www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দেওয়ান বাড়ির সিন্দুক

গল্প-০৪



১৮ জুলাই ২০১৩ রাত ১০ টা,টঙ্গী,গাজীপুর।

করিমগঞ্জের দেওয়ান বাড়িতে হঠাৎ হৈচৈ শোনা গেল। এমনিতে দেওয়ান বাড়ির লোকজন উচু স্বরে কথাই বলেনা সেখানে শোরগোল হৈচৈ হচ্ছে বিষয়টা নিশ্চই সাংঘাতিক। আরজ আলী দেওয়ান এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী লোক। ছোট খাট বিচার আচারও তিনি হরহামেশা করে থকেন। তার কথার ওপর কেউ কথা বলতেই সাহস পায়না। সেই আরজ আলী দেওয়ানের বাড়িতে হৈচৈ হট্টগোলের শব্দ তাই মনে খটকা ধরায়।
তাহলে কি সাংঘাতিক কোন ঘটনা ঘটে গেল! দেওয়ান বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল রমিজ উদ্দিনের ছোট ছেলে হাবলু। হাবলুর বয়ষ তের বছর। দেখতে রাজপুত্রর মত আর বুদ্ধিতেও প্রখর। কিন্ত হাবলুদের পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালনা। একবেলা খায় তো দুই বেলা না খেয়ে থাকে। দেওয়ান বাড়ির লোকেরাও হাবলুকে খুব পছন্দ করে। শোরগোল শুনে হাবলুর মনে হল সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে তা না হলে সবাই এমন চিৎকার চেচামেচি করবে কেন। আজ গেটে দারোয়ানও নেই। তার মানে সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। হাবলু গেট ঠেলে বাসার ভিতর ঢুকে গেল। বাসার সবাই নিমগাছের নিচে জড় হয়েছে। হাবলু সেখানে গেল। হাবলুকে দেখেও কেউ কিছু বললোনা। অথচ অন্যসময় সবাই হাবলুকে খুব আদর করতো। দেওয়ান বাড়ির কাজের লোক আব্দুলে ছেলে তারিকুল হাবলুর খুব ভাল বন্ধু। হাবলু তারিকুলকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো ঘটনা কি? সবাই এতো হৈচৈ করছে কেন? তারিকুল তখন সব খুলে বললো। সব শুনে হাবুলর মাথায় হাত। আরজ আলী দেওয়ানের দাদা ছিলেন মস্ত জমিদার। তার নামে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেত। সেই দাদা মারা যাবার আগে একটা সিন্দুক রেখে গিয়েছিলেন এবং সিন্দুকের ওপর একটা ডায়রি রেখেছিলেন। সেই ডায়রিতে লিখা ছিল কিভাবে ব্যবহার করতে হয় আর সিন্দুকের ভিতরে কি ছিল তা কাউকে বলে যাননি। তবে সবার ধারণা মূল্যবান কিছু ছিল যার কারণে তিনি মারা যাওয়ার সময় বলেছেন ডায়রির সমস্যার সমাধান করে তবেই সিন্দক খুলতে। আজ পচিশ বছর সেই সমস্যার সামাধান কেউ করতে পারেনি এবং কেউ সিন্দুক খোলার সুযোগ পায়নি। আজ সকালে ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে বুয়া দেখলো সেই ডায়রিটা নিচেয় পড়ে আছে আর সিন্দুকের ডালা খোলা।ভিতরে উকি দিয়ে দেখা গেল কিছুই নেই। সাথে সাথে বুয়া চিৎকার করে উঠলো এবং তার চিৎকারে অন্যরাও জড় হল। এবং দেখা গেল দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন ঘেরা সিন্দুক খোলা এবং শূন্য পড়ে আছে। সবাই হায় হায় করে উঠলো। কে করলো এই সর্বনাশ। সবার একই প্রশ।ন। তারিকুলের মূখ থেকে সব শুনে হাবুলও চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিইতো কে খুললো এই সিন্দুক। পচিশ বছর ধরে চেষ্টা করেও যে সিন্দুকের রহস্য উদঘাটন হয়নি সেই সিন্দুক খুলে সব নিয়ে গেল কে সেই চোর। এ নিয়েই কানাঘুষা চলতে লাগলো। সেই সম্মিলিত শব্দের কারনেই এতো হট্টগোল। করিগঞ্জ থানায় জানানো হয়েছে আগেই। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ চলে আসলো। দেওয়ান বাড়ির সবার সাথেই থানার বড় বাবুর ভাল জানা শোনা ছিল। তারা আশ্বাস দিল কে খুলেছে তা তারা বের করেই ছাড়বে। এর পর একে একে বাড়ির সবাইকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করা হলো। কে খুলেছে কেউ স্বীকার করলোনা। সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেও তিনজনকে জিজ্ঞেস করা হলোনা।এক দেওয়ান সাহেব,দুই তার স্ত্রী এবং তিন নম্বর হলো তার বাগানের মালি অভিসন্ধি কুন্ডু। পুলিশ অভিসন্দি কুন্ডুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল দেওয়ান সাহেবই নিষেধ করলেন।তিনি বললেন কুন্ডু আমার সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তি। সে তার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড মিনিট আমার সেবায় নিয়োজিত থেকেছে আর তাছাড়া বাড়ির অন্দর মহলে এমনকি ড্রয়িং রুমে যাওয়ার সাহসও তার নেই। সব শুনে থানার বড় বাবু অভিসন্দি কুন্ডুকে কোন জেরা করলেন না। কিন্ত যে করেই হোক সমস্যার সমাধান করতেই হবে। খুজে বের করতে হবে মূল হোতাকে। দেওয়ান সাহেব গোয়েণ্দা বিভাগের সহযোগিতা চেয়ে লিখিত আবেদন করলেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার সিআইডিকে নির্দেশ দিলেন রহস্য উদঘাটন করতে। কিন্ত পনের দিন হয়ে যাওয়ার পরও কোন সমাধান মিললোনা। ওদিকে দেওয়ান বাড়ির বড় মেয়ের জামাই সরকারী তদন্তে বিশ্বাসী নয়। সে প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থায় যোগাযোগ করলেন। প্রাইভেট গোয়েন্দাদের মধ্যে প্রথমেই গেলেন মিসির আলীর কাছে। যদিও মিসির আলী গোয়েন্দা নন তবুও এ ধরনের সমস্যা তিনি সমাধান দিয়ে থাকেন।মিসির আলী অসুস্থ। তিনি কেস হাতে নিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। তাছাড়া তার মনটাও খুব বেশি ভালনা। গত বছর ১৯ জুলাই তার বন্ধু হুমায়ুন আহমেদ মারা যাবার পর থেকে তাই মিসি আলী নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। শেষে ভদ্রলোক হতাশ হয়ে তুখোড় গোয়েন্দা মাসুদ রানার অফিসে গেলেন।মাসুদ রানা দেশের বাইরে। বাহরাইনের বাদশা নাদির শাহ এর আমন্ত্রনে সেখানে গেছেন। কি আর করা হতাশ হয়ে তিনি আবার মিসির আলীর কাছে ফিরে আসলেন। যদি অনুনয় বিনয় করেও তাকে রাজি করানো যায়।দেওয়ান বাড়ির বড় মেয়ের জামাইয়ের নাম মিজানুর। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মিসির আলীকে তিনি অনেক অনুরোধ করলেন। সত্যি সত্যিই মিসির আলী খুব অসুস্থ। আর তাছাড়া তিনি এক কথার মানুষ। যা বলেন তার কোন হেরফের হয়না।তার এক ছাত্র তার সেবায় ব্যস্ত। স্যারের সেবায় ব্যস্থ থাকলেও ছেলেটা সবার কথা মন দিয়ে শুনছিল। ছেলেটার নাম সুফিয়ান। সবাই তাকে ডাকে জুনিয়র সুফিয়ান বলে। বয়স ২৯ বা তার কিছু বেশি।সে মিসির আলীর ছাত্র এবং দারুন ভক্ত।মিসির আলী অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই দিন রাত তার পাশে থেকে সেবা করে যাচ্ছে। লোকটার অনুরোধের মাত্রা বাড়তেই থাকলো। শেষে সুফিয়ান নামের ছেলেটা মিসির আলীকে অনুরোধ করে বললো স্যার আপনার অনুমতি পেলে আমিই কেসটা হাতে নিতাম। সুফিয়ানের ওরপর মিসির আলীর বিশ্বাস আছে। তিনি সুফিয়ানের ওপর দায়িথ্বটা দিলেন। ভদ্রলোক বোধহয় এতে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। তার পরও মেনে নিলেন। পরদিন সকালে মিসির আলীর অন্যতম ছাত্র জুনিয়র সুফিয়ান দেওয়ান বাড়ি এসে হাজির। তার চোখ জহুরীর চোখের চেয়ে তীক্ষন। সচেতন পদক্ষেপ,দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যেন একটা অনু পরিমান বিষয়ও চোখ এড়িয়ে না যায়। নিজের পরিচয় দিয়ে জুনিয়র সুফিয়ান সোজা চলে গেলেন সিন্দুকের কাছে। তাকে সিন্দুকের কাছে নিয়ে গেল দেওয়ান বাড়ির মালি অভিসন্দি কুন্ডু।দেওয়ান বাড়ি আসার আগে কম বেশি সব জেনে নিয়েছেন মিসির আলীর ছাত্র তরুন গোয়েন্দা জুনিয়র সুফিয়ান। দেওয়ান বাড়িতে ঢুকেই রহস্য সমাধানের একটা অংশ তার হাতে এসে গেল।তিনি সিন্দুকটার সামনে গিয়ে দাড়ালেন। অনেক পুরোনো একটা সিন্দুক। লম্বায় ছয়ফুট মত আর উচু প্রায় পৌনে তিন ফুট। কালো রং সিন্দুককে আরো বেশি রহস্যময় করে রেখেছে। বহু পুরোনো হলেও সিন্দুকটি চকচক করছে। যেন এইমাত্র তৈরি করে রং করে রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে। কি মনে করে জুনিয়ার সুফিয়ান সিন্দুকটা খুলতে চেষ্টা করলেন।। আসলে সেরকম চেষ্টা নয় বরং রহস্যের কিনারা ধরে একটু টান মারা আরকি। জুনিয়র সুফিয়ান যখন সিন্দুকের এক দিক ধরে টান দিচ্ছিলেন তখন বাগানের মালি অভিসন্দি কুন্ডু পাশে দাড়ানো। হঠাৎ অস্ফুট স্বরে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো ওভাবে নয়। গোয়েন্দা সুফিয়ান বলে উঠলেন কি বললেন। অভিসন্দি কুন্ডু খুব দ্রুত নিজেকে শুধরে নিলো। বললো না কিছুতো বলিনি। কিন্ত গোয়েন্দাদের চোখ যেমন ফাকি দেয়া যায়না তেমনি তাদের কানও ফাকি দেয়া যায়না। সুফিয়ান মালিকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বললেন না আমার মনে হল কেউ যেন কিছু বলছে। তিনি একটু এদিক ওদিক ঘুরলেন তারপর মালির দিকে চোখ রেখে বললেন সবার চোখ ফাকি দেয়া যায়না। সবাইকে ধোকা দেয়া যায়না। চোর নিজেই হয়তো জানেনা যে চুরি করার সময় সে চিহ্ন রেখে গেছে।গোয়েন্দা সুফিয়ানের কথঅ শুনে দেওয়ান বাড়ির মালির বুকটা কেপে উঠলো। ঘর থেকে বের হতে হতে তিনি মালিকে বললেন সেই ডায়রিটা তার চাই এবং বিকেলে দেওয়ান সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। এই বলে তিনি মালির হাতে একটা চিঠি ও একটা কলম ধরিয়ে দিলেন। সাথে বলে দিলেন সে যেন দেওয়ান সাহেবকে বলে যে সিন্দুক যারা খুলেছে তাদের খোজ পাওয়া গেছে। বলেই জুনিয়র সুফিয়ান মালির হাতে কলম আর চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। করিমগঞ্জের ভিতর দিয়ে নরসুন্ধ্যা নদী বয়ে চলেছে অবিরাম।তরুন গোয়েন্দা সেই নদীর ঘাটে গিয়ে বসলেন। মনে মনে কত কিছু ভাবলেন তার হিসাব নেই। ওদিকে গোয়েন্দা বেরিয়ে যাওয়ার পর মালি দেওয়ান সাহেবের সাথে দেখা করলো। আশে পাশে কেউ নেই। দেওয়ান সাহেব ইজি চেয়ারে বসে হুকো টানছিলেন। কুন্ডু ভিতরে এসে হুজুর একটু কথা চিল বলতেই তার দিকে ফিরে তাকালেন। হুকোর পাইপটা নামিয়ে রাখলেন। কুন্ডুর কপালে ভাজ পড়েছে। সেটা দেওয়ান সাহেবের চোখ এড়ালোনা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার কুন্ডু তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? আশে পাশে চোখ ঘুরিয়ে যখন দেখলো ধারে কাছে কেউ নেই তখন বাগানের মালি কুন্ডু ফিসফিস করে দেওয়ান সাহেবকে বললো অল্প বয়স্ক যে গোয়েন্দা এসেছে সে বলেছে ইতমধ্যে সে নাকি যারা সিন্দুক খুলেছে তাদের চিনতে পেরেছে। এ কথা শুনে দেওয়ান সাহেবের কপালেও ভাজ পড়লো। তিনি বললেন এটা কি করে সম্ভব। সে কি তোমাকে কোন প্রশ্ন করেছিল? মালি অভিসন্ধি কুন্ডু জানালো যে গোয়েন্দা তাকে কোন প্রশ্ন করেনি। দেওয়ান সাহেব একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন সব ভাওতাবাজি। কাউকে জিজ্ঞেস না করে কে সিন্দুক খুলেছে তা বের করা সম্ভব নয়।আচ্ছা সিন্দুকের ভিতরে যে দাদাজান সিন্ধু সভ্যতার.........................যা এখন অনেক মূল্যবান গোয়েন্দা কি সেটাও জেনেছে। মালি বললো গোয়েন্দা তাকে আর কিছু বলেনি শুধু বলেছে বিকেলে আপনার সাথে দেখা করবে আর কে সিন্দুক খুলেছে তা জানাবে। সাথে একটা চিঠি আর এই কলমটা দিয়ে বলেছে আপনাকে দিতে। ভাজ করা চিঠিটি মালির সামনেই খুললেন। সাদা একটা কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়। ওলট পালট করে দেখলেন তাতে কিছুই লেখা নেই। দেওয়ান সাহেব বুঝে উঠতে পারলেন না ঘটনাটা কি। তিনি কলমটি দিয়ে সেই কাগজে লিখতে চেষ্টা করলেন। দেখা গেল কলমে লেখা হচ্ছেনা। খুব উচু স্বরে নয় তবে হো হো করে হেসে দিলেন দেওয়ান সাহেব। বললেন দেখছো কি উদ্ভট কান্ড পাগলা গোয়েন্দা সাদা কাগজ ভাজ করে দিয়ে বলেছে এটা নাকি একটা চিঠি আর কালি ছাড়া একটা কলমও দিয়েছে। সে নিজেই এক বদ্ধ পাগল সে কি করে বের করবে যে কারা সিন্দুক খুলেছিল। দেওয়ান সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই মালি বললো হুজুর জিনিষটা কি দাদাজানের কবরের পাশেই রাখছেন না অন্য কোথাও। দেওয়ান সাহেব বললেন আরে নাহ তাই রাখা যায় নাকি। কী মহামুল্যবান জিনিষ। ওটা আমার বালিশের ভিতরে রেখেছি। বলে তিনি সাদা কাগজ আর কালি ছাড়া কলম মালির হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন যাও দেখ গোয়েন্দা কোথায় আছে।। এগুলো তাকে ফেরৎ দিয়ে আস আর বিকেলে আমার সাথে দেখা করতে বলো। আর সবাইকে বলো বিকেলে বাড়িতে থাকতে যেন পাগলা গোয়েন্দা কি বলে তা সবাই নিজ কানে শুনতে পায়। বলেই তিনি আবার হাসিতে লুটিয়ে পড়লেন। তবে আর যাই হোক তার হাসি চার দেয়ালের বাইরে গেলনা। বাগানের মালি সেই ভাজ করা সাদা কাগজ আর কালি বিহীন কলম নিয়ে দেওয়ান বাড়ি থেকে বের হলেন। উত্তর দিকে তাকাতেই দেখলেন গোয়েন্দা নদীর ধারে বসে আছে। তার পাশে হাবলু নামের ছেলেটাও বসা। হাবলুকে দেখেও কুন্ডু বাড়ির মালির কোন ভাবান্তর হলনা। তার মন তখন প্রফুল্ল। সে ভাজ করা কাগজ আর কলম ফিরিয়ে দিয়ে কৌতুক মেশানো সুরে বললো দেওয়ান সাহেব আপনার চিঠির উত্তর দিয়েছেন সুফিয়ান সাহেব ভাজ করা কাগজটি খুললেন। ঠিক আগের মতই আছে। তিনি মনটা একটু ভার ভার করলেন ওদিকে সেটা দেখে বাগানের মালির মূখটা হাসিতে উজ্জল হয়ে উঠলো। গোয়েন্দাদের চোখ কোন কিছুই এড়ায়না। মালি জানালো দেওয়ান সাহেব বিকেলে আপনার সাথে দেখা করবে বলেছে। তার পর আবার হাসি। সে যদি জানতো যে তার হাসি দু মিনিটেই বন্ধ হয়ে যাবে তাহলে সে হাসতোইনা। জুনিয়র সুফিয়ান কলমটা পকেটে রাখতে রাখতে বললো এতো হাসা ভালনা। আর দেওয়ান সাহেবকে বলুন শুধু শুধু আমাকে পাগলা গোয়েন্দা ভাবার কোন কারণ নেই। তার কথা শুনে মালির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে মূখ কাচু মাচু করে ফেললো। কে বলবে যে একটু আগে এই মুখটাই হাসিতে উজ্জল ছিল। সে কোন কথা না বাড়িয়ে পড়ি মরি করে দেওয়ান বাড়িতে ফিরে গেল। আসার সময় সে দেওয়ান সাহেবের দাদার লেখা ডায়রিটা নিয়ে এসেছিল সেটা এখন গোয়েন্দা জুনিয়র সুফিয়ানের হাতে। নদীর ধারে বসেই তিনি ডায়রির পাতা উল্টাচ্ছেন। তার পাশে তের বছরের হাবলু চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ডায়রির পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ খেয়াল হলো মাঝখান থেকে দুটো পাতা নেই। খুব ভাল করে লক্ষ্য করে দেখা গেল পাতা দুটো কয়েকদিনের মধ্যে ছেড়া হয়েছে। সুতরাং ওই দুটো পাতা ছাড়া যে ডায়রির রহস্য সমাধান সম্ভব নয় এটা বুঝতে তার বাকি থাকলো না। ওদিকে মালি ফিরে গিয়ে দেওয়ান সাহেবকে কি বললো তা কারো জানা নেই। বিকেল চারটার দিকে নদীর ঘাট থেকে উঠে দাড়ালেন শখের গোয়েন্দা জুনিয়র সুফিয়ান। তার সাথে উঠে দাড়ালো হাবলু নামের তের বছরের ছেলেটা। দুপুরে হাবলুর আনা একটা পেয়ারা দু ভাগ করে খেয়েছে এ ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়নি। বিকেলে হাবলুকে সাথে করে দেওয়ান বাড়িতে ঢুকতেই দেওয়ান সাহেব তাকে স্বাগত জানালেন। কাজের লোককে বললেন এই তোমরা গোয়েন্দা সাহেবকে খানার এন্তেজাম কর। জুনিয়র সুফিয়ান খেয়াল করলেন দেওয়ান সাহেবের বলার ভিতরে তাচ্ছিল্য আছে। তার পরও তিনি কিছু বললেন না। তার পাশে হাবলুকে দেখে দেওয়ান সাহেব বললেন আরে আমাদের হাবলু যে তা কি খবর এদিকে এসো। হাবলু দেওয়ান সাহেবের পাশে গিয়ে দাড়ালো। দেওয়ান সাহেব হাবলুর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললেন তা হাবলু মশায় তুমিও কি গোয়েন্দা হতে চাও? হাবলু বুঝে না বুঝে মাথা নাড়ালো। জুনিয়র সুফিয়ানের মাঝে কোন তাড়া নেই। তাকে দেখলে মনে হয় অল্প বয়সী মিসির আলী। কোন কিছুতেই সে বিচলিত নয়। ধীরে ধীরে খাওয়া শেষ করলেন। তার সাথে হাবলুও পেট ভরে খেলো। অনেকদিন পর হাবলু পেট ভরে ভাল খাবার খেলো। খাওয়া শেষে গোয়েন্দা সোফায় গিয়ে বসলেন। একে একে বাসার সবাই এসে হাজির হল। দেওয়ান সাহেব বললেন গোয়েন্দা সাহেব এবার বলুন কে সিন্দুক খুলেছে আর সিন্দুকের ভিতরে কি ছিল। জুনিয়র সুফিয়ান পকেটে রাখা কলমটা হাতে নিলেন। সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে চেহারায় গাম্ভির্য আনলেন এবং বলতে শুরু করলেন “ সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা নিজেকে চালাক মনে করে অত্যাধিক জ্ঞানী মনে করে অন্যকে তাচ্ছিল্য করে অথচ তারা জানেনা যে তাদের চেয়ে আরো অনেকে বেশি জানে। অন্যের জন্য ফাদ পাতলে তাতে নিজেই আটকা পড়তে হয়।“
তরুণ গোয়েন্দার কথা বোধহয় কারো খুব এটা ভাল লাগছিলনা। সেটা সবার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। দেওয়ান সাহেব বললেন ভণিতা না করে সোজা বলুন। তরুণ গোয়েন্দা জুনিয়র সুফিয়ান জানালেন সত্য কথা শুনলে সবার হৃদয় ভেঙ্গে যাবে। কিন্ত এসেছি যখন তখনতো বলতেই হয়। সিন্দুকটা খুলেছিল এ বাড়ির দুজন লোক। একথা শুনে সবাই একে অন্যের মূখের দিকে তাকালো। শুধু মালি আর দেওয়ান সাহেব এক পলকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দেওয়ানসাহেবের বড় মেয়ের জামাই জিজ্ঞেস করলেন কারা সেই দুইজন ? তরুণ গোয়েন্দা বললেন তাদের একজন এ বাড়ির মালি অভিসন্ধি কুন্ডু। সবাই অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকালো। দেওয়ান সাহেব অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন ওহে গোয়েন্দা আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? সে তার জন্ম থেকে এ বাড়িতে আছে। সে কিছুতেই এ কাজ করতে পারেনা। আর তা ছাড়া সে লেখাপড়াও জানেনা যে সে ডায়রী পড়ে সিন্দুক খুলবে। আর তাছাড়া বাড়ির ভিতরে তার প্রবেশের কোন অধিকার দেয়া হয়নি। অন্যরাও সেই সাথে সুর মিলালো। তরুণ গোয়েন্দা বললো কুন্ডু পড়ালেখা জানেনা ঠিক আছে কিন্ত আমি বলেছি এ বাড়ির দুজন সিন্দুক খুলেছে। বাকিজনতো পড়ালেখা জানে। সবাই বলে উঠলো সেই বাকি জনকে? জুনিয়র সুফিয়ান দেওয়ান সাহেবের মূখের দিকে তাকালেন। লোকটা এলাকায় খুব সম্মানি ব্যক্তি। তার অসম্মান হোক এটা কেউ চায়না। তিনি দেখলেন দেওয়ান সাহেবের মূখটা মলিন হয়ে গেছে। তারপরও দেওয়ানী রক্তের জোর দেখানোর জন্য তিনি বললেন বাকি জনের নাম বলুন অথবা সিন্দুকের ভিতরে কি ছিল তা বলুন। এটুকু বলতে গিয়ে তার গলা কেপে উঠলো। অন্যরা খেয়াল করুক না করুক গোয়েন্দা সুফিয়ানের দৃষ্টি এড়াতে পারলোনা। তিনি হাবলুকে বললেন দেওয়ান সাহেবের রুম থেকে ওনার বালিশটা নিয়ে আস। এবার দেওয়ানসাহেবের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বালিশটা আনতেই তরুন গোয়েন্দা সেটার কভার ছিড়ে ফেললেন। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন স্বর্ণমুদ্রা। অন্যরা অবাক হয়ে সেগুলো দেখতে লাগলো। এর মাঝেই পুলিশ চলে আসলো। গোয়েন্দা নিজেই তাদের আসতে ফোন করেছিল। পুলিশ দেখে কুন্ডু নামের মালি ভয়ে কুচকে গেল। কাচুমাচু স্বরে বললো আমি কিছু জানিনা দেওয়ান সাহেব আমারে যেভাবে বলেছে আমি সেভাবেই করেছি। গোয়েন্দা জুনিয়র সুফিয়ানকে বলতে হলনা কে সেউ দ্বিতীয় ব্যক্তি। সবাই ছি ছি করে উঠলো। থানার বড় বাবু মুদ্রাগুলো নিতে নিতে বললেন এমনটি না করলেও পারতেন। দেওয়ানসাহেবের আর কিছু বলার থাকলোনা। সবাই যার যার ঘরে যাওয়ার আগে দেওয়ানসাহেব সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তিনি জানতেও পারলেন না কে তাকে ক্ষমা করলো আর কে করলোনা। থানার বড় বাবু তরুণ শখের গোয়েন্দা জুনিয়র সুফিয়ানের সাথে হ্যান্ডশেক করে তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। দেওয়ান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোয়েন্দা যখন মিসির আলেীর বাসার দিকে হাটছিলেন তার পাশে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে হাটছিল তের বছরের হাবলু। তার চোখের দৃষ্টিই বলছিল সে জানতে চায় গোয়েন্দা কিভাবে বুঝলেন যে ওরাই সিন্দুক খুলেছে। জুনিয়র সুফিয়ান কোন কথা বললেন না কেবল পকেট থেকে কলমটা বের করে একটা বোতাম চাপলেন আর দেওয়ান সাহেবের গলা শোনা গেল।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৫/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • দীপঙ্কর বেরা ০১/০৬/২০১৪
    বাহ বেশ ।
    অবগাহনের ওয়েব পেজ একটু জানাবেন ।
    • জাজাফী ০৫/০৬/২০১৪
      ধন্যবাদ। সামনে অবগাহনের ঈদ সংখ্যা প্রেস থেকে বের হবে। আশা করি লিখবেন। বর্তমানে অবগাহনের মূল সাইটের কাজ চলছে। তবে ডেমো সাইটের লিংক দিলাম দেখুন www.obogaahon.blogspot.com
  • ভাল লাগল !
  • তাইবুল ইসলাম ২১/০৫/২০১৪
    গল্পের প্রতিটি চরিত্র তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে চরম অবস্থানে আছে
    খুব ভাল লাগল
    শুভেচ্ছা নেবেন
    • জাজাফী ৩১/০৫/২০১৪
      আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করলো।আপনার শুভেচ্ছা গ্রহণ করলাম। ধন্যবাদ।
  • প্রবাসী পাঠক ২১/০৫/২০১৪
    চমৎকার লিখেছেন। সাবলীল বর্ণনা। লেখাটা একসাথে না দিয়ে প্যারা করে দিলে পাঠকদের পড়তে সুবিধা হত। দৃশ্যপট অনুযায়ী প্যারা করে দিলে ভাল হত।
  • সুরজিৎ সী ২১/০৫/২০১৪
    চমৎকার লেখনী
  • কবি মোঃ ইকবাল ২১/০৫/২০১৪
    একটু সময় নিয়ে পড়লাম। ভালো লাগলো ভাই।
    • জাজাফী ৩১/০৫/২০১৪
      আপনার ভাললাগা আমায় অনুপ্রাণিত করলো। ধন্যবাদ।
 
Quantcast