www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দুজোড়া প্রাণের একজোড়া আক্ষেপ

দু'জোড়া প্রাণের একজোড়া আক্ষেপ


এক.
এপ্রিল মাসের এক উত্তপ্ত দুপুর। মৌমি কলেজ ক্যান্টিনের পাশে যে বিশাল বটগাছটা রয়েছে, তার নিচে বসে আছে। চোখে মুখে ক্লান্তি ও উদভ্রান্তির ছাপ, মনে হল যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। গোল গোল চশমার ভেতর হতে চোখজোড়া যেন বারবার সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পার হলো, এবার তার ভাবভঙ্গিতে পুরো বিরক্তির একটা ভাব চলে এসেছে। এমন সময় তার সেই চোখে মুখে যেন একটু শান্তি নেমে এলো।

এতক্ষণে সুমিত আসলো। আইসক্রীম আনতে পাঠিয়েছিল সেই কতক্ষণ আগে! বেচারা সুমিতও বা আর কি করবে! ক্যান্টিনে যে পরিমাণ ভিড়, আইসক্রীম তো দূরের কথা, সেখানে ঢুকতেই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। যাই হোক, সে আইসক্রীম আনতে পেরে এমন হাবভাব দেখাতে লাগলো, যেন সে যুদ্ধজয় করেছে। ওদিকে মৌমি রাগ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

সুমিত হেসে বললো, "আরে বাবা! এই তো নিয়ে আসলাম! এত রাগ কেন?" মৌমি একবার সুমিতের দিকে তাকালো, তারপর আবার অন্যদিকে ফিরে রাগ করে রইলো। সুমিত এবার মৌমির একদম পাশে গিয়ে বসলো যেটা সে সবসময়ই করে থাকে। বললো, "আচ্ছা, দেরি হওয়ার জন্য স্যরি, কিন্তু আমি কি ইচ্ছে করে করলাম? ক্যান্টিনে এত যে ভিড়...."

মৌমি এবার মুখ ঘোরালো, কিছুই বললো না এবং সুমিতের হাতের দুটো আইসক্রীম থেকে একটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। সুমিত বেচারাও আর কি বলবে? সেও কথা না বলে একই কাজ করতে লাগলো।

মৌমি-সুমিত বেস্ট ফ্রেন্ড, একেবারে মানিকজোড়। সিটি কলেজে পড়ে, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। কলেজের ক্যাম্পাসে এদেরকে একসাথে ছাড়া কেউ কখনো একা দেখেছে কিনা তা বলা মুশকিল। তবে ক্লাসের মধ্যে এরা সবসময় একসাথে বসে না।

মৌমি রূপে যেমন রূপবতী, গুণেও তেমন গুণবতী। ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েগুলোর মধ্যে একটি। অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজের আর শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে সে, যে কেউ দেখেই বলে দেবে এ কথা। আর তার চোখে গোল গোল চশমায় তাকে অত্যন্ত মায়াবী লাগে, যদিও সুমিতের কখনো তা মনে হয়নি। মৌমি সবসময় খুব গোছালো থাকে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের শহুরে মেয়ে, তবে বিলাসীতার প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। তাই বলে একেবারেই যে নেই তা কিন্তু নয়।

সুমিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, চোখে স্বপ্ন আর বুকে আশা নিয়ে শহরে আসা তার। তার বাবা-মায়ের তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন, সেও জানে তা। কলেজের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের কথা বলা হলে সুমিতের নামও যে কেউ বলবে। তবে পড়ালেখার প্রতি খুব একটা সিরিয়াস না, তারপরেও পরীক্ষায় সে ভালো করে।

মৌমি সুমিতকে প্রথম দেখেছিল একেবারে কলেজে ভর্তির দিনে। সে প্রায় দেড় বছরেরও বেশি আগের কথা। এক মজার কান্ড হয়েছিল সেদিন। মৌমি আগে থেকেই সে কলেজে ছিল, সে ইন্টারমিডিয়েট ওই কলেজ থেকেই পাশ করেছে। আর সুমিত ভর্তি হতে কলেজে এসেছে, গ্রাম থেকে। সুমিত সেদিন একেবারে সহজ সরল ভাব নিয়ে কলেজে এসেছিলো। পরনে ছিলো সাদা চেক শার্ট, কালো সুতির প্যান্ট, হাতে বিস্তর কাগজপত্র। আর তার চুলগুলো ছিলো একদম আঁচড়ানো। প্রথম দেখে মানতেই হবে, ভদ্র ঘরের সন্তান। তবে এতটা ভদ্র হয়ে এসেছিল যে, একেবারে নিষ্পাপ ভ্যাবলার মত লাগছিল তাকে। তার হাঁটার ভঙ্গিও কেমন যেন গাঁইয়া গাঁইয়া ছিল। মৌমি ও তার এক নতুন বান্ধবী দূর থেকে সুমিতকে লক্ষ্য করছিল ও তার হাবভাব দেখে হাসছিল। সুমিত অবশ্য সেদিকে খেয়ালই করেনি। তার গন্তব্য যেখানে, মানে কলেজের অফিসে, সেখানেই সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে একদৃষ্টিতে হেঁটে যেতে লাগলো।

কিন্তু বিপত্তিটা বাজলো তখনই। কলেজের অফিসের একটু আগে কয়েকটা ছোট-বড় গাছের সারি ছিল। সে ঠিকই তার মত করে যাচ্ছিল, কিন্তু ওই জায়গায় গিয়ে সে থেমে গেলো। মৌমি দূর থেকে লক্ষ্য করতে থাকলো ওকে। সুমিত চেহারায় বিচ্ছিরি একটা ভাব এনে মাথায় হাত দিলো! যা ভাবলো তাই! কাক সর্বনাশ করেছে। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে সামনে একজন ছেলেকে পেলো, ওয়াশরুমের ঠিকানা জিজ্ঞেস করলো।

ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় মৌমির পাশ দিয়েই গেলো। সুমিত অবশ্য অত খেয়াল করেনি তাকে, কত মেয়েকেই তো সে দেখছে! কিন্তু মৌমি বিশেষভাবে সুমিতকে নজরদারি করছিলো। সামনে দিয়ে যখন সুমিত যাচ্ছিল, তখন মৌমি স্পষ্ট দেখতে পেলো সুমিতের মাথার অবস্থা এবং সব বুঝতেও পারলো। হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু লাভ হয়নি। মুখ চেপে ধরার পরেও হো হো হাসি বেরিয়ে এলো। হাসি ব্যাপারটা ছোঁয়াচে। তার দেখাদেখি নতুন বান্ধবীটাও হাসিতে যোগ দিলো।

সুমিত শুনতে পেলো, একবার পিছনে ফিরে তাকালো। যেটা ভেবেছে তাই। তাকে দেখেই মেয়েরা হাসছে। একে তো তার ভাবভঙ্গির গাঁইয়া অবস্থা, দুইয়ে তো কাকে করলো সর্বনাশ, সে খুব লজ্জা পেয়ে গেল। ওদিকে মৌমি আর তার বান্ধবী সমান তালে হেসে যাচ্ছিল। এমন সময় সুমিত দুই হাতের বুড়ো আঙুল মাথার দুপাশে রেখে বাকি আঙুলগুলো নেড়ে জিহবা বের করে ওদেরকে ভেংচি কাটলো। তারপর জোরে জোরে হেঁটে ওই জায়গা ত্যাগ করলো। মৌমি আর তার বান্ধবী যেন একটু থতমত খেল! তারপর আবারো হো হো হাসিতে যোগ দিলো।

সেদিনের পর থেকে ক্লাস শুরু হওয়া পর্যন্ত সুমিতের সাথে মৌমির আর দেখা হয়নি।

কলেজে যেদিন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাস যেদিন হলো, সেদিন সবার মধ্যেই একধরনের আনন্দ। পুরো কলেজে সব অপরিচিত মুখ। মৌমির অবশ্য কয়েকজন বান্ধবী ছিলো। সুমিতেরও কয়েকজন বন্ধু হয়েছিল, কিন্তু তেমন ভালো বন্ধু কেউই ছিল না। অবশ্য তার তা নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও নেই। অবসর সময়ে লেখালেখি করে খুব। আর গানের গলাটাও খুব ভালো, মাঝেমধ্যে বন্ধুদের নিয়ে গায়।

মৌমি কলেজ লাইব্রেরীতে গেল। গল্প-উপন্যাসে তার আগ্রহ অত্যন্ত বেশি, সময় পেলেই সে পড়ে। সে লাইব্রেরীতে গিয়েছিল কোনো ভালো বই আছে কি না দেখার জন্য। লাইব্রেরীতে ঢুকলো যখন, দেখলো একটি ছেলে এককোণে বসে বসে কি যেন লিখছে। খুব হ্যান্ডসাম ছেলেটা, দেখেই বুঝতে পেরেছিল সে। চুলে স্পাইক করা ছিল, খারাপ ছিল না অবশ্য। চোখে ছিল ফ্রেমলেস চশমা, হাতে একটা স্টাইলিশ পেন, আর অত্যন্ত গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে একান্তমনে কি যেন লিখছে! একমুহূর্তের জন্য ছেলেটার প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেল মৌমি!

মৌমি অনেকক্ষণ খুঁজেও পড়ার মত তেমন কোনো উপন্যাস পেল না। ভালো উপন্যাস ছিল বটে, কিন্তু বেশিরভাগই তার পড়া হয়ে গেছে। অগত্যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শেষের কবিতা' বইখানা নিয়ে ছেলেটি যেখানে বসেছে, ঠিক তার বিপরীতে ছেলেটির দিকে মুখ করে বসলো৷ জায়গা আরো ছিলো, কিন্তু সে সেখানে ইচ্ছে করেই বসলো ছেলেটির এটেনশন পাওয়ার আশায়৷ সে টুঁ শব্দটি না করে পড়া শুরু করলো, যদিও আগেও সে পড়েছে বইটি।

ছেলেটি টের পেল একটা মেয়ে তার সামনে এসে বসেছে। সে একবার মুখ তুলে তাকালো এবং মেয়েটাকে দেখলো। দেখেই চিনতে পারলো, তারপর লাফ দিয়ে উঠলো যেন! দু চোখে তখন বিস্ফোরিত ভাব। ভাবলো, "আরে! এ সেই মেয়ে না যে আমাকে প্রথম দিন দেখে মজা লুটেছিল?" মৌমিও তাকালো তার দিকে। এবার ছেলেটার পুরো চেহারা দেখতে পেলো। সত্যিই অপূর্ব! অসাধারণ! কেমন একটা সরল ভাব! বস্তুত, তার চেয়ে সুন্দর ছেলে মৌমি আগে কোথাও দেখেছে কিনা তা-ই ভাবতে লাগলো!

কিন্তু যখন দেখলো ছেলেটা বিধ্বস্তের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে তখন সে একটু আমতা আমতা বোধ করলো। মৌমিই প্রথমে বললো, "হ্যালো"। ছেলেটি বললো, "হ্যালুউউ", একেবারে ঠোঁট সুচালো হয়ে গেল 'উউ' বলার সময়। মৌমি একটু হেসে ফেললো ছেলেটার চেহারার ভঙ্গি দেখে, ভেরী ফানি! তারপর বললো, "এভাবে তাকিয়ে আছেন যে?" ছেলেটা এবার একটু স্বাভাবিক হলো, "না। এমনিই। দেখছি আরকি।" "কি দেখছেন?" "কিছু না।"

এরপর কিছুক্ষণ কথা চললো। কলেজে কে কোন বিষয়ে পড়ে, উপন্যাস-গল্প নিয়ে, বিভিন্ন লেখকদের নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা চললো। এরই মধ্যে ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিও মৌমির কাছে মজার মনে হল এবং তাকে অদ্ভুতরকমের ভালো লেগে গেল! তারপর হঠাৎ করেই ছেলেটি বললো, "আমি কিন্তু আপনাকে আগেও দেখেছি"। মৌমি আশ্চর্য হয়ে বললো, "কোথায়?" 
- কোথায় আবার? কলেজেই।
- সেকি! কখন দেখলেন আবার?
- দেখেছি আপনাকে। সাথে আপনার এক বান্ধবীকেও।
- হুম হতে পারে। আমার ফ্রেন্ড তূর্ণা হয়তো, আমরা প্রায়সময়ই একসাথে থাকি। কিন্তু কলেজের কোন জায়গায় দেখেছেন?

ছেলেটি একটু হাসলো, অনেকটা চালাকি ভঙ্গিতে। তারপর দু'হাতের বুড়ো আঙুল মাথার দু'পাশে দিয়ে বাকি আঙুলগুলো নেড়ে নেড়ে জিহবা বের করে ভেংচি কাটলো।

মৌমি যেন আকাশ থেকে পড়লো! বুঝতে বাকি রইলো না এ কে। না বললে অবশ্য মৌমি চিনতেও পারতো না। অবাক হয়ে শুধু ভাবলো, এই কয়েকমাসে এত পরিবর্তন? এও কি সম্ভব?

(চলবে...)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৪৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/০৫/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast