www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গন্ধ - ৬ষ্ঠ পর্ব

( আগের সংখ্যার পর )


সুকুমার বাবু ওগুলোর দিকে এক নজর দিয়েই বলে উঠলেন – হ্যাঁ, আরে এগুলো তো সঞ্জয়ের। শেষ বার যখন কলকাতায় এসেছিল, নিউ মার্কেট থেকে আমি কিনে দিয়েছিলাম। অর্ক আবার জিজ্ঞেস করল – কবে এসেছিলেন এবং কেন? সুকুমার বাবু উত্তরে বললেন- আসলে, সঞ্জয় মাসদুইয়েক আগে এখানে এসেছিল, আমায় বলেছিল, যে ওর খুব সখ, এগুলো পরার, কারণ এতে নাকি ও নিজের ভারতীয় সত্ত্বাকে আরও ভাল ভাবে প্রকাশ করতে পারবে।
অর্ক এবার ছবি বার করে সুকুমারবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল - দেখুন তো আপনি এই ছবি চিনতে পারেন কিনা? সুকুমারবাবু ছবি দুটো দেখে বললেন, এটা তো সঞ্জয়ের, আর এটাও তো সঞ্জয়েরই মনে হচ্ছে। উইগ আর গোঁফটাও তো পরে আছে এই ছবিতে। কিন্তু...।
সুকুমারবাবুকে কথা বলা শেষ না করতে দিয়ে, অর্ক বলে উঠল – আরে, রসুন দাদা, এত তাড়াহুরো কিসের? এই বলে ভদ্রমশাইকে চোখটিপে একটা ইশারা করেই ও মিঃ তিচেরোর কাছে গিয়ে সেই উইগটা ওনার মাথায় পরিয়ে দিয়ে, আর গোঁফটা ওনার হাতে দিয়ে বলল- এবারে এটা একটু পরে ফেলুন মিঃ সুযুকি, তাড়াতাড়ি।
মিঃ সুযুকি, লাফিয়ে উঠে সরে যেতে গেলেন, কিন্তু, পিছন থেকে ভদ্র মশাইয়ের বজ্রমুষ্টির বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে আবার ধপ করে সোফায় বসে পরে একবার অসহায় ভাবে মিঃ তাকাহাসির দিকে তাকালেন, কিন্তু কোনও উপায়ন্তর না পেয়ে, গোঁফটা নিজের নাকের তলায় লাগাতে বাধ্য হলেন, আর সাথে সাথে দুজনের আর্ত চিৎকারে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকাতেই দেখলাম, সুকুমার বাবুর চোখ ছানাবড়া আবার ওদিকে জাপানীস কনস্যুলেটের ডেলীগেট মিঃ কাতসুমিও লাফিয়ে উঠে পরে বলছেন- ওহ মাই গড, দিস লুকস অলমোসট সঞ্জয় তাকাহাসি, লুক, আই হ্যাভ হিস পাসপোর্ট ফটোকপি।
অর্ক এবারে বজ্রকঠিন গলায় বলে উঠল- সঞ্জয়বাবু আপনি কি এবারে আপনার মুখে লাগানো মিঃ সুযুকির মাস্কটা নিজেই খুলবেন না আমরা খুলব? আমার কাছে ফাঁকি আপনি দিতে পারেন নি সঞ্জয়বাবু ওরফে নকল মিঃ সুযুকি। আমি অবাক বিস্ময়ে একবার মিঃ তিচেরো থুড়ি, সঞ্জয়বাবুকে দেখছিলাম আরেকবার মিঃ তাকাহাসির দিকে তাকাচ্ছিলাম। অর্ক মিঃ ভদ্র কে নির্দেশ দিল,- আপনি ফেস মাস্কটা খুলে নিন ওনার মুখ থেকে। কিন্তু তার আর দরকার পরল না, কারণ সঞ্জয়বাবু নিজেই মাস্কটা খুলে দিলেন, আর সাথে সাথে তার আসল চেহারা আমাদের সামনে চলে এল। ওনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল এক খাকি উর্দিধারী। মিঃ তাকাহাসির অবস্থা আরও শোচনীয়, বৃদ্ধ দুহাতে মুখ ঢেকে সোফাতে বসে ছিলেন, উনি মুখ তুললেন অর্কর কথাতে।
কি মিঃ তাকাহাসি, বলেছিলাম না আপনার ছেলেই নিজেকে খুন করেছে – হাসতে হাসতে অর্ক বলল এবং তারপরই গম্ভীর হয়ে বলল – কি ডেঞ্জারাস প্ল্যানিং মশাই? তো পুরো ঘটনাটা আপনি বলবেন না আমি বলব? এই নাও, প্রিতমদা, তোমাদের আসল কালপ্রিট... সঞ্জয় সান তাকাহাসি...
এই প্রথমবার আমার বুদ্ধি হয়ত আলোর রেখা দেখতে পেল, আমি বলে উঠলাম, বুঝেছি, তার মানে আসলে খুন হয়েছেন.........
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিঃ তাকাহাসি বলে উঠলেন – হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই, আমি খুন করেছি ওই শয়তান সুযুকি তিচেরোকে। আমার ছেলে কিছু করে নি, ওকে তোমরা ছেড়ে দাও, আমি সব কিছু কবুল করছি। আমায় তোমরা জেলে পাঠাও। দয়া করে ওকে ছেড়ে দাও।
বৃদ্ধ একেবারে ভেঙ্গে পরেছেন, চোখের জল মুছে, মুখটা একটু তুলে বললেন – আমি সব বলছি, কিন্তু তাহলে আপনাদেরকেও একটু পিছনের দিকে ফিরে যেতে হবে।  
আমার ঠাকুরদা মিঃ ইগেরো তাকাহাসি ছিলেন, জাপানের রাজ পরিবারের পারিবারিক বন্ধু। আমাদের বংশ পরম্পরার গরিমা ধরে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন সব সময়। আমার বাবাও সেটাই করে গেছেন আজীবনকাল। এইরকম বংশে আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই সমস্ত সুখ সুবিধা পেয়ে মানুষ হয়েছি, আমার বাবা আমায় সবরকম ভাবে সাপোর্ট করে গেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল বড় বৈজ্ঞানিক হবার, তার জন্য প্রচুর পরিশ্রমও করেছি। কিন্তু এই সুখের ছবিটা পাল্টে গেলো, আমার বিয়ে করার পর। আমার স্ত্রী ওআকাহামা বিশ্ববিদ্দ্যালয়ে আমার ল্যাব অ্যাসিসটেনট হিসাবে কাজ করত, আপনারা হয়ত জানেন না যে আমার স্ত্রী এই কলকাতার বাঙ্গালী মেয়ে ছিল। আমার পরিবার আমার এই বিয়ে মেনে নিতে পারল না, আর তারপরই আমার জীবনে অন্ধকার নেমে এল। আমাদেরকে গবেষণার ল্যাব থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। আমরা অসহায় ভাবে জীবন কাটাতে লাগলাম। যে কোনও কাজ করে জীবন চালাতে হচ্ছিল। তখনি আমাদের জীবনে এক পুত্রসন্তান এলো। আমার স্ত্রী সাধ করে ছেলের নাম রাখল সঞ্জয়।
যাই হোক এবারে, সুযুকির কথায় ফিরে আসি, ও ছিল আমার ছেলের স্কুলের বন্ধু। ছেলেটা অনেক নাম করেছিল জুনিয়ার বৈজ্ঞানিক হিসাবে। সে একদিন আমার কাছে, আসে আমার গবেষণার বিষয়ে জানার জন্য। আমায় বলল – সে নাকি বিশ্ববিদ্দ্যালয়ের আর্কাইভ থেকে আমার গবেষণার কিছু পুরন কাগজপত্র জোগাড় করেছিল। ও নিজেও আমার গবেষণার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে আমাকে ও এই বিষয়ে গবেষণা করার সাহায্য করতে চাইল। সুযুকি আমায় কথা দিল যে সে আমার হারানো সম্মান ফিরিয়ে দেবে এবং ওই আমাকে আবার বিশ্ববিদ্দ্যালয়ের গবেষণাগারে তার সিনিয়র হিসাবে জায়গা করে দেবে। শুধু তাই নয়, যদি আমাদের গবেষণা সফল হয়, তাহলে ও আমায় তার পেটেন্ট ও রয়্যালটি দুটোরই অধিকার দেবে। আমি প্রথমে আমি রাজী হয়নি, কিন্তু সঞ্জয় ও তার মা এর চাপে, আমাকে রাজী হতে হল।  
ঘরে তখন যেন পিন পরলেও শব্দ শোনা যাবে। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত মিঃ তাকাহাসির কথা শুনে চলেছি।
একটু দম নিয়ে উনি বার শুরু করলেন- কিন্তু, হায়, আমি ওখানে আবার কাজ শুরু করতে দেখি আমাকে তিচেরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে রাখা হয়েছে। আমি কাজ ছেড়ে দিতে চাইলে, তিচেরো আমায় অনুরোধ করে থেকে যাওয়ার জন্য, ও বলল – আসলে বিশ্ববিদ্দ্যালয়ের নিয়মানুসারে নাকি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা ও বদলাতে পারে নি, তবে কাজ সফল হলে বাকি প্রতিশ্রুতি ও নিশ্চয়ই রক্ষা করবে। যাই হোক আমি আবার নতুন উদ্দ্যমে কাজ শুরু করে দিলাম। আমার গত দশ বছরের প্রচেষ্টায় আমি আমার গবেষণায় সফল হলাম। কিন্তু বিধি বাম, এখানেও আমি হেরে গেলাম, আমার এত পরিশ্রমের সমস্ত সাফল্য নিয়ে নিল তিচেরো। আমার প্রাপ্য সম্মান আমায় দেওয়া হল না, আর এই দুঃখে আমার প্রিয় স্ত্রীও হৃদরোগে মারা গেলেন।
আপনারাই বলুন, এই অবস্থায়, আমার আর কি করার ছিল, যত না দুঃখ আমি আমার জন্য পেয়েছি, তার চেয়েও বেশি দুঃখ, আমার কাছে আমার স্ত্রীর মৃত্যু। হোঅ্যাট আ লাভলী ওইয়াইফ আই হ্যাড। - চোখের জল মুছে বৃদ্ধ বললেন। আমি আবার ভেঙ্গে পরলাম। আমার ছেলে সঞ্জয় ততদিনে প্রতিষ্ঠিত ইভেন্ট ম্যানেজার হয়ে উঠেছিল। সঞ্জয় আমার এই ভেঙ্গে পরা দেখতে পারল না, আমায় বলল ও যে করেই হোক, প্রতিশোধ নেবে। আমরা দুজনে মিলে প্ল্যান করলাম তিচেরোকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার। সঞ্জয় কে আমি আবার তিচেরোর কাছে নিয়ে গেলাম আমাদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য। সঞ্জয় ইংরাজীতে খুবই সাবলীল, তাই ও ওনার দোভাষীর কাজটাও করতে শুরু করল। সঞ্জয় আমাদের এই সফরের দু মাস আগেই কলকাতায় এসে প্রথমে প্ল্যানের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে নিয়ে গেলো। আমরা পরকল্পনা মতই কলকাতাতে প্রথমে আমাদের স্পীচটা দিতে এলাম, কিন্তু এখন বুঝছি, যে ওই খবরের কাগজের আর্টিকেলটাই আমাদের কাল হল। আমি জানতাম যে, তিচেরো একবার আমাদের পথ থেকে সরে গেলে, আমাকেই, এই গবেষণার বিষয়টা জাপানের সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে দিয়ে দেবে। বলতে পারেন, কেন, কেন আমি আমার সারাজীবনের পরিশ্রমের গবেষণা নিজের হাতছাড়া হতে দেব? এসব আমার গবেষণার ফল, অন্য কারুর নয়, বলতে বলতে বৃদ্ধ হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন।


(চলবে)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৬৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩০/০৭/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অভিষেক মিত্র ২২/০৮/২০১৫
    ভালোই
  • অনবদ্য লেখা। খুবই ভালো লাগলো। কিছু বানান শুদ্ধ করে নিতে হবে। শুভেচ্ছা রইল।
  • কিশোর কারুণিক ৩১/০৭/২০১৫
    সুন্দর
 
Quantcast