে আসতাম।
এখনকার মত তখন কিন্তু বড়রা কেউ আমাদের সেই খেলায় লুকিয়ে চুরিয়ে নজরদারি করত না। ফলে সারা পাড়া জুড়ে চোর পুলিশ খেলা, এর ওর ঘরে যখন তখন লুকিয়ে পড়া, খড়ের গাদায় লুটোপুটি দেওয়া, সর্ষে খেত শাক তলা ধান জমি সবজি বাগান মাড়িয়ে দেওয়ার মজাই ছিল আলাদা।
এখনও বাচ্চারা নিজেদের মত খেলে। সে মোবাইল নিয়ে গেম খেলা হোক, জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরা হোক, স্কুল বাসে যেতে ভুল সুরে গান গেয়ে ওঠা হোক কিংবা খাতায় রঙ ঢেলে দুষ্টুমি হোক বা অঙ্কের খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে এরোপ্লেন বানানো হোক সবেতেই কিন্তু লুকিয়ে বড়দের নজরদারি করাও অনেক বেড়ে গেছে।
- এই, এটা করবি না।
- কি রে, ওঠা ও ভাবে নয়।
- তখন থেকে বলছি, এভাবে খেলতে হয়, শুনছিস না যে?
- তোরা কি রে, আমাদের মত একদম খেলতে পারিস না।
- সব বোকা, হাঁদারাম কোথাকার। বড় হয়ে কিছুটি পারবি না। তোদের বয়সে আমরা এই করতাম আর ওই করতাম।
বড়দের এইসব কথা এখন প্রায়ই ছোটোদের শুনতে হয়। বারবার শুনে শুনে ছোটরা তাদের নিজেদের মত ছেলেবেলার খেলা খেলতেই পারে না। বিরক্ত হয়ে ছোটদের ছেলেবেলা নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলছে। আবার খুব সহজে ছোটরা বুঝতে পারে বড়দের এই নজরদারি, বড়দের হস্তক্ষেপ। তারাও তাই নিজেদের ছেলেবেলার আবরণ ছেড়ে বড়দের কার্যকলাপ লুকিয়ে দেখে। বড়দের মত করে সেইসব অকালপক্ক খেলা খেলে। ফলে আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছে তাদের নিজেদের ছেলেবেলার খেলা।
প্রত্যেকে যে যার বয়সকে পরখ করে নিতে চায়। অন্য বয়স তার উপরে খবরদারি করলে সে মানবে না। সে শিশুবেলা হোক যৌবনবেলা হোক কিংবা বার্ধক্যবেলা। যে কোন মানুষের অন্য যে কোন বেলা বলে ওঠতেই পারে - আমি তোমার কথা মানি না। কিন্তু উল্টে ঘুরে বলা এই মানামানির বয়স ছেলেবেলা পায় না। কেন না সে যে বড় বয়সের অধীনে থাকতে বাধ্য হয়। ঘুরে বলতে পারে না। বলা যায় না। তাই নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিয়ে হারিয়ে ফেলছে তার নিজের শিশুবেলা। ছেলেবেলার খেলা।
এখন বেশিরভাগ ফ্যামিলিতে একটা অথবা দুটো ছেলেমেয়ে। প্রায় প্রতিটি ফ্যামিলি এখন নিউক্লিয়ার। বাচ্চার যদি কিছু হয়ে যায় সেই ভয়ে শিশুদের থেকে বড়দের চোখ আর সরে না। ফলে আমাদের মত মাঠ নেই, আশেপাশে কোন পুকুর নেই, খেলার মত কোন সঙ্গী সাথি নেই, গল্পবলা দাদু নেই, চোখে পড়ার মত সবুজ সবুজ দিগন্ত নেই, পড়ার চাপ বেশি, আলাদা করে সময় বের করতে পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি নানান রকম আপশোষ বাণীতে আমরা বড়রা এখনকার শিশুদের ছেলেবেলা এবং মেয়েবেলার মূল্যায়ন করি।
কিন্তু আমরা ভাবি না সময় বদলে গেছে। রূপান্তর এসেছে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো খেলার মত খেলার জন্য এখনকার শিশুবেলা নয়। আমরাই জনসংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ইট কাঠ পাথর ফেলে ফেলে পুকুর মাঠ সবুজ সব সব কিছু ধ্বংস করেই চলেছি। আমাদের মত এই খেলা ওই খেলা দৌড়নো কিত কিত করে আমরাও বা কি সোনার ফসল আমাদের শিশুদের সামনে তুলে ধরেতে পেরেছি? আমাদের খেলা ওইসব ছেলেখেলা খেলে খেলে যে আদর্শ জীবন রচনা করা যায়, তা কি আমরা জোর গলায় বলতে পারি?
তাহলে? এখন শিশুরা যা পাচ্ছে তাকে সেইটুকু কি আমরা পর্যাপ্ত দিতে পারছি? তাতে কেন কার্পন্য করছি? কেন লুকিয়ে চুরিয়ে নজরদারি করে যাচ্ছি।
- এখানে নোংরা, হাত দিবি না।
- তখন থেকে বলছি মুখে হাত দিবি না, শুনছিস না কেন?
- বললাম না গাছের রঙ সবুজ মেশানো কমলা নয় শুধু সবুজ, ডিপ সবুজ।
- কি শিখবি? পেনসিল বক্সটাও গুছিয়ে রাখতে পারিস না?
- এটা কোন খেলা হল? কেন এরকম খেলিস?
শিশুরা নিজেরা নিজেদের মত খেলতে চায়। থাকতে চায়। শিশুবেলার সাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে শিশুবেলা পেরিয়ে বড়বেলা হতে চায়। কিন্তু পারে না। আমাদের নজরদারির কাছে বার বার হেরে যায়।
বরং এখন স্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়েদেরা ভালো ভালো বন্ধু পায়। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। আগডুম বাগডুম করে নানা রকম খেলা খেলে। ঘর কেটে আঁকিবুঁকি করে। আমরা বরং অতটা এক্সপার্ট ছিলাম না।
কিন্তু সেখানেও আণ্ট আণ্টিদের আরো বেশি নজরদারিতে আরও বেশি হতোদ্যম হয়ে পড়ে।
তাই ছেলেবেলার খেলা আমরা খেলতাম প্রাণ খুলে এখন সেই খেলা খেলা হয় অন্যরকমভাবে অন্যমেজাজে বড়দের নজরদারির আড়ষ্ঠতায়।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৫৬৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০১/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অভিজ্ঞতার অসাধারণ মূল্যায়ণ। এ কালের আর সেকালের ব্যবধান করার দারুণ প্রয়াস।
    লেখককে ধন্যবাদ।
  • ন্যান্সি দেওয়ান ২০/০১/২০১৯
    Nice.
  • স্মৃতি জাগানিয়া।
  • দারুন
 
Quantcast