www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বৃদ্ধাশ্রম

( বি.দ্র : আজ বিশ্ব প্রবীণ নাগরিক দিবস।
আমার এই লেখাটা সেই মানুষদের জন্য যারা ঘোলা দৃষ্টিতে ছল ছল চোখে জল নিয়ে দিনাতিপাত করছেন।)



__ “বাবা, নাম কি তোমার?”
__ “আমার নাম শূন্য।”
__ “শূন্য!! এইটা কেমন নাম!!”
__ “এইটা একটা অর্থসম্পন্ন নাম। যার অর্থ কিছুই না। নাম দিয়ে বিচার করলে আমি আসলে কেউ না।”
__ “নাম দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না বাবা। আমার ছেলের নাম তো রহিম। রহিম মানে দয়াময়। অথচ, আমার ছেলেই আমাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। কতদিন হলো ছেলেটাকে দেখি না! আর তোমার নামের অর্থ কিছুই না, তুমি আমার কেউ না অথচ, তুমিই আমার সাথে কত দরদি গলায় কথা বলছো।”

কথাগুলো বলতে বলতে-ই বৃদ্ধ রাজ্জাক সাহেবের চোখ দুটো দিয়ে অবিরাম ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমরা রমণীর চোখের জলকে ভালোবাসি, কাব্য রচনা করি, সন্তানের চোখে জল দেখলে বুক ফেটে যেতে চায় কিন্তু বৃদ্ধদের চোখের জল আমাদের কাছে মূল্যহীন। শুধু লোনা পানি ছাড়া আর কিছুই না।

মা, বাবা। তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের অনেক ভালোবাসে। তোমাদের কষ্ট, চোখের পানি দেখে ওদের অনেক খারাপ লাগে। কিন্তু তোমাদের সন্তানেরাও তো নিরুপায়। ওদেরও তো সন্তান আছে, স্ত্রী আছে। স্ত্রী-সন্তানদেরকেও তো সময় দিতে হবে। সন্তানদের কাছে তো তোমরা বাবা-মা কিন্তু ওদের স্ত্রী-সন্তানদের কাছে তো তোমরা কেউ না। তোমরা আজ বৃদ্ধ হয়ে গেছো। সন্তানদের বুকে আকড়ে ধরে রাখার শক্তি তো তোমাদের নষ্ট হয়ে গেছে। তোমাদের ভালোবাসা আজ নিরবে-নিভৃতে চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, বাতাসে আর্তনাদ করে কিন্তু সন্তানদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের পেয়েছে, সন্তানেরা তাদের মা-বাবাদের পেয়েছে আর তোমরা বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রম পেয়েছ। তোমরা বৃদ্ধ, তোমাদের সন্তানের দরকারটা কি!!

__ “ছেলেকে দেখার কী খুব ইচ্ছে হয়?”
__ “দেখতে ইচ্ছে হবে না!! সবসময় হয়। আমার দেহ তো এখানেই থাকে কিন্তু মন চলে যায় ছেলেটার কাছে আর গিন্নির(স্ত্রী) কাছে। অতি প্রিয়জনদের অল্প কিছুদিন না দেখতে পেলেও মনে হয় যে, অনন্ত কাল ধরে দেখি না।”
শেষের কথাগুলো বলতে রাজ্জাক সাহেবের গলা ধরে আসলো। চেহারাটা দুঃখিত দুঃখিত হয়ে গেল আবার।
__ “আপনার স্ত্রী এখন কার কাছে থাকে?”
__ “ও,ও,ওতো…………।।”

রাজ্জাক সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না। ঘোলা চোখ দুটো আবার ভিজে উঠতে শুরু করোলো। বুঝে নিলাম, ভালোবাসার চরম পরিনতী হয়েছে। ভালোবাসার মানুষগুলো যতক্ষন কাছে থাকে, ততক্ষন ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু থাকে না। সবকিছুতেই ভালোবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ভালোবাসতে বাসতে যখন ভালোবাসার মানুষগুলো হারিয়ে যায় তখন, ভালোবাসার চরম পরিনতী হিসাবে অন্তরে আর দৃষ্টিতে স্মৃতির আর্তনাদ ভেসে বেড়ায়। রাজ্জাক সাহেব কিছুক্ষন নিরবে স্মৃতি রোমন্থন করে আবার কথা বলতে শুরু করলেন। তার কথা বলার স্বরটা নেশাগ্রস্থ মানুষদের মত শোনাচ্ছে। যথেষ্ট পরিমান আবেগ নিয়ে কথা বলছেন।

__ “ছেলে বেলাটা আমার অনেক সুন্দর কেটেছে। গ্রামের ছেলে ছিলাম তো তাই, স্বাধীনতা জিনিসটা পুরো-পুরি উপভোগ করেছি। বিয়ের আগ পর্যন্ত, ছন্নছাড়ার মতই সময়টা কাটিয়ে দিয়েছি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, মারা-মারি, খেলা-ধুলা, শয়তানি, যাত্রাপালাদের সাথে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরা। কি করিনি! সব করেছি। সবদিক থেকেই জীবনটাকে রসিয়ে রেখেছিলাম। যুবক বয়সটা অনেক সুন্দরভাবে পাড় করে দিয়েছিলাম। অবশ্য তোমাদের মত এমন নগ্ন পরিবেশ, সভ্যতা আমি দেখি নি। তারপর বিয়ে, নতুন বউ! বউ এর জন্য আনচান করা মন, ঘড়ে রহিমের আগমন, নতুন স্বপ্ন!! অনেক ভালো কেটেছে দিনগুলো। দেখতে দেখতে ছেলেটা বড় হয়ে গেল। বিয়ে কোরে ঘড়ে টুক টুকে লাল বউ নিয়ে আসলো। দ্বিতীয়বারের মত আমার ঘড়টা নতুন লাজুক মুখে উজ্জল হয়ে উঠলো! তারপরেই আসলো আমার ঘড়ে নতুন মেহমান। নতুন মেহমানকে নিয়ে আমাদের দুইজনের দিনভর খুনসুঁটি আর লুকোচুরি খেলা চলতো। একসময় সকল খুনসুঁটি আর লুকোচুরি খেলা মিটিয়ে আমার গিন্নি…………!!
কত রাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি তা আর মনে নেই। এখনো, প্রায় রাতই না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। আগে গিন্নির জন্য ঘুমাতে পারতাম না আর, এখন যোগ হয়েছে ছেলেটা। ছেলেবেলাটা অনেক সুখে কেটেছে বলেই মনে হয় এখন এতো দুঃখ সইতে হচ্ছে আমাকে। তাই বলে, আমি কখনই ছেলেবেলায় ফিরে যেতে চাই না, নতুন বউ-এর জন্য মন আনচান করা সময়ে যেতে চাই না। কিন্তু ছেলের সাথে ওদের সুখে-দুঃখে একসাথে থাকতে চাই। বাবা হিসাবে, এটা কি আমার অনেক বেশি চাওয়া?
আমি কি এতটুকুও চাইতে পারি না!! ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের সাথে জীবনের শেষ সময়টুকু একসাথে কাটিয়ে দিতে চাওয়াটা কি, খুব বেশি চাওয়া হয়ে গেলো!!”


রাজ্জাক সাহেবের কষ্টেভরা শেষের কথাগুলোর উত্তর আমার কাছে থাকলেও, আমি নিশ্চুপ-ই থাকলাম। আসলে কথা বলার সাহস পাচ্ছি না। যদি গলাটা কেঁপে যায়, এই ভয়ে। বুঝতে পারছি গলার ভিতর ব্যাথা করছে। চোখ ভিজে উঠতে চাচ্ছে। আমি চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। রাজ্জাক সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছে। অঝোর ধারায় কাঁদছে। আশে-পাশে তাকালাম। নিঃসঙ্গ অনেক বৃদ্ধকেই বসে থাকতে দেখলাম। আমি জানি, এখানে প্রত্যকটা বৃদ্ধের মাঝেই কিছু না কিছু কষ্টের কাহিনী লুকিয়ে আছেই। আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে অনেক বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। বন্ধুদের জন্য কত কি করলাম, প্রেমিকার জন্য কত সময় নষ্ট করলাম, শিক্ষার জন্য কত কষ্ট করলাম আর, যারা আমার জন্য পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তুলেছে তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। এত কিছু জীবনে করার পরেও, আজ নিজেকে অপদার্থ-ই মনে হচ্ছে।

আমি রাজ্জাক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেরিয়ে আসলাম। পথে নামতেই দেখলাম, ব্যাস্ত রাস্তা, ব্যাস্ত মানুষ, ব্যাস্ত সময়। সবাই ব্যাস্ত। পৃথিবীতে এত ব্যাস্ততার মাঝেও অনেকে ব্যাস্ত থাকার ভানও করতে পারে না!! স্মৃতিতে ব্যাস্ত থাকতে গেলেও কান্না এসে যায়।
অসহায়!! বড়ই অসহায়!!
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৬৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০৮/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast