www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অব্যক্ত

-দাদা...তোর ফোন বাজছে’...বাথরুম থেকে তিন্নির আওয়াজ পেলো নীলাঞ্জন। অফিস থেকে ফিরেছে সে কিছুক্ষন আগেই। প্রতিদিন এত দেরী হয় না। আজ একটু বেশীই দেরী হয়ে গেছে। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। তাই মনে মনে সে ভাবলো আজ আর নো টিভী-বিভি। মুখ হাত ধুয়ে, রাতের খাবার খেয়ে সোজা রেস্ট। আজ একটু বেশী টায়াড লাগছে। অফিসে এত কাজের চাপ, আর ভাল লাগে না।
তিন্নির আওয়াজ আবার-‘দাদা ফোন...আননোন নাম্বার, তাড়াতাড়ি বের হ’।
নীলাঞ্জন বাথরুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। শেষ রিং এর আগেই তড়িঘড়ি করে সে ফোনটা রিসিভ করেই ফেললো।
নীলাঞ্জন দত্ত। এক মাল্টি ন্যাশানাল কম্পানীর ডেপুটি জেনেরল ম্যানেজার। চাকরীটা সে পেয়েছে প্রায় এক বছর হলো। তবে সঠিক অর্থে বললে, বলা হবে চাকরীটা তাকে দেওয়া হয়েছে। কলকাতাতে বিসনেস ম্যানেজমেন্ট শেষ করার পর ইন্টারভিউ তো সে দিয়েছিল অনেক, কিন্তু মনের মত চাকরী বা মাইনে কোনটাই হচ্ছিল না। হতাশার মধ্যে কাটছিল বেকারত্তের দিনগুলো। অনেক কষ্টের দিন দেখেছে তারা। চাকরী তাকে একটা পেতেই হতো। তারপর বিনু মামার সুবাদে এই চাকরীটা হাতে এল। ঠিক যেমনটা সে চাইছিল। কম্পানী দিল্লিতে তাকে পোস্টিং দিয়েছে। এই এক বছরে সবকিছু সামলে নিয়েছে সে। মা আর ছোট্ট বোন-তিন্নিকে নিয়ে এই থ্রী-বেডরুম ফ্ল্যাটে তাদের সময় গুলো বেশ ভালই চলছে। সারাদিন অফিস, বাড়ি ফিরে টিভি দেখা, মা আর তিন্নির সঙ্গে হাসি মজা, বেশ কেটে যায় দিন গুলো।
তবে নীলাঞ্জনদের দিনগুলো শরু থেকে এমন ছিল না। কলকাতা থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে প্রতন্ত্য এক গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল। এখনও আছে। বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তবে বাঁচেন নি বেশীদিন। নীলাঞ্জন তখন ক্লাস সেভেনে, আর তিন্নি খুবই ছোট বাবা মারা গিয়েছিলেন। তারপর বিনু মামা একদিন মা সমেত তাদেরকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। মামা সরকারী চাকরী করতেন। নিজের কাছে রেখে নীলাঞ্জন আর তিন্নিকে লেখাপড়া শেখান। নীলাঞ্জন ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল। মায়ের পেনশটা তো ছিলই, তবুও মামা মামীর ঋণ তারা কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। গ্র্যাজুয়েশনের পর নীলাঞ্জনের বিসনেস ম্যানেজমেন্ট করার আইডিয়া টা বিনু মামারই ছিল।
ঘরের আলোটা নেভানোই ছিল। মার্চ মাসে দিল্লির আবহাওয়াটা খুব ভাল থাকে। এসির প্রয়োজন হয় না। তাই নীলাঞ্জন মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। এই উঁচু ইমারতের ঝুলন বারান্দা থেকে আকাশটা বেশ ভালই দেখা যায়। রাতের তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে তার চোখে। অপরিচিত নাম্বার সাধারনত নীলাঞ্জন রিসিভ করে না। তবুও ফোনটা কানে রেখে বলল, -হ্যালো...
-‘হ্যালো, নীল। আমি প্রিয়া। কেমন আছো তুমি’?
ফোনের ওপারের কথা গুলো নীলাঞ্জনের কানে বজ্রপাতের মত শোনালো। অকস্মাৎ একটা ভয়ঙ্কর তুফান যেন ওর গোটা পৃথিবীকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ তাকে জাপটে ধরে আছে। সে কথা বলতে পারছে না। এই দিনটার আশঙ্কা তার মনে সব সময় চলতো, কুরে কুরে খেতো তাকে...। তবে আজ এত দিন পর...। সে তৈরী ছিল না মোটেই। নীলাঞ্জনের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
ফোনের ওপারে আবার সেই চেনা গলা-‘নীল তুমি শুনছো...কোথায় আছো তোমরা এখন’?
নীলাঞ্জনের বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুদ যন্ত্রনা অনুভূত হচ্ছে। খুব জোরে চিৎকার করে তার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। সে জানে প্রিয়া ছাড়া তাকে আর কেউ ‘নীল’ বলে ডাকে না। আগের মতো করে আরও একবার ফোনে সে বলতে পারলো না...
-‘হ্যাঁ প্রিয়া আমি শুনছি। তুমি তো জানো, তোমার কথা শুনতে আমার কত ভাল লাগে। তোমাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে করছে...’।
কোনো শব্দই বের হলো না নীলাঞ্জনের মুখ থেকে। শুধু চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়লো। দৃষ্টিটা নিমেশে ঝাপসা হয়ে গেল। বাইরের খোলা আকাশটা আর নেই। অথচ নীলাঞ্জন দেখতে পাচ্ছে সব কিছু। চোখের সামনে ভাসছে প্রিয়ার মুখটা। সেই মিস্টি হাসি, সেই কথা বলা, তার সঙ্গে কাটানো সেই সব...সব দিন গুলোই।
কলেজের লাইব্রেরীতে বসে একদিন বই থেকে নোটস্‌ কপি করছিল নীলাঞ্জন। এটা সে প্রায়শই করে। বই কেনার খরচাটা বাঁচে। কারন মামার উপর আর বেশি চাপ দিতে চায় না সে। তার নিজের বিসনেস ম্যানেজমেন্টের খরচা, তিন্নির পড়াশনা, মায়ের ব্লাড প্রেসারের অষুধ সবই তো বিনু মামাই করছে। লিখতে লিখতে হঠাৎ তার পেনের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আসেপাশেও কেউ বসে নেই, কার কাছে চাওয়া যায় একটা পেন, এমনটি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে দেখলো একটা ফর্সা সুন্দর হাত একটা পেন নিয়ে তার দিকে আগিয়ে দিচ্ছে। মুখ তুলে তার দিকে তাকাতেই নীলাঞ্জনের ভিতর এক মায়াবী স্নিগ্ধতা ছেয়ে গেল। ভীষণ সুন্দরী একটা মেয়ে। তার হাত থেকে কলমটা নিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল...
-না...। না...থ্যাঙ্ক ইউ বলার প্রয়োজন নেই। আপনি লিখুন। কালকে ফেরত দেবেন। কাল আবার দেখা হবে। আমি প্রিয়া। প্রিয়া বোস।
তারপর মেয়েটি চলে গেল লাইব্রেরীর বাইরে। নীলাঞ্জন কিছুই বুঝতে পারলো না যে, এই এক মিনিটে কি হয়ে গেল। তবে এটুকু সে বুঝলো মেয়েটি দূর থেকে অনেকক্ষন ধরে নিশ্চয় তাকে দেখছিল। নীলাঞ্জন লেখায় মন দিলো।
পরের দিন যথারীতি প্রিয়ার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল লাইব্রেরীতে। কলম ফেরত দেওয়ার বাহানায় কিছুক্ষন কথাও হলো। প্রিয়া কম্পিউটর এপ্লিকেশনের কোর্স করছিল। ওর সবচেয়ে আকর্শনীয় জিনিস ছিল ওর সারল্য, খুব সুন্দর করে কথা বলতো। মানুষের সাথে মিশতে ভালবাসতো। বাবা বড়লাক। নিজস্ব বিসনেস আছে একাধিক শহরে। কলকাতায় এবং ব্যাঙ্গালোরে দুই জায়গায় বাড়ি আছে। তবে কোনো রকমের কোনো অহংবোধ প্রিয়াকে স্পর্শ করতো না। আর সেইজন্যই প্রিয়াকে নীলাঞ্জনের ভাল লাগতো। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে আসতে বেশি দেরী হয় নি ওদের। বন্ধুত্বটাও একটু একটু করে বেশ জমে উঠেছে তাদের। দুজন দুজনার সানিধ্য বেশ পছন্দ করে। নীলাঞ্জন কম্পিউটরে একটু দূর্বল ছিল। প্রিয়া ওকে হেল্প করতো। আসলে প্রিয়া নীলাঞ্জনের খুব খেয়াল রাখতো। তার মত করে নীলাঞ্জনকে খুব কম বন্ধুই বুঝতো। নীলাঞ্জন বুঝতে পারছিল যে, প্রিয়া একটু একটু করে তার জীবনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাকে নীল বলে ডাকা, তিন্নির পড়াশনার কিম্বা মায়ের অসুস্থ্যতার খবর নেওয়া, আরো অনেক কিছুই কোথাও যেন একটা বন্ধন প্রিয়ার সঙ্গে বেঁধে ফেলছিল নীলাঞ্জনকে। সে জানতো প্রিয়ার সঙ্গে তার তফাৎ অনেকখানি। তাই সে অনেক সন্তর্পনে সে পথে চলা থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারে নি। নীলাঞ্জনের জীবনের শুধু একটাই স্বপ্ন- তাকে অনেক বড়লোক হতে হবে। অনেক টাকা কামাতে হবে। জীবনের সর্বোস্ব সুখের চরমে উঠতে হবে। প্রেম-ভালবাসা হয়তো তার জন্য নয়। কিন্তু শেষ একদিন প্রিয়ার ভালবাসার সামনে সে নিজেকে হারতে দেখে খুশি হয়েছিল। নীলাঞ্জন প্রিয়ার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। তারপর অনেক গুলো দিন কেটে গেছে। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পড়াশনার ব্যাস্ততায় তারা একে অপরকে বেশি সময় না দিলেও দিনে একবার ফোনে অবশ্যই তাদের কথা হতো। প্রিয়ার কাছে মোবাইল ছিল, নীলাঞ্জনের কাছে মামার বাড়িতে ল্যান্ড লাইন। প্রিয়া কথা বলতে ভালবাসতো আর নীলাঞ্জন শুনতে। রেজাল্ট আউটের কিছুদিন আগে ওরা প্রায়ই দেখা করতো। প্রিয়া কেন যেন আর আগের মতো খুশি খুশি থাকতো না। হয়তো ওর মনে হত, নীল এবার তার থেকে অনেক দূরে চলে যাবে কিম্বা ও নিজে নীলের থেকে। কলেজে আর তাদের দেখা হবে না। নীলাঞ্জন ওকে বোঝাতো, আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের কোনো সমস্যা হওয়ার কথাই নয়। সে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই থাকুক না কেন। প্রিয়া নীলাঞ্জনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল-
-‘নীল তুমি কেন বুঝছো না। পাস্‌ আউটের পরে ড্যাড আমাকে হয়তো বেশিদিন কলকাতায় রাখবে না। আমরা ব্যাঙ্গালোর চলে যেতে পারি। আমার বিয়ের কথাও বলাবলি হচ্ছে’।
-‘প্রিয়া আমরা নিশ্চই যোগাযোগ রাখবো। আমিও কি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো বলো’?
-‘কিন্তু নীল, তোমার স্বপ্ন? তোমার বড় হওয়ার স্বপ্ন? আমার ভালবাসার জন্য তুমি নিজের প্রতি অবহেলা কোরো না প্লিজ’।
-‘না প্রিয়া, তা নয়। বড় আমাকে হতেই হবে একদিন। শুধু একটা চাকরী পেলেই আমি তোমার বাবার কাছে তোমায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবো। আমি তোমাকে নিতে আসবো’।
-‘জানি নীল, তোমাকে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি এবং সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। তোমার জন্য আমি আমার বাকি পুরো জীবনটা অপেক্ষা করতে রাজী আছি’।
ঘরের আলোটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো। তিন্নি নীলাঞ্জনকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল- এমা, দাদা তুই অন্ধকারে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথা বলা হয়ে গিয়ে থাকে তো চলে আয়, মা খাবার জন্য ডাকছে।
বোনকে লুকিয়ে নীলাঞ্জন চোখের জলটা মুঝে বলল-‘হ্যাঁ চল, আমি আসছি’।
তিন্নি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু অতীতের সেই ধোঁয়াশায় ভরা জলছবি এখনও তার চোখের সামনে ভাসছে।
নীলাঞ্জন আর প্রিয়ার রেজাল্ট ভালই হয়েছিল। দেখা সাক্ষাত তারপর একটু কম হত বটে। তবে ফোনে কথা হত তাদের। একে অপরকে খুব মিস্‌ করতো তারা। এর মধ্যে নীলাঞ্জনকে কয়েকবার ইন্টারভিউ এর জন্য কলকাতার বাইরেও যেতে হয়েছিল। বেশ কিছুদিন প্রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সময় এবং মানসিক অবস্থার সংকট চলছিল নীলাঞ্জনের। মায়ের শারীরিক অবস্থা হঠাৎ খারাপের দিকে চলে গেল। হাই ব্লাড প্রেসার সাথে সুগারও। বিনু মামা যথা সাধ্য চেষ্টা করছিলেন। কোনো একটা ইন্টারভিউও ঠিক মনের মত হচ্ছিল না নীলাঞ্জনের। প্রিয়ার ফোন আসা কমে গিয়েছিল। ফেসবুকেও প্রিয়া নেই। একদিন নীলাঞ্জন ফোনও করেছিল মায়ের সুস্থ্যতার পর। প্রিয়ার নাম্বার আস্তিত্বহীন বলছিল। একটা মানসিক চাপের মধ্যে চলছিল নীলাঞ্জনের দিন গুলো। ঠিক তেমনই তাদের সংসারও। সেই মুহুর্তে তার একটা চাকরী ভীষণ প্রয়োজন ছিল। মামার রিটায়ারমেন্টের আর বেশি বাকি নেই। হঠাৎ একদিন বিনু মামা নীলাঞ্জনকে তাঁর অফিসের বসের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গেলেন। বসের এক দিল্লির বন্ধু তাজিন্দর সিং আরোরা নীলাঞ্জনের প্রোফাইল এবং রেজাল্ট দেখে তাঁরই কম্পানীতে একটা চাকরী দেওয়ার জন্য আগ্রহী হয়েছেন। তাকে দেখে এবং তার সঙ্গে কথা বলে তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন। তার স্মার্টনেস আর পারসোন্যালিটি তাজিন্দর সিং আরোরাকে ভালই প্রলুব্ধ করেছিল। আর সেই সাথে প্রলুব্ধ করেছিল তার দেওয়া চাকরীটা নীলাঞ্জনকে। এক মাল্টি ন্যাশানাল কম্পানী, অনেক টাকা মাইনে আর ডেপুটি জেনেরাল ম্যানেজারের পোষ্ট। নীলাঞ্জন হঠাৎ যেন তার দেখা স্বপ্নের সাক্ষাত পেয়েছিল। তবে তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল একটা শর্তের উপরে। তাজিন্দর সিং আরোরার মেয়ে সোনিয়া, তাকে বিয়ে করার শর্ত নীলাঞ্জনকে। সোনিয়া ডিভোর্সি এবং নীলাঞ্জনের থেকে বয়েসে একটু বড়। শ্যামল-বর্ণা, মুখশ্রী মোটামুটি সুন্দর।
নীলাঞ্জনের বন্ধুরা ছাড়া পুরো ব্যাপারটা কারোর কাছেই আপত্তিকর বলে মনে হয় নি। বিনু মামা, মামি, তিন্নি, মা সবাই বেশ খুশি হয়েছিল। আর তাছাড়া নীলাঞ্জনের বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে তাকে একদিন করতেই হতো। এত ভাল একটা চাকরী, সাথে বিয়ে এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ তার হাত ছাড়া করা উচিত নয়, বিনু মামা এটাই বুঝিয়েছিল।
প্রিয়ার জন্য নীলাঞ্জনের খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। বন্ধুরা অনেকবার বলেছিল যে, তার উচিত প্রিয়ার সঙ্গে একবার কথা বলা, তাকে একবার জানানো। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় নি। প্রিয়াও আর ফোন করে নি। আর নীলাঞ্জনের পক্ষে এই খবরটা প্রিয়াকে জানানো সম্ভব ছিল না। এক সপ্তাহের মধ্যে নীলাঞ্জনকে চাকরীতে জয়েন করতে হয়েছিল। দিল্লিতে। তারপর মা আর তিন্নিকে নিয়ে দিল্লির এই বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে চলে আসা। বিনু মামাকেও সঙ্গে নিয়ে আসতে চেয়েছিল নীলাঞ্জন, কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর কলকাতায় সরকারী আবাস ছেড়ে মামা গ্রামের বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করলেন।
চাকরীর দুই মাসের মধ্যেই নীলাঞ্জন আর সোনিয়ার বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। শুরু শুরুতে এক অদৃশ্য যন্ত্রনা নীলাঞ্জনের বুকে বিঁধতো। কোথাও যেন এক দংশন হচ্ছে। বিবেকের দংশন। তবে এসব কিছুই সে তার স্ত্রীকে বুঝতে দেয় নি কোনোদিন। সোনিয়া বেশির ভাগ সময় বাপের বাড়িতেই থাকে। ওখানেই ওর ভাল লাগে। অবাঙ্গালী হলেও বাংলাটা বোঝা এবং বলা রপ্ত করে নিয়েছে সে এই এক বছরে প্রায়। সোনিয়া এখন তার বাপের বাড়িতেই আছে।
নিস্তব্ধতা চারিদিক ঘিরে ফেলেছে নীলাঞ্জনকে। গোটা পৃথিবী এখন শুন্য লাগছে তার সামনে। শুধু কানে আসছে প্রিয়ার কান্নার আওয়াজ। নীলাঞ্জনের পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। সে জিঙ্গেস করলো – ‘প্রিয়া তুমি কাঁদছো কেন’?
-‘নীল আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি জানি তোমার অভিমান হয়েছে। আমরা ব্যাঙ্গালোরে চলে গিয়েছিলাম, আমার নাম্বারটাও বদলাতে হয়েছিল। আমি তোমাকে অনেকবার মামার বাড়ির ফোনে যোগাগোগ করার চেষ্টা করেছি। তোমারা ওখানে ছিলে না। অনেক কষ্টে অনেক পুরানো বন্ধুদের কাছ থেকে গত সপ্তাহে তোমার নাম্বারটা যোগাড় করেছি’।
-‘ঠিক আছে প্রিয়া। তুমি এখন কেমন আছো বলো। আমায় বললে না যে, তুমি কাঁদছো কেন’। প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিল-
-‘আমায় একটু কাঁদতে দাও নীল। তবেই হয়তো আমি তোমার কাছে ক্ষমা পাবো। আমি তোমার বিশ্বাস ভেঙে ফেলেছি নীল। গতকাল আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এখন কলকাতায় আছি’।
গোটা পৃথিবীটা নীলাঞ্জনের চারপাশে আরও একবার কেঁপে উঠলো। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। বুকের যন্ত্রনাটা এবার যেন মাথায় অনুভূত হচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে প্রিয়ার ঐ খবরে নয়, খবরের পিছনের সততার জন্য। অনেকক্ষণ সে চুপ করে থাকলো। তারপর আড়ষ্টতাটা বুঝতে না দিয়ে সে বলল
-কিন্তু প্রিয়া আমি যে... নীলাঞ্জনের কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রিয়া বলে উঠল-
-‘আমি জানি নীল, তুমি এখনো চাকরী পাও নি। চাকরী পেলে নিশ্চই আমাকে তুমি নিতে আসতে। আমি তোমার কথা বাড়িতে বলেছিলাম, তোমার কাছে পালিয়ে আসবো ভেবেছিলাম। কিন্তু কিছুই সম্ভব হয় নি। সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেল নীল। বাড়ির লোক আমার ভালবাসার কথা শুনলোই না। বাবার এন আর আই বন্ধুর ছেলের সঙ্গে...। সফ্‌টওয়ার ইঞ্জিনীয়ার। স্যানফ্রান্সিস্কোতে থাকে। পোরশু আমি সেখানেই চলে যাচ্ছি নীল। তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না’।
নীলাঞ্জনের এবার সত্যিই খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। গলার কাছে একটা দলা পাকানো যন্ত্রনাকে উগরানো সম্ভব হচ্ছে না। আর সম্ভব হচ্ছে না চোখের জলটাও লুকানো। মা কিম্বা তিন্নি যে কোনো সময় ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। প্রিয়ার আর কোনো কথাই নীলাঞ্জনের কানে ঢুকছে না। তবুও প্রিয়া বলে চলেছে...
-‘নীল প্লিজ তুমি কেঁদো না। তোমার জীবনে আমি যে আঘাত দিলাম তার শাস্তি আমি পাবোই। নীলাঞ্জন এবার উত্তর দিলো,-‘প্রিয়া অমন কথা বোলো না, নিজের জীবনের সবটাই সব সময় নিজের হয় না, কখোনো কখোনো নিজের অনেক কিছুই ছেড়ে দিতে হয় অন্যের জন্য’।
-‘তাই বলে কি নীল এমনটি করে তুমি আমায় ছেড়ে যেতে পারতে, যেমনটি করে আজ আমি তোমায় ছেড়ে গেলাম’।
নীলাঞ্জনের চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে আসছে। কানে আসছে প্রিয়ারও কান্নার আওয়াজ। দুটো মানুষ নিঃশব্দতায় অনুভব করছে নিজের নিজের যন্ত্রনা অব্যক্ততার দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে।
প্রিয়া আবার বলে উঠলো,- ‘নীল এবার আমি ফোন রাখবো। মা আর তিন্নিকে দেখো। আর একটা শেষ অনুরোধ তোমায় করছি...প্লীজ নীল, তুমি বিয়ে করে নিও’।
নীলাঞ্জন বুকে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে এবার বলার চেষ্টা করলো-
-প্রিয়া আমি......আবার নীলাঞ্জনের কথা শেষ না করতে দিয়েই প্রিয়া বলে উঠল-
-‘না নীল, আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমি না আমায় ভালবাসো। আমার এই শেষ অনুরোধটা রেখো। আমায় ভূলে যেও। আমি আজও তোমায় ভালবাসি’।
একটা দূর্বিসহ যন্ত্রনার কান্নার আওয়াজ কানে এলো নীলাঞ্জনের। আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। দুজনের কারোরই। প্রিয়ার শব্দ এবার আর আসছে না। ফোনটা সে রেখে দিয়েছে। যেমন বজ্র হেনে এসেছিল তেমনই বজ্র হেনে বিদায় নিলো প্রিয়ার ফোনটা। শুধু বদলে দিয়ে গেল নীলাঞ্জনের অনুতাপের অভিমুখ। বাইরের আকাশটা ততক্ষনে আরও অনেক গভীর অন্ধকার হয়ে গেছে। দূরের তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে নীলাঞ্জন আরও একবার প্রিয়ার মুখটা মনে করার চেষ্টা করছে। প্রিয়ার কন্ঠস্বর এখনও তার কানে বাজছে “আমি আজও তোমায় ভালবাসি নীল”
ডাইনিং রুম থেকে মায়ের ডাক এলো- খোকা...খাবি আয়।
চোখের জলটা মুঝে, একটু স্বভাবিক হয়ে নীলাঞ্জন বলল- ‘আসছি মা’।
রাতের খাবার টেবিলে তিনটে মানুষ প্রতিদিন একসাথে একই অভ্যাসের সামনাসামনি আরও একবার। খেতে খতে হঠাৎ তিন্নি জিঙ্গেস করলো-‘দাদা কার ফোন ছিল রে’?
একটু জড়তার সঙ্গে সে উত্তর দিলো- ‘ও কারোর নয়...। রং নাম্বার ছিল’। নীলাঞ্জন নিজের মনে ভাবলো, রং নাম্বারে এতক্ষন কেউ কথা বলে না। তিন্নি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মা বলে উঠলেন- ফোনের কথা রাখ তো, হ্যাঁরে খোকা...সোনিয়া কবে ফিরবে? নীলাঞ্জন মায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়-‘তাড়াতাড়ি ফিরবে মা’।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৬০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/০২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ফয়জুল মহী ১৭/০৪/২০১৬
    অনন্য লেখা
  • সাইদুর রহমান ০৫/০২/২০১৬
    ভালো লাগলো গল্পটি।
  • Bithi Chakraborty ০৫/০২/২০১৬
    মনে হল বিখ্যাত কোন লেখকের গল্প পড়লাম ৷ আসাধারণ লাগল ৷
    • আজিজ আহমেদ ০৫/০২/২০১৬
      তুমি অনেক বেশি করে বলছো বিথী আমাকে খুশি করার জন্য।
      গল্পটা যদিও আমার খুব প্রিয়। ভাল লাগে।
      ধন্যবাদ।
      আজ আর একটা পোস্ট করেছি।
  • ধ্রুব রাসেল ০৩/০২/২০১৬
    খুব ভাল লাগল। আরো চাই।
  • অসাধারণ লাগল, গল্পটা । খুব সুন্দর আজিজদা ।
    • আজিজ আহমেদ ০২/০২/২০১৬
      ধন্যবাদ শান্তনু।
      তোমাকে আমার গল্প পড়াতে পেরে ভাল লাগছে।
      সত্যি কথা বলতে কি এই গল্পটা আমি ১৯৯৭ এ লিখেছিলাম।
      technically একটু বদলে পোস্ট করেছি।
      আরও গল্প আছে। তোমাকে পড়াবো।
  • দুর্দান্ত একটা গল্প পড়লাম॥
  • অভিষেক মিত্র ০২/০২/২০১৬
    ভালো লাগল আজিজ দা। দারুণ গল্প।
    • আজিজ আহমেদ ০২/০২/২০১৬
      ধন্যবাদ অভিষেক। ভাল লাগলো তোমায় পাতায় পেয়ে।
      তুমি সে পয়েন্ট টা বলেছো। সেটা আমিও ভেবেছিলাম।

      প্রিয়া যে বন্ধুর কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার যোগাড় করেছে, তার কাছ থেকে নীলাঞ্জনের বাকি information কেন পেলো না?

      আসলে ওখানে লিখেছি...অনেক পুরানো বন্ধু। কিম্বা ঐ বন্ধূটি intentionally কিছু বলে নি।
      যাহোক কিছু একটা ভেবে নাও। এই আর কি ...হা...হা...হা...
  • তারুণ্যে স্বাগত , একটা ছোট গল্পের গুনগুলো লেখায় বর্তমান। বেশ কিছু টাইপো আছে , শুধরে নিন।
    ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ কিন্তু ক্যাম্পাসে হয়। রং নম্বরের আর কতক্ষণ কথা বলা যায় !
    • আজিজ আহমেদ ০২/০২/২০১৬
      ধন্যবাদ দাদা।
      আপনি ঠিক বলেছেন। ঠিক করে নিচ্ছি। টাইপো গুলো খুঁজছি।
      রং নাম্বারের কথাটা মিথ্যে বললেও, আপনার পয়েন্ট অফ ভিউটা ঠিক।
      এক লাইন জুড়ে দিলাম তাই। ধন্যবাদ... এত নিখুঁত নিরিক্ষনের জন্য। পাশে ছিলেন, এবার হৃদয়ে এলেন।
 
Quantcast