www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মেঘনার কোল (অধ্যায়-১)

"মেঘনার কোল" রেদোয়ান আহমেদের প্রথম উপন্যাস। এটি ২০১৯ সালে দৈনিক রুদ্রবার্তা পত্রিকায় সিরিজ হিসেবে প্রকাশ পায়।এটাকে উপন্যাস হিসেবে দেখার অনুরোধ রইলো।এখানে স্থান,কাল,পাত্র কাল্পনিক।

{মুখবন্ধ}
মেঘনার তীরবর্তী একটি এলাকা বলাহী।প্রধান মেঘনা নয়,শাখা নদী।তবে বেশ বড়।হাজার ইতিহাস,স্মৃতি ধরে রেখে টিকে আছে এই চরাঞ্চল।গ্রামটাও ততটা বড় না।বলতে গেলে এককথায় একটি সুখী পরিবার।কিন্তু সুখী পরিবারেও কিছু মানুষ থাকে যারা আসলে সুখী না,তবে অভিনয় করে।তেমন একটি গ্রামীণ জীবন! মানুষের ভাব আবেগের মাঝে দুঃখ অভাব এর মিশ্রণ নিয়ে মানব সত্তা মনে যে প্রেম গড়ে ওঠে তারই বিশুদ্ধতা নিয়ে,এরপর...

♦প্রথম পরিচ্ছেদ♦

নতুন রাস্তা হয়েছে,এই গত বছরও এই রাস্তা ছিলো ভাঙা।কিছুদিন আগে শেষ হলো রাস্তার কাজ।নতুন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এই কার্যক্রম। দীর্ঘদিনের আশা ভরসার ফসল এই রাস্তা।ফজরের নামাজের শেষে এই পথ ধরেই গঞ্জের দিকে যাচ্ছে রমিজ উদ্দিন।গ্রামের ঠিকাদার।বিভিন্ন কাজে গ্রামের লোক লাগিয়েই কাজ করানো তার পেশা হয়ে দাড়িয়েছে তার পিতার হাত ধরেই।সকালের হালকা আবছা আলো-আধারীর গল্পের মাঝে হেটে যাচ্ছে রমিজ।বয়স তেমন নয়।চল্লিশে পা দিয়েছে কেবল। তাই এই বয়সে সকালের মৃদু বাতাসে বেশ লাগছে তার।আবছা আলোয় রাস্তাটা সোজা ততটা দেখা যাচ্ছে না।হালকা বাতাস রাস্তার দুই পাশে মাঝারি আকাড়ের গুল্মলতা গুলো বেশ দুলছে।এ যেন সকালের ঠান্ডা বাতাস কে প্রকাশ করছে।রমিজ একটা পাতলা চাদর গায়ে বেড়িয়েছে।বাতাসটা গায়ে কাটা দিয়ে যাচ্ছে।চাদরটা একটু টেনে শক্ত করে ঝাপটে ধরে নিলো রমিজ।এর মধ্যেই সামনে হটাৎ একটা মানুষের অভয়ব দেখা যাচ্ছে।ভালো করে বোঝার চেষ্টা করছে রমিজ।ঠিক মতো বুঝা না গেলেও একজন মুরুব্বি আসছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে।হালকা হালকা স্পষ্ট হচ্ছে দেহখানি।এই তো রমিজের চেনা এই মুখ।হাজি মোজাফফর হোসেন।সদ্য গত বছর হজ্জ করে আসা মুরুব্বি।ধনদৌলতে প্রভাবশালী হওয়ায় বলতে গেলে গ্রামের মোরল পদে আছে।আস্তে আস্তে অনেকটা রমিজের কাছে চলে আসে।সাদা পাঞ্জাবিতে হালকা মিষ্টি আতরের গন্ধ এবার রমিজের নাকে লাগছে।

আসসালামু আলাইকুম হাজি সাব।-আলাইকুম আসসালাম,রমিজ নাকি?হ চাচা আমিই। তা চাচা আপনার শইলডা কেমন?না বাবা শইলের অবস্থা বেশি ভালা না।যেই দিনকাল পরছে।দিনের লগে বের পাইনা।তোরে আমিই খবর দিতাম কিছুদিনের মধ্যে। যাই হোক তোরে পাইয়া গেলাম ভালোই হইছে।আর কই যাছ এহন?এইতো চাচা একটু গঞ্জে যামু।রহিম মুন্সি গোয়াল ঘরটা বান্ধাইবো।নতুন কয়টা বাশ-টাশ আনতে যাই।আর আমার খোজ কি হইছে চাচা?কোন দরকার নাকি?আগে শোন-বান্ধের বাইরে ভাটার কাছে আমার পরা জমিটা আছে না,ওইটাই এইবার আমন লাগাইতে চাইতাছি।তুই কি কছ?হ ভালা কথা তো চাচা।তাইলে লাগান।আমি লোক লাগাইয়া দিমু নে।হুম লোকের জন্যই তোর খোঁজ।এইবার খিলের ধারের আউশ বেশি ভালা হয় নাই।তাই কইতাছি বান্ধের জমিটায় আমন লাগাইয়া দেখি।-হ চাচা ভালো হইবো।এহন রোপা আমন লাগাইলে তো আমনের চারা কিনতে হইবো।আপনে তো আর চারা ছিটান নাই।হ তা তো লাগবোই।কিন্তু বিলের ধারে রোপা আমনে ঝামেলা হইবো না তো?কি কন চাচা দুনিয়ার মাইনষে রোপা-২৯ লাগাইতাছে।হেগো কিছু অয় না আর আপনের।আচ্ছা রমিজ তাইলে আজ বিকালে আমগো বাইত আইছ।তোরে টেকা পয়সা কিছু দিমু নে,কাল গঞ্জেরতে চারা কিনবি আর চার-পাঁচ জন লোক লগাইয়া সামনের জম্মার আগে ধান লাগানো শেষ করিছ।কিন্তু চাচা এর আগে তো জমিটার একটু জোস দেওন লাগবো।আরে না, একটা কলা গাছ কাইট্টা টাইনা দিলেই হইবো,এই কয়দিন আগেই তো নদীর পানিতে ডুবা আছিলো। এহন খালি আছড়াইয়া দিলেই চলবো।মাটি নরম আছে।আইচ্ছা তাইলে আমি দুইজন মানুষ লইয়া কাল জমিটা আছড়াইয়া দিমু নে।আচ্ছা।তয় চাচা এহন যাই।আছরের পর আপনে গো বাইত জামু নে।হ মনে কইরা আসিছ।কথা শেষ করে নিজের পথে এগিয়ে যাচ্ছে রমিজ।

♦দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ♦

একটা ডুমুরের ডাল থেকে পাতার আড়ালে বসে একটা দোয়েল অবিরাম মধুর ডাকে সকালের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে।সকালের সূর্যটা এবার বেশ আলো দিচ্ছে।নদী থেকে সারেং এর আওয়াজ আসছে।দু-একটি বলগেট অল্প ঢেউ তুলে ইট-পাথরের বোঝাই নিয়ে ছুটে যাচ্ছে।ভোরের শ্রমিক দের কাজ শুরু হয়ে গেছে।টিনের তৈরি তেলের ড্রাম নামাতে ব্যাস্ত হয়ে ওঠেছে শ্রমিকরা।টিন পেটানোর শব্দও আসছে।ট্রলার ঘাটে মাছ নামাতে ব্যাস্ত মাঝি ও শ্রমিকদের হৈচৈ এবং মাছের গন্ধে উড়ে আসা কাকের শব্দে জীর্ণ-শীর্ণ মরিচা পরা ঘর থেকে বের হয় পাহাড় আলী প্রধান।ঘরের দরজার পাটাতন মাটির সাথে ভাঙা ইটের কোনরূপ মিলিয়ে মিশিয়ে রাখা হয়েছে।ভাঙা পাটাতনে বসে চোখ মুছতে মুছতে অনেক কিছুই ভাবছে সে।ঘুম ভেঙেছে সেই ভোরে আযানের ধ্বনিতে।নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরে এসে ঘরে বসেই তসবীহ জপছিলো পাহাড় আলী।নামটা তার বাবা রেখেছে।কেননা তাদের দুর্দশার মধ্যে ঘর আলো করে এসেছিল সে।তার বাবা বড় আশা করেছিলেন, যে তারা গরীব হতে পারব সত্য।কিন্তু তাদের ছেলের বিশাল পাহাড় পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে।তাই শত আদর ভালোবাসায় এই নাম রেখেছে।এবং বংশীয় খেতাব প্রধান।কিন্তু কে জানে তার বাবা নিজের ছেলের মুখে বাবা ডাকটাও শুনে যেতে পারবেন না।ছেলের মাত্র দুই মাসের মাথায় হটাৎ একদিন অজানা রোগে মারা যায় সে।সবাই বলে বাতাস লাগছে।ভালো কোন ডাক্তার ছিলো না, তবে কবিরাজের কাছে নেওয়া হয়ছিলো সে বলেছিলো এগারোটা কালো শিং ছাড়া ছাগল দিতে হবে তাকে তাহলে সে রাহু দোষ কাটিয়ে এই রোগ সারাতে পারবে।কিন্তু নিজের পালিত তিনটি ছাগল ব্যাতিত অন্য কোন ছাগল দেওয়ার সামর্থ্য তাদের ছিলো না।তাছাড়া নিজেদের ছাগল গুলো কালো নয় এবং তাদের শিং আছে।শত চেষ্টা করেও ছাগল জোগাড় করতে পারে নি তার মা।তার বাবার মৃত্যুর পর তার মা নিজে গোবর শুকিয়ে বিক্রি করে তাকে বড় করেছে।আট বছর বয়স থেকেই সে খেত-খামারে কাজ করছে।তার বাবার ইচ্ছা আর পুরোন হয় নি।এই সত্তরের কোটায় পারা দিয়েও পাহাড় আলী নিজের সন্তানের খাবার জোগাড় করতেও হিমশিম খান।আজও নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করেন। তবে কাউকে বুঝতে দেন না।গত তিনদিন ধরে কোন কাজ পাননি তিনি।রমিজ উদ্দিনই তাকে কাজের জন্য ডাকে।তাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে তার একটাই প্রার্থনা থাকে,আজ যেন রমিজ মিয়া তার বাসায় আসে।এবং ডাক দেয় পরধাইন্না কামে যাইবা না।এই ডাকটাই তার সারাদিন নিশ্চিত থাকার প্রয়াস ঘটায়।কিন্তু গত তিনদিন রাজন এবাড়িতে আসে নি।আজ না আসলে তাকে বিলে মাছ ধরতে যেত হবে।কিন্তু ঘরেও তো চাল নেই,কি খাবে?মনে মনে ভাবছে,যার কপাল খারাপ তার কপাল কোন দিনও ভালো হয় না।দুই মেয়ে এবং এক ছেলের জনক পাহাড়।বড় মেয়েটির বছর খানেক হয় বিয়ে দিয়েছে।কত কষ্টের জমানো টাকায় বিয়ে দিয়েছিলো।জামাইর একটা মাছ ধরার নৌকা আছে।বয়ষ্ক ভাতার কিছু টাকা জমিয়ে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে জামাইকে। কিন্তু জামাই তার ভালো পরে নি।সারাদিন কাজ শেষে রাতে যায় জুয়ার আসরে।সারাদিনের উপার্জনের টাকা রাতেই শেষ করে দেয়।এই বছর খানেকের মধ্যে কতবার তার মেয়েকে মেরে বাপেরবাড়ি পাঠিয়েছে টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য।কিন্তু বাপ হয়ে সে মুখ বুঝে যা পেরেছে দিয়ে দিয়েছে।তবু আশা করে যদি জামাই তার সুবুদ্ধি হয়।এই পোড়া কপালে তার যদি আজ ছেলেটা বেচে থাকতো।বড় মেয়ের পর এক ছেলে।তাহলে ও হয়তো কিছুটা সাহায্য করতে পারতো।কিন্ত তা হলো না বিধি সেই ছেলেটা কেও মাত্র খেলার বয়সেই কেড়ে নিলো।কতো ছুটা ছুটিই না করতো তার ছেলেটা।কত আবদার তার।গঞ্জে গেলেই মিঠাই আনার কথা বলতো।কিন্তু বেশিরভাগ দিনই সে পায় নি তা।তবে তার খুব আশা ছিলো তার ছেলেকে নিয়ে।কষ্ট হলেও ছেলেকে প্রাইমারি স্কুলে পড়াতে চেয়েছিলো।কিন্তু হটাৎ কলেরা তাকে কেড়ে নিলো।নিজে কিছু করতে পারলো না,তার ছেলেটাকে বাচাতে।ছেলেটার মৃত্যুর দেড় বছরের মাথায় ছোট মেয়েটার জন্ম।বিষাদ অসহায়ত্তের মাঝে এই মেয়েটি যেন তাদের আকাশের চাঁদ।বোধহয় স্রষ্টা তাকে এই পরিবারের আদলেই বানিয়েছেন। কোন প্রকার আবদার নেই শুধু সারাদিন মা-বাবার পাশে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া!খেতে দিলে খাবে না দিলে কোন দিন চেয়ে খাওয়ার প্রয়াস তার মাঝে দেখা যায় নি।নানাবিদ চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে গালে হাত বুলাতে বুলাতে তার মনটা খারাপ থেকে আরো খারাপ হতে থাকলো।হটাৎ পিছন থেকে বাবা ডাকটা কানে আসে,
-ভিতর থেকে চোখ মুছতে মুছতে দরজায় এসে দাঁড়ায় বিনু।শুভ্রতা বিনয়ী দেবী।অতি আদরের বহিঃপ্রকাশ এই নাম।তার বাবার জীবনের কোন আবেগের সম্পূর্ণটা প্রকাশ পেয়েছে এই নামে।পাহাড় আলীর জীবনের কোন আবেগ এতোটা প্রকাশ পায় নি কোন দিন।তবে নিজের ছোট মেয়ের নামের ক্ষেত্রে সেটা পুরোটা প্রকাশ করতে পেরেছে পাহাড় আলী।দেবী নামটার জন্য ব্যাপক বেগ পেতে হয়েছে।কেননা মুসলমান কন্যা সন্তানের নাম দেবী কেন হবে।তবু নানা বাধা ভিন্নতা পেরিয়ে কোন রকম ডাক নাম নিয়েই বেঁচে আছে বিনু।ঘুম ভেঙেই তার বাবা দরজায় বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যাচ্ছে বিনু।বিনু এসে তার বাবার পাশে বসলো।পাহাড় আলী নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন,প্রভাতের মিষ্টি আলো এসে পরছে তার মুখে।কত রূপ তা মাঝে।দেবী রূপ নিয়েই যেন পৃথিবীতে এসেছে। মেয়ে তার বড় হয়ে যাচ্ছে।
-বাবা তুমি কাজে যাও নাই?
-কাজ পাইলে তো যাইতাম।মা তোর কি খিদা লাগছে?
মাথা নিচু করে বসে আছে।বিনু কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতেও পারছেনা।যে ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে তার মধ্যে কোন আনন্দ খুশি থাকে না।রোজ তার বাবা কাজে গেলে তাদের খাবার জুটবে তা না হলে জুটবে না।এটাই নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে।তাই এখন বিনুর আসলে কিছু বলার নেই।
পাহাড় আলীও বোধ হয় বিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে মেয়ের মনের ভাব।নিয়মিত সন্তান কে খাবার দিতে না পারলে আসলে এর চেয়ে ভালো কিছু মুখ আসা করা যায় না।
মুখভঙ্গিতে উভয়ের মাঝে কথা হয়ে যায় সংসারের অভাবের কারণে পিতা মেয়ের নিস্তব্ধতায়।

♦তৃতীয় পরিচ্ছেদ♦

গঞ্জের কাজ শেষ।বাড়িতে আত্মীয় এসেছে। গঞ্জ থেকে টাটকা তরকারি ও ২ কেজি গরুর দুধ নিয়ে বাড়ির দিকে হাটা ধরেছে রমিজ।বাড়িতে যাওয়ার আগে তাকে একটা কাজ করতে হবে।পাহাড় আলীকে খবর দিতে হবে।আজ কিছু খুটিনাটি কাজ আছে তার বাড়িতে।গঞ্জ থেকে কাছেই পাহাড় আলীর বাড়ি।জঞ্জাল ভর্তি নদীর পাশেই এক নিরব বাড়িতে পাহাড় আলীর বাস।বাড়ির পেছনে একটি বড়ই গাছ বাকা হয়ে রাস্তাটাকে নিচু করে দিয়েছে।কেউ বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে মাথা নিচু করে বাড়িতে ডুকতে হবে।এই জিনিসটাই ভালো লাগে না রমিজের। মাথা নিচু করে বাড়িতে প্রবেশ করতেই দুটি কাশি দিয়ে রমিজ ডাক দিলো- পাহাড় আলী...আছো নাকি বাড়িতে?ঈদের চাঁদ দেখার মতো তার বা দিকে তাকিলো পাহাড় আলী।
-কি বাপ মাইয়া এক লগে বইসা আছো?মন মরা কে?
-না মাহাজন।ঘুমেরতে মাত্র উঠলাম তো।
-খাইছো কিছু?
-না,এখনো খাইনাই।তয় খামু!
-আইচ্ছা একটা কাম আছে,আমার বাড়িতে কয়টা মেহমান আইছে।তাগো জন্য পুকুরতে মাছ ধরা লাগবো। কিছুক্ষণ পর আমগো বাড়িত আইয়ো দেরি কইরো না।
-আইচ্ছা মাহাজন,আপনি যান আমি আসতাছি।আব্বা তুমি কাম পাইছো!আইজ আমগো আর চিন্তা নাই।মা মা আব্বা আইজ কামে যাইবো...
দুয়ার থেকে চিৎকার করে দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলো বিনু।বিনু বড়ই আনন্দিত হয়েছে।
এই চিৎকারের শব্দে সকালের বাতাসটাও ভারি হয়ে ওঠে।পাহাড় আলী এবার মন ভরে শ্বাস নিচ্ছে।বোধহয় কেউ হয়তো তার সারাজীবনের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে।পাহাড় আলী এইবার উঠে দাঁড়ায়।রান্নার ঘরে যায় কয়লা আনতে।রান্নার ঘরের ধইঞ্চার তৈরি কাঠামোর এক কোনায় ঝুলন্ত একটা বোতলে পরিশোধিত কয়লা থেকে কিছু পরিমাণ কয়লা হাতে নিয়ে পুকুরের দিকে রওয়ানা দেয় পাহাড় আলী।বাড়ির থেকে কাছেই পুকুর মাঝে উঠোনের পর শুধু দুটি কড়ি গাছ।পাশে একটা সদ্য যুবা আম গাছও রয়েছে।পুকুরের পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাহাড় আলী তার শাহাদাত আঙুল দিয়ে দাঁতে কালি ঘষছে।গচগচ শব্দে কিছুক্ষণ দাঁত ঘষার পর আস্তে আস্তে পানিতে নামে সে।তিন বার মাথায় পানি দিয়ে টুব করে ডুব দেয় এক অনন্ত প্রশান্তিতে।

♦চতুর্থ পরিচ্ছেদ♦

রমিজ উদ্দিন বাড়িতে ঢুকেই দেখতে পায় তা বোনের ছেলে রফিক একটা জলচকিতে বসে তার মামীর সাথে কথা বলছে। রমিজ উদ্দিন খুক খুক কাশি দিয়ে রসিকতার স্বরে বলে-মামীর সাথে কি এমন কথা?মামারে পছন্দ হয়না?খালি মামীরেই হয়।আদর সংকোচ নিয়ে বলে না মামা তুমি বাড়িতে নেই তাই মামীর সাথেই কথা বলছিলাম। তা কি কথা কও তোমারা?রফিক বললো মামা মামী তোমাদের পুকুর পারের ভুতের কথা বলছিলো।ওই যে এক পা কাটা।হইছে হইছে আর বলা লাগাবো না।বুঝছি! কিন্তু তোর মামীর পাগইল্লা কথা শুনিছ না।এত বছর সংসার করলাম এই বাড়িতে।কোনদিন ভুত কে এক চোরও আসে নাই এই রমিজ মিয়ার বাড়িতে।গর্বের সাথে বুক ফুলিয়েই কথাটা বললেন রমিজ।রফিক শহুরে জীবনে গড়ে ওঠা শিক্ষিত ছেলে।সে যে তার মামীর কথা বিন্দু মাত্র বিশ্বাস করে নি তা তার চেহারা দেখেই বুঝা যায়।আদরের সমবয়সী রমিজের ছেলে বিজয়। বিজয় বাবার কাজ কর্মেই সাহায্য করে।সকালবেলা বিজয় ঘুম থেকে ওঠেই কোথায় যেনো চলে গিয়েছে। তারও দেখা নেই।রমিজ রফিকের দিকে তাকিয়ে,
বাবা কিছুক্ষণ পর এক লোক আসবো আমগো পুকুরে মাছ ধরার জন্য কইছি।বিজয় আসলে ওরে পুকুরপারে যাইতে কইয়ো।
-আচ্ছা মামা,আমি বলবো।আর আমিও যাবো মাছ ধরা দেখতে।
-যাইয়ো বৈকি,মাছতো ধরতাছি তোমগো জন্যই।
-আদর মুখটা মৃদু নাড়িয়ে উঠোন থেকে ঘরের দিকে রওয়ানা হলো।
প্রভাতের সূর্য এবার তীক্ষ্ণ রূপ নিয়েছে দিনের আলো হবার জন্য।শত বছর পুরোনো রাস্তায় হেটে যাচ্ছে একটা লোক।হালকা পাতলা গড়নের লোকটার মুখের ভাব যেন স্বয়ং স্রষ্টাও বুঝতে পারছে না।আসলে লোকটা পাহাড় আলী।তিনদিন পর আজ কাজ পেয়েছে। ঘরে আজ খাবার জুটবে।খাবারের জন্য আজ তার মনটা ভালো কিন্তু অন্যাদিকে একটা প্যাচ রয়েই গেছে,বিনুকে বলে এসেছে তার জন্য আজ বড় একটা মাছ নিয়ে ফিরবে।এখন দুশ্চিন্তা এখানেই রমিজ মিয়া যদি তাকে টাকার বাইরে কোন মাছ না দেয়?ঠিক এই ভালো মন্দের মিশ্রণের মাঝেই পাহাড় আলীর মুখটা সুখ-দুঃখ কোন একক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না।কিছু ঘটনা থাকে যা পৃথিবীতে শুধু একবারই প্রতিফলিত হয় এবং ওই মানুষটি ছাড়া অন্য কেউই সেই প্রতিফলন শুনতে বা দেখতে পায় না।পাহাড় আলীর জীবনের কোন ঘটনাই বুঝি অন্য মানুষ দেখতে পায় না।সবসময় নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। নিজের ছোট মেয়ে এখন বড় হচ্ছে,চিল শকুনের নজর পরবে।আবার তাকে বড় মেয়ের মতো আগলে রাখতে হবে।বড় মেয়ে সৎ পাত্রে দান করতে চেয়েও পারে নি।তাই এবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর কোন ভুল নয়।সবটুকু দেখেই এবার বিনুকে হাত থেকে ছাড়বেন।বড় আদরের মেয়ে যে।জগতের সব চিন্তা বুঝি পাহাড় আলীর মাথায়।নানা রকম চিন্তা ভাবনায় ডুবেই রমিজের বাড়িতে প্রবেশ করে পাহাড় আলী।


♦পঞ্চম পরিচ্ছেদ♦


গরুর গোস্তের ঝোল দিয়ে চালের রুটি খাচ্ছিলেন রমিজ উদ্দিন।পাহাড় আলীকে আসতে দেখে মুচকি হাসি দিলেন,
-আসো আসো এতো দেরি করাল কে?বসো একটা রুটি খাও।
-থাক মাহাজন সাব।আপনি খান।
-আরে খাইয়া লও মিয়া, পুকুরে নাইমা জাল টানতে হইবো না।শইলে তো হাড্ডি ছাড়া কিছুই নাই।(রমিজ উদ্দিন খাবার ছেড়ে উঠলেন।তার বাটিতে পরে রইলো একটা রুটি ও আধ-বাটি ঝোল।)
-বড়ই তৃপ্তি সহকারে খাবার খেলেন পাহাড় আলী।


হাটুপানিতে জাল ফেলছে পাহাড় আলী।পুকুরপারে ঝোপের পাশে বসেই মাছ ধরা দেখছে আদর ও বিজয়।কিছুক্ষণ আগে হটাৎই উত্তরের বাতাসের মতো এসে উপস্থিত বিজয়।আদর ও বিজয় নানা বিষয়ে কথা বলছে এবং হাসছে।পাহাড় আলী মাছ ধরার মাঝে মাঝে আদরকে দেখছে কত প্রান খুলেই হাসছে ছেলেটা।সুদর্শন এই ছেলেটাকে দেখে তার বারবার নিজের অবস্থার প্রতি আক্ষেপ হচ্ছে যদি তার অবস্থা একটু ভালো হতো!বিনুর জন্য রাজপুত্র। কিন্তু না বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো ঠিক না।পৃথিবীতে মানুষের হাসি দেখেই সবচেয়ে সহজে নির্ণয় করা যায় মানুষটার আবেগ ও ভালোবাসা।অনেক সময় ধরে মাছ ধরারপর পাহাড় আলীকে রমিজ তার পাওনা দিয়ে দিলো।পাওনা দেওয়ার পর রমিজের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাহাড় আলী।এইবার রমিজ পাহাড় আলীর দিকে তাকিয়ে,
-কিছু বলবা নাকি মিয়া?
-মাহাজন সাব!আমারে ছোট দেইখা একটা মাছ দেওয়া যাইবো?
-কি কও তোমারা বুঝি না?টাকা না দিলাম।আবার মাছ চাও কোন মুখে?
-(পাহাড় আলী মাথা নিচু করে আছে)বিড়বিড় করে বলল আমার ছোট মাইয়টা আবদার করছিলো মাহাজন সাব।
-সব আবদার পূরণ করা লাগে না।লাই পাইয়া গেলে মাথা থেকে নামাইতে পারবা না।(একটু সহজ হয়ে)যাও বালতি থেকে একটা ছোট কার্পো নিয়া যাও।
পাহাড় আলী নিতান্তই খুশি হলেন।এতোক্ষণের সকল অপমান যেনো ধুলায় মিশে গেলো।শান্তি পৌঁছে গেলো সকল আত্মার আত্মীয়ে।


♦ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ♦


ঠিক এইসময় ঝোপঝাড়ের বাড়িটায় বসে আপন মনে ভাবছে বিনু।বাবাকে যে বলে দিলো মাছ আনার কথা,তার বাবা কিভাবে মাছ আনবে তাকে তো টাকা ছাড়া আর কিছুই দিবে না রমিজ উদ্দিন।এই বয়সে এসে আসলে বাবার কাছে আবদার করাটা তার ঠিক হয় নি।হটাৎই নিজেকে অনেক বড় ভাবতে শুরু করলো বিনু।কেন বা বাবা কে বলতে গেলো মাছ আনার কথা।মাছ না আনলে কি বা এমন ক্ষতি হতো?কতদিন তো তারা না খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছে।হটাৎ বাবার কাজ পাওয়ার আনন্দে কথাটা বলা আসলে ঠিক হয় নি।বিনু মুখটা কালো করে বসে আছে সাথে অনুশোচনাও রয়েছে নিজের প্রতি।প্রকৃতি আসলে এমনই দুঃখ-কষ্টের মাঝেও নিজের মনের কথা কি করে যেনো বেড়িয়ে যায়,তা স্রষ্টাই ভালো জানে।বিনুর মা তার বাবা যাওয়ার পর বেড়িয়ে গেছে জংলী কচু তুলে আনার জন্য।প্রতিদিন এই সময়টা বিনুকে একাই বাসায় থাকতে হয়।একা সময় কাটানোর মাঝেও একটা আনন্দ আছে কিন্তু সারাজীবন নয়।
-বিনু ওই বিনু...(কর্কশ গলায় বাড়ির পেছন দিক থেকে ডাক দিচ্ছে বিনুর মা)
-মা আমি আসছি!(বিনু দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।)
বয়স বেশি হয় নি,কিন্তু প্রকৃতির দান অপার মহীমায় তাকে পেয়ে বসেছে।তার এই চলন যেন অসুরের দৃষ্টিগ্রাহ্য না হয় সে কামনাই বাবা মায়ের চিরজীবনের।
-কি হইছে মা?(আদুরে গলায়)
-আরে ওঁরাটা(বাঁশের তৈরি এক ধরনের দ্রব্য সামগ্রী আনা নেওয়ার বস্তু)ধর।কোমরের হাড় সব এক হইয়া গেলো।
-এতো ভারি কেন মা।কচুতো এতো ভারি হয় না?
-আগে ঘরে চল পরে দেহিস কি জিনিস।
দুজন ধরাধরি করে ওঁরাটা কে ঘরে নিয়ে গেলো।বিনু অবাক চোখে চেয়ে আছে।আজ যে তার মা শুধু কচু নয় সাথে এনেছে কিছু টিমেটো,গাজর,একটা ছোট মতো কুমড়া ও একটা কচি লাউ।
-এগুলো কিভাবে আনছো মা?
-(বিনুর মা ফিসফিস করে) আস্তা কথা ক। দেয়ালেরও কান আছে।আরে রহিম মুন্সির খেত থিকা গাজর আর টমেটো আনছি আর পাশের আরেকজনের লাউয়ের জংলা থিকা এই লাউটা আনছি।বাড়িত আওনের পথে রমিজ উদ্দিনের কুমড়া খেত থিকা কুমড়াটা।
-তুমি এইগুলা আনতে গেলা কে মা?চুরি করাতো ভালো না।
-চুপ বেশি কথা কইছ না।বেশি বুঝছ?এইগুলা না আনলে খাবি কি?তোগো তো সংসারের চিন্তা নাই।
-তারপরও মা,গত তিনদিন বাবায় কাজে যায় নাই।আমরা তো না খাইয়া মইরা যাই নাই।তাইলে চুরি করতে গেলা কে? কেউ দেখলেতো মান সম্মান সব যাইতো।
-আইছে আমার মান সম্মানওয়ালা বেটি।এতো বুঝলে একটা ভাতার দেইখা চইলা যাস না কেন?এখনো গলায় ঝুইলা আছোছ।স্বামীর ঘরে গেলে বুঝবি সংসার চালাইতে কি কি লাগে।(বড়ই উচ্চস্বরে কথা গুলো বলল)
বিনু মায়ের এই রাগান্বিত কথা বড়ই কষ্ট পেলো।মা বাবা কেউ তাকে তেমন শাসন করে না।তবে মা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে অনেক কথা শোনায়।এই মুহূর্তে আর ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।বাবা বাসায় থাকলে সে হয়তো বাবার পাশেই বসে থাকতো।মায়ের কথা এখনো শেষ হয়নি।তাই বিনু দ্রুত পায়ে ঘর থেক্ব বেড়িয়ে গেলো যেখানে কোন অকথ্য ভাষা নেই শুধুই প্রকৃতির অপার দান আর মহীমা।
এই ঘটনার কোন দৃশ্যই চোখে দেখেনি পাহাড় আলী।বাড়ির বাইরে থেকে উচ্চস্বরে বিনু বিনু বলে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ডুকলো পাহাড় আলী।কিন্তু বাড়িতে এসেই থমকে দাড়ালো পাহাড় আলী।বিনু কোথাও নেই।
-কি বিনুর মা বিনু কই?
-কই গেছে কেমনে কইতাম?কতক্ষণ আগে বাইরে গেছে কইয়া যায় নাই।
-বিনু মাছ আনতে কইছিলো।মাছটা দেখবো না আমার মাইয়াটা?
-এতো আল্লাদ কইরা লাভ নাই।মাইয়াটারে লাই দিয়া দিয়া মাথায় তুলছো কোন কথাই শোনে না।আমার মুখের উপরে কথা কওয়া শিখছে।
-তুমি বিনুরে কিছু কওনাইতো?
-কইতাম না কে?ইচ্ছা মতো ধোলাই করছি।যাতে ঠিক হইয়া যায়।(বিনুর মা মুখে আর যাই বলুক,মনে মনে সে নিজেও ব্যাথিত হয়েছে।মেয়েটাকে মুখ ফসকে কত কি না বলে ফেলেছেন।
-তোরে ঘর তে বাইর করমু।তুই আমার আদরের মাইয়াটারে শাসন করছ?(রাগান্বিত হয়ে পাহাড় আলীও ঘর থেকে চলে যায়)যাওয়ার আগে বিনুর মাকে বলল আমার মাইয়া আসার আগে ভুলেও মাছটা কাটবি না।ওরে মাছটা দেখাইয়া কাটবি না।


পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য্য কিছু সময়ের জন্য মলিন হয়ে যায়।বিনুর কাছেও ঠিক তাই হয়ে ওঠেছে।এই বাগান বাড়িতে আসলে বিনুর সবসময় মন ভালো হয়ে যায়।কিন্তু আজ তার মন ভালো হওয়ার কোন লক্ষন নেই।কিছুই তার ভালো।লাগছে না।মা তাকে কি ভাষাই না কথা গুলো বললো।বাগান বাড়িতে এক ছোট্ট পেয়ারা গাছে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে বিনু।
ঠিক এসময় ঠিক ভিন্ন মনের এক মানুষ পাগল হয়ে ওঠেছে গ্রামের প্রকৃতি দেখার জন্য।বিজয়কে সাথে নিয়ে তাই বেড়িয়ে পরল আদর। বিজয় আর আদর গ্রামের নানা চিরায়ত রূপ দেখছে এবং গ্রামের নানা প্রেক্ষাপটে কথা বলছে আর হাসছে।এই গ্রাম ও মাটি এবং মাটির প্রতিটান মানুষ ও মানুষের মনের বাইরে।এই রূপ ও গন্ধ পৃথিবীর নয়।আত্মার টানে টানে চলে আসা কোন বন্ধন মিল হওয়ার প্রতিক্ষায় দুজনের এক হওয়ার পাল্লায়।ভিন্ন ভিন্ন কারনে দুজন ঘরে বাইরে একত্রিত হওয়ার মেলবন্ধন এবার জগৎ দেখতে যাচ্ছে।

♦সপ্তম পরিচ্ছেদ♦


নতুন পেয়ারা গাছ।চোখের সামনেই বেড়ে ওঠা।পেয়ারা ধরেছিলো গত বছর।তত ভালো জাত নয়।তবে বিনুর ভালোই লেগেছে।আজ মন খারাপ তাই কেন জানি এই পেয়ারা গাছটায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে বিনু।বিনুর মুখ দেখে যে কেউ বলবে সে বুঝি কারো অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে এবং সে আসেনি বা দেরি করছে তাই মন খারাপ।কিন্তু প্রকৃতি সবচেয়ে দক্ষতা বুঝি এই পরাগায়নে।হটাৎই দুজন ভিন্ন আলাদা মানুষের মেলবন্ধন।পেয়ারা গাছটার ঠিক উল্টো দিকে একটা শতবর্ষী পুরোনো বট গাছের আড়ালে দুটো মানুষ। অনেক সময় ধরেই দেখছে মেয়েটাকে।এদের একজন হলো বিজয় অন্যজন রফিক।বিজয়ের তেমন কোন আগ্রহ নেই,কিন্তু আদর কোন মতেই এখান থেকে যাচ্ছে না।সে যেন কোন ঘোরের মধ্যে আছে।বিজয় রফিককে অনেকবার টেনেছে চলে যাওয়ার জন্য।ওরা গরীব,কামলার মেয়ের মধ্যে কি এমন আছে?নানা কথা।বিজয় রফিককে একরূপে মেয়েটির সব পরিচয় দিয়ে দিয়েছে।তিরস্কারের স্বরে বললেও এটাও বলেছে-ওর নাম বিনু।আইজ আমগো পুকুরের যে লোক জাল টানছে ওই লোকের মাইয়া এইটা।আনাড়ি মাইয়া মা বাবা ছাড়া অন্য কারো লগে জীবনেও কথা কয় না।রফিক বিজয়ের কথা গুলো শুনছে আর ভাবছে যেই মেয়ের মলিন মুখটাই এতো সুন্দর সেই মেয়ে হাসলে যেনো কতই না সুন্দর হবে।এ যেন স্বর্গের অপ্সরা।রফিক ভাবছে কি করে এই মেয়েটার মন খারাপ হতে পারে?বিজয় এবার বড়ই বিরক্ত হলো-
-যাবি না তুই?(বিজয় জোড়ে ধাক্কা দিতেই সম্মতি ফিরে পেলো রফিক)
-আহা,একটু দাড়া না।কি যাই যাই করছিস!
-তুই এইখানে দাড়াইয়া থাকিস সারাজীবন আমি কিছু বলমু না।কিন্তু ওই মাইয়ার দিকে চাইতে পারবি না।
-কেন?সমস্যাটা কি?
-কোন সমস্যা নাই।ওয় কামলার মাইয়া।কামলার মাইয়ার দিকে এতোক্ষণ চাইয়া থাকলে মাইনশে কি কইবো?
-বিজয় তুই এক কাজ কর,বাড়িতে যা।আমি আসছি।
-পাগল হইছি নাকি?তোরে এইখানে রাইখা আমি বাড়ি যামু।যেমনে দেখতাছোছ না জানি কখন যাইয়া ওই মাইয়ারে প্রেম প্রস্তাব দিয়া বসোস!
-এবার মৃদু হাসলো আদর।কোন কথাই বললো না সে।(ধীরে ধীরে রফিকের পা সচল হচ্ছে,ধীরগতির এ পা বড়ই দূরন্ত।)
-আরে কই যাস?
-(রফিকের মনে এখন শুধুই একটি চেহার।শুধু একবার তার মুখে তার নামটা শুনতে চায় আর কিছু না)


♦অষ্টম পরিচ্ছেদ♦


বিনু প্রথম খেয়াল করে নি।কিন্তু কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে বিজয়ের সাথে একটা অপরিচিত ছেলে তাকে দেখছে।সামান্য বিব্রতবোধ করেছে বিনু।অপরিচিত একটা ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখছে।যেকোনো মেয়েই বিব্রত বোধ করবে।বিনু নিজেও এই পরিস্থিতিতে অনেকবার পরেছে।কিন্তু অন্যবারের ছেলেরা বিনুকে কিভাবে যেন দেখতো তার বড়ই বিব্রতবোধ হতো।কিন্তু এই ছেলেটা শুধু তার চোখ বরাবর তাকিয়ে আছে।এতোক্ষণ ধরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বুঝি ছেলেটার স্বাদ মিটেনি।এখন তো ছেলেটা ধীরে ধীরে সামনে আসছে।বিনু এবার নড়ে চড়ে দাড়াল।বাড়ি থেকে মন খারাপ করে এখানে আসলেও এখন আর সেই খেয়াল নেই।এখন শুধু ভাবছে ছেলেটা কেন তার দিকে আসছে?এবার ছেলেটা আর বিনুর ব্যাবধান মাত্র দু-হাত।ঘোর থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে এবার রফিক বললো-তোমার নাম জানতে পারি?
-(চোখ বড় বড় করে বিনু তাকালো)
-কি কিছু বলছো না?
-এবারও বিনু তাকিয়ে আছে।
-আরে বাবা আজব মানুষ তো তুমি!নামটাতো বলো...
-বিনু চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।
-আরে কোথায় যাও?একটু নামটা বলে যাও!
-বিনু...(নামটা বলেই দৌড় দেওয়ার উপক্রম হলো বিনুর)
কিভাবে নামটাই না বললো বিনু।আহ পাগল হয়ে যাবো।মৃদুভাবে ঢুলে মুচকি হাসিতে মাটতে পড়ে গেলো আদর।
দূর থেকে এতোক্ষণ আদরের কর্মকাণ্ড সবই দেখছিলো বিজয়।কিন্তু এখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না বিজয়।কি কারণে যেন রফিক মাটিতে ঢুলে পড়লো।কোন দূর্ঘটনা ঘটলো নাকি?
দৌড়ে এসে রফিককে ডাকছে বিজয় কি হলো তোর?
বিনু একমনে হেঁটে যেতে যেতে ভাবছে পাগল নাকি ছেলেটা?এভাবে পরে গেলো কেন?নাকি অন্য কোন সমস্যা।সাপ খোপ কামড় দিয়েছে কিনা?কই না তো সাপ হলে তো সে দেখতো।নানা কিছু ভাবতে ভাবতে বিনু হেটে চলেছে।আবার ভাবছে ছেলেটাকে ধরা উচিত ছিলো।মানুষ হিসেবেও তো তাকে ধরা যেতো!আফসোস হচ্ছে নিজের প্রতি পরক্ষণেই আবার ভাবছে কি দরকার?বিজয়তো আছেই।আর শুধু শুধু একটা ছেলেকে কেন সে ধরতে যাবে?ভাবতে ভাবতেই বিনু বাড়িতে প্রবেশ করলো।


♦নবম পরিচ্ছেদ♦


মাছ নিয়ে অনেকটা সময় ধরে বসে আছেন বিনুর মা।সে আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না।
বিনুর প্রবেশে মনে মনে খুশি হলেও মুখে ঠিক তার উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখালেন।
আসছে আমার নওয়াবজাদি!এতোক্ষণ কই আছিলেন?
-পুকুর পারে দাড়িয়ে ছিলাম।
-পুকুর পারে?কার জন্য দাড়াইছিলেন মনে এতো রঙ আসে কইত্তে?
-মা,আমার ভালো লাগছে না।তুমি শুধু শুধুই আমাকে বকছো!
-হইছে হইছে!
-মা তুমি মাছ নিয়ে বসে আছো?বাবা মাছ এনেছে?
-উৎসুক দৃষ্টিতে মাছ নেড়েচেড়ে দেখছে বিনু।
-হইছে হইছে দে এইবার মাছটা কাটি।


বিনু রান্নাঘর থেকে বের হয়ে মূল ঘরে প্রবেশ করলো।কিন্তু বিনুর মাথায় এখনো ছেলেটার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।কিন্তু বিনু এটাও ভাবতে লাগলো যেহেতু বিজয়ের সাথে দেখেছে তার মানে ও বিজয়দের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।ওরা বড়লোকের ছেলে ওদের সাথে তাদের কিসের সম্পর্ক?
প্রত্যেক মানুষের রক্তের রঙ একই হয় কিন্তু রক্তে থাকে ব্যাপক ভিন্নতা।রক্তে থাকে হিংসা,বিদ্বেষ আর অহংকার আবার এই লাল রক্তেই থাকে অন্যের প্রতি সম্মান,প্রেম ও নিষ্পাপ ভালোবাসা।
বিনু চুপ করে জানালায় হেলান দিয়ে বসে এইসব ভাবতে লাগলো।
ভবঘুরে পৃথিবী দেখছে ধীরে ধীরে গভীর তন্দ্রায় ডুবে যাওয়া মায়াবতীকে।

♦দশম পরিচ্ছেদ♦

কিরে বললি না কেন তুই পড়ে গেলি? ওই মেয়ে তোকে ধাক্কা মেরেছিলো?
এই তুই থাম সেই কখন থেকে এককথা বলে যাচ্ছিস। ধাক্কা তো অবশ্যই মেরেছে তবে হাতে নয় এই বুকে।
ওহহ্ বুঝতে পেরেছি,মনে রঙ ধরেছে!কিন্তু রফিক ওই মেয়েতো কামলার মেয়ে,ওর মধ্যে কি এমন দেখেছিস?
দেখেছি ওর বিষণ্ণতা মাখা মায়াবী চোখ,ওর প্রশান্তি মাখা ঠোঁট।
পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই।বাবা জানতে পারলে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
আরে না!তুই না বললে মামা কিছু বলবে না।আর মামা জানবেই বা কিভাবে?
আচ্ছা বাদ দে অন্য কথা বল।
বিজয় কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে রফিক বললো তোদের এখানে নাকি কিসের মেলা হচ্ছে,সকালে মামী বললো।
হুম।ওই তো দরগাবাড়ির বটতলায় মেলা বসেছে।প্রতি বছরই কার্তিকের ১৩ তারিখ ওরস হয় সেই উপলক্ষে এক সপ্তাহব্যাপী মেলার আয়োজন।
তাহলে চলনা আজ মেলায় যাই।বাচ্চামো কন্ঠেই যেন বলছিলো রফিক।তাহলে আজ বিকালেই আমরা মেল্য যাবো।তুই মামাকে বলিস।বিজয় ও চাইছিলো কোন একটা সুযোগে মেলা থেকে ঘুরে আসতে।এবার রফিকের নাম করেই ঘুরে আসতে পারবে।কারন রফিকের নআম করলে বাবা আর কিছু বলবে না।


বিনু এমনিতে বাবা মায়ের অনুগত মেয়ে।কিন্তু বয়সের বৃদ্ধিজনিত কারন চাঞ্চল্যের কারনে মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য বাবা মাকে না বলেই অনেক কিছু করে।যেমন বান্ধবীদের সাথে গঞ্জে যাওয়া,নদীর পার ধরে হাটা,গোসল করতে পুকুরে যাওয়ার কথা বলে নদীতে যাওয়া।তবে এই দূরন্তপনা বিনুকে এক অন্য পৃথিবীর সাথে পরিচয় করাবে।

চলবে...
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast