www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অপেক্ষা

আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল খুব সকালে উঠে ব্যায়াম করা আর গানের রেওয়াজ করা। খুব সকালে উঠতে মন চাইতো না একদমই, তবুও রুটিনের বাইরে তো যেতে পারতাম না। বাবা বলতেন, "রুটিন জীবন, রুটিন মরণ।" তাই ঠিক সকাল সাড়ে ছ'টা বাজলেই অ্যালার্ম বেজে উঠতো, আধ ঘণ্টা হাত পা নাড়িয়ে আর এক ঘণ্টা সারেগামা করার পর একটা কর্মব্যস্তময় দিনের সূচনা হতো।

সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

আমি ব্যায়াম করার পর অনলাইনে গেলাম একটু। সকাল সকাল তেমন কিছু থাকে না অনলাইনে, ম্যাসেঞ্জারে দেখলাম একটি ম্যাসেজ রিকুয়েস্ট এসেছে, "হ্যালো, আপনার সাথে কি কথা বলা যাবে?"

আইডির নাম শুনলে আপনিও অবাক হবেন (হাসবেনও বটে), "অচেনা রাজকন্যার অপেক্ষায়।" আমি ভাবলাম রিপ্লাই দেয়া যায় কিনা বা দিলেও কি রিপ্লাই দেয়া যায়। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর লিখলাম, "কেন? কে আপনি?" ভাবলাম ওকে আজকে জব্দ করবো, ক'জন অচেনা রাজকন্যাকে এভাবে ইনবক্সে নক দিয়েছে বের করে ছাড়বো।

ওর রিপ্লাই এলো দুপুরের পর, "আমি একজন মানুষ আরকি।"

ইসস! উত্তর শুনে আমার যেন মরে যেতেই ইচ্ছে হলো। লিখলাম, "আশ্চর্য! গরু-ছাগলও কি ম্যাসেঞ্জার চালায় নাকি? সেটা আগে জানতাম না!"
- ভালো সেন্স অব হিউমার তো আপনার।
- হা হা। এখন বলুন কেন নক দিয়েছেন।
- কেন? নক দিতে কি কারণ লাগে সবসময়?
- না লাগে না। কিন্তু আপনি তো আমার পরিচিতও নন। তো আমার কারণ জিজ্ঞেস করাটা কি স্বাভাবিক নয়?
- আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে। তাই নক দেয়া।
- দেখুন আমি কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার আইডিটাও ফেইক। কে বলুন তো আপনি? আমার পরিচিত কেউ নয় তো?
- ওকে ওকে রিল্যাক্স। আমি আপনার পরিচিত না হলেও আপনি আমার পরিচিত। আপনার আইডি আমি বহু কষ্টে খুঁজে পেয়েছি। থাক সে কথা, পরে একদিন বলবো সে কথা।
- আমি জানতে চেয়েছি আপনি কে? এতকিছু শুনতে চাইনি। পরিচিত না হলে পরিচয় দিন।
- অমিত্রাক্ষর।
- অমিত্রাক্ষর? আপনার নাম?
- হ্যাঁ। ডাকনাম অমিত্র।
- বেশ। তা আপনার আইডির এমন নাম কেনো?
- আসলে নিজেকে পাবলিকলি প্রকাশ করাটা পছন্দ না।

সেই ছিল অমিত্রের সাথে আমার প্রথম কথোপকথনের কিছু অংশ। দুইদিন বেশ কথা বললাম, সে আমাকে টুকটাক ভয়েস ম্যাসেজ দিতো। ওর সম্পর্কে আরো জানলাম, এত সুন্দর করে ম্যাসেজ লিখে ছেলেটা কি বলবো, যেন প্রতিটি ম্যাসেজই একেকটা আর্ট। আর ওর কন্ঠস্বর এতই ভরাট, এতই পরিণত ছিল যে প্রথম শুনে যেকোনো মেয়েরই বুক ধড়াক করবে এটা আমি বাজি রেখে বলতে পারি। সত্যি বলতে এই দু'দিনেই তার প্রতি একটা ভালোলাগার ব্যাপার কাজ করছিলো। জানিনা ভালোলাগাটা আসলে তার প্রতি নাকি তার ম্যাসেজ লেখার স্টাইল, বা কন্ঠের প্রতি। ছেলেটাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।

সেদিন রাতে আমি বললাম, "আপনার একটি ছবি দেবেন?" খুব লজ্জা করলো, তাও বললাম। সম্ভবত আমিই প্রথম মেয়ে যে কিনা ইনবক্সে কোনো ছেলের কাছ থেকে ছবি চেয়েছিলাম, কে জানে!

সে বললো, "হ্যাঁ দেবো, তবে আজ নয়। আপনার সাথে আগে আমার একটা কনভার্সেসন দরকার। মানে কল দিয়ে কিছু কথা বলবো, যদি আপনি কিছু মনে না করেন!"

আমি অতি কৌতুহলী হয়ে পড়লাম, কিন্তু তবুও কৌতুহল নিয়ন্ত্রণে রাখলাম, "হ্যাঁ, কিছু মনে করবো কেনো? চাইলে এখনি দিতে পারেন কল।"

সেই রাতে আকাশে অর্ধচাঁদের মৃদু জ্যোৎস্না ছিল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে অবলোকন করছিলাম চাঁদ, আকাশ, মেঘ। বাতাসে কি এক অজানা ঘ্রাণ ভেসে আসছিলো, মিষ্টি ভীষণ! অনেকক্ষণ চিন্তা করেও বুঝতে পারলাম না কিসের ঘ্রাণ। চিন্তায় ছেদ পড়লো ম্যাসেঞ্জার রিংটোনের আওয়াজে, দেখলাম অমিত্রের কল। কথা হলো আমাদের প্রায় দু ঘণ্টা। যা জানলাম, যা বুঝলাম, তা হলো, অমিত্র আমাকে ভালোবাসে আজ দু বছর ধরে। কোনো একটা ফাংশনে আমার গান শুনেছিলো। সেই থেকে আমার খোঁজ করেছে অনেক। এতদিনে পেয়েছে! আহা! বেচারার জন্য একটু দুঃখ হতে লাগলো। তবে অমিত্রের কথা শুনে আমার একটুও মনে হয়নি যে সে কোনো কিছু বানিয়ে বলেছে। জানিনা কেন মনে হলো, মনের সাথে মনের যোগাযোগ নামে একটা ব্যাপার আছে বোধহয়।

আমি কলে কিছু বলতে পারলাম না, লজ্জায় নাকি সাহসের অভাবে জানিনা। আমি লিখেই দিলাম, "আসলে এই কয়েকদিনে আমিও আপনার কথাবার্তা, ব্যক্তিত্বের ভীষণ প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আপনাকে দেখিনি কখনো, আপনি বাস্তবে কেমন তাও জানিনা। তবুও আমিও যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলছি, এ কথা আমি অস্বীকার করতে পারবো না মোটেই। আপনার ছবি এখন না দেখালেও আমার সমস্যা নেই। চেহারায় আর কি আসে যায়!"

সে শুধু বললো, "শুভরাত্রি। বিদায়।"

আমি ঘুমাতে গেলাম, ঘুমানোর আগে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে মনে হলো। ভাবলাম একটু আগে অমিত্রের সাথে আমার কথোপকথনের কথা। এত সুন্দর করে কেউ প্রেম প্রকাশ করতে পারে, তা আমার ভাবনাতে ছিল না।

সকাল সকাল উঠে পড়লাম, সেই প্রতিদিনকার রুটিন অনুযায়ী। ব্যায়াম, রেওয়াজ ও অন্যান্য কিছু কাজ করার পর টিভিতে একটু খবর দেখতে বসলাম ১০টা বাজে, মা-ও সাথে ছিল। একটা খবর শুনে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো আমাদের, "সকাল ৭ টার দিকে বাস উল্টে খাদে পড়ে চট্টগ্রামে চার জন নিহত, আহত ৩০। যে চারজন মারা গেলো তাদের পরিচয় সহ ছবি ভাসতে লাগলো টিভির পর্দায়। একটা যুবক ছেলে ছিল, তার হাসিমুখের ছবি দেখা যাচ্ছিল পর্দায়। কি সুন্দর আর মায়াবি দেখতে‌! আমি নাম খেয়াল করিনি, শুধু তার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মা বারবার বলছিল, "হে ভগবান। কি সুন্দর ছেলেটা মারা গেলো! হে ভগবান!" আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা কন্ঠে বললাম, "আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না মা। ইসস্ কি করুণ নিয়তি!"

যাই হোক, ভাবলাম একটু অনলাইনে যাই। দেখি অমিত্রকে নক দিয়ে। রাতের পর থেকে আর অনলাইনে যাওয়া হয় নি। ভাবলাম এই এক্সিডেন্টের কথাটা অমিত্রের সাথে শেয়ার করি, তাতে মন যদি একটু হালকা হয়। কারণ খবরটা শোনার পর থেকেই মন ভারী হয়ে আছে ভীষণ। অমিত্রের আইডিতে গিয়ে দেখলাম সে আমাকে ভোর পাঁচটার দিকে একটা ছবি পাঠিয়ে রেখেছে। আর ম্যাসেজে লিখেছে শুধু, "আমায় দেখতে চেয়েছিলেন না?"

ছবিটা ডাউনলোড হতে দেরি হচ্ছিলো, নেটওয়ার্ক একটু দুর্বল ছিল। আমি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে চরম উত্তেজনায় তাকিয়ে আছি। যেই মুহুর্তে অমিত্রের ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, আমি এক মুহুর্তের জন্য যেন জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিলাম। আমি আর মা টিভিতে যে ছেলেটাকে দেখে আফসোস করছিলাম, এ সেই ছেলে। হে ভগবান, এ সেই ছেলে। আমি ফোনের স্ক্রিনের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তারপর "মা" বলে অনেক জোরে একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। এরপর আর জানি না...

আজ তিন বছর পূর্ণ হলো অমিত্র নেই। প্রতিবছর এই দিনটা যে আমি কিভাবে কাটাই নিজেও জানি না। এক মহাকাশের সমান মন খারাপ হয়, চোখে আমার বৃষ্টি নামে। এই দিনে একটা অপূর্ণতার বেদনায় আমার মন ছেয়ে যায়, এই দিনে ভগবানের প্রতি আমার অভিমান বাড়ে। এই দিনে আমি ঠিক এ জগতে থাকতে পারি না। আমার ছলছল চোখে ভাসে আরেক জগতের অস্পষ্ট এক দৃশ্য। আমি অপেক্ষা করি, অমিত্র একটি ম্যাসেজ দেবে, আবার কথা হবে, আবার নতুন করে তার প্রেমে পড়বো। কিন্তু হয় না, কিছু হয় না, কিছু হওয়ার আর বাকিও নেই। অমিত্র যে 'শুভরাত্রি' বলে চলে গেলো, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে সেই শুভরাত্রি আর শুভ সকালে পরিণত হবে না। চোখের নিচে শুধু বৃথা অপেক্ষার কালোছাপ পড়ে...

এইতো সেদিন স্বপ্নে দেখলাম, আমি এক গভীর রাতে নির্জন পাহাড়ের উপর চন্দ্রালোকের মাঝে বসে বসে মোবাইল চালাচ্ছি। আমার চোখের সামনে বিশাল আকাশের শূন্যতা। চারিদিকে মৃদু কুয়াশা আর ঝিরিঝিরি বাতাসে পাহাড়ি ফুলের সুবাস। হঠাৎ ম্যাসেজ রিকুয়েস্ট এলো 'অচেনা রাজকন্যার অপেক্ষায়' নামক আইডি থেকে, "হ্যালো, অপেক্ষায় আছেন?"
.
.
.
সেপ্টেম্বর ৮, ২০২০
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৭৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/১০/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast