www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অব্যাক্ত

জীবনের নানা উত্থান-পতন পেরিয়ে,আক্ষেপ,অভিমান,বিরহ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হরিপদের নিঃসঙ্গ জীবন।তার জীবনেও স্বপ্ন ছিলো আর দশটা মানুষের মতো বাঁচার,শান্তিতে ঘুমোনোর।কিন্তু নেশার অমোঘ ঘোর তাকে শেষ অবধি সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বুক থেকেই।তারপর,হরিপদের বয়ানেই শোনা যাক বাকী কথা।

চেয়ারম্যান সাবের লগে আমার মাখামাখি সম্পর্ক।আমি আমার এলাকার মেম্বার।এজন্যিই হয়তো।চেয়ারম্যান সাব যে কোনো সালিশ-বিচারে তো লয়া যান ই লগে স্পেশাল কোনো দাওয়াত থাকলে আমারে লয়া যাইতে ভোলেন না।একদিন চেয়ারম্যান সাবের সহকারী অশোক খবর লয়া আইলো চেয়ারম্যান সাব ডাকসেন।গিয়া দেখি এলাহী কান্ড।চেয়ারম্যান সাব মোটা কাপড় দিয়া প্যাঁচায়া সুখ নিতাসেন।আমারে দেইখাই চেয়ার আনতে কইলেন অশোক রে।বসামাত্রই মোটা কাপড় দিয়া প্যাঁচায়া সুখ নিতে আগায়া দিলেন আমার দিকে।আমি আর কোনোদিন সুখ লই নাই।ডর ডর লাগতাসিলো।সুখ কি জিনিস সেটা পয়লাবার বোঝার জন্যি ২ টা হেঁচকা টান দিসিলাম।হাত-পা কাঁপা শুরু করসিলো।চেয়ারম্যান সাব বড় বিচক্ষণ মানুষ।লগে লগে অশোক রে দিয়া আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা কইরা দিলেন।একটু উন্নতি হইলে অশোক ই বাড়ি দিয়া আসছিলো ঐ রাইতে।
ঈশ্বরের কী লীলা!ঐ বছরই চেয়ারম্যান সাব মইরা গেলেন।আবার নির্বাচন হইলো।নতুন চেয়ারম্যান!নতুন চেয়ারম্যান সাব ও আমারে বড় ভালোবাসতেন।তিনি আমারে আগের চেয়ারম্যান সাবের চেয়ে আরো বেশি ডাকতেন।আর সুখ নিতে তো ডাকতেন ই।ইউনিয়ন কাউন্সিলে আমার মেম্বারির মেয়াদ শেষ হওনের পর রাজনীতির মাঠ থাইকা নিজেরে সরায়া নিলাম।ধরলাম ব্যবসা।
চেয়ারম্যান সাব ও আর ডাকে না।ব্যবসার সুবাদে বহুত লোকের লগেই উঠাবসা করি।এদের মধ্যে অনেকেই মোটা-পাতলা কাপড়ে প্যাঁচায়া সুখ লয়।
আমিও তো সুখ নেওয়া দলেরই।প্রথমবার যখন সুখ নিসিলাম বুকে একটা চিনচিন ব্যথা উঠসিলো,হাত-পা কাঁপসিলো।বাড়ি ফিইরা বউয়ের লগে একটা কথাও কই নাই।সোজা ঘুমায়া গেসিলাম।
আহারে মেয়েমানুষ!আহা!
স্বামী নেশায় বুদ হয়া বাড়ি ফিরলো আর সে অঘোরে ঘুমাইতেছে।
রতন দা,জানোই তো গতবছর ই বিয়া করসিলাম।বড় মায়াবতী আছিলো বউডা!লম্বা চুল,হরিণের মতোন চোখ।তোমার বৌদিরে তো দেখছোই রতন দা।হাতে টাকাপয়সা যা আছিলো সব ব্যবসায় খাটানোর জন্যি সংসারে অভাব,ক্যাচক্যাচানি লাইগাই থাকতো।বউয়ের লিগা ভালোবাসা ঠিকই আছিলো।কিন্তু অভাব থাকলে কি আর ভালোবাসা থাকে রতন দা?বুঝোই তো মেয়ে মানুষের কত আবদার।।
যাই হোক রতন দা,ঐ যে মাধবীলতার কথা কইসিলাম না তোমারে?ওরে ভুলতে পারি নাই কখনোই।ভার্সিটি পাশ দিয়া যখন গ্রামে ফিইরা আইলাম তখন মাধবী আমারে ছাইড়া দিসিলো।বিয়াও করসিলো গোপনে।আমারে কয় নাই।বউ যত সুন্দরীই হোক,মন পইড়া থাকতো মাধবীর কাছে।কিন্তু তোমার বৌদিরে কোনোদিন ঠকাই নাই রতনা দা!কোনোদিন ই মাধবীর লগে দেখা করি নাই।ওর ঠিকানা যেহেতু জানতাম,চাইলে অবশ্যিই পারতাম।কিন্তু এইটা করলে তো তোমার বৌদি রে ঠকানো হইতো,তাই না?
হরিপদের প্রতি রতন দা'র প্রশ্নঃমাধবী দি রে বিয়ে করলেন না কেন কর্ত্তা,শেষ পর্যন্ত একটা কিছু তো হইতোই।
কি যে কও রতন দা!ব্যবস্থা হইতো?না,হইতো না।বাপ-মা মইরা গেসে,চাচা-জ্যাঠার ঘরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ হইসি।কেমনে ব্যবস্থা হইতো রতন দা?যারে এতো ভালোবাসি চোখের সামনে তার কষ্ট তো দেখতে পারুম না রতন দা।
যাই হোক,বাদ দেও।লও,সুখ লই।দুঃখবিলাস আমারে শোভা পায় না।

মাস তিনেক পর হরিপদের স্ত্রী কানন দেবী কি এক বিরল রোগে ভোগে মারা যান।তারপরঃ
এখন আর অনিয়মিত সুখ নেই না,নিয়মিতই নেই।বুকে ব্যথা উঠে না,হাত-পা কাঁপে না।আর অস্বস্তি?
কি যে কও রতন দা!
ঐসব ভাবনের সময় পাই কই?বড় বড় ব্যবসায়ী লোকজনের লগে উঠাবসা করি।আমি নিতান্ত ছোড ব্যবসায়ী।তারা ডাকলেই যাইতে হয়।বুঝলা,রতন দা?
তুমি কি খেয়াল করসো রতন দা?ইদানীং বাড়িতে সুখ নেই না তেমন একটা।কাস্টমার আছে একজন,তার লগেই বেশি সুখ নেই আজকাল।মাঝেমধ্যে যখন দেখো দরজা-জানালা বন্ধ কইরা একলা ঘরে বইসা আছি,বুঝবা সুখ নিতাছি।এখন সুখ নেওয়ার পরে কি যে আনন্দ পাই,রতন দা!দুনিয়ার আর কোনো সুখের লগে মিলাইতে পারবা না।অবশ্যি কালেভদ্রে ডাল-বীজ এগুলা থাকে।শক্তি থাকে না।তবুও কাস্টমার তো লক্ষী।লক্ষী ধইরা রাখতে ঐগুলা লইতে হয়।কিন্তু যেইদিন ডাল-বীজ কম থাকে,শক্তি বেশি থাকে।বড় শান্তি পাই।
এই দেখো রতন দা,কইতেই ভুইলা গেসি।ঐ দিন চেম্বার অব কমার্সের মিটিং আছিলো।রাঘব-বোয়াল ব্যবসায়ীদের লগে দেখা।শালারা থাকেই সুখের খোঁজে।হয় নেশা নয় নারী।প্রচুর পয়সার প্রভাব,বোঝো তো।
শুয়োরের বাচ্চা এক একটা।যাক গে,ঐখানে মোটা-পাতলা দুই কাপড়ে প্যাঁচায়াই সুখ নিছিলাম।ঐ সব তুমি বুঝবা না।এইসব মিটিং বিরাট ব্যাপার।ঐ মিটিংয়ে বন্ধুর সুবাদে এক বড় ব্যবসায়ীর লগে পরিচয়।ব্যবসাপাতি খারাপ যায় শুইনা তিনি কি এক তেলেসমাতি কারবার করলেন,আমিও জানি না।হুট কইরা ব্যবসা বাড়া শুরু হইলো।এখন শহরের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকানটা আমার,একাই দেখতে হয় সব।কাজের চাপ কতো বুঝতেছো রতন দা?নিজে খুঁইজা জিনিসপত্র জোগাড় কইরা সুখ লওয়া হয় না।
এই দেখো রতন দা,সুখ লইতে লইতে আবার মাধবীর কথা মনে পইড়া গেলো।তুমি কইতেই পারো যে,মাধবী রে যেহেতু ভুলতেই পারি নাই তাইলে তোমার বৌদি রে বিয়া কইরা আনসিলাম কেন?জানো তো,পুরুষদের সব মানতে হয়,সব দুঃখ কইতে নাই?আমারও হইসিলো সেই দশা।এই আইজকার দিনে,হ,হ-আইজকার দিনেই মাধবীর বিয়া হয়া গেসিলো।শুনছিলাম,গঞ্জে জামাইয়ের মুদির ব্যবসা আছে।হঠাৎ মাধবীর কথা মনে পড়তাসে।আরোও একটু সুখের ব্যবস্থা করো রতন দা।
আহা!রতন দা।সব রঙিন লাগতাসে।কোনো দুঃখ নাই,পিছুটান নাই।আমি ছাড়া কেউ নাই আমার।
রতন দা,ও রতন দা,মনে রাইখো আমি মানুষটা ভালো কি খারাপ আমি মরার পর জানবা।
আক্ষেপ,বাবা-মা হারানোর দুঃখ,অভিমান,অকালে স্ত্রী হারানো নাকি মাধবী হরিপদের নেশাগ্রস্ত জীবন বেছে নেওয়ার পথ খোঁজা গল্পের জন্ম দিয়েছে তা স্পষ্ট নয়।তবে যাইহোক,প্রকৃত অর্থে হরিপদ যথেষ্ট মানবিক ই ছিলেন।কোনো গরীব ই কোনোদিন তার দরজা থেকে ফিরে যায় নি,দান-দক্ষিণায় ও ছিলেন মুক্তহস্ত।
নেশায় বুদ হয়ে থাকা,ব্যবসার চাপ সব মিলিয়ে কাটছিলো হরিপদের নিঃসঙ্গ,বিষন্ন দিনগুলো।
মাস তিনেক পরে হরিপদ ও রতন দা'র কথোপকথনঃ
"রতন দা,আজকাল গলাটায় খুব জ্বলে।বুকে খুব ব্যথা।কাশির সাথে রক্ত পড়ে।ভাবতাসি কালকে ডাক্তার দেখাই,কি কও তুমি রতন দা?"
রতন দা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
ডাক্তারের দেওয়া পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর হরিপদ যা দেখলো,তা দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না একদম।রিপোর্টে লেখাঃ
নামঃহরিপদ মুখার্জ্জি,বয়সঃ৩৫,রোগঃথাইরয়েড ক্যান্সার।
ডাক্তারের ভাষ্যমতে হরিপদের হাতে বেশিদিন নেই আর।টেনেটুনে ১৫ দিন বড়জোর।রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলো হরিপদ।রতন দা কে বিদায় করে দিলো।শেষ দিনগুলোতে দরজা বন্ধ করে একা ঘরে শুধু মৃত্যুর প্রহর গুণতো হরিপদ।
মাধবী!মাধবী জানতে পেরেছিলো হরিপদের অসুখের কথা।বাড়ি ফেরার ২-৩ দিন পর স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে হরিপদ কে দেখতে এসেছিলো।শত ডাকাডাকির পরেও হরিপদ দরজা খুলে নি।শুধু ভেতর থেকে এতোটুকু বলেছিলো 'চলে যাও,কেন এসেছো?আমার শবদাহের সময় একবার এসো।আমার মৃত্যুতে কাঁদবে তুমি?কাঁদলে কেঁদো।আমার মৃত্যু তোমায় কাঁদিয়েছে এই তো আমার পরম পাওয়া।আমার আত্মার শান্তি।এখন চলে যাও।জামাই জানতে পারলে খারাপ কিছু হয়ে যাবে।'
বেচারি অপেক্ষা করে চলে গেলো।বাড়ি ফেরার ১৪ দিনের মাথায় হরিপদ বদ্ধ ঘরে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলো।কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন।সে দেখছিলো,একটা সাদা আলো তার দিকে এগিয়ে আসছে,সে আলোটাকে ধরতে চাইছে।সেই আলোতে শান্তি আছে।পার্থিব কিছু নেই।
ইহলোক ত্যাগ করলো হরিপদ।
মাধবীকে এই খবর দিয়েছিলো রতন দা।রতন দা মুখাগ্নি দিচ্ছিলো সময় মাধবী বিলাপ করছিলো রীতিমতো স্বামী-সন্তানের সামনেই।চোখের সামনে প্রাক্তনের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার শোকের ছায়া কেমন করে ছোঁয় অপর জনকে তার নিদারুণ উদাহরণ।
আহারে হরিপদ!আহারে মাধবীলতা!
একজন সব হিসেব চুকিয়ে গেলো জীবন দিয়ে অন্যজনকে দিয়ে গেলো আমৃত্যু শোক।
মুখাগ্নি করা শেষ,শবদাহ হবে এমন সময় একদল লোক এসে হাজির।মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখে আনা কিছু একটা মোড়কে বাঁধাই করে নিয়ে এসেছেন উনারা।রতন দা অতোদূর পড়াশোনা করে নি।বুঝতে পারছিলো না কি লেখা আছে।মাধবী লোকগুলোকে বলছিলো মোড়ক খুলতে,পড়বে বলে।লোকগুলোর উত্তর ছিলো শবদাহ হয়ে যাক,গোড়ের পাশে লাগিয়ে দেয়া হবে সময় সবাই দেখতে পাবেন।শবদাহ শেষ,হরিপদের গোড়ের পাশে লাগানো হলো মার্বেল পাথরে খোদাই করা সেই লেখা।যাতে লেখা আছে,
'Here,Here is sleeping SHREE HARIPAD MUKHARJEE.He,who loved someone of us from his very core of heart,but the one has ignored him,left him,killed him.
REST IN PEACE,DEAR'

লেখাটা পড়ে মাধবী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো।একফোঁটা ও পানি পড়ছিলো চোখ থেকে।হরিপদের মারা যাওয়ার তিনদিনের মাথায় স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি করে এসেছিলো।বদ্ধ জীবন,নিঃসঙ্গতা,পিছুটান হীনতা,সুখ ও নেই।
থাকার মধ্যে আছে কেবল হরিপদের স্মৃতি।
মাধবীলতা এতোদিন পর এসে বুঝলো সময় বদলায়,প্রেক্ষাপট বদলায়,কিন্তু সম্পর্ক?সম্পর্ক চিরনতুন।কক্ষনো বদলায় না,কক্ষনো না।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২২৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/১০/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast