www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

প্রিয় বান্ধবী

আজই তো পিয়াসীর জন্মদিন, ৬ই ডিসেম্বর। একটু মন খারাপ হল বুঝি আমার। একটুই মনখারাপ হল কী? জানি না।  আমার প্রিয় বান্ধবী পিয়াসী। দু'টাকার বরফগোলা ওর সাথে খেতাম রোজ। একসাথে স্কুলগেটের বাইরে দাঁড়ানো ফুচকার দোকানে ফ্রি চেতাম।হিসেব করতাম দুই বান্ধবীতে,-"না কাকু, তিন টাকায় ১০ টা ফুচকা। ১০ টা-য় একটা ফ্রি হলে, ১৫ টায় দেড় টা ফ্রি হয়। তুমি দুটা দিবা। আমরা রোজ খাই তো।" আর কাকু রোজই ১ টা ফ্রি দিত। সেই একটা ফ্রি ফুচকা একদিন আমি খেতাম, একদিন পিয়াসী। সেই আমি, পিয়াসী, অনন্যা, রেখা, দ্বীপা দের ছেড়ে, আমার প্রিয় অজগাঁয় স্কুলটি ছেড়ে চলে এলাম মরতে এই শহরের স্কুলে। মাধ্যমিকে ফল ভাল হবার পরে বাবা

আর মা'র আপত্তি শোনে নি। বলেছিলেন-"আমাদের তো একটিই মেয়ে, পড়ুক ও শিউলি, ভাল যায়গায় পড়ুক। " আমারও যে লোভ ছিল না ভাল স্কুল-ড্রেসের, তা বললে মিথ্যে বলা হবে। মনে হত পরীদের দেশে
আসব,নতুন গার্লস স্কুলে কত নতুন বান্ধবী হবে, ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলব।

এলাম নতুন দেশে, হষ্টেলে ভর্তিও হলাম, কিন্তু বান্ধবী কোথায়? এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করলে যে ময়ুর হওয়ার চেষ্টায় বাকী জীবন যাবে, বেশ বুঝছিলাম। প্রথম ১০ দিনের মাথায় আমার রুমমেট শ্রাবণীর থেকে নিজের সম্পর্কে যা যা জানলাম,-
(১)আমি গাঁইয়াদের মত টেনে টেনে কথা বলি।(একবার ভেবেও ছিলাম, মত বলার কি প্রয়োজন! গাঁইয়াই আমি, তাতে কার কি অসুবিধে?)

(২)আমি কাটা চামচ দিয়ে নুডলস খেতে পারি না।(ডাহা মিথ্যে কথা, আমি পারি। নেহাত আমার এমনি চামচেই খেতে সুবিধে হয়, তাই প্রথমে এমনি চামচেই শুরু করেছিলাম। পড়ে ওদের টিটকারিতে কাটা চামচ ধরলে,

হাত থেকে  অনেকটা নুডলস ড্রেস-এ পড়ে যায়। সেটা অ্যাক্সিডেন্ট। হতেই পারে কখনও সখনও।)

(৩)আমার বাবা আমাকে খুব কম টাকা পাঠিয়েছে। তাই আমি যেটুকু চাঁদা দিতে পারব, তাই দিয়ে, ওরা আমার সাথে পিকনিক করবে না।(সেই প্রথম একা একা কান্না, মার আঁচল যখন দুর্লভ, তখনই ওই জিনিসটির মূল্য

সবচেয়ে বেশী হয়ে গেল। মুখে বলতে হল, আমারও পক্ষে সম্ভব না। মেলা কাজ আছে আমার। শ্রাবণীটা কি বদমাস।  সবার সামনেই বলে-" ওর ব্যঙ কাজ আছে। পয়সা নেই, সেটা বল।" কান্না পেলেও মায়ের আঁচল নেই)

(৪)দিদিমণিদের আমি দিদিমণি বলি, এখানে মিস বলতে হয়।(আচ্ছা, অনেকেই তো বিবাহিত, তাদের মিসেস বলব না কেনো?)

(৫) আমি নিজের ফিগার সম্পর্কে সচেতন নই। আমার ওয়েট ৬০ কেজি। শ্রাবণী স্লিম, ওর ওয়েট ৫০ কেজি। ওকে বয়েস স্কুলের ছেলেরা খুব পছন্দ করে। ওর জীবন সার্থক(!)।(ওকে তো স্কুলের মেয়েরাওপছন্দ করে,

আরে 'নেহা' নামের ওই ছেলেটাইপ মেয়েটা সেদিন বলছিল রূপাকে-"শ্রাবণীকে আমি খুব ভালবাসি, ওর জন্য মরতেও পারি।" আমি লুকিয়ে শুনেছি। আমার বাবা এসবের দরকার নেই। আমি একলা চলতে ভালবাসি।  )

(৬)আমি বোকা, আমার কাছ থেকে ভিখিরিরা টাকা চাইলে আমি "খুচরো নেই" বলতে পারি না।(আরে মিথ্যে বলার কি দরকার। একবাক্স খুচরো আছে। দিলে ওরা আশীর্বাদ দেয়।)

-আরও প্রচুর আছে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম, তবু ষান্মাসিক-এ আমি দ্বিতীয়। শ্রাবণী প্রথম। ইস, খালি ঘুরে বেড়ায়, কিভাবে এক নম্বর বেশী পেল আমার থেকে ও। বাবা চিঠি পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দ্বিতীয়
হবার। শুভেচ্ছা চুলোয় যাক। আমাকে প্রথম হতেই হবে বার্ষিক-এ। দুদিন হল রাতে খেতে যাই না, খালি পড়ি। মাঝেমধ্যেই রুমমেট ও বাকি বান্ধবীদের ব্যাকা কথায় মায়ের আঁচল আর পিয়াসীর কথা মনে পড়ে। আজ একটু
ছুটি নিলাম দশ মিনিটের। পিয়াসীর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে শুরু করলাম;

পিয়াসী,
  কেমন আছিস? আমি ভাল নেই, তোরা খুব ভাল থাকিস। এখানে আমার কোন বন্ধু নেই। শুভ জন্মদিন। এই আমার ঘর বাড়ি ছেড়ে প্রথম বিদেশ। তোদের কথা খুব মনে পড়ে।"-আর লিখতে হল না, পিছন থেকে শ্রাবণীর গলার আওয়াজ শুনলাম-"আর লিখিতে হবে না বিদেশিনী। এবার আহার করিবে চল।"তাকিয়ে দেখি, শ্রাবণী হাসছে পুরো। বলল- "তুই বিদেশ -এ এসেছিস বুঝি! তুই কোন দেশ থেকে কোন দেশ-এ এসেছিস? আমি চিনি গো চিনি তোমারে-----, ওগো বিদেশিনী, -----। ওঠ চল, খাবি।" আমি বললাম,- "খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেলে খেতে দেয় না।" শ্রাবণী বলল-"তুই দুপুরেও টিফিন খাস নি। এভাবে থাকলে শরীর অসুস্থ হবে বলে চুপচাপ নিজের খাবারটুকু টিফিনবাক্সে তুলে লুকিয়ে এনেছি। খা, খেয়ে বলিস তো বিদেশের খাওয়ার কেমন লাগল ।"

-"তুই কি খাবি তালে!"

-"আরে আমার শরীরে যেটুকু মেদ জমেছে কমে যাবে একবেলা না খেলে। তুই খা চুপচাপ।"

-হঠাত, মায়ের আঁচল, পিয়াসীর কথা মনে পড়ে গেল। বললাম -"দেশ বলে কিছু থাকে না, মানুষের মনই হয়ে ওঠে স্বদেশ।" শ্রাবণী হেসে দিল, বলল "না, তুই খুব মিষ্টি সাহিত্যিক হবি রে, তা কোন দেশের পক্ষ থেকে নোবেল প্রতিযোগীতায় যাবি?" বলেই আবার হাসতে শুরু করল। এই প্রথম আমি ওর মুখে পিয়াসীর মুখ দেখতে পেলাম। সত্যি আমি কি বোকা! না বুঝে যে কেন মানুষ সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ভাবি, ভগনান জানে। পরের দিন, শ্রাবণী চিঠিটা পোষ্ট করেছিল আমার সাথে গিয়ে। বলেছিল-"তোর স্বদেশী বান্ধবীটিও কি তোর মতই রে, বোকার মত বাসস্টপের বুড়িগুলোকে ৫ টাকার নোট দেয়, জানিস এসব ব্যবসা।" দিলাম পিঠে দুমাদুম। হেসে উঠল শ্রাবণী। আমার একটি নতুন প্রিয় বান্ধবী হল।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৪৫৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৬/১২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আপনি ভালো লিখবেন সেই আশাতেই খুঁজে খুঁজে পড়ি। হতাশ করেন না।
  • অগ্নিপক্ষ ১৩/১২/২০১৪
    আমরা নিজের বাড়িতে একান্তে যেমন খুশি চলতে পারি। কিন্তু সামাজিকভাবে আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। তুমি বাড়িতে পা দিয়ে ভাত মেখে খেতে পারো - কেউ বারণ করবে না। কিন্তু সবার সঙ্গে বসে খেতে গেলে হাত দিয়েই মুখে তুলতে হবে। তেমনি সবার সঙ্গে যখন চাউমিন খাবে তখন কাঁটা দিয়ে খাবে আর একা একা খেলে চামচ দিয়ে।

    আর রেনেসাঁ নামটি তথা উচ্চারণটি ভুল। আমাদের ছোটবেলায় অনেক কিছু ভুল শেখানো হয়। যেমন বেগুনের ইংরিজি বৃঞ্ছল বা ভিন্ডির ইংরিজি লেডিস ফিঙ্গার। এই দুইটির আসল ইংরিজি যথা ক্রমে এগপ্ল্যান্ট এবং ওক্র্যা। অনুরূপে তোমার নিকের আসল উচ্চারণ হবে ( french ) রেনেসাঁস বা ( uk / us ) রেনেসান্স। তোমার ভার্চুয়াল নামটি অতি স্বত্বর ঠিক করে নাও!
    • রেনেসাঁ সাহা ১৪/১২/২০১৪
      আমার নিক নয়, প্রকৃত নামই রেনেসাঁ,। আর ইংরেজি বানান RENAISSANCE, যার উচ্চারণ রেনেসাঁস বা রেনেসান্স বা রেনেসাঁ (ইতালীয় ভাষা থেকে আগত ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে।)

      ধন্যবাদ। :-)
  • পরিতোষ ভৌমিক ০৯/১২/২০১৪
    পড়লাম, ভালো লাগলো বেশ ।
  • কিছু কাছের মানুষ আছে তাদের ভালোবাসা চেপে রেখে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উল্টো আচরণও করে। শ্রাবণীর কথা পড়তে গিয়ে আমার এমন এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল।

    গল্পকারকে অভিনন্দন পাঠক কুলকে আবেগাপ্লুত করতে পেরেছে বলে।
  • তুহিনা সীমা ০৮/১২/২০১৪
    বাবার চাকুরির কারনে অনেক জায়গায় বদলি হতে হয়েছে। অনেক স্কুল পাল্টাতে হয়েছে। আর এ জন্যই অনেক বন্ধু হয়েছে। আপনার লেখাটি পড়ে তাদের কথা মনে পড়ে গেলো।
  • বাহ সহজ সরল ভাষায় সুন্দর লিখেছেন। বেশ ভালো লাগলো আপনার নতুন পিয়াসির গল্প।
  • আবিদ আল আহসান ০৬/১২/২০১৪
    অসাধারণ গল্প। আমাকে একটু লিখা শিখিয়ে দিবেন কেমন
    • রেনেসাঁ সাহা ০৬/১২/২০১৪
      হি হি। :-)। ধন্যবাদ।
  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০৬/১২/২০১৪
    সমাজান্তরে মানুষের কৃষ্টি সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকেই। মফস্বলের তূলনায় বড় শহরের জীবনাচার বা কৃষ্টি সংস্কৃতির ভিন্নতার দরুণ প্রথমদিকে শ্রাবণীকে ভুল বোঝার বেশ কারণ ছিল বৈকি। কিন্তু শ্রাবণীও যে একজন সামাজিক মানুষ। সেও অনুভূতিময়, তারও আছে জীবনবোধ। ছোট কিংবা বড় উচু কিংবা নিচু, বন্ধু মানুষের চাই ই চাই। শ্রাবণী যতই নাক উঁচু স্বভাবের হোক না কেন তারও বন্ধু চাই। সেই বন্ধু বাৎসল্যতাই গল্পেটিতে বেশ সুন্দর ভাবে আঁকা হয়েছে। ঔন্নাসিকতার পাশাপাশি স্নেহ-প্রীতি আর মানবিক আবেগ সব মিলিয়ে একটা সার্থক গল্প হয়ে উঠেছে।

    কবিকে অভিনন্দন ও সান্ধ্য শুভেচ্ছা।
  • একনিষ্ঠ অনুগত ০৬/১২/২০১৪
    সত্যিই আপনি বড় সাহিত্যিক হবেন... :)
 
Quantcast