www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অনেকটা বাবার মতোন

অনেকটা বাবার মতোন
__________________________________

"কাকু একটা লজেন্স দিনতো..... ঐ যে সেই লজেন্সগুলো...হপ্তাখানেক আগেই নিলাম যে---হ্যাঁ ঐতো ওটাই....এই নিন দু' টাকা ।"
"কিন্তু খোকা এই লজেন্সের দাম তো কদিন হলো বেড়েছে....আরও একটাকা লাগবে....তিনটাকা দাম। "
খানিক থমকে দাঁড়িয়ে ব্রহ্মাণ্ডের সকল হিসেব যেন এক লহমায় মেলানোর চেষ্টা করছিল হারু ,ওরফে দ্যুতিমান দাশগুপ্ত। ডাকনামের সাথে প্রকৃত নামের দ্বন্দ্ব তার অনেকদিনের। বছর সাতেক বয়স হবে হয়তো ছেলেটির ,গুণের কথা খুব একটা কানে না আসলেও দ্যুতির রূপের দ্যুতি সত্যই নজরকাড়া। একজোড়া মায়াবী চোখ আর ঠোঁটের কোণে একটা মনভোলানো হাসি নিয়ে অত্যন্ত নীচু গলায় সামান্য আবদারের সুরেই সে বলে -" টাকাটা কাল দিয়ে গেলে হবে গো কাকু? আসলে আমি তো ঠিক জানতাম না......তাই বলছিলাম ......"
এমন মিষ্টি কথায় না ভোলে এমন সাধ্য কার? এমন ছেলেকে একটাকা মাফ করে দিলেও ব্যবসায় ভাটা আসার প্রশ্নই আসেনা।
" ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে....এতে এত ইতস্তত করার কি আছে?? তুমি কি নতুন নাকি? যাও তোমার এবারের জন্য ঐ টাকাটা মকুব .. কেমন....।"
এহেন ব্যক্তিত্বও আজকাল খুব কম নজরে আসে যাদের কাছে আর্থিক আত্মতুষ্টির চেয়ে মানুষের অন্তরাত্মায় আনন্দ যোগ অনেক বেশি শ্রেয় বলে বিবেচিত হয়। দোকানদারের মন ছিল উদার, নাম চৈতন্যনাথ মহাপাত্র। বছর পনেরো হলো সে মুদির দোকান দিয়েছে এ পাড়ায়; পাড়ার লোকেরা পাত্রবাবুর দোকান বলেই চিনে এসেছেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। জন্ম থেকেই হারুকে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে দেখেছে সে....আগে প্রতি সপ্তাহেই বাবার সাথে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে লজেন্সের সমাহার দেখে ছেলেটির আবদারের সীমা থাকতো না। হারুর বয়স যখন তিন, তার বাপ কোথায় যেন পালিয়ে যায় মাতৃহারা ছেলেটিকে একলা ফেলে; পরবর্তীতে যদিও জানা যায় সে অন্য সম্পর্কে আবদ্ধ - সংসারী লোক। ছোটো থেকেই তাই জীবনের প্রতিটি সংজ্ঞা, প্রতিটি ব্যাখ্যা হাতে ধরে চিনতে শিখেছে সে--বুঝতে শিখেছে কঠোরতর সত্যগুলোকে। বাবা হারালেও সপ্তাহে এক-দুদিন সময় করে পাত্রকাকার দোকানে যাওয়ার অভ্যেসটা তার হারায়নি। বাপের পরে এই একটি লোক যার সাথে সকল কথা নিশ্চিন্তে ভাগ করে নেওয়া যায়। চৈতন্যনাথ বহুবার ভেবেছিল ছেলেটির বাড়ি গিয়ে যত্সামান্য সাহায্য করবে-- তবে হয়ে ওঠেনি কোনোদিন.... স্ত্রী তার আবার বড্ড সংরক্ষী। দোকানের শনি-রবিবার বিক্রিবাট্টা চুকিয়ে সে একটু একটু করে অধ্যয়ন করেছিল হারুর কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটার ধরণ... মায়াবী চোখ; আরও কত কী। ছেলেটি দূর থেকে দাঁড়িয়েই হরেক রকম লজেন্স আর বিবিধ বিস্কুটের বাহার উপভোগ করতো। মাঝেমধ্যে ভালোবেসে এক-দুটো দিয়ে দিত পাত্রবাবু ; বলতে গেলে তখন থেকেই অঙ্কুরিত তাদের অসম বন্ধুত্বের বীজ। লোকের মুখে চৈতন্যনাথ শুনেছিল হারু নাকি পড়াশোনায় এককালে বেজায় ভালো ছিল। এক শ্রাবণসিক্ত শনিবারের বিকেলে পাত্র একটু গম্ভীর হয়েই তাকে প্রশ্ন করে- " কোন ইস্কুলে পড়তে এর আগে?"
খানিক অপ্রস্তুত হয়েই হারু জানায়-"সাউথ সিটি"
পিতার সম্পত্তি ছিল প্রচুর, তবে তা যে সর্বদা উত্তরাধিকার সূত্রে একমাত্র পুত্রের নামেই পুঞ্জিভূত হবে তার অন্তঃসারশূন্যতা শিরায়-শিরায় উপলব্ধি করতে দেরি হলোনা মহাপাত্রের।
"বাবা তুমি পড়াশোনা করতে চাও? আবার ইস্কুলে যেতে চাও?"
"হ্যাঁ চাই...কিন্তু ......কিন্তু টাকা বলতে যে কিছুই নেই কাকু।"
তখন কতই বা বয়স হবে হারুর? খুব জোর পাঁচ; এক বছর পাঁচেকের ছেলের মুখে এমন পরিপক্ব বাস্তবতার সুর আশাও করেনি চৈতন্য। খানিক স্তব্ধ থেকে জীবনের সকল অভিজ্ঞতাকে সেই সীমিত মূহুর্তে কেন্দ্রীভূত করে সে বলে -" আমি দেবো টাকা...."
জীবনে ইতিপূর্বে কোনোদিনও ছেলেটি এহেন লজ্জিত হয়েছিল কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে-- তবে বাপের বয়সি মানুষটির মুখের ওপর কথা বলার সাহস বা তেমন শিক্ষা কোনোটিই ছিল না তার; তাই খানিক পরেই মাথা নাড়িয়ে বলে -"আচ্ছা...!"
দুদিন পর থেকেই হারুর স্কুল জীবনের হারানো সুরে আবার জুড়তে থাকে নতুন নতুন রাগ...নতুন নতুন সুর। তার অন্দরে শায়িত প্রতিভাগুলো আবার জেগে ওঠে এক এক করে। শুধু যে লেখাপড়া তা নয়, হারুর প্রায় সকল খরচই চালাতো উদারচেতা চৈতন্যনাথ। প্রতি সপ্তাহে মাত্র দুবার দেখা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে দোকানের বাইরে কোনোদিনও দেখা হয়নি তাদের। মহাপাত্র হয়তো খানিক চক্ষুলজ্জার ভয়েই বাইরে দেখা করতে চাইতও না তেমনভাবে।
" তা তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে হারু? সব ঠিকঠাক তো?"
"হ্যাঁ ভালোই চলছে ....কাকু যদি আপত্তি না করেন একটা কথা বলতে পারি? "
"অবশ্যই .... কীসের আপত্তি?? তুমি নিশ্চিন্তে বলো"
"কাকু আমাকে আপনার দোকানে কাজ করতে দেবেন? মাস গেলে যা হোক কিছু মাইনে দেবেন আমাকে.....।"
চৈতন্য ঢের বুঝতে পারল নিশ্চয়ই কিছু তাৎপর্য রয়েছে এই কথার পেছোনে;আদ্যপ্রান্ত লেখাপড়া প্রেমী ছেলেটি হঠাৎ কাজে ঢুকতে চাইছে এ একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রাসঙ্গিক।
"কাকুর কাছে কিছু লুকিও না ... আসল ব্যাপারখানা খুলে বলো দেখি......."
"আসলে কাকু .....আমি রোজগারের ঐ টাকায় একখানা সাইকেল কিনতে চাই , দামটা ঠিক ঠাহর করতে পারছি না....তবে আমি খুব পরিশ্রম করে তা দিয়ে ঠিক কিনতে পারব। দেবেন কাকু একখানা কাজ?"
একটু আপত্তির সুরেই চৈতন্য জানায়--" তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো.....যত পরিশ্রম, সাধনা সব সেই দিকেই উজাড় করে দাও...মানুষের মতো মানুষ হও....এখনই জীবনটা সমাজের এই জাঁতাকলে নিষ্কাষিত হতে দিওনা....।"
এমন জটিলতর কথাগুলোর অর্থ হয়তো হারু বুঝেছিল; বুঝেছিল জীবনের গোপন মন্ত্র- হয়তো তার দূরদর্শী মনে অনুধাবন ঘটেছিল একরাশ ভবিষ্যদ্বাণীর, তাই এক লহমায় সে বলে -" ঠিক আছে কাকু....আপনিই সত্যই বলেছেন ; দেখবেন আমি অনেক অনেক বড়ো হবো....মস্ত বড়ো "
যদিও নিজ আবেগে লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছিল চৈতন্যনাথ মহাপাত্র। পরদিনই সবার অলক্ষ্যে একখানা নতুন সাইকেল কিনে উপহার দিয়েছিল হারুকে। পিতার অনুপস্থিতিতে কখন যে একটু একটু করে হারুর পিতৃসম হয়ে উঠেছিল সে, বুঝতেও পারেনি। সাইকেল পেয়ে খুশির জোয়ারে মেতেছিল দ্যুতি , রক্তের টান যে শেষ কথা বলেনা- হৃদয়ের টানেই যে মিলন ঘটে আত্মা-পরমাত্মার, তা স্বচক্ষে অবলোকন করেছিল সে।
এমনি করেই কালচক্রের বহমানতায় হারু বড়ো হতে থাকে....শুধু হারু বললে ভুল হবে- ধীরে ধীরে প্রৌঢ়ত্বের ভ্রুকুটি কড়া নাড়তে থাকে মহাপাত্রের জীবন-আঙ্গিনায়। দেখতে দেখতে ষোলোয় পা ফেলে হারু। এর মধ্যেই ঘটে যায় এক অবাঞ্ছিত ঘটনা--যার আন্দাজ পাত্রবাবু করেছিল বহু বছর পূর্বে...যার প্রাবল্য সম্পর্কে অনুমান করা গেলেও পরিণতি ছিল অনিশ্চিত - পাড়ার কোনো এক লোকের মুখে চৈতন্যনাথ মহাপাত্রের স্ত্রী বিস্তারিত শুনেছিল ব্যাপারখানা .... ধুন্ধুমার বেধেছিল দুটিতে। পাত্রবাবুকে বউয়ের মুখের ওপর জবাব দিতে হয়তো প্রথমবার শুনেছিল গোটা পাড়া। স্বামীর এহেন দৌরাত্ম্য আর মিথ্যাচার না মানতে পেরে সে তাদের মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল বাপের ভিটেয়। চৈতন্য বহুবার গিয়েছিল ফিরিয়ে আনতে...অনুরোধ করেছিল সহস্রবার, তবে তা কোনো কাজে আসেনি - মায়ের মতো মেয়েটিও তার বড্ড একরোখা...সটান জানিয়ে দেয়-" তোমাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে আমার, আজ থেকে মনে করবো আমার বাবার পঞ্চোত্তর প্রাপ্তি ঘটেছে...."
সবার বোধবুদ্ধি বা দূরদর্শীতা হারুর মতো পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি এই ভেবে মেয়ের কথাগুলোকে 'অপ্রাসঙ্গিক ভুল' হিসেবে বিবেচনা করেছিল পাত্র - তবে কয়েক ফোঁটা পরিশিষ্ট আত্মসম্মানের স্রোতেই সে আর কোনোদিনও শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ মাড়ায়নি; হারুর জন্য এতোদিনের সম্পর্ক....এতোদিনের মেলামেশা ....এতো পরিচয় সব নিমেষে পরিত্যাগ করেছিল সে। পাছে ছেলের মনোজগতে বিপর্যয় আসে, তাই দ্যুতির কাছে এই সকল ঘটনা অজানাই রেখেছিল পাত্রবাবু।
"তোমার মাধ্যমিকের আর কতমাস বাকি হারু?? তুমি কোনো অতিরিক্ত গৃহশিক্ষক নিতে চাও? ..."
কথাটির অনুরণন শেষ না হতেই সে আবার শুরু করলো- " তুমি মেধাবী ছাত্র ....তোমার ফলাফলে যাতে আমার মাথা ঐ যে শহীদ মিনার আছে যে....তার থেকেও উঁচু হয়ে যায়....অনেক উঁচু ...তুমি পারবে তো বাবা?"
"পারবো....নিশ্চয়ই পারব ।"
কথাগুলো বলার সময় চৈতন্যনাথের গলার তেজ অনেকটা ম্লান হয়েছিল ; হয়তো চোখ থেকে দু ফোঁটা বারিধারাও নেমেছিল সবার অজ্ঞাতেই। শনি-রবিবার প্রায় পুরোটাই কেটে যেতো হারুর লেখাপড়ার দিকে আলোকপাত করতে। একখানা গৃহশিক্ষকও রেখেছিল পাত্রবাবু....তিনি ঐ দুদিন দোকানে এসেই পড়াতেন হারুকে।
"ছেলেটি বড্ড মেধাবী .... চিন্তা করবেন না...ছেলে আপনার দারুণ ফল করবে....।"
শিক্ষকটির হারুকে করা মাত্রাহীন প্রশংসার জন্যই হোক কিংবা চৈতন্যনাথ মহাপাত্রকে তার পিতা বলে সম্বোধন ...পাত্রবাবু এমন স্বর্গসুখ ইতিপূর্বে কোনোদিনও অনুভব করেননি।
দেখতে দেখতে হারুর মাধ্যমিক শেষ হলো। সবার নজর কেড়ে রাজ্যে তৃতীয় স্থানাধিকারী সে।পাত্রবাবুর আনন্দের অশ্রুধারা সেদিন পেয়েছিল পার্বত্য পথ....ঝরে পরেছিল বঙ্কিম বেগে। গোটা পাড়ায় রকমারি মিষ্টান্ন বিতরণ করেছিল সে...হারুকে সাধুবাদ জানিয়েছিল প্রত্যেকে।
একদিন দোকানে হারুকে বুকে জড়িয়ে আবেগাপ্লুত মহাপাত্র জিজ্ঞাসা করে -" উচ্চমাধ্যমিকে তুমি কী বিজ্ঞান নিতে চাও ? নাকি ঐ যে আর্স না কী যেন বলে , ওটা? "
"কাকু আমি বিজ্ঞান নিয়েই এগোতে চাই....আমার ভীষণ পছন্দের....কাকু বলছিলাম যে আমি দু একটা টিউশন পড়াতে পারি?? না , টাকার জন্য নয়- জিনিসগুলো চর্চায় রাখার জন্য..."
"তা বেশ তো....পড়াও...তবে নিজের পড়াশোনা বজায় রেখে...."
যথারীতি টিউশন পড়িয়ে সেই টাকায় পাত্রবাবুকে একখানা খাসা পোশাক কিনে দেয় সে। ধীরে ধীরে উচ্চমাধ্যমিকেও রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানার্জন করে দ্যুতিমান দাশগুপ্ত। ছেলেকে মস্ত কলেজে পদার্থবিদ্যায় ভর্তি করানোর সব খরচ একা হাতে সামলান তিনি। কদিন পরেই সবার মুখে মুখে শোনা যায় হারুর নাম ; চৈতন্যনাথ নিজ মনেই আবিষ্কার করে এবার হয়তো ছেলেটির পোড়া কপালে দ্রবীভূত হবে সকল সাফল্য---সকল সুখ হয়তো নিমজ্জিত হবে হারুর সংকীর্ণ ললাটে। দ্যুতিমান কলেজেও সেরা, শিক্ষকদের নজরকাড়া এক অনিবার্য চরিত্র। তার এখন বন্ধুবান্ধব অগণিত - তাদের মাঝেই হয়তো কোনো বিশেষ বান্ধবীও ছিল- যাকে পাত্রবাবু বার দুয়েক দোকানের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখেছিল দ্যুতির জন্য। ছেলেটা বড্ড লাজুক , চৈতন্যবাবুকে এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেনি। কতবার মহাপাত্র ইঙ্গিত করেছিল মেয়েটির , তবে প্রতিবারই সলজ্জ দৃষ্টিতে তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ পরিণতি পেয়েছিল একটি মিষ্টি হাসিতে। তবে পাত্রবাবুর বুঝতে সময় লাগেনি মোটেই।
" বাবা চুল গুলো তো আর এমনি সাদা হলোনা...মেয়েটিকে একদিন পরিচয় করিয়ে দাও আমার সাথে....তোমার বুড়ো কাকাও দেখুক তার ছেলের পছন্দ..."
"ধুর! কি যে বলছেন কাকা.....ও তো .. ঐ আর কি ...."
সেদিন তাদের দুজনের হাসির জোয়ারে ভেসেছিল গোটা পাড়া...প্লাবিত হয়েছিল সকল ঘেরাটোপ ; শূন্য হয়েছিল বয়সের অন্তর।
ইদানিং হারুর যাতায়াত খানিক কমেছে। ছেলে যুবক হয়েছে, তাছাড়া লেখাপড়ার অনেক চাপ; তাই এ ব্যাপারে তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি মহাপাত্র - শুধুই মনে প্রাণে ঠাকুরকে ডেকেছে দিনরাত--ছেলেটা যাতে মস্ত বড় চাকরি পায়; যাতে অনেক নামডাক হয় তার। হারুর নামে পুজো দিতে বার কয়েক দক্ষিনেশ্বরেও যান তিনি। মাঘ মাসের এক ক্লান্ত বিকেলে চৈতন্যনাথ খবরের কাগজখানা উল্টে পাল্টে দেখছিল। সহসাই সে উপলব্ধি করে গত সপ্তাহে হারুর অনুপস্থিতি - প্রায় বারো দিন হলো ছেলেটি বেপাত্তা। মহাপাত্রের উত্কণ্ঠা সবে নিজ শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছতে যাবে, ঠিক তখনই সকল স্তব্ধতা, সকল দুশ্চিন্তা দূরীভূত করে আগমন ঘটে দ্যুতির।একটু কাতর সুরেই পাত্রবাবু জিজ্ঞাসা করে- "আগের হপ্তায় এলেনা যে বড়ো? কাকা এখন পুরোনো হয়ে যাচ্ছে বুঝি? "
" আসলে গত সপ্তাহে একখানা ইন্টারভিউ ছিল ...এক মস্ত কোম্পানিতে ....তাই আসতে পারিনি ।"
জীবনের প্রথম ইন্টারভিউতে হারু নিজ পিতৃসম পাত্রকাকাকে না জানিয়ে, তার আশীর্বাদ না নিয়ে যাবে ,এ অতি বেমানান- কথাটা কিছুতেই আত্মস্থ করতে পারছিল না চৈতন্যনাথ মহাপাত্র- তবে যতই হোক , হারু তার পুত্রসম; হয়তো পুত্রের থেকেও আরও বেশি কিছু; আর ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে বাপ-মায়ের প্রতি একটু নজর কমে- একথার যথার্থতা পূর্বেই অনুধাবন করেছিল মহাপাত্র--তার তো একখানা মেয়েও ছিল কিনা!! তাই নিশ্চিন্তেই হারুকে সুধিয়েছিল- "কেমন হলো বাবা ইন্টারভিউ?"
"বেশ হয়েছে কাকু....আশা করি চাকরিটা হয়ে যাবে--তখন কিন্তু আপনার এই দোকানপাট ছেড়ে আমার সাথেই থাকতে হবে..."
"অবশ্যই থাকব বাবা....অবশ্যই থাকব...।"
দিনে দিনে হারুর যাতায়াত আরও কম হতে থাকে, এক সপ্তাহের ফাঁকি এখন পর্যবসিত হয়েছে এক মাস,দু মাসে। অভ্যেসেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন; লুপ্ত হয়েছে সেই পুরোনো হাসি আর নিখুঁত চোখদুটোর মায়া।
প্রায় মাস দুয়েক হলো হারু আসেনি তার কাকার কাছে।পাত্রবাবুর শরীরখানাও তেমন সুবিধের নয়...দেখতে দেখতে বয়সটা তো আর কম হলোনা।খানিক রাগ আর বেহিসেবি অভিমান নিয়ে সে ভেবেছিল হারু আসলে তাকে খুব করে বকে দেবে; গালে একখানা চড় কষিয়ে সমস্ত অভিমানের মুক্তি ঘটাবে এক নিমেষে, পরক্ষণেই অনুতপ্ত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাটিয়ে দেবে অনেকগুলো মুহূর্ত।পরবর্তী কয়েকদিনেও হারুর দেখা পাওয়া গেল না। চৈতন্যেবাবু খানিক বিচলিত হয়েই একে তাকে প্রেরণ করে হারুর একখানা খবর এনে দিতে; তবে তার মতো সামান্যতম এক মানুষের বিন্দুবৎ আবেগের গুরুত্ব বা সম্মান দেওয়ার মতো মানসিকতা কারোর মধ্যেই উন্মোচিত হয়নি।
হারুকে শেষবারের মতো কবে দেখেছিল তার সঠিক দিনটিও বয়সের ভারে তেমনভাবে অনুমান করতে পারে না চৈতন্যনাথ মহাপাত্র। আর স্থির হয়ে বসে থাকা মোটেই চলে না। প্রৌঢ়ত্বের অবাঞ্ছিত ভার এবং ঘনীভূত একগুচ্ছ আশাকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পরে সে। হারুর বাড়িতে যেতেই দেখা মেলে একদল অচেনা মুখের; দামি দামি পোশাক পরিহিত বিলিতি স্বভাবের এই লোকগুলোকে ইতিপূর্বে এ পাড়ায় দেখা যায়নি কোনোদিনও। চৈতন্যবাবু ভেবেছিল হয়তো হারুর বন্ধুরাই হবে-- মস্ত কলেজে পড়ে, বাবা মার টাকার তো আর অভাব নেই , তাই এমন পরিচ্ছন্ন সাহেবি পোশাক পড়েছে। হঠাৎ করেই মহাপাত্রের মনে অতীতগুলোর পুনরুত্থান ঘটতে থাকে এক এক করে, হয়তো বয়সের স্বভাব দোষেই নিজ অন্তরে প্রতিফলিত হয় আত্মবিশ্বাসী কিছু বুলি - "হারু আমার বেজায় মাটির মানুষ ...সাদাসিধে ছেলে....সে এমন পোশাক পরে কখনও নবাবিয়ানা দেখানোর ছেলে মোটেও নয়--দরিদ্র কাকার সান্নিধ্যে মানুষ কিনা! দারিদ্রের জ্বালা সে বোঝে। এমনভাবে সেজে কাকাকে সে কখনওই চমক দিতে পারবে না....।"
খানিক ইতস্তত হয়েই সে কিছু শুনতে যাবে ঠিক তখনই একটা সাদা ধবধবে গাড়িতে যেন হারুর মতোই কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখে সে; খানিক একমনে তাকিয়ে থাকে গলির শেষ মাথায়; গাড়িটি দৃষ্টিসীমানা অতিক্রম করতেই তার আশায় গাঁথা অলীক স্বপ্নগুলো আবারও অধিগ্রহণ করে চৈতন্যের মনোজগত। সে দোষারোপ করে নিজ দৃষ্টিশক্তিকে -- চোখের থেকেও অধিক বিশ্বাস তার হারুর ওপর...নেত্রযুগল ভুল উত্তর দিলেও হারু ভুল হতে পারেনা, তার জীবন জুড়ে হারুই শেষ সত্য --সুতরাং ওটা হারু হতে পারে না মোটেই । সামান্য ইতস্তত হয়েই সে জিজ্ঞাসা করে-" বলছি বাবা হারু আছে? তোমরা কি হারুর বন্ধু? "
"Excuse me...Who are you?"
জীবনের প্রথমাবস্থায় শেখা ইংরেজির যত্সামান্য শিক্ষাকে বহু কষ্টে পুনরুদ্ধার করে কম্পিত কণ্ঠে সে জানায় -"Father.....father, ইয়ে মানে Uncle ....অনেকটা বাবার মতোন ।"
খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জরাজীর্ণ চৈতন্যনাথ পুনরায় মিনতি করে--" একটু ডেকে দেওনা বাবা হারুকে ....আমার হারুকে।"
"Who is Haru? মানে হারুটা কে?"
"হারু...আমার ছেলে...মানে এ বাড়ির মালিক ...তোমরা নিশ্চয়ই ওর বন্ধু?"
কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে মহাপাত্রের দিকে চেয়ে তার কথাগুলোর অর্থ পুনরায় আবিষ্কারের চেষ্টায় বিফল লোকটি জানায়- "এটা স্যার দ্যুতিমান দাশগুপ্তের বাড়ি....আপনি বোধহয় ভুল জায়গায় এসে পরেছেন।"
"ঐ একই তো মানুষ...আমার ছেলে...দ্যুতিমান....মানেই তো হারু!"
নিজেদের মধ্যে কী যেন আলোচনা করে লোকগুলো নিক্ষেপ করল মহাপাত্রের জীবনে শোনা কিছু কঠোরতর অপ্রিয় সত্য , "কী বার বার ছেলে ছেলে করছেন বলুন তো মশাই ? স্যারের পিতৃপরিচয় আমাদের অজানা নেই...উনি তো বহুকাল পূর্বেই চলে গেছেন কোথায় যেন, আর ওনার মা মারা গেছেন সেই ছোট্ট বেলায়।"
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে সামান্য বিষাদের সুরেই মহাপাত্র জানতে চায় -"আমার কোনো পরিচয় দেয়নি? আমি ...মানে চৈতন্যনাথ মহাপাত্র...আমার কথা কিছু বলেনি আমার হারু? তোমাদের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে বাবা.."
"দেখুন..বারবার হারু হারু কাকে বলছেন? আপনার কোনো পরিচয় কেনই বা দিতে যাবেন তিনি? দ্যুতিমান দাশগুপ্ত বলে ডাকুন...USA তে এক মস্ত International Company র মালিক এখন তিনি... আপনার মতো আটপৌরে লোকের ধারে কাছে থাকার সময় বা ইচ্ছে কোনোটিই তার নেই। Disgusting!! ......"
হৃদস্পন্দন যেন তার বাহাত্তরের গুণিতকে প্রবাহমান , সব এক লহমায় শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়েই হোক কিংবা উদারচেতা মানুষটির আত্মসম্মানবোধেই-- একরাশ তপ্ত নিশ্বাস থেকে থেকেই বেরিয়ে আসছিল জরাজীর্ণ হৃদয়ের কাল-কুঠুরি থেকে। প্রায় মিনিট দুয়েক নীচের দিকে তাকিয়ে থেকে জীবনের অন্তিম শক্তিগুলোকে কোনোরকমে কুড়িয়ে সে চেষ্টা করে হারুর ঘরে ঢোকার- তবে তা শুধুই ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। এক প্রবলতর ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পরে সে; চশমার মোটা কাচগুলো বিচূর্ণ হওয়ার শব্দ আরও গভীরতর করে তোলে চৈতন্যনাথের হৃদয়ভরা অন্ধকার। লোকগুলো অত্যন্ত অমানবিক সুরে জানায়-" স্যার সাফ জানিয়ে গেছেন এ এলাকায় তার কেউ নেই...তিনি একটু আগেই বেরিয়ে গেলেন আমেরিকার উদ্দেশ্যে....আর ফিরবেন না তিনি।এই বাড়িটা নিলাম করতে এসেছি আমরা...কাজ হয়ে গেছে...এখন ফিরে যাব...।"
খানিকক্ষণ পরেই আরেকটি দামি গাড়িতে করে লোকগুলো বেরোলো বাড়ি থেকে, সামনের দরজায় লাগানো হলো এক মস্ত তালা। যেতে যেতে লোকগুলোর হৃদয়বিদারক কিছু কথোপকথন ভেসে আসল মাটিতে পরে থাকা চৈতন্যনাথের কানে , " বুড়োটা বেজায় ধুরন্ধর, যেই দেখেছে টাকা পয়সার ব্যাপার, লাভের আশায় ঠিক চলে এসেছে।"
উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তিও তখন চৈতন্যের নেই- শুধু শারীরিক নয়, মানসিক শক্তিতেও সে শূন্য। নেত্র বেয়ে আগত অশ্রুবিন্দু ক্রমাগত বাষ্পীভূত হয়ে মিশে যাচ্ছে মস্ত সেই গাড়িটির বর্জিত ধোঁয়ার সাথে। মোড়ের মাথায় গাড়িখানা অদৃশ্য হতেই কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত সৈনিকের মতো টলমল পায়ে পাত্রবাবু চলতে লাগল দোকানের পথে। একখানা লরি পথের ধারে সঞ্চিত কাদা জলের অনিশ্চিত শয্যার অবসান ঘটিয়ে বেরিয়ে গেল বীরবিক্রমে। দু এক ফোঁটা কাদা হয়তো ছিটেছিল চৈতন্যনাথ মহাপাত্রের সাদা পাঞ্জাবিটাতেও; কানে ভেসে এলো কারখানার সাইরেন আর দূরের কোনো মসজিদের শান্ত আজানের সুর, দেখতে দেখতে পথের শেষে অদৃশ্য হলো চৈতন্যনাথ মহাপাত্র।
বিক্রিবাট্টা আর হয়না তেমন, প্রতিটি ঘন্টা কেটে যায় অতীত কল্পনায়। মহাপাত্র মন থেকে হয়তো আজও মানতে পারেনা হারুর অনুপস্থিতি। নিজ কল্পনায় হারুর সাথে বিড়বিড়িয়ে কথাও বলে মাঝেমধ্যে। শনি রবিবার আজও খোলা রাখে দোকানের ঝাঁপ---মোটা চশমার আড়ালে অপেক্ষারত একজোড়া প্রাচীন চোখ আজও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দরজার পানে- হয়তো শ্রাবণসিক্ত কোনো আবদার নিয়ে আবার দরজা ঠেলে ঢুকবে সেই ছোট্ট হারু....তার মনভোলানো চোখের মায়ায় হয়তো আবার মেতে উঠবে বুড়োর মন...হয়তো শান্ত গলায় সে আবার বলে উঠবে----
"কাকু....একটা লজেন্স দেবেন?"
________________________________
_ শুভদীপ চক্রবর্তী
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৮২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/১০/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast