www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শীত কথা



মাসুম জবুথবু হয়ে বসে আছে ফুটপাথের উপর, সামান্য একটু রোদের আশায় , সালেহা একটু দুরে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার রাস্তা ঝাড়ু দিতে শুরু করে। এই বছর এমন কুয়াশা আর শীত পড়বে কেউ ভাবে নাই। অনেকটা হুড়মুড় করে চলে এলো শীত আর কি দাপট শীতের। অন্য বছর এসময় তো এত শীত লাগে না। আর এইবার এখনি যেন হীম বাতাস শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এই শীত কিভবে কাটবে তাই নিয়ে সালেহার যত চিন্তা। হাতে একটা টাকা বেশি থাকে না সারাদিনের খাওয়া খরচ শেষে। ছেলের জন্য একটা গরম কাপড় না হলে সত্যি ভীষণ সমস্যা হয়ে যাবে, এমনিতেই সারা বছর সর্দি লেগে থাকে মাসুমের।
''মা মা আমার শীত করে মা'' মাসুমের ডাকে সালেহার চিন্তার সুতো ছিড়ে যায়, দৌড়ে ছেলের কাছে আসে। ''বাজান একটু কষ্ট কর,কিছুদিন পর সরকার তেরান দিবি , তখন আর তোমার শীত করবিনা দেখবানে"।

শুক্রবার সকাল থেকেই শোনা যাচ্ছে ত্রানের কম্বল, সুয়েটার দেয়া হবে, কিন্তু কোথায় কখন সেটা কমলাপুর স্টেশন এর পাশের বস্তিবাসীরা বলতে পারছে না। এই বস্তির শত শত মানুষ শীতে কষ্ট করে। সর্দি, কাশি, জ্বর যেন প্রতিদিনের জীবনের সাথে জড়ানো। কিন্তু করার কিছু নাই, একটা গরম কাপড় নাই বলতে গেলে কারো। ওষুধ কেনার টাকাই বা পাবে কোথায় অসহায় এই মানুষগুলো?

ত্রানের খোজ নিতে নিতেই শুক্রবারটা পার হলো সালেহা, মাসুম, রইসুদ্দিন, কমলা আরো এরকম কতগলো অসহায় মানুষের। কেও কাজেও তেমন মনোযোগ দিতে পারছিলনা ত্রানের চিন্তায়। আর এই জন্যই কর্পোরেশনের শহীদ ভাই এসে সবাইকে বকাঝকা করে গেল...

" সুযোগ পাইলেই কমে ফাকি দেয়া লাগবে তাই না?? মামা বাড়ির আবদার পাইছ?''

'' শুনছ নি বুবু আইজ নাকি তেরান দিতে আসবি'' সালেহার মুখে এই কথা শুনে করিমের মার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। সারা রাত শীতে ঘুমাতে পারে নাই, এখনো শরীর কাপছে ঠান্ডায়। করিমের বাপের কদিন থেকেই হাপানির টান বেড়েছে। '' তার কষ্ট আর চোখে দেখা যায় না রে বইন'' একটা কম্বল পাইলে ভালই হইত।
''তালে চল গিয়ে দেখি কনে তেরান দিচ্ছে'' করিমের মাকে নিয়ে সালেহা হাটা শুরু করে। স্টেশনের দক্ষিন পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখে বেশ কিছু লোক চায়ের কাপ হাতে গল্পে মগ্ন , গল্পের বিষয় ত্রান।
দোকান ছাড়িয়ে আরো কিছু দূর গিয়ে ওরা অনেক লোক জড়ো হতে দেখে সেদিকেই এগিয়ে যায়।
'' এত লোক কোত্থেকে আইলোরে সালেহা? মুখ দেইখা তো চিনতে পারিনা! করিমের মার প্রশ্ন শুনে সালেহার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। ''তেরানের খবর শুনি অন্য জায়গায় থাকি লোক আসিছে বুঝলা বুবু।''

দেখতে দেখতে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। কিন্তু ত্রান কর্মীরা এত লোকের ত্রান আনে নাই বিধায় স্থানীয় নেতার সাথে পরামর্শ করে একটা তালিকা তৈরী করে , তারপর ত্রান দেয়া শুরু করে। তখন বেলা বেড়ে গেছে, সূর্যের তাপে সবগুলো মুখ লালচে দেখায়।

ত্রান নিতে আসা মানুষগুলোর অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না। মাইলখানেক লম্বা লাইনের শেষ দিকে দাড়ানো সালেহা আর দাড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়ে। '' কিরে বইসা পড়লি কেন?'' করিমের মার কোথায় চমকে তাকে সালেহা। সে কোথায় ঠিক বুঝতে উঠতে পারে না। হঠাত মাসুমের কথা মনে পরায় সালেহা কিছুটা দিশেহারা বোধ করে। বাচ্চাটাকে একা রেখে এসেছে, কখন ফিরবে তার ঠিক নাই , সারাদিন ছেলেটার মুখে একটু খাবার পড়ল কিনা ভাবতে ভাবতে সালেহার মাথা ঘুরে উঠে। তাই দাড়াতে গিয়েও আর দাড়াতে পারেনা,

এদিকে সারা দিন পেটে কিছু না পরে করিমের মার অবস্থাও খারাপ।ওরা ত্রানের আশা ছেড়ে হাটা দেয় নিজের ডেরায়।

দূর থেকেই জায়গাটা কেমন থমথমে লাগে সালেহার। '' বুবু , ও বুবু দেখ দেখি সব কেন খালি খালি লাগে?'

হায় হায় করে উঠে করিমের মা। সালেহার হাত ধরে দৌড়াতে থাকে বস্তি যেখানে ছিল সেদিকে। কি হয়েছে বুঝতে বাকি থকে না আর।
বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে, সম্ভবত নেতার আগমন উপলক্ষেই। ত্রান দিতে নেতা আসবেন আর সেখানে কিনা এরকম নোংরা বস্তি থাকবে?
নেতার চলার পথে কোনো নোংরা ময়লা যেমন থাকবেনা তেমনি থাকবেনা কোনো দৃষ্টিকটু বস্তি। তাই নেতা আসার আগেই সব পরিস্কার করা হয়েছে।

আজ শুক্রবার , সালেহার ছেলে মাসুম, করিমের বাপ, হায়দারের মেয়েটা কারো খোজ পাওয়া যায় নাই গত সাত দিনেও। আপনজন হারানো মানুষ গুলো জানে না কেন এমন হয়?
শীত থেকে বাঁচার ত্রান নিতে গেলে কেন তাদের হারাতে হয় মাথা গুজার ঠাই? কেন হারাতে হয় কারো স্বামী, কারো ছেলে?
এই তীব্র শীতের ঠান্ডা বাতাসের সাথে যুক্ত হয় স্বজন হারানোর ব্যথা । হয়ত এই শীত কোন না কোনো ভাবে পার করে দেবে এই সালেহা. কিন্তু তার একরত্তি মাসুমের জন্য সারা জীবন এক তীব্র কনকনে ব্যথা থেকে যাবে সারাজীবন এই স্বামীহারা নারীর।

সালেহাদের মত শত শত অসহায় , নিরাশ্রয় মানুষগুলো কনকনে শীতের রাতে প্রতিক্ষায় থাকে কখন সকাল হবে, এক চিলতে রোদ কখন ওদের গায়ে এসে পড়বে একটু উষ্ণতা নিয়ে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৮৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সুলতান মাহমুদ ৩০/১১/২০১৩
    দুঃখজনক তবে ভালো লাগল
  • প্রবাসী পাঠক ১৭/১১/২০১৩
    অসাধারন একটি লেখা। শেষটা এমন করুন হবে ভাবিনি। মন খারাপ করে দিলেন।
    • রোদের ছায়া ১৮/১১/২০১৩
      মন খারাপ করে দেবার জন্য দুঃখিত হওয়া ছাড়া আর তো কিছু করার নেই, তবে মন দিয়ে গল্পটি পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
  • অসাধারন তবে পড়ে বুঝতে প্রলাম আমার পড়া উচিত হয়নি এখন।
    • রোদের ছায়া ১৮/১১/২০১৩
      এখন পড়া উচিৎ হয়নি কেন বুঝলাম না যে?? তবে পড়েই যেহেতু ফেলেছেন তাই ধন্যবাদ।
 
Quantcast