www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আদিবাসী -৭(শেষ পর্ব)

পাহাড়ের বুকে সূর্য ওঠার ঠিক আগ মুহূর্ত। গুহা থেকে ফিরে পুরনো কাঠের ঘরে সবাই বসে। বাতাস ভারী, কিন্তু বুকের ভেতর যেন খানিকটা হালকা।

রুদ্র, নিশি, রক্তিম, রিক্তা, ইজোমো, স্টালিন—আর সামনে থান ম্রো ও সাংবাদিক রাফি রায়হান।

টেবিলের ওপর রাখা সেই ধাতব ট্রাঙ্ক, তার ভেতরে অভিজিৎ সেনের জবানবন্দি, রিপোর্ট, ও ছবি। আর ঠিক পাশে রাফির ক্যামেরা, ল্যাপটপ, মোবাইল—সব কাজ করছে একসাথে।

রাফি বলল, — “সব তথ্য এখন আপলোড হচ্ছে। আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস পোর্টাল, ঢাকার বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম—সব জায়গায় পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল সকালেই এ নিয়ে জাতীয়ভাবে আলোড়ন উঠবে।”

নিশি ধীরে বলল, — “তাহলে অভিজিৎ সেন এখন আর একা নন।”

স্টালিন জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, — “পাহাড় এবার নিজের গল্প নিজেই বলবে।”

রক্তিম বলল, — “তবে এখনো আমাদের শোনার বাকি… সেই অধ্যায়টা, যা এই পাহাড়কে রক্তাক্ত করেছিল।”

সবাই থমকে তাকাল থান ম্রোর দিকে।

তিনি একটু চুপ করে রইলেন। তারপর শুরু করলেন—

— “সেই বছরটা ছিল ২০০৫। আমরা ভাবতাম সেনাবাহিনী শুধু রাস্তা বানাতে এসেছে, উন্নয়ন করতে এসেছে। তারপর একদিন মাঝরাতে ওরা এলো। ঘর জ্বালিয়ে দিল।পাড়াটাতে খুব অল্প মানুষই ছিল।সবাই নিরীহ,পরিশ্রমী কিন্তু শান্তিপ্রিয় ছিল। তবুও কিছু লোক প্রতিবাদ করেছিল, তাদের আর ফেরত আসতে দেখিনি।”সবচেয়ে ভয়ংকর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল শিশুদের।তোমরা দেখনি এই পাড়ায় সবার বয়স ৪০ এর উপরে।ঐ ঘটনায় পাড়ার মানুষ এতটাই রুদ্ধ হয়েছিল,,,তারা নতুন করে আর কোন শিশুর জন্ম দেয়নি। ঘটনার বিশ বছর পরও পাড়াটি আজও শিশু শূন্য।আর জনসংখ্যা শুধু কমছে।হয়তো একদিন এই পাড়া জনশূন্য হয়ে যাবে,এই পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকবে একা।

তার কণ্ঠ ভেঙে আসে। চোখে জল।

— “অভিজিৎ সেন তখন একজন তরুণ মেজর। সে স্পষ্ট করে বলেছিল—এই অভিযান বর্বরতা। ‘অপারেশন হাই নেস্ট’ নামের সেই পরিকল্পনায় ওর অংশগ্রহণে আপত্তি ছিল। তাই ওকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আসে। কিন্তু ওকে শুধু সরায়নি—ওকে ‘উদাহরণ’ বানিয়ে মেরে ফেলা হয়।”ওকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়।আমি যেহেতু প্রথম থেকে সেনাদের সাথেই ছিলাম, অভিজিৎ হত্যার প্লান আমার জানা ছিল। কিন্তু আমি তাকে সাবধান করিনি নিজের স্বার্থে।কারন অভিজিৎ পালিয়ে গেলে ওরা আমাকেই সন্দেহ করতো আর শাস্তি দিত।আমি ভুল করেছিলাম।
কান্নায় ভেঙে পড়ে থান ম্রো।

নিশি মুখে হাত চাপা দেয়। গলা ভার।

— “তুমি তখন কী করেছিলে?” জিজ্ঞেস করল রুদ্র।

থান ম্রো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, — “আমি নীরব থেকেছিলাম। কিন্তু ওর শেষ অনুরোধ শুনেছিলাম—‘আমার কণ্ঠস্বরকে মাটির নিচে রেখো না।’ সেই কথা আজ আমি পালন করতে পেরেছি।”

একটু নীরবতা।

রাফি ধীরে বলল, — “এই কাহিনী এখন শুধু প্রতিবেদন নয়—একটা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে থাকবে।”


---

দুদিন পর।

ঢাকার পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম—
“অভিজিৎ সেন হত্যা: পাহাড়ে সেনা নিপীড়নের গোপন ইতিহাস ফাঁস”
টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা—সবাই আওয়াজ তুলছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। সরকার বিবৃতি দিয়েছে। আর পাহাড়ে, সেই নিঃশব্দ গ্রামে, এক আশ্চর্য শান্তির আবহ।


---

শেষ বিকেল। বিদায়ের সময়।

গ্রামের প্রবীণরা এসে দাঁড়িয়েছেন পাহাড়ের কিনারায়। চোখে কৃতজ্ঞতা।

থান ম্রো বললেন, — “তোমরা কেবল ইতিহাস খুঁজে পাওনি… তোমরা আমাদের ভয়কে পরাজিত করেছো।”

নিশি হেসে বলল, — “আমরা কিছুই করতে পারতাম না, যদি তোমরা আমাদের বিশ্বাস না করতে।আর জনাব থান ম্রো,আমি আর রুদ্র জানি তোমার অভিনব সাহায্য ছাড়া আমরা এর তল খুঁজে পেতাম না।"

রুদ্র সামনে এগিয়ে বলল, — “এই পাহাড় আর কখনো নীরব থাকবে না। অভিজিৎ সেনের গল্প শুধু এই মাটির নয়, পুরো দেশের বিবেক জাগাবে।”আর এই পাহাড়কে একা হতে দেয়া যাবেনা।আগের মত বিয়ের সানাই বাজাতে হবে, পাহাড়ের কোলে উপহার দিতে হবে নতুন শিশু।আর থান ম্রো, অভিজিৎ সেন এবার তোমাকে ক্ষমা না করে পারবে না। তুমি কালিমা মুক্ত।"

সবার চোখে জল।

আর পাহাড়ের ঢালে বাতাস বইতে থাকে—নীরব, কিন্তু দৃঢ়, এক মুক্তির বার্তা নিয়ে।

ওরা ছয়জন আমিয়াপাড়াকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে সবুজ গুল্মে ছাওয়া সরু পথ ধরে।পাহাড়িয়ারা একে একে সবাই যার যার ঘরে গেল। শুধু থান ম্রো ওদের গমন পথের দিকে শেষ পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো।


#আমিয়াপাড়া(৭ম/শেষ পর্ব)
🖊️ রবিউল হাসান
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩০/০৬/২০২৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast