www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

চোরকাঁটা - ১২ পর্ব

( গত সংখ্যার পর )



আমি তাড়াতাড়ি সব কাগজ গুলো একজায়গায় করে গুছিয়ে নিয়ে, আবার পলিথিনের প্যাকেটে ভরে রাখছিলাম, কিন্তু একি, মুকুলিকার ছবির খামটা কোথায় গেলো? আমি চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু মুকুলিকার ছবি ভরা খামটা আর পেলাম না। সমস্ত কাগজ গুলো জলে ভিজে চুপসে গেছে। আমার নিজের নির্বুদ্ধিতার উপরে নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হল। চকিতে আমি ঘড়ি দেখে বুঝলাম, যে সাকুল্যে আমি মিনিট পনেরো সময় অর্ক কে খুঁজতে গিয়ে নষ্ট করেছি, আর এরই মধ্যে কেউ এইসব ঘেঁটে মুকুলিকার ছবি ভরা খাম নিয়ে চম্পট দিয়েছে। কিন্তু কেন? মুকুলিকার ছবিগুলোতে কি আছে? যাই হোক, অন্য কাগজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করছিলাম, পাশ থেকে ইটের টুকরোতে লাগানো কাগজটাও তুলে নিজের পকেটে রেখে দিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করব ভাবছি, ভদ্রদাকে ফোনে করব কিনা ভাবছি, তখনই দেখতে পেলাম অর্ক এদিকে এগিয়ে আসছে।

অর্ককে দেখতে পেয়ে আমি পাগলের মত চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিরে কোথায় ছিলিস তুই ? আমি তখন থেকে তোকে খুজছি...অর্ক হাত তুলে আমায় শান্ত হতে বলল – তারপর আমায় বলল -  তুই ঠিক আছিস তো ? আমিও ঠিক আছি। চল আমাদের বাড়ি চল, আমি তোকে একা আর তোর বাড়ি যেতে দেব না এখন, কাল সকালে একেবারে থানা থেকে ঘুরে, বাড়ি ফিরে অফিসে চলে যাস।

আমি ওকে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম – অর্ক তোর হাতে তো লেগেছে নাকি ? দেখি... অর্ক হাতটা সামনে মেলে ধরে বলল- না রে ইটটা এসে লেগেছে পলিথিনের প্যাকেটটাতে, আমি বাঁ হাতে সিগারেটটা ধরে ছিলাম আবার কবজিটা প্যাকেটের মধ্যে ঢোকানো ছিল আগে থেকে। তাই প্যাকেটটা আমার ঠিক বুকের কাছে ছলে এসেছিলো সিগারেটটা টানতে যাবার সময়। কি নির্ভুল টিপ একবার বোঝ, একেবারে বুকের দিকে তাক করে মেরেছিল...প্যাকেটটাই বাচিয়ে দিল রে। এত জোরে মেরেছিল যে প্যাকেটটা ছিঁড়ে পরে গেলো, আর তাতেই হাতে একটু ছড়ে গেছে। যাই হোক, একটুর জন্য ধরতে পারলাম না রে, ফস্কে গেলো। চল এবারে, এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে হবে না।

আর কাকে কি বলব, অর্ককেও তো কথাটা বলতে পারছি না, যে প্যাকেট থেকে ছবি ভরা খাম উধাও। আর তার জন্য দায়ী আমি নিজে, তাও পকেট থেকে ইট মোড়ানো কাগজটা অর্ক কে দিয়ে বললাম, এতে তো কিছু লেখা নেই... অর্ক না দেখেই বলল – আগে বাড়ি চল , তখন সব কিছু দেখব। অগত্যা আর কি করা আমার ফোন থেকে ফোন করে অর্ক মাকে জানিয়ে দিল যে আমি আজকে রাত্রে আর বাড়ি যাচ্ছি না...আমরা অর্কদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।


এখনো মাথাটা ঝিম ধরে আছে, এই প্রথম আমরা সরাসরি কোনও বিপদের সম্মুক্ষীন হলাম। অর্ক ঘরে ঢুকে প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটটা খুলে কাগজপত্র গুলো বার করে দেখতে দেখতে বলে উঠল – আরে ছবি গুলো গেলো কোথায় ? আমি আর উপায় না পেয়ে অর্ককে পুরো ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বললাম। শুনতে শুনতে অর্কর চোখ কুঁচকে গেলো। আমার দিকে সোজা তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল – কিন্তু আমি যে তোকে বলে গেলাম তুই আগে ওইগুলো নিজের কাছে রাখ...আমি মাথা নীচু করে বললাম আমার কাছে সবচেয়ে আগে তুই, যদি তোর কোনও বিপদ হতো তাহলে?

এইবারে অর্ক হঠাৎ হাসতে হাসতে বলে উঠল – সত্যি বন্ধু তোমার জুড়ি মেলা ভার। যাই হোক আর একটা জিনিশ মিসিং দেখছি যে, আমি অবাক হয়ে তাকাতেই অর্ক বলে উঠল মুকুলিকার জন্মের শংসা পত্রটাও গায়েব দেখছি যে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে বললাম, বলিস কি রে মিনিট পনেরোর মধ্যেই এত কিছু, কিন্তু কি ভাবে? এত প্রফেশনাল এরা ?

অর্ক গম্ভীর ভাবে বলে উঠল – হু তাই তো দেখছি, যাই হোক চিন্তা করিস না, দেখি কি করা যায়। আমরা তো এরকমই কিছু একটা চেয়েছিলাম তাই না ? ভালই হয়েছে। আমি চমকে উঠে বললাম – মানে? কি আবোল তাবোল বকছিস ?

অর্ক এবারে উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল -  মানিকচাঁদ,  তোর কি মনে হয় আমি এমনি এমনি চার রাস্তার মোড়ে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম ? ওটা আমার প্ল্যানিং ছিল... এবারে আমার আরও অবাক হবার পালা...। আমি বললাম – মানে? মানে কিছুই না, চেম্বার থেকে বেরিয়েই লক্ষ্য করেছিলাম, একজোড়া ছায়া আমাদেরকে অনুসরণ করছে। বুঝলাম কিছু একটা করার মতলবে এরা এসেছে, ওদের কে টাইম দিলাম কিছু করার জন্য, তো তাতে কাজ ভালই হল, কিন্তু খেয়াল করলাম, যে শুধু একজন পালাল, আর একজন কে দেখতে পেলাম না, তখনই বুঝলাম যে ওদের মতলব আমাদের হাতের প্যাকেটটা। তাই আর কালবিলম্ব না করে ছায়ামূর্তির পিছু নিলাম, কিছু দূর গিয়েই তোকেও ডেকে নিলাম, কারণ জানতাম এত অল্প সময়ের মধ্যে তুইও সেগুল গোছাতে পারবি না, আর তুই ও আমার পিছু পিছু এসে গেলি...আমি চা এর দোকানে লুকিয়ে পড়লাম যাতে তুই ও আমায় খুঁজে না পাস...কারন না হলে আমাদের কথাবার্তা হতো আর এই শীতের রাতে হয়ত ওরা শুনতে পারত। তুই গলির মধ্যে যেতেই, আমি আবার বেড়িয়ে ওই মোড়ের কাছে গাছের গোঁড়ায় লুকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম, দেখলাম অপরজন ততক্ষনে, প্লানমাফিক প্লাস্টিক থেকে ছবির খামটা ও একটা কাগজ নিয়ে বাকি গুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়েই আবার দ্রুতপদে চলে গেলো।

কিন্তু ওরা বুঝতেও পারলো না যে আমি এখন ওদের দিকে নজর রেখেছিলাম। তারপর আমি পিছন নিলাম, দেখলাম দৌড়ে ছায়ামূর্তিটা মুকুলিকাদের বাড়ির গলিতে ঢুকে গেলো আর তারপর ওদেরই বাড়ির পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে পালিয়ে গেলো

আমি বলে উঠলাম – মানে ? তাহলে কি ওখানকার কোনও ভাড়াটে নাকি ...? অর্ক আর কিছু বলল না, চুপ করে গেলো, খালি বলল -  কিন্তু... আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম কিসের কিন্তু? ও হেসে বলল – কিছু না, এমনি ভাবছি, ছবি গুলো নিয়ে চোর কি করবে ? আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, তুই আমায় না ডাকলে তো আমি ওখানেই থাকতে পারতাম, ওরাও আর কিছু নিতে পারত না...

আমার কথা শেষ না করতে দিয়ে অর্ক বলল – না, ওরা তোকেও একই ভাবে সরাবার চেষ্টা করত, তোকেও আহত করত, আমি তো প্লাস্টিকএর দয়ায় বেছে গেছি, তুই কি ভাবে বাঁচতিস? তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারলাম, তোকেও আর আহত হতে হল না, আর আমাদের উদ্দেশ্যও সফল হল... আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো, বললাম - তার মানে ওরা আমাদের উপরে সব সময় নজর রাখছে... বাপরে বাপ কি জোর বেঁচে গেছি...সত্যি তোর উপস্থিত বুদ্ধির জুড়ি নেই ভাই... কিন্তু এবারে ওইগুলো পাব কি করে ? না হলে আমাদের তদন্ত এগুবে কি করে? তুই কি লোকটাকে চিনতে পেরেছিস ?  

অর্ক হেসে বলে উঠল – ওরা শুধু আমাদের উপরে নজর রাখছে তা নয়, অবিনাশবাবুদের উপরেও সমান নজর আছে ওদের। তবে ওই জিনিসগুলোর আর বিশেষ দরকার নেই, কারণ ছবি গুলো আমার কাছেই আছে...এই বলে অর্ক পকেট থেকে একটা ছোট পেন ড্রাইভ বার করে আমাকে দিয়ে বলে উঠল, অবিনাশ বাবুকে যে কাগজটা দিয়েছিলাম লিখে যে আমাদের কি কি দরকার আছে পয়েন্ট করে করে, তার শেষে দুটো পয়েন্ট আরও ছিল...

১।  সবাই কে জানিয়ে দেবেন যে এগুলো আমরা আপনার কাছে চেয়েছি, আমি চাই এইগুলো যে আপনি আমাদেরকে দিচ্ছেন সেটা আপনার আশেপাশে থাকা সমস্ত লোক যেন জানতে পারে।

২।  আমাকে যা যা ডকুমেনটস দেবেন তার প্রত্যেকটির সফটকপি কোনও সাইবার ক্যাফে থেকে আমার এই পেনড্রাইভে তুলে দেবেন। এর যেন অন্যথা না হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে অপরাধীর এর উপর নজর থাকবে।

আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম, তুই গ্রেট অর্ক, সিমপ্লি গ্রেট... কিন্তু পেনড্রাইভটা তুই কখন দিলি...ওনাকে? আমি তো দেখতে পেলাম না...অর্ক উত্তরে কিছু না বলে শুধু হেসে উঠে বলল-  যাই হোক, তুই এক কাজ কর তুই খেয়ে শুয়ে পড়, আমাকে একটু কাজ করতে হবে।

আর কি করা, কাকীমার হাতের কষা মুরগীর মাংস ও গরম গরম রুটি দিয়ে রাত্রের খাবার খেয়ে একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে শুতে এসে দেখি, অর্ক তখনও ল্যাপটপে নিজের হেডফোনটা লাগিয়ে একমনে কিসব যেন শুনছে। আমি দুবার খাবার কথা জিজ্ঞাসা করাতে হাত তুলে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে আবার নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলো।

আমি বইটা নিয়ে লেপের তলায় ঢুকে পড়লাম আর কালবিলম্ব না করে, কিন্তু বই পড়ার ইচ্ছাটা কিছুতেই যেন আর আসছিলো না। খালি মনে হচ্ছিলো, ওরা কারা যারা আজ আমাদের উপরে আক্রমণ করেছিলো, ভাগ্যিস প্লাস্টিক ব্যাগটা অর্ক হাতে ধরেছিল, নাহলে, তো ইটের টুকরোটা সোজা ওর বুকে এসে লাগতো। আমরা কি পারবো এই অদৃশ্য অপরাধীদের ধরতে ? মুকুলিকা ওদের কি করেছিলো? নাকি অবিনাশবাবু আর তমালিকাদেবীর উপর রাগবশত কেউ এই কাজ করেছে। কিন্তু অর্ক লোকটার কথা চেপে গেলো কেন? আবার ওদিকে অর্ক একশো ভাগ নিশ্চিত যে ওনাদের অতীতের সাথে এই কেসএর কোনও যোগ নেই।, তবে অন্য কোনও ভাড়াটীয়া নাকি খোদ পাকরাশি জ্যেঠু ...না কিন্তু গত দশদিনে এমন কি হল, যে কেউ ওই ফুলের মতো মেয়েটিকে হত্যা করে দিল... কে জানে, আমরা সত্যি পারব তো ? যদি না পারি, তাহলে অবিনাশবাবু ও তমালিকাদেবীকে মুখ দেখাব কি করে ? পরাণদা কেই বা অর্ক কিভাবে ছাড়াবে? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। অর্ক কি এতো সহজে ছেড়ে দেবে ওদেরকে? ওরা ওর আত্মসম্মানে ঘা দিয়েছে আজ, আর যাই হোক, অর্ক কিছুতেই ওদের কে ছাড়বে না। এইসব ভাবতে ভাবতে আবার চোখ বুজে এলো।


( চলবে )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৩৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/১০/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ওরা যা পারে করুক, অর্ক তো আছে, আমাদের সাথে।
    কিন্তু আপনি কাকিমার হাতে কষা মুরগি মাংস খাবেন আর আমরা .....

    তাড়াতাড়ি করুন ! মানে অর্ককে বলুন তাড়াতাড়ি সলভ করতে। দেরী যে সয় না ভাই!

    দারুন ভাই দারুন !
  • শুভাশিষ আচার্য ২৯/১০/২০১৫
    আর কত অপেক্ষা। জমে গেছে।
  • ভালো চলছে। বেশ কিছু আগ্রহী পাঠক ও তৈরী হয়েছে। শংসা পত্র কথাটা মুখে ব্যবহার করা হয় না। সার্টিফিকেট লিখলে ভালো হোত।
 
Quantcast