www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ঈদের দিনে

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঈদের দিন সকালে টিভি অন করতেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার নিউজটা দেখে কেমন জানি অথর্বের মতো হয়ে গেলাম। মাথার ভিতরে সব বোধ জট লেগে গেলো। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এতোগুলি তাজা প্রাণ! এ কোন বর্বরতার ইতিহাস লিখতে যাছে পৃথিবী? তবে কি স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের অহংকার পরিহাস করতে শুরু করেছে বীর বাঙ্গালীকে? সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ আর কোন দাওয়াত রক্ষা করতে যাবোনা। কোথাও বের হবোনা। কিন্তু দুপুরের পর বুকের মধ্যে কেমন একটা অস্থিরতা বাড়তে থাকলো। দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। ঘরের ভিতর যেন দম আটকে আসবে। তারপর হুট করেই বেড়িয়ে পড়লাম। শম্ভুগঞ্জ ব্রীজের মোড় থেকে একটা ভীড়ে ঠাসা বাসে উঠে গেলাম।

দুই ঘন্টার জার্নি করে চলে এলাম শহর থেকে অনেকটা দূরের অজপাড়া এক গাঁয়ে। এটা সেই নীল-সবুজ প্রজাপতিদের গ্রাম। যাদের গল্প গত বছর লিখেছিলাম। তখনই কামাল ভাইয়ের(ছদ্মনাম) সাথে আমার পরিচয়। যে পেশায় একজন দিনমজুর। বছরের বেশিটা সময় রিকশা চালিয়ে আর মৌসুমে ধান কেটে তার আয়। সেইবার সারাদিন ধরে গ্রামের পথে হেঁটে, কখনো ডিঙিতে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছি। আর হটাৎ করেই গল্পে গল্পে সে আমার এসিস্ট্যান্ট হয়ে গেলো। অগ্রিম ঈদ দাওয়াতও পেয়েছিলাম সেই সময়েই। কিন্তু এভাবে চলে আসবো, তা সত্যি কখনো ভাবিনি। আসার আগে তাকে জানানোর মতো কোন সুযোগও পাইনি। গন্তব্যে পৌঁছতে তখনো প্রায় তিন মাইল বাকি। এদিকে গত দুদিনের ভারি বর্ষণে মেঠো পথ জায়গায় জায়গায় কাদার পুকুর। রিকশা চলাচল বন্ধ। অগত্যা জুতা জোড়া বগলদাবা করে, কাদার রাজ্য ভেঙে হাঁটা দিলাম। রাস্তার দুই পাশে তাজা সবুজের পশরা সাজিয়েছে প্রকৃতি। কখনো দুদিকে বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত, আবার কখনো নদীর কিনারা ঘেঁষে মেঠো সরু পথ চলেছে। নদীতে বানের জল থৈথৈ করছে। সেই জল কেটে মাঝে মাঝেই চলে যাচ্ছে ছোট বড় ট্রলার। প্রকৃতি যেন তার সব রঙ রূপ দু'হাত উজার করে দিয়েছে এই গাঁয়ে।

অনেকটা আচমকাই কামাল মিয়ার অতিথি হয়ে গেলাম। নদীর ধার ঘেঁষে এক চিলতে জমিতে দিনমজুর কামাল ভাইয়ের ছোট্ট বসতবাড়ি। জায়গা কম হলেও বেশ সাজানো, গোছানো। তাও নিজের জায়গা নয়। বাপ-দাদার আমল থেকে স্থানীয় একজন দয়াবান ভূস্বামীর আশ্রিত তারা। যাই হোক, সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো যখন কামাল মিয়ার বাড়িতে পৌঁছলাম। নদীর ওপাড়ে নীল আকাশে, অস্তরবির মিস্টি লাল-কমলা আভা। বাড়িতে ঢুকতেই চারদিক থেকে অনেক ছানাপোনা এসে জড়ো হলো। কিছু মধ্যবয়স্কা ও বৃদ্ধাও এসেছিলেন। তাদের কারো কারো কৌতূহলী মুখ দেখে মনে হলো, এমন মেঘলা বাদলা দিনে, এরকম বেহাল অবস্থায়, শহুরে এক আগন্তুককে দেখে তারা কিছুটা চিন্তিত। আমি তাদের সামনে এগিয়ে গেলাম ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। আর কাছে যেতেই শিশু, বৃদ্ধা সব আড়ালে চলে গেলো। মূহুর্তেই হাওয়া। এর মধ্যেই কামাল ভাই আমার ফ্রেশ হওয়ার জন্য যে আয়োজন করেছে, তা দেখে প্রায় মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। দুই রকমের সাবান, গরম ও ঠান্ডা জল, নতুন গামছা, নতুন মগ। আর দুটো সানসিল্কের স্যাশে। আমি একটু হেসে কামাল ভাইকে বললাম, "ভাই নদীতে স্নান করা যাবে? অনেকদিন নদীতে নামিনা"। সে যেন একথা শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়লো। যাই হোক, তার অঙ্গভঙ্গিতে বুঝলাম, তার জিম্মায় থাকতে এই উপচে পড়া ভরা নদীতে নামা কিছুতেই সম্ভব নয়। অগত্যা আর কোন উপায় নেই বুঝতে পেরে নির্বিবাদে বাড়ির কর্তাকেই অনুসরণ করা!

গিয়েছিলাম এক কাপড়ে। কলপাড়ে কামাল ভাই এসে একটা নতুন কড়কড়ে লুঙ্গী আর ভাঁজ না ভাঙ্গা সাদা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়ে গেলো। পরে জানতে পারলাম, এগুলো না-কি দু'বছর আগে ঈদ উপলক্ষে নিজের জন্য কেনা হলেও, আগামীদিনের প্রয়োজনের কথা ভেবে তাঁর আর পড়া হয়নি। এই আন্তরিক ঔদার্যে আমি সত্যি খুব আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লাম। এইযে আদর, এতো যত্ন, নিখাদ ভালোবাসা- এইসব মানবিক রীতি, তা বাংলার সরল জীবন ছাড়া পৃথিবীর কোন প্রান্তে আর কোথাও কল্পনা করা যায়না।
প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম। সিলভারের নকশা আঁকা প্লেটে চালের গুড়ার নরম সাদা রুটি। ডিম, নারকেল, দুধ দিয়ে আশ্চর্য রকমের সুস্বাদু সেমাই, আর শেষে পোলাও ও কষা মুরগির মাংস দিয়ে পেট ভরে খেলাম। এ বাড়িতে টিভি নেই, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট নেই। জীবন এখানে বিশালাকায়, বৈচিত্র্যময়। সন্ধ্যা নামতেই মাটির উনুনে লাকড়ির আগুন, কাঁচা বারান্দায় লম্বা শিখার সলতে বাতি। বারান্দায় বেতের চাটাই পেতে ছোটদের লুডো খেলা। এখানেই কি শান্তির ঈশ্বর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছেন?

এতো সব সুখাদ্য পরিবেশনের পড়েও তাদের যে আমাকে খাইয়ে আত্মতৃপ্তি হয়নি, সে কথা বারবার তাদের মুখে ফিরছিল। সেই বিনয়ে কোন অভিনয় নেই। নেই কোন অতিরঞ্জন। এটাই গ্রাম বাংলা। এটাই বাংলার মুখ। কামাল ভাইয়ের পরিবারে তারা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও তাদের দুটি ছেলেমেয়ে রয়েছে। তারাও বাপমায়ের মতোই। এই গাঁয়ের মতো সরলতায় পরিপূর্ণ। খাওয়াদাওয়ার পর তাদের সাথে ছবি তোলা হলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম আর গল্পগুজবের পর বিদায় নিতে গেলাম। সে কথা বলতেই কামাল ভাই দরজার চৌকাঠের উপর বসে পড়লো। তার একান্ত নিবেদন, রাতে নদীর তাজা মাছ আর ডাল ভাতের আয়োজন হচ্ছে। রাতে চারটে খেয়ে পরের দিন সকালে যেতে হবে। এতোকিছু খাওয়ার পর যা আমার জন্য রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। এদিকে কামাল ভাইয়ের ছয় বছর বয়েসি মেয়ে ইয়াসমিনের আধোআধো কথা শুনে, আমার তিনমাস বয়েসি ছোট্ট পিদিমের কথা মনে পড়ে গেলো। এখনি যেতে হবে আমাকে। আবার কেমন জানি সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। আমি যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে, কামাল পরিবারের কাছে নিজের মানসিক অবস্থা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, বাচ্চাদের সামান্য কিছু উপহার দিয়ে রাত দশটায় বিদায় নিলাম।

এদিকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমি যাবো মেয়ের কাছে, তার মামাবাড়িতে। জায়গাটা এখান থেকে প্রচলিত পথে দশ মাইল। কামাল ভাই জানালো একটা সংক্ষিপ্ত পথ আছে। সেই পথে সাত মাইল। তার মধ্যে তিন মাইল নৌকায়। আর বাকিটা হেঁটে। কিন্তু এতো রাতে তার উপর ঈদের দিন ওদিকে নৌকা পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। আবহাওয়াও অনুকূল নয়। কামাল মিয়া এক মূহুর্ত চিন্তা করে নিজের রিকশা বের করে ফেললো। আমার খুব খারাপ লাগছিলো এই রাতে তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু কামাল মিয়া তার সিধান্তে অনড়। আমি বললাম, "আসার সময় এতো রাতে যাত্রীও পাবেন না। তাছাড়া বৃষ্টি বাদলার দিন বিপদ-আপদ কতো কি হতে পারে"। এসব কিছুই কানে না নিয়ে আমাকে রিকশায় উঠে বসতে বললো সে। আমরা বিদায় নিয়ে রওনা হলাম। পনেরো মিনিট চলার পর জোড় বৃষ্টি নামলো। সাথে প্রবল বাতাস। বাতাসের উলটো দিকে এগুনোই মুশকিল। বাধ্য হয়ে একটা গাছের তলায় রিকশা থামানো হলো। দুজনেই পলিথিনে ঢেকে সিটে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থামলে, হ্যারিকেনের মিটিমিটি আলোতে, অন্ধকারের বুক চিরে আবার চলতে শুরু করলো তিন চাকার রিকশা। ছয়-সাত মাইল যাওয়ার পরে কাঁচা রাস্তা আর চলার উপযোগী থাকলোনা। রিকশার চাকা আঁঠালো কাদায় ঘনঘন ডেবে যাচ্ছিলো। লোকটা সর্বশক্তি দিয়ে রিকশাটা টেনে যাচ্ছে। আমি একপর্যায়ে তাকে থামালাম। আমার শ্বশুরবাড়ি ওখান থেকে আর মাইল তিনেক দূর। তাকে ফিরে যেতে বললাম। বললাম এখান থেকে আমি একা চলে যেতে পারবো। আমার 'না' উপেক্ষা করে আরো মাইল দুইয়েক যাওয়ার পর বহু অনুরোধ করে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে ফেরত পাঠালাম।

ঘড়িতে তখন রাত একটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। মাথার উপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগে জুতো। খালি পায়ে জল কাদা মাড়িয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছি। চারদিকে ঘনকালো অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়ার উপায় নেই। মাঝে মাঝে পিছলে পড়ার ভয় হচ্ছিলো। মোবাইলের ফ্লাশলাইটের আলোতে যতদূর দেখা যায় শুধু জমা জল। জলে ঘামে একাকার হয়ে বাড়ির উঠোনে এসে দেখি, সব ঘুমে বিভোর। ঘরের দরজায় নক করতে যাবো এমন সময় মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। সে কি বুঝতে পেরেছে আমি এসেছি? তখনি মনে পড়লো কামাল মিয়ার মেয়ে ইয়াসমিনের কথা। এই ঈদের দিনে ঝড়-বৃষ্টির রাতে, সেও হয়তো বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। কতদূর গেলো কামাল মিয়া? রাস্তায় কি কোন সমস্যা হবে?

এসব ভাবতে ভাবতে তখন প্রায় তিনটা বেজে গেছে। ভোরের পাখিরা ডাকছে। একটা দুটো নয়। অনেক পাখি এক সঙ্গে। হটাৎ খুব গর্ব হতে লাগলো এই দেশটার জন্য। এই কামাল মিয়াদের জন্য। এরা আছে বলেই আজ আমি এই দুর্যোগের মধ্যেও আমার সন্তানের কাছে আসতে পেরেছি। এই কামাল মিয়াদের সততা, স্রলতা, বিনয়, শ্রমে আর ঘামে দেশটা আজও এতো সুন্দর। এতো সবুজ আর প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা। ভালো থেকো কামাল ভাই। তোমরা যতোদিন থাকবে, বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতার 'লাল সবু্‌জ' ডানা মেলে বুক ফুলিয়ে উড়তে থাকবে।

©সুব্রত ব্রহ্ম
৯ই জুলাই, ২০১৬ ইং:
ময়মনসিংহ।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৪৭৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/০৩/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • শ.ম. শহীদ ০৫/০৪/২০২১
    খুব ভালো লাগলো কামাল মিয়ার গল্প। এই কামাল মিয়াদের জন্যই দেশটা এতো সুন্দর!
  • outstanding...
  • ঈদের খুশি
    জীবন বুঝি।
  • বেশ ভাল লেখা
  • Outstanding
  • ফয়জুল মহী ২৫/০৩/২০২১
    কমনীয় ভাবনায় যাদুকরী উপস্থাপন । মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম লেখাটা।
 
Quantcast