আদিবাসী -৪
রুদ্র পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে সামনের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে ছিল। নিশি এসে চুপচাপ পাশে দাঁড়াল।
— “তুমি এখনো সেই মূর্তিটা নিয়ে ভাবছো?”
রুদ্র মাথা ঝাঁকাল, ধীরে বলল,
— “ওটা শুধু মূর্তি নয় নিশি, ওটার চোখে একটা চুম্বকীয় টান আছে... একটা ইতিহাস আছে। আমি সেটা খুঁজে বের করবো।”
ওদের সঙ্গে থাকা বৃদ্ধ আদিবাসী—থান ম্রো—যে কিনা চুপচাপ থেকেছে গতকাল রাত থেকে, হঠাৎ বলল,
— “ওটা যার চোখে পড়ে, তার জীবনে অন্ধকার নামে। সেই মূর্তি আর সামরিক ধাতব খন্ড শুধু প্রতীক নয়, একসময় এই পাহাড়ে গোপন সেনা ঘাঁটি ছিল। অনেককে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল তখন। সেই পাথরের মূর্তি... তাদেরই একজনের প্রতিকৃতি।”
সবাই চুপ। বাতাসটা যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। রক্তিম কাঁপতে কাঁপতে বলল,
— “মানে... আমরা এক অভিশপ্ত ইতিহাসের মাঝে এসে পড়েছি?”
স্টালিন চোখ কুঁচকে বলল,
— “আমাদের বেরোতে হবে। কাল সকালেই।”
কিন্তু রুদ্র তা মানতে নারাজ।
— “তোমরা চাইলে চলে যেতে পারো। আমি এখানেই থাকবো। এই রহস্য আমি উদঘাটন করবোই।”
নিশি চুপ। ও জানে রুদ্রের একগুঁয়ে মন। ওর চোখে তাকিয়ে বলল,
— “তাহলে আমি তোমার পাশে থাকবো।”
রাত্রে তারা দু’জন শুধু একটা লণ্ঠন নিয়ে আবার সেই মূর্তিটার কাছে ফিরে গেল। এবার খুব কাছে গিয়ে রুদ্র লক্ষ্য করল, মূর্তির চোখের মাঝে খোদাই করা কিছু প্রতীক, যেটা আগেরবার খেয়াল করেনি।
হঠাৎ চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পেছনে ঝোপের ভেতর থেকে একটা শব্দ এলো—ঝরঝর করে পাতা নাড়া খাওয়ার শব্দ। নিশি রুদ্রের হাত শক্ত করে ধরল।
— “ওটা কি... কোনো মানুষ?”
রুদ্র ফিসফিসিয়ে বলল,
— “আশেপাশে কেউ থাকার কথা নয়।”
শব্দটা আরও কাছে আসছে। নিশি আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল। রুদ্র সাহস করে লণ্ঠন উঁচু করে ধরল। হঠাৎ—একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল, তার চোখে ছিল আগুনের মত জ্বলে ওঠা আলো।
আর তখনই পেছন থেকে এক ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
— “তোমরা যদি সত্য জানতে চাও... তবে প্রস্তুত হও আত্মত্যাগের জন্য।”
সেই কণ্ঠস্বরটা যেন বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। রুদ্র আর নিশি পেছন ফিরতেই এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল। মাটি ছুঁয়ে নেই তার পা-যেন ভেসে আছে।
নিশি কাঁপা গলায় বলল,
— “এটা কি... মানুষ না আত্মা?”
রুদ্র নিশির হাত শক্ত করে ধরে রাখল, কিন্তু ওর নিজের হাতও কাঁপছিল।
— “আমরা ভয় পাবো না নিশি। আমাদের জানতে হবে... এরা কারা ?যারা চায় না যে আমরা এগোই।”
ছায়ামূর্তিটা এবার স্পষ্ট হলো। তার গায়ে ছেঁড়া, সামরিক ধাতব পোশাকের ছিটেফোঁটা, হাতে একটি রক্তমাখা কলম, আর বুকের মাঝে ফুটে ওঠা গুলির দাগ। কণ্ঠটা এবার আরও স্পষ্ট:
— “আমি ‘অভিজিৎ সেন’... মেজর র্যাঙ্কে ছিলাম। এই পাহাড়ে এক গোপন মিশনে এসেছিলাম, আদিবাসীদের হটিয়ে সেনা ঘাঁটি গড়ার আদেশ ছিল। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করেছিলাম... আর তাই...”
সে থেমে গেল। নিশির চোখে জল চলে এলো।
— “তোমাকে মেরে ফেলা হয়েছিল?”
ছায়াটা মাথা নাড়ল।
— “না... আমাকে এই পাথরের মূর্তির সঙ্গে বেঁধে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। এই মূর্তি সেই বন্দিত্বের প্রতীক। আমার আত্মা এখনও মুক্ত হয়নি।”
রুদ্র এবার সাহস করে কাছে এগিয়ে গেল, মূর্তির খোদাই করা চোখের প্রতীকে হাত রাখতেই যেন একটা চমক খেল পুরো গা বেয়ে। হঠাৎ চারপাশটা ঘুরে উঠল, আর তারা চলে গেল অন্য এক সময়ের ভেতরে—
একটা স্মৃতি!
সেনারা পাহাড়ি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, আদিবাসীরা দৌড়াচ্ছে, গুলির আওয়াজ, চিৎকার, রক্তে ভেজা পাথর!
এই দৃষ্টিভ্রম মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু মনে হলো শতাব্দী পেরিয়ে গেছে।
দৃশ্য মিলিয়ে গেল। নিশি ক্লান্তভাবে রুদ্রের কাঁধে মাথা রাখল।
— “আমরা যদি সত্যিই এর শেষ চাই... তবে আমাদের ওর মুক্তি দিতে হবে।”
রুদ্র ধীরে ধীরে বলল,
— “হ্যাঁ, আর সেই মূর্তির নিচে লুকানো আছে একটা ফাইল... অভিজিৎ সেনের জবানবন্দি... সেই ফাইলই হচ্ছে আমাদের হাতিয়ার। আমরা সেটা খুঁজে বের করবো। এই ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে থাকবে না।”
তবে এই কথোপকথনের ঠিক পরেই মাটির নিচ থেকে একটা গর্জন উঠে এলো—মূর্তির নিচে কিছু যেন কাঁপছে!
রুদ্র পেছনে তাকাল—নিশির চোখে তখন শুধুই আতঙ্ক আর বিশ্বাস।
আর ঠিক তখনই পাহাড় কেঁপে উঠল...!
(চলবে...)
— “তুমি এখনো সেই মূর্তিটা নিয়ে ভাবছো?”
রুদ্র মাথা ঝাঁকাল, ধীরে বলল,
— “ওটা শুধু মূর্তি নয় নিশি, ওটার চোখে একটা চুম্বকীয় টান আছে... একটা ইতিহাস আছে। আমি সেটা খুঁজে বের করবো।”
ওদের সঙ্গে থাকা বৃদ্ধ আদিবাসী—থান ম্রো—যে কিনা চুপচাপ থেকেছে গতকাল রাত থেকে, হঠাৎ বলল,
— “ওটা যার চোখে পড়ে, তার জীবনে অন্ধকার নামে। সেই মূর্তি আর সামরিক ধাতব খন্ড শুধু প্রতীক নয়, একসময় এই পাহাড়ে গোপন সেনা ঘাঁটি ছিল। অনেককে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল তখন। সেই পাথরের মূর্তি... তাদেরই একজনের প্রতিকৃতি।”
সবাই চুপ। বাতাসটা যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। রক্তিম কাঁপতে কাঁপতে বলল,
— “মানে... আমরা এক অভিশপ্ত ইতিহাসের মাঝে এসে পড়েছি?”
স্টালিন চোখ কুঁচকে বলল,
— “আমাদের বেরোতে হবে। কাল সকালেই।”
কিন্তু রুদ্র তা মানতে নারাজ।
— “তোমরা চাইলে চলে যেতে পারো। আমি এখানেই থাকবো। এই রহস্য আমি উদঘাটন করবোই।”
নিশি চুপ। ও জানে রুদ্রের একগুঁয়ে মন। ওর চোখে তাকিয়ে বলল,
— “তাহলে আমি তোমার পাশে থাকবো।”
রাত্রে তারা দু’জন শুধু একটা লণ্ঠন নিয়ে আবার সেই মূর্তিটার কাছে ফিরে গেল। এবার খুব কাছে গিয়ে রুদ্র লক্ষ্য করল, মূর্তির চোখের মাঝে খোদাই করা কিছু প্রতীক, যেটা আগেরবার খেয়াল করেনি।
হঠাৎ চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পেছনে ঝোপের ভেতর থেকে একটা শব্দ এলো—ঝরঝর করে পাতা নাড়া খাওয়ার শব্দ। নিশি রুদ্রের হাত শক্ত করে ধরল।
— “ওটা কি... কোনো মানুষ?”
রুদ্র ফিসফিসিয়ে বলল,
— “আশেপাশে কেউ থাকার কথা নয়।”
শব্দটা আরও কাছে আসছে। নিশি আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল। রুদ্র সাহস করে লণ্ঠন উঁচু করে ধরল। হঠাৎ—একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল, তার চোখে ছিল আগুনের মত জ্বলে ওঠা আলো।
আর তখনই পেছন থেকে এক ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
— “তোমরা যদি সত্য জানতে চাও... তবে প্রস্তুত হও আত্মত্যাগের জন্য।”
সেই কণ্ঠস্বরটা যেন বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। রুদ্র আর নিশি পেছন ফিরতেই এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল। মাটি ছুঁয়ে নেই তার পা-যেন ভেসে আছে।
নিশি কাঁপা গলায় বলল,
— “এটা কি... মানুষ না আত্মা?”
রুদ্র নিশির হাত শক্ত করে ধরে রাখল, কিন্তু ওর নিজের হাতও কাঁপছিল।
— “আমরা ভয় পাবো না নিশি। আমাদের জানতে হবে... এরা কারা ?যারা চায় না যে আমরা এগোই।”
ছায়ামূর্তিটা এবার স্পষ্ট হলো। তার গায়ে ছেঁড়া, সামরিক ধাতব পোশাকের ছিটেফোঁটা, হাতে একটি রক্তমাখা কলম, আর বুকের মাঝে ফুটে ওঠা গুলির দাগ। কণ্ঠটা এবার আরও স্পষ্ট:
— “আমি ‘অভিজিৎ সেন’... মেজর র্যাঙ্কে ছিলাম। এই পাহাড়ে এক গোপন মিশনে এসেছিলাম, আদিবাসীদের হটিয়ে সেনা ঘাঁটি গড়ার আদেশ ছিল। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করেছিলাম... আর তাই...”
সে থেমে গেল। নিশির চোখে জল চলে এলো।
— “তোমাকে মেরে ফেলা হয়েছিল?”
ছায়াটা মাথা নাড়ল।
— “না... আমাকে এই পাথরের মূর্তির সঙ্গে বেঁধে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। এই মূর্তি সেই বন্দিত্বের প্রতীক। আমার আত্মা এখনও মুক্ত হয়নি।”
রুদ্র এবার সাহস করে কাছে এগিয়ে গেল, মূর্তির খোদাই করা চোখের প্রতীকে হাত রাখতেই যেন একটা চমক খেল পুরো গা বেয়ে। হঠাৎ চারপাশটা ঘুরে উঠল, আর তারা চলে গেল অন্য এক সময়ের ভেতরে—
একটা স্মৃতি!
সেনারা পাহাড়ি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, আদিবাসীরা দৌড়াচ্ছে, গুলির আওয়াজ, চিৎকার, রক্তে ভেজা পাথর!
এই দৃষ্টিভ্রম মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু মনে হলো শতাব্দী পেরিয়ে গেছে।
দৃশ্য মিলিয়ে গেল। নিশি ক্লান্তভাবে রুদ্রের কাঁধে মাথা রাখল।
— “আমরা যদি সত্যিই এর শেষ চাই... তবে আমাদের ওর মুক্তি দিতে হবে।”
রুদ্র ধীরে ধীরে বলল,
— “হ্যাঁ, আর সেই মূর্তির নিচে লুকানো আছে একটা ফাইল... অভিজিৎ সেনের জবানবন্দি... সেই ফাইলই হচ্ছে আমাদের হাতিয়ার। আমরা সেটা খুঁজে বের করবো। এই ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে থাকবে না।”
তবে এই কথোপকথনের ঠিক পরেই মাটির নিচ থেকে একটা গর্জন উঠে এলো—মূর্তির নিচে কিছু যেন কাঁপছে!
রুদ্র পেছনে তাকাল—নিশির চোখে তখন শুধুই আতঙ্ক আর বিশ্বাস।
আর ঠিক তখনই পাহাড় কেঁপে উঠল...!
(চলবে...)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২২/০৬/২০২৫মুগ্ধ
-
ফয়জুল মহী ১৯/০৬/২০২৫অসাধারণ লিখেছেন