পরী বউ
লল্লন খুব ভালো ছেলে । দেখতে কার্টুনের মতো । নাক একটা ইয়া লম্বা, চুলগুলো খাড়া খাড়া । সং এর মতো লম্বা ছিপছিপে গড়ন । ছোট বেলা থেকেই মা-বাবা তাকে খুব ধুর-ছাড় করে । ডাক্তার বলেছে বয়েসের অনুপাতে তার মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি মানে অপরিনত । এখন আর তাকে নিয়ে কেউ বেশী মাথা ঘামায় না, হাতে কোন কিছু পেলে তাকে ললিপপের মতো চুষতে থাকে, সকাল নেই দুপুর নেই বনে বাদারে ঘুরে বেড়ায় , বন্য ফল খায়, বন্য পশুপাখিদের সঙ্গে কথা বলে , ভাব জমায় । এভাবে কেটে যাচ্ছিল লল্লনের দিনরাত । একদিন হঠাৎ করে সন্ধ্যে বেলায় কোথায় থেকে এসে লল্লন একেবারে মায়ের কাঁধে চেপে বসেছে । মা তো হেসেই খুন এত বড় ছেলে ! সে কিনা মায়ের কাঁধে চেপেছে ! লল্লন বলল, ‘মা মা আমি বইয়ে করব” । “সে কি কথা ! কাকে বইয়ে করবি ! কে বলেছে তোকে বিয়ে করতে !” মা চমকে জিজ্ঞেস করলো, হাসিটা চেপে রাখতে পারছে না আর। কেননা মা জানে, লল্লন এভাবেই প্রায় সময় তাকে জ্বালাতন করে । পাড়ার ছোটবড় সকলেই লল্লনকে নিয়ে হেঁয়ালি করে , তাকে এটা ওটা শিখিয়ে দেয়, সে এসে মায়ের কাছে বলে , আবদার করে, নালিশ দেয় । লল্লন কিন্তু সিরিয়াস, সে বলল, ‘আজকে দুপুর বেলা একটা টিয়া পাখি আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছে, ,আমাকে কামরাঙ্গা এনে খাইয়েছে , সে বলেছে এই জঙ্গলে নাকি একটা পরী আছে, আমাকে দেখাবে, আমার বন্ধু করে দেবে কিন্তু আমার তাকে বিয়ে করতে হবে ।“ একটু থেমে আবার বললো, “মা, পরীরা খুব সুন্দর হয়, তাই না !” লল্লনের মা তার কথার আগা মাথা কিছু বুজল না, নিজের কাজে ব্যস্ত হতে গিয়ে এমনি এমনি বলে দিল,”আচ্ছা যা, বইয়ে করগে, তুর যা ভাল্লাগে তাই করগে যা ।“ লল্লন হাতের কাঠিটাকে ললিপপের মতো চুষতে চুষতে নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল,”কি মজা কি মজা ! আমি পরীকে বিয়ে করব !” পরের দিন লল্লন কোথায় আছে কি করছে অতসব কেউ খোঁজ খবর রাখেনি, অন্যান্য দিনের মতোই সবাই যে যার মতো দিনাতিপাত করছে । এদিকে লল্লন বনে গিয়ে টিয়া পাখির লাল ঠোঁটের গল্প শোনে, স্বপ্ন বুনে । এই করতে করতে একদিন সত্যি সত্যিই একটা অপরূপ সুন্দরী পরী এসে হাজির লল্লনের সামনে । কি সুন্দর তার চেহারা ! জেমন গায়ের রঙ তেমনি গড়ন, যেমনটা সে গল্প শোনেছে, যেমনটা বইয়ে পরেছে । এ পরী যেন তার চাইতেও আরো অনেক বেশী সুন্দরী, কাছে এলেই একটা অসাধারন মিষ্টি গন্ধ লল্লনকে পাগল করে দেয় । পরীটার হাতে সব সময় একটা ছোট্ট কাঠির মতো থাকে, যার মাথায় একটা লাল রঙের তারার মতো লাগানো আছে, সেটা সব সময় মিট মিট করে জ্বলতে থাকে । পরীটা এসে লল্লনের কাছে বসে, হাসে , মিষ্টি করে কথা বলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, গান শোনায় আবার লল্লন কিছু খেতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে এনে দেয়, যা চায় তাই খেতে পারে । শুধুমাত্র একটাই সমশযা এই সুন্দর কথাটা লল্লন কারো কাছে বলতে পারে না, কেননা পরী আর টিয়া পাখি লল্লনকে সাবধান করে দিয়েছে, এ কথা কাউকে এমনি মা’কে বলা যাবে না, বললেই পরদিন থেকে হাওয়া হয়ে যাবে সবাই । লল্লন কাউকে বলেনি,বলবেও না কিন্তু একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছে সে, শুধু পরী’টা নয় এখন এই বনে যত পশুপাখি আছে সবাই তার বন্ধু । সবাই তাকে খুব ভালোবাসে । এতসব প্রানী যে এই ছোট্ট জঙ্গলে আছে বা থাকতে পারে সেটাও অবাক করে লল্লনকে । লল্লন দেখে হিংস্র শেয়াল এসে তার পাশে বসে, অজগর সাপ তার গা ঘেঁষে যায় , বাননের দল তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে । সেদিন একটা প্যাঁচা এসে কাধের উপর বসলো, মানুষের মতো করে কিছু বলার চেষ্টা করেছে অনেকক্ষণ বুজতে পারে নি সে । এভাবেই রঙীন স্বপ্ন মাখা বেশ কিছুদিন কেটে যাচ্ছে লল্লনের ঠিক সেই সময়ে টিয়া পাখিটা তাকে মনে করিয়ে দিল, পরীকে বিয়ে করার কথা । লল্লন যদিও মায়ের থেকে আদেশ নিয়ে রেখেছে তবুও ভাবনায় পরে গেল, সে তো দেখেছে, বিয়ে করলে বউকে ঘরে নিয়ে রাখতে হয় ,বউ ঘরের কাজ করে, ছেলেরা রোজগার করে এনে বউকে অনেক কিছু কিনে দেয় । লল্লন এসব ভাবনার কথা টিয়াকে জানায় । পরে পরী এসে তাকে আদর করে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বুজিয়ে দেয় এ বিয়ে সেরকম বিয়ে নয়, সে তো আর মানুষকে বিয়ে করছে না, তাই তাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না । এ পরীও সেই পরী নয়, এই পরীটি একটি অভিশপ্ত টিয়া পাখি ছিল, একসময়ে বন্দীনি ছিল, তখন সে বাড়িতে এক সাধুবাবা প্রবেশ করে, টিয়া পাখি অন্য সব মানুষের মতোই তার সঙ্গে খেয়াল মশকরা করতে করতে বলেছিল, “কি গো সাধুবাবা, বউ চুরি করতে এসেছো “ । সাধু রেগে গিয়ে সে সময়ে তাকে অভিশাপ দিয়েছে । সেই অভিশাপের কারনেই সে এখন পরী, সে যদি মানুষকে বিয়ে না করতে পারে তাহলে তার এই অভিশাপ থেকে মুক্তি হবে না । কতযুগ ধরে যে এই অপেক্ষায় আছে তার হিসেব নেই, শেষ পর্যন্ত তাই লল্লনকে পেয়ে ওরা খুশী । পরী জানিয়েছে, লল্লন যদি পরীকে বিয়ে করে , তাকে বাড়িতে তো নিতে হবেই না উপরন্তু সে বনের রাজার মতো এখানে যখন যা খুশী করতে পারবে, থাকতে পারবে, খেতে পারবে, আরোও কত কি ! লল্লন তো শোনে অবাক, ভেবে ভেবে পাগল হবার যোগার । আর কোন কথা না বাড়িয়ে সে পরীকে বিয়ে করার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকে তবে বোকা হলেও সে এরই ফাঁকে জানিয়ে রাখে প্রতিদিন রাতে সে ঘরে ফিরে যাবে এবং আর কাউকে না বলার শপথ দিয়ে মায়ের কাছে সব কথা বলবে সে । তবে পরী জানায়, বিয়ের সতের দিন পর্যন্ত এ কথা সে মাকেও জানাতে পারবে না । সতের দিনের মধ্যে ওদের বিয়ের সমস্ত রীতি রেওয়াজ শেষ হয়ে বাসর রাত হয়ে গেলে তারপরে জানালেও আপত্তি থাকবে না কেননা ততদিনে পরী যদি সন্তান সম্ভবা হয়ে যেতে পারে তবেই সে অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে আবার টিয়ার জীবন ফিরে পেতে পারবে । লল্লন কিছু ভেবে কিছু না ভেবে তার অপরিনত মস্তিষ্ক প্রসূত বুদ্ধি বিবেচনায় পরীকে বিয়ে করে ফেলে । বিয়ের রীতি রেওয়াজ দেখে তো তার চক্ষু চড়ক গাছ । যেমন অপরূপ সুন্দরী বিয়ের পাত্রী পরী তেমনি সুন্দর করে সাজালো আমাদের কার্টুন লল্লনকে । জাদুর মতন সব কিছু হাতের কাছে পেয়ে যায় সে । পোশাক, খাবার দাবার ইত্যাদি সব কিছু । শুধু একটাই দুঃখ বন্ধু বান্ধব কাউকে সঙ্গে আনতে পারে নি সে । তবে মনের কথা বললে সবাই বুজে, সামনে যে থাকে সে-ই বুজে , গরু-ছাগল-ভেরা-মহিষ-শেয়াল-কুকুর-হাঁস – মুরগ ইত্যাদি ইত্যাদি । না, এই বনে কোন কুমীর কিংবা বাঘ সিংহকে দেখতে পায়নি সে তবে একটা শঙ্খচিল এসেছিল, আর একটা গরুর পাখিকেও দেখতে পেয়েছে সে, বয়ষ্ক মানুষের মতো অভিভাবকের ভঙ্গিতে বসে থেকে বিয়ের কাজটা শেষ করে গেছে । লল্লন বুজতে পারছে কি সে কি করেছে ! নাহ, বুজা গেল না, কেননা শেষ করেই সন্ধ্যার আগে আগে লল্লন ঘরে ফিরে গেল । আজ তার একদম ক্ষিদে নেই । চেহারায় একটা উৎফুল্ল ভাব । মা তাকে বার বার খেতে ডাকলো, চেহারার ভঙ্গিমায় পরিবর্তন দেখে কারন জানতে চাইল, তবে লল্লন না ভাত খেল না কিছু বলল । লল্লন যেহেতু এখন আর পড়াশোনা করে না, কোন কাজ কর্মও খুব একটা করে না তাই বাড়ির অন্যরা লল্লনের খুব একটা খোঁজ খবর রাখে না । এদিকে সে ভোরের অপেক্ষায় থাকে, সকালের আলো ফোটতেই বনের দিকে যাবার জন্য মন আনচান করে উঠে । আজকে আরোও একটু বেশী ঘন জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল । না কোন ভয় নেই তার, কেননা পুরো জঙ্গলের শায়েনশা এখন সে । কোন বন্য জন্তুর ভয় নেই, খাবার দাবারের চিন্তা নেই , রাজকীয় আবেশে লল্লনের বেলা বাড়তে থাকে । পরী তাকে কাছে পেয়ে কত আদর যত্ন করতে থাকে । লল্লন একদিন বলেছিল, টিভিতে পিৎজা খেতে দেখে সে, তার খুব ইচ্ছা একদিন পিৎজা খাবে সে, লল্লনের পরী বউ তাকে পিৎজা খেতে দিয়েছে । কোলে করে উড়ে গিয়ে একটা বড় গাছের ডালে বসেছে , প্রথমে লল্লন যা ভয় পেয়েছে ! সারাটা দিন কি করে যে কেটে গেল টেরই পেল না সে । মায়ের বকুনি খেতে হবে জেনেই লল্লন খুব সন্তর্পনে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে । এভাবে সপ্তাহ কেটে গেল, ভাল ভাল খাবার খেয়ে, পরীর আদর যত্ন পেয়ে লল্লন এখন অনেকটাই পরিনত, সুস্থ, সৌষ্ঠব । পরী তাকে দিনে দিনে দুনিয়ার হাল হকিকৎ বাস্তবতা সব কিছু শেখাতে লাগলো, পাশাপাশি পরী জগতের অলৌকিকতার গল্পও শোনে সে । এভাবেই পনের দিন কেটে গেল ওদের ; এদিকে মায়ের যন্ত্রণায় অস্থির লল্লন । ছেলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে মা খুব চিন্তায় পরে গেছেন । একজন কবিরাজকে ডেকে এনে তাবিজ পরিয়ে দিয়েছেন গলায় । লল্লন কিন্তু তবুও কিছু বলে না বরঞ্চ বোধ বুদ্ধিতে পরিনত হওয়ার কারনে সে এখন কথাও বলে অনেক কম । মা কিন্তু ছেলের এই পরিবর্তনে অশুভ ঈঙ্গিত দেখে খুবই চিন্তায় পরে গেছেন, শুধু তাবিজ নয় এবারে বাড়ি থেকে বেড়োতে দিতে চান না । এদিকে পরী জঙ্গলে পাগল পারা হয়ে আছেন । ষোল দিনের দিন লল্লন কোন ভাবেই বাড়ি থেকে বেড়োতে পারল না কেননা বাড়িতে কি এক হোম যজ্ঞের আয়োজন করেছে মা, লল্লন যদিও জানে এসবে তার কিচ্ছু হবে না , আর মাত্র একটা দিন সুন্দর ভাবে কাটিয়ে আসতে পারলেই লল্লন আরেকটা নতুন জীবনের স্বাদ পাবে । পরী বলেছে সতের দিনের পরে সে আর আসবে না তবে লল্লনকে যেহেতু স্বামী রূপে গ্রহন করেছে সে তাই যতদিন পরী থাকবে ততদিন জঙ্গলে এসে তাকে ডাকলেই পেয়ে যাবে আবার সে যদি অভিশাপ মুক্ত হয়ে টিয়া পাখি হয়ে যেতে পারে তবে অবশ্যই লল্লনের সাথে সাথে থাকবে । ষোল দিনের শেষে রাতটায় কোন ভাবেই লল্লনের ঘুম আসলো না । পরের দিন ভোর হতেই কাউকে কিছু না বলে লল্লন ছুটে গেলো সেই বনের দিকে । পরী তাকে দেখতে পেয়ে খুব খুব আদর করলো, খুব কাঁদলো, তারপর তাকে নিয়ে গাছে গাছে উড়ে উড়ে গহীন বনে এক বট গাছে ছায়ায় বসে চোখের নিমেষে নরম তুলতুলে বিছানা বানিয়ে সারাদিন খুব খুব গল্প করল, পরী তাকে আদর করলো, সেও পরীকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভ্রিয়ে দিল । এখন লল্লন একেবারে সুস্থ সুন্দর যুবক । এই সতের দিনের ভিন্ন জগতে থাকতে থাকতে সে বুজে গেছে আগামীকাল থেকে সে যখন আবার সাধারণ ভাবে সাধারনের ভিড়ে মিশে যাবে শুরু হবে লড়াই সংগ্রাম , জীবন যুদ্ধ, এক সময়ে মনে হয় আমি যদি আগের মতোই থাকতে পারতাম তাহলে কি মন্দ ছিল ! আবার যখন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের কথা মনে হয় তখন আবার একটা ভীষণ ভালোলাগা এসে জড়িয়ে ধরে লল্লনকে । লল্লন ঘরে ফিরে গেল, সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক ছেলে হয়ে মায়ের কোলে ফিরে গেল সে, মা ঈশ্বরকে খুব খুব ধন্যবাদ জানালেন, কৃতজ্ঞতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বরের কাছে । কবিরাজের তাবিজ আর হোম যজ্ঞের অসীম ক্ষমতার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পরল । কিন্তু লল্লন সব কিছুর ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই বনে বাদাররে গিয়ে খুঁজে সেই টিয়া পাখিকে, খুঁজে বেড়ায় তার পরী বউকে কিন্তু পায় না । এভাবেই লল্লনের আগামী দিন আসতে থাকলো চলতে থাকলো, সে যখন মায়ের কাছে তার পরীবউয়ের গল্প করলো , মা ‘আলগা বাতাস’-এর থেকে মুক্তির জন্য বার বার ঈশ্বরকে আর কবিরাজকে ধন্যবাদ জানাতে থাকলো । বছর পাঁচেক পরে লল্লন যখন সুন্দর টুকটুকে একটা বাচ্চার বাবা হলো তখন বাড়ির উঠানের কোনে একটা ডালিম গাছে এসে বসলো একটা খুব সুন্দর টিয়া পাখি, শিশুটা আদো আদো করে বলল,’বাবা, বাবা ঐ দেখ একটা টিয়া”।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ১৭/০৮/২০২৫চমৎকার উপস্থাপন। মুগ্ধতা রইলো।