www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্পের শেষ নেই

পেরেরা সাহেব বসে আছে পাক আর্মি কমান্ডারের সামনে। বেশ ছোকরা বয়সের হলে বেশ তেজ আছে বলতে হবে। বিহারী টাইপের চেহারা। পেরেরাকে ধরা হয়েছে কালীগঞ্জ বাজারের টেলিসামাদের আলুর দোকান থেকে। পেরেরার চোখ বাঁধা। খালি গা। অবশ্য ডিসেম্বরের এই কনকনে শীতে তাকে সারা রাত খালি গায়ে বাইরে ফেলে রাখা হয়েছিল। পেরেরা ভয়ে কাঁপ্ছে। জানি না তার কপালে আজ কি আছে। ভইয়ে সে পাজামায় দু'বার পেসাবও করে ফেলেছে। কমান্ডার তাকে জিজ্ঞাস করল, কি নাম?
-পেরেরা
-খালি পেরেরা? আশে পাশে কোন নাম নাই? পেরেরা ভয়ে সব ভুলে গেছে। এমন কি নিজের নামও। জাবাব দিচ্ছিস না কেন?
-স্যার ভয়ে ভুলে গেছি। কিছুই মনে করতে পারছি না।
-হিন্দু?
-না স্যার, খ্রীষ্টান।
-বাকী মুক্তিরা কোথায়?
-স্যার বিশ্বাস করেন, আমি কোন মুক্তি বাহিনীকে চিনিনা। এমন কি জীবনে চোখেও দেখি নাই। আমি সামান্য কবি। কবিতা লিখি আর ঘুরে বেড়াই।
-আচ্ছা লেখক। হা হা হা। শালা। লেখক, দেখি হাতটা। পেরেরা হাতটা বাড়িয়ে দিতেই হাতের কাছে থাকা একটি মোটা লোহার দন্ড দিয়ে তার পাঁচ আঙ্গুলে এমন আঘাত করল, সাথে সাথে পাঁচটি আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়। পেরেরা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

পেরেরা জানে তার এই নরক যন্ত্রনা থেকে রক্ষা নেই। মৃত্যু ছাড়া এই ক্যাম্প থেকে সে কোন দিন বের হতে পারবে না। পেরেরা স্বাধীন বাংলা বেতারের গান গ্রামের লোকদের শোনাতো। এছাড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করত মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর জন্য। এলাকার পাগলা কবি হিসেবে তাকে সবাই চিনে জানে, এই জন্য তাকে কেউ সন্দেহ করতে পারেনি যে সে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী। ভীতু প্রকৃতির হোয়ার কারনে তাকে মুক্তি বাহিনীতে নেওয়া হয়নি। তাই সে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করে আস্ছে যুদ্ধের শুরু থেকে। গতকাল সে গিয়েছিল কালিগঞ্জ বাজারে মুক্তিবাহিনীদের জন্য বাজার করতে। সেখানেই সে ধরা পড়ে পাক বাহিনীর কাছে।

পেরেরা সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে। শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আঙ্গুলে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। নাড়াতে পারছে না। তাকে আবার কমান্ডারের সামনে আনা হলো। কমান্দারের মেজাজ আরো চড়া। কারন মুক্তিবাহিনী ও কালীগঞ্জ এলাকাবাসীরা আড়িখোলা রেল ষ্টেশনের কাছে রেল লাইন উপড়ে ফেলেছে। এই কারনে ঢাকা থেকে তাদের কোন রশদ আসতে পারছে না। পাকিরা ক্ষিপ্ত হয়ে গতকাল রাঙ্গামাটিয়া গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছে। অনেক লুট্পাট ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরেছে। বিহারী কমান্ডার আবার জিজ্ঞাস করল, বল তোদের সংখ্যা কত জন? ইন্ডিয়ান জওয়ান কত জন?
-স্যার আমি কিছুই জানি না, আমি মুক্তি চিনি না।
-ওদের ব্যাংকারগুলো কোথায়? আর কে কে আছে তোর সাথে।
-স্যার আমি কিছুই জানি না। আমি কবি মানুষ।কবিতার লাইন ছাড়া কিছুই চিনি না। বিশ্বাস না হয় এই কালুকে গিজ্ঞাস করেন। কালু আমাদের বাড়িতে কামলা খাটে। কালু ছুপ করে আছে মাথা নিচু করে। সে রাজাকারে নাম লিখিয়েছে। পাকিদের খেদমত ও লুটপাট করে। কালু কিছুই বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে একবার পেরেরার মুখের দিকে চাইল। তার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। কমান্ডারের কালুর ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখালো না।
কমান্ডার এবার এক জওয়ানের কানে কানে যেন কি বলল। জওয়ানটি এসেই তার পাজামা এক টানে খুলে ফেলল। অবশ্য তার পাজাম অর্ধেক খোলাই ছিল। সাথে সাথেই চিতকার করে বলল, স্যার এই আদমী মালোয়ান। বলেই পেরেরার নিম্নাঙ্গে এমন লাথি মারল সাথে সাথেই পেরেরা অজ্ঞান। না এবার আর তার রক্ষে নেই। মনে হচ্ছে সে মারা যাচ্ছে। কোন এক অন্ধকার গলিরে সে একা একা হেঁটে যাচ্ছে।

তিন দিন পেরেরা অজ্ঞান অবস্থায় ছিল। আজ সকালে তার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ সামান্য খোলতেই যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠল। তার সামনে মাথা নিচু করে কালু দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কালুর স্ত্রী। পেরেরা কিছুই বুঝতে পারল না কি হচ্ছে। অনেক কষ্টে শুধু একবার বলল, কালু আমি কোথায়? আমি কি মারা গেছি? কালু হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
পেরেরা দা, আমি বেঈমান, গাদ্দার দেশের সাথে, আপনার সাথে বেঈমানী করেছি। আমারে আপনে মেরে ফেলেন। এবার পেরেরা গিজ্ঞাস করল, বল কালু কি হয়েছিল আমার? কিভাবে বেঁচে আছি?
-পেরেরা দা, আপনি লাথি খেয়ে যখন অজ্ঞান হইলেন, তখন পাকিরা ভাবল আপনি মারা গেছেন। আমি আপনার কাছে গিয়ে দেখলাম আপনার শ্বাস কাজ করছে। কমান্ডারকে অনেক অনুরোধ করলাম। বললাম স্যার লাশটা দেন, কুত্তার দিয়ে খাওয়াই। রাজী হইল। কাঁধে করে আমার বাড়ি নিয়ে আসলাম। সবাই মিলে সেবা করলাম। তিনদিন আপনার হুশ ছিল না। ভাবলাম আপনাকে সেবা দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করি। আপনাদের বাড়িতে আমাকে কাজ না দিলে না খেয়ে মারা যেতাম। আপনার সাথে বেঈমানী কেমনে করি বলেন?

দেশ স্বাধীন হলো। পেরেরা হাঁটতে পারে না। কালূ তাকে বহন করে ভিবিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়।পঙ্গু থাকার কারনে সে আজ ভিক্ষে করে খায়। কালীগঞ্জ মদনার মিষ্টির দোকানের পাশে বসে ভিক্ষে করে। কালুও তার সাথে বসে থাকে।

আজ সকাল সকাল কালুকে নিয়ে বাজারে চলে আসে ভিক্ষে করতে। কিন্তু কিছু লোক তাকে সেখানে বসতে দেয়নি। আজ নাকি এখান জনসভা আছে। ঢাকা থেকে মন্ত্রী আসবে। পেরেরা এক লোককে জিজ্ঞাস করে,'ও ভাই কোন মন্ত্রী আসবে?
- আরে বাপরে ফকিরেও মন্ত্রীর নাম জানতে চায়? ও মিয়া চিনবা? সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী কেরামত আলী।
পেরেরা কেরামতকে চিনে কুখ্যাত রাজাকার ছিল। একবার ধরা পড়েছিলো মুক্তযোদ্ধাদের হাতে। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানের অনুরোধে বেঁচে যায়। পেরেরা আর কোন কথা বলল না। শুধু মুখ থেকে এক দলা থুতু রাস্তার মাঝখানে ফেলে কালুকে নিয়ে চলে গেল।সে আজ ভিক্ষে করবে না।

১২/১০/২০১৩

(হৃদয়ে একাত্তর)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০২৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/১২/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • אולי כולנו טועים ১৪/১২/২০১৩
    এই গল্পের শেষ হবে একদিন।
    সুন্দর লিখেছেন।
  • আফিয়া খাতুন মলি ১৩/১২/২০১৩
    দারুন লিখেছেন। এখনও এই রাজাকার আর নব্য রাজাকারের দল স্বাধীন ভাবে দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নব্য রাজাকারে দেশ ছেয়ে গেছে। ভয়ংকর।
  • Înšigniã Āvî ১৩/১২/২০১৩
    বাস্তবের অনুভুতি মনকে চঞ্চল করে দেয়
  • ইসমাত ইয়াসমিন ১২/১২/২০১৩
    ভাল লাগল। এই সব রাজাকার রাই এখন দেশের বড় বড় পদে বসে আছেন। আর মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে বেচে আছে।
 
Quantcast