www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

চিঠি ।। ছোটগল্প

মধ্যাহ্ন খাবারের পর নাজিয়ার শরীরে ভাতের দুলুনি ওঠে । অভ্যাসটা পুরনো । এ সময়ে করার মত হাতে কাজ থাকেনা বলে সে বিছানার ডাক শুনতে পায় । ঠিক ঘুমও নয়, আবার জেগে থাকাও নয় । কেবল মস্তিস্কের ভেতর এলোমেলো চিন্তায় নির্লিপ্ত হয়ে থাকা । ভাবনাগুলো নিজেকে নিয়ে । আশফাকের ঘর ছেড়ে চলে   আসা, আশা ও হতাশার দ্বন্দ্বে নিজেকে তৈরি করা , ভালোবাসার যোগফলে শূণ্য পাওয়া , মনীষাকে নিয়ে অযাপিত জীবন পার করার ধূসর স্বপ্ন দেখা এবং আরও কতকিছু।

হঠাৎ নাজিয়া একটা শব্দ শুনতে পেল । কেউ যেন চিঠি , চিঠি বলে চিৎকার  করছে। প্রথমে ভেবেছিল ব্যাপারটা স্বপ্ন । স্বপ্নে তো এরকম কত  ব্যাপার ঘটে । কিন্তু ডোরবেলের যান্ত্রিক শব্দ তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করলে , সে শোয়া থেকে ওঠে বসে । অনিচ্ছা স্বত্বেও তার মুখে হাই ওঠে স্বাভাবিক ভাবে।

নাজিয়ার চুল এলোমেলো । কপালের উপরের দিকের চুলগুলো ফর্সা   চেহারার  উপর ঝুলে আছে । কয়েদিকে হাতকড়ি পরানোর মত করে সে চুলবেন্ড দিয়ে চুল বেঁধে নিল। তারপর ব্লাউজের উপর শাড়ির আঁচল ঠিকমত বসিয়ে মেহগনি কাঠের দরজা খুলে দাঁড়াল।
আপা চিঠি । ডাকপিয়ন চিঠি বাড়িয়ে ধরল।
নাজিয়া স্যাটেলম্যান্ট অফিসারের মত ডাকপিয়নকে একবার জরীপ করে নিল। দেখতে বেটেখাট, দৈর্ঘ পাঁচ ফুটের বেশি হবে বলে মনে হয় না। গায়ের রঙ আফ্রিকানদের মত কালো । মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি । শরীরের চেয়ে পেট অতিরিক্ত মোটা । পরেছে কাবলিওয়ালাদের মত পোশাক । রং ধূসর কালো । কাধে ঝোলানো ক্যানভাসের ব্যাগটার  রঙ তামাটে ।এ ধরনের লোকদের বয়স অনুমান করা বেশ কঠিন । নাজিয়া পিয়নটাকে আগে কখনো দেখেনি ।সম্ভবত অন্য এলাকা থেকে বদলী হয়ে এসেছে । চৈত্র মাসের গরমে লোকটাকে গলায় উলের মাপলার জড়িয়ে রাখতে দেখে নাজিয়ার নিজেরই গরম লাগে । কাঁচাঘুম ভাঙ্গার বিরক্তি তার ঠোঁটে লেগেই ছিল , সেখানে আরও একটু যোগ হল।

রেজিস্ট্রি । এইখানটাই দস্তখত করুন । ডাকপিয়ন কলম বাড়িয়ে ধরল নাজিয়ার মুখের কাছে।

নাজিয়া সরাসরি তাকাল লোকটির চোখের দিকে । গভীর  চোখ । অনেকটা অন্ধকার কূপের মত । নাজিয়ার মনে হল, লোকটি এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন জীবনে এই প্রথম মেয়েমানুষ দেখেছে । সে আগের পিয়নটির কথা ভাবে। মজিদ না কি যেন নাম । কথাবার্তায় ভদ্র ছিল । নাজিয়াকে বেশ সম্মান   দেখাত । নাজিয়াও মাঝেমধ্যে তার পরিবারের খোঁজখবর  নিত, ছেলেমেয়েদের কথা জানতে চাইত । দেশের বাড়ি ছিল কুমিল্লা । একবার ভাবে লোকটির কাছে মজিদের কি হল জনাতে চাইবে । পরক্ষণে চিন্তাটা বাতিল করে দিয়ে দ্রুত ডাকপিয়নকে বিদায় করে দিল।
আস্লামুআলাইকুম । লোকটি দ্রুত পা ফেলে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
নাজিয়া জবাব দিলনা । মেহগনি কাঠের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে  আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

চৈত্রের আকাশে রোদের তেজ কমেনি । গত বছরের তুলনায় এ বছর তাপমাত্রা বেড়েছ । তার গলার বলিরেখার ভাঁজে ঘাম জমেছে । সে আঁচলে ঘাম মুছে নিল। লক্ষ্য করল, পাশের বাড়ির কার্নিশে দুটি কবুতর বসে আছে। নাজিয়া ভাবে, কবুতর তো শান্তির প্রতীক । কিন্তু প্রতীক কী মানুষের জীবনে কোন উপযোগিতা পূরণ করতে পারে ? এই যে লোকটি বলে গেল, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক । গত পনের বছর ধরে সে কী শান্তিতে আছে ? একাকীত্বের যন্ত্রনায় সে জীবনের রঙ খুঁজে বেড়িয়েছে । কেবল অন্ধকার ছাড়া অন্যকোন রঙের অস্তিত্ব সে দেখেনি ।সুতরাং তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক কিংবা জগতে সকল প্রাণী সুখি হোক, সবকিছু তার কাছে প্রতীকি বিষয় বলেই মনে হয়। বাস্তবে এর কোন ফলাফল তার উপলব্ধিতে আসেনি ।

নাজিয়া চিঠির খামটি টেবিলের উপর ছুড়ে দিল । নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে । তার ধারণা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে আশফাক । বিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান। গুরুত্ব দিয়ে এ চিঠি পড়ার কোন অর্থ হয়না । ধীরে ধীরে তার মন ভারী হয়ে এল, যেন একখণ্ড কালো মেঘ তার মনের উপর জোর করে বসে আছে।
নাজিয়া বিছানায় শুয়ে পড়ে । বিক্ষিপ্ত চিন্তায় তার আর ঘুম এলনা । এক সময় সে ভাবত আশফাককে ডিভোর্স দেবে । কিন্তু মনীষার কথা ভেবে সে তার  সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছে । তারা তো একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল । কিন্তু  সে ভালোবাসা যে বিয়ের পর এত তিক্ততার  জন্ম দেবে নাজিয়া কখনো ভাবতে পারেনি। ভার্সিটিতে পড়াকালীন আশফাকের ধ্যানে-জ্ঞ্যানে ছিল শুধুমাত্র নাজিয়া । বিয়ের  পর নাজিয়া লক্ষ্য করে, সময়ের সাথে সাথে আশফাকের পরিবর্তন । বিশেষ করে মনীষার জন্মের পর থেকে আশফাক যেন অন্যমানুষ হয়ে গেল । রাত করে ঘরে ফেরা শুরু করল । নিয়মিত ড্রিংসের অভ্যাসটাও করে নিল । আশফাক কখনো বাইরে খাবার খাওয়া পছন্দ করতনা । দুপুরের জন্য নাজিয়া লাঞ্চপট দিয়ে দিত । রাতের খাবার তারা একসাথেই খেত । ধীরে ধীরে আশফাক অনিয়মিত ভাবে বাইরে খাওয়া শুরু করল । সামান্যতেই চিৎকার দিয়ে কথা বলত। তখন নাজিয়ার মনে হত, আশফাকের সংসারে সে বুঝি ক্রীতদাসী । কাজের বাহানা দিয়ে দিনের পর দিন আশফাক মিথ্যে গল্প শুনাত তাকে । আর এদিকে একটার পর একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে যেত নাজিয়ার । একবার গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার নাম করে বসের স্ত্রীকে নিয়ে রাঙামাটি বেড়াতে যায় । তার কলিগরাই ফোন করে নাজিয়াকে এসব কথা জানাত । যেদিন মিসেস শাহানা ও আশফাকের গোপন রোমান্স প্রকাশ হয়ে গেল, আশফাক চাকরি হারাল।

নাজিয়া কোনদিন ভুলতে পারবেনা সে রাতের কথা । তখনকার রাতগুলোকে তার চীনের প্রাচীরের মত মনে হত । যেন অনড় হয়ে থমকে আছে, কাটতে চাইত না। নির্ঘুম, দুঃচিন্তা, হতাশা তার চোখের নিচে চিহ্ন ফেলেছে । নাজিয়া ভাবতো, সে তো কোন পাপ করেনি, তবে এ কীসের দন্ড তার জীবনকে নরকের আগুনে ঠেলে দিয়েছে। এ কী তার ভাগ্য ? ফেরেস্তারা কী তার আমলনামায়  এসব লিখে রেখেছেন ? কেন ?

ভাগ্যকে বদলানো না গেলে মেনে নিতে হয়, নাজিয়া একথাই জানে । কম্প্রোমাই?  কিন্তু স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছে, সেটা কীভাবে মেনে নেয়া সম্ভব ? তবে কী বিদ্রোহ করবে, আর এভাবে  কী তার অধিকার ফিরে পাওয়া সম্ভব?

রাত আরও গভীর হল । নাজিয়া আরকিছু ভাবতে পারেনা । তার চোখ ভিজে আসছিল বারবার । আশফাক এল । প্রতিরাতের মত আজো ড্রিংক করেছে । তাকে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল । কালবৈশাখির ঝড়ে কোন গ্রামকে লন্ডভন্ড করে দেয়ার মত । নাজিয়া চুপচাপ । অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল । এই মুখ ফিরানোতে ঘৃণা ও অভিমান দুটোই কাজ করেছে ।  

অভিমান এ কারণে যে, আশফাক তার ভালোবাসার মর্যাদা দেয়নি । নাজিয়ার ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিলনা । আশফাক তার প্রথম ভালোবাসা । তার জীবনের আরাধ্য পুরুষ । একবার প্রতিবেশী এক ছেলেকে ভালো লেগেছি । সে তখন কলেজে পড়ে । কিন্তু ভালোলাগার কথা সে কোনদিন ছেলেটিকে জানায়নি । ব্যাপারটা ওখানেই চুকে গিয়েছিল ।
কী নেই নাজিয়ার ? যে কোন পুরুষের দ্বিতীয়বার তাকানোর মত সুন্দরী সে । শিক্ষিতা, স্মার্ট এবং একটি ভাল কোম্পানিতে চাকরিও করে । কিন্তু আশফাক কেন অন্যরকম হয়ে গেল নাজিয়া অংক মিলাতে পারেনা । এখন তাকে ঘৃণা করা ছাড়া নাজিয়ার আর কিবা করার আছে।

নাজিয়ার চুপ হয়ে থাকাতে পরিবেশ বড় অস্বাভাবিক লাগছিল আশফাকের । ভেবেছিল নাজিয়া একটা তুলকালাম কান্ড ঘটাবে । কিন্তু সেরকম কিছু না ঘটাতে সে বিস্মিত হল । বাম পা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের টুলখানি টেনে এনে বসে পড়ল । কোমর বাঁকা করে ঝুঁকে পা থেকে জুতা-মোজা ছাড়াতে লাগল ।

ছেড়ে দিলাম । উদেশ্যহীনভাবে আশফাক কথাটা বলল । নাজিয়া গায়ে মাখল না। যেন শুনতে পায়নি । নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকার ভঙ্গিতেও কোন পরিবর্তন আসল না । একবার সে পাঁচ বছরের ঘুমন্ত মনীষার দিকে তাকাল । ঘুমন্ত শিশুর মুখ খুব সরল । শ্বাস-প্রশ্বাসে মনীষার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে । নাজিয়া সেদিকে তাকিয়ে রইল নিবিষ্ট হয়ে ।

চাকরি ছেড়ে দিলাম । আশফাক টাইয়ের নট আলগা করছিল । তার কন্ঠ বিড়বিড় শুনাল । উত্তাপহীন, শীতের কুয়াশায় ঘিরে ধরার মত । নাজিয়ার  কোন প্রতিক্রিয়া হলনা । যেন এঘরে তার অস্তিত্ব নেই । সে আশফাকের মুখে কোন কথা শুনতে চায় না আর  দিনের পর দিন ঐ কপট মুখ থেকে মিথ্যে গল্প শুনতে শুনতে সে এখন ক্লান্ত।

বস লোক ভালনা । আশফাক কোটের বোতাম খুলছে । নাজিয়ার দৃষ্টি ঘুরে গেল। তির্যক ভাবে তাকিয়ে আছে আশফকের দিকে । যদি নাজিয়ার দৃষ্টি ধনুকের ফলা হত, এক্ষুনি ছুটে গিয়ে বিদে যেত আশফাকের জ্বিবাহর মাঝখানে । সে বুঝতে পারে আশফাক খুব স্বাভাবিক ভাবে মিথ্যে বলতে পারে । আশফাক কিছুটা অপ্রস্তুত হল কিন্তু তেমন বুঝা গেলনা ।

ভণ্ডামিরও একটা সীমা থাকা চাই । শরীরের উষ্ণতায় নাজিয়ার ঠোঁট কেঁপে উঠলে সে একটাকে আরেকটার সঙ্গে পিষে রাখে । তার মায়ের কথা মনে পড়ে । মা বলত, যখন তুই রেগে যাবি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকবি । মাটি তোর রাগ টেনে নেবে । কিন্তু নাজিয়া ঘরের ভেতর মাটি কোথায় পাবে ? তার রাগ আরও চড়ে ওঠে ।

কী বলতে চাচ্ছ ? আশফাক কোট ছুড়ে মারল কার্পেটের দিকে । হঠাৎ গাড়ির হার্ডব্রেক চাপার মত ক্যাচ ক্যাচ শব্দ বের হল তার গলা থেকে । বুঝতে পারল, আসার পথে সাকুরা ক্লাবে বসে দুই পেগ র’ ঢেলেছিল তা এখন কাজ করতে শুরু করেছে । এখন খেস্তিখেউড় আওড়াতে আর সমস্যা নেই । আশফাকের কন্ঠ চড়ে উঠতে লাগল । শালা শূয়রের বাচ্চা সোলাইমান, ফকিরনীর পোলা, আমি তোমার আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সব কাহিনী জানি । নিজেকে বাদশাহ সোলাইমান মনে কর নাকি ? আমি তোর চাকরির নিকুচি করি । কলিগদের সামনে অপমান করার প্রতিশোধ আমি নেবই নেব ।

দেখ, নিজেকে সংযত করে কথা বল । এখানে আশেপাশে ভদ্রলকেরা থাকেন । অপরাধ করেছ তুমি । বসের স্ত্রীকে নিয়ে ফস্টিনষ্টি করবে আর তিনি মুখ বুঝে সব দেখে যাবেন নাকি । আমি তো জানি সোলাইমান সাহেব খুব ভাললোক ।
নাজিয়া নিজেই অবাক হল, সে আশফাকের মুখের উপর এতকথা বলতে পেরেছে দেখে । তার মনে হল অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিৎ এবং মানুষ তাই করে ।

নাজিয়া তুমি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ । আশফাক রাগ সামাল দিতে পারেনা । সে একপাটি জুতা তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে । সেটা বাথরুমের  দরজায় আঘাত করে কার্পেটের উপর পড়ে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে থাকে । সব মিথ্যে, বানোয়াট, স্ক্যান্ডাল । তার কন্ঠ পুরনো সেলাইকলের মত গজ গজ করতে থাকে ।

আমার কাছে প্রমাণ আছে । কথার পিঠে কথা এসে যায় । নাজিয়া আর চুপ করে থাকতে পারেনা ।

প্রমাণ ! আশফাক চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠল । মনে হল ফ্লোরে কাঁসারবাটি পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দ হচ্ছে । তার লাফ দেয়ার ভঙ্গিও  ছিল আনেকটা হাইজাম্পের মত । তারপর যা হবার তাই হল । আশফাক দুহাতে নাজিয়ার গলা চেপে ধরে বলল, একদম চুপ। যা জেনেছ তা ভুলে যাও, আর কিছু জানার চেষ্টা করবে না । আশফাকের হাত থরথর করে কাপছিল । যেমন করে ভূমিকম্পে পৃথিবী কাঁপে ঘরের আসবাব কাঁপে ঠিক সেরকম ।

নাজিয়া গলায় আঙুলের চাপ অনুভব করছে । আশফাক আর একটু চাপ বাড়ালে হয়ত তার দম আটকে যাবে । নাজিয়া কিছু বলতে চেষ্টা  করে স্বাভাবিক ভাবে বলতে পারলনা । সেই রাতে চুপ হয়ে  গিয়েছিল । পাখিডাকা ভোরে নাজিয়া মনীষাকে নিয়ে মায়ের বাসায়  চলে এল । আশফাক তখন গভীর ঘুমে নাক ডাকছিল।

মা, তুমি কী ঘুমুচ্ছ ? মনীষার ডাকে নাজিয়ার তন্ময়তা কেটে যায় । মনীষা মায়ের বুকের  উপর ঝুঁকে আসে । সে ব্লু জিনস ট্রাউজারের সাথে সাদা হাতাকাটা ফতোয়া পরেছে । ফতোয়ার উপর পরা স্বর্ণের চেনটি চকচক করে ঝুলে আছে নাজিয়ার স্তনের উপর । ফেস পাউডারের গোলাপি আভায় তার চিবুক আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে । কোথাও যাওয়ার মত করে সেজেছে মনীষা ।  

না । নাজিয়া চোখ মেলে দেখে মেয়েকে । মনীষা বড় হয়েছে । কলেজে পড়ছে। তার কপালটা সামান্য বড় হলেও চেহারা হয়েছে বাপের মত আর রঙ পেয়েছে মায়ের ।

আমাকে একশ’টা টাকা দাওনা । মনীষার কন্ঠে উচ্ছ্বাস । চোখের তারা দুটো আরও বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ।

টাকা দিয়ে কী করবি ? নাজিয়া বালিশে ঠেস দেয় । পা দুটো ভাঁজ করে দ-এর আকৃতি বানায় । শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসে ।

টাউন হলে নাটক দেখব । আমার বান্ধবী সুমনার প্রথম নাটক । সবাইকে রিকোয়েস্ট করল দেখার জন্য । মনীষা বিছানায় বসে পড়ে । সে পায়ের উপর পা তুলে দেয় মেমসাহেবদের মত ।

বাঃ, বেশ তো ! সুমনার তাহলে থিয়েটারের স্বপ্ন পূরণ হল । কয়টার দিকে যাবি?  নাজিয়ার আঁচল কোলের উপর গোটিয়ে আছে । ঈদের বাঁকা চাঁদের মত ব্লাউজের গলার ফাঁক দিয়ে তার স্তন উঁকি দিচ্ছে ।
সন্ধ্যে ছয়টার দিকে । মনীষা তার ফতোয়ার দিকে তাকায় । খুব আটসাট হয়ে শরীরে লাগে আছে । মনে হচ্ছে স্তন চেপে ধরেছে । বুঝতে পারে শরীরের কিছুটা উন্নতি হয়েছে ।

সে তো অনেক দেরি আছে । নাজিয়া তর্জনীতে চুলের আগা প্যাঁচায় ।
তুমি যাবে মা ? মনীষা ঠোঁট লম্বা করল । তার সাদা দাঁত চকচক করছে ।

যেতে পারি । অনেকদিন হলে গিয়ে নাটক দেখা হয়না । হঠাৎ এরকম আমন্ত্রণ নাজিয়ার ভাল লাগে । কিছুটা সময় হলেও চিঠির দুঃচিন্তা থেকে দূরে থাকা যাবে । তোর নানু কোথায় ?

ড্রয়িংরুমে বুয়াকে ধমকাচ্ছে । মনীষা আঙুলের নেলপলিশ পরীক্ষা করে ।
কেন ? নাজিয়ার দৃষ্টি টেবিলে রাখা চিঠিখানার দিকে চলে যায় । বুঝতে পারে মনীষা এখনও সেটি লক্ষ্য করেনি ।
ছোটমামা আমেরিকা থেকে যে ফ্লাউয়ার ভাসটা এনেছিল, ধুলো ঝাড়তে গিয়ে বুয়া সেটা ভেঙ্গে ফেলেছে । মনীষার পায়ে ঝিঝি ধরেছে । সে উঠে দাঁড়ায় ।
কোনকিছু ভেঙ্গে গেলে সেটা আর ফেরত আসেনা । নাজিয়া ছাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
বুয়া বারবার বলছিল শয়তান তার হাত থেকে ফেলে দিয়েছে । সে ভাঙ্গে  নাই । নানু বুয়ার কথা বিশ্বাস করল না । মনীষা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ঘাড় বাঁকা করে তার নিতম্ব দেখে নিল । ট্রাউজারটা শরীরের সাথে মানানসই মনে হল তার ।
আচ্ছা আমি ওদিকটা দেখে আসি । তারপর রেডি হব ।
মনীষা নিজের ঘরে এসে বাবাকে ছোট্ট একটা এসএমএস করল । লিখল-মা আর আমি টাউন হলে নাটক দেখতে যাচ্ছি । তুমি আসবে । সাবধান, মা যেন বুঝতে না পারে আমি ইনফরমার ।
মনীষা যখন বড় হল, মাঝে মাঝে বাপের সাথে দেখা করতে যেত । প্রথম প্রথম নাজিয়া নিষেধ করত । এখন করেনা । মনীষা বড় হয়েছে, অনেককিছু বুঝতে শিখেছে । যতই খারাপ হোক, আশফাকই তার জন্মদাতা । মেয়ের তো বাপের জন্য টান থাকবে । তবে মনীষা মায়ের সামনে তেমন একটা বাবার গল্প করেনা । কথা প্রসঙ্গে দু চার কথা বলতে চাইলেও নাজিয়া থামিয়ে দেয় । বলে, তোর বাবার গল্প আমার সামনে করবি না । সে এখন আমার কেউ নয়, শুধু তো বাবা ।
মায়ের কথায় মনীষা কষ্ট পেলেও তা লুকিয়ে রাখে । কিন্তু তার চেহারায় যে অন্ধকার নেমে আসত তা লুকাতে পারত না । এটা এমন এক অন্ধকার দামী দামী ফেস পাউডার মেখেও তা দূর করা যায় না । তখন সে বালিশে নিজের মুখ লুকিয়ে রাখত । কারণ দীর্ঘ পনের বছর ধরে সে দেখেছে মায়ের নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের যন্ত্রণা । সে দেখেছে তাকে মানুষ করার জন্য মায়ের সংগ্রামী জীবন । তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, অফিস সংসার সবি তো মা একাই সামলে নিয়েছে । তাই মা কষ্ট পাক এমন কাজ মনীষা সচেতন ভাবে এড়িয়ে যায় । কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারেনা, কেন মা এত অভিমান পুষে রাখে মনে ? বাবা তো কতবার এসে ক্ষমা চেয়েছে মায়ের কাছে । মা তখন শ্বেতপাথরের মূর্তির মত নির্বাক হয়ে থাকত । কেন যে মা আজো বাবাকে ক্ষমা করতে পারলনা, মনীষা ভেবে তার কোন কূল কিনারা করতে পারেনা ।

নাজিয়া আশফাককে ছেড়ে আসার পর আশফাক আর চাকরির চেষ্টা  করেনি । নিজের কিছু জমানো টাকা ও এক বন্ধুর সহায়তায় ব্যাবসায় নেমে পড়ে । কয়েক বছরের মধ্যে সে যথেষ্ট উন্নতিও করে । তার হাতের মুঠোয় এল গাড়ি, বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, আরও এল নতুন নতুন  নারী । কিন্তু কোন নারীতে সে নিজেকে স্যাটেল করাতে পারেনি । অনেক দেরিতে হলেও এটিই তার উপলব্ধি যে, নাজিয়ার অভাবটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভাব ।
আশফাকের জুলপির চুলে পাক ধরেছে । আয়নার দিকে তাকিয়ে সে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে । বুঝতে পারে সময় অনেক গড়িয়ে গেছে । জীবন নিয়ে সে জুয়াই খেলেছে । যাকিছু অর্জন করেছে, হারিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি । হয়ত নাজিয়া আবার ফিরে আসবে, হয়ত আসবেনা । দুটোই সম্ভাবনা । কিছুটা আশা, কিছুটা হতাশা এভাবেই বাকি জীবন কাটাতে হবে তাকে । সে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা নাজিয়ার ছবিটি হাতে তুলে নেয় । তার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে-তুমি কী কেবল ছবি ? তার চোখের কোণ ভিজে আসে । ঠিক এসময়ে মনীষার এসএমএস এলার্ম দিল তার সেলফোনে ।

নাজিয়ার তৈরি হওয়া শেষ । সে পরেছে মেরুন কালারের সিল্ক শাড়ি । সাজলে নাজিয়াকে কম বয়সী মেয়ে মনে হয় । মনীষা বলে উঠল, দারুন লাগছে । আমি কেন তোমার মত সুন্দরী হলাম না মা ?
থাক, আর বলতে হবে না । নাজিয়া শাড়ির কুচি ঠিক করে নেয় । মুখে হাল্কা হাসি আড়াল করার চেষ্টা করেও পারল না ।
রিয়েলি, তুমি যত সুন্দর তার চে বেশি সুন্দর তোমার মন । মনীষা মাকে জড়িয়ে ধরে । মায়ের গালে নিজের গাল চেপে রাখে । তখন মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় টেবিলের উপর । সে চিঠিখানা দেখতে পায় ।
কার চিঠি মা ? মণীষার দৃষ্টি এখনও চিঠির দিকে ।
তোর বাবার । নাজিয়া আঁচল পরীক্ষা করে দেখল । হাঁ, ঠিকমত পিঠের দিকে ঝুলে আছে ।
খুলনি কেন ? মনীষার চোখ মায়ের চোখের দিকে সোজা হল ।
প্রয়োজন মনে করিনি । নাজিয়া দৃষ্টি ফিরাল দেয়ালের দিকে । দেয়ালের বিভিন্ন জায়গাতে রঙ ওঠে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে । বুঝতে পারল বাড়ি রঙ করার সময় এসেছে।
একবার দেখতে । তোমার কী কৌতূহলও নেই ? মনীষা মায়ের হাত ধরে আছে।
রেজিস্ট্রি চিঠি । মনে হচ্ছে ডিভোর্স লেটার । নাজিয়ার মন একটু একটু দুর্বল হচ্ছে।  চোখের পাতা কেঁপে উঠল ।
বাবা কী ডিভোর্সের কথা কখনও বলেছিল ? মনীষার চোখে বিস্ময় । মাকে পাঠ করার চেষ্টা করে ।
না । নাজিয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল ।
তুমিও তো বাবাকে ডিভোর্স দিতে পারতে । কেন দাওনি ? মনীষার নিজেকে হাইকোর্টের উকিল উকিল মনে হল এবং নিজের জেরা করার স্টাইল দেখে নিজেই চমকিত হল । নাজিয়া চুপ করে রইল । মনীষা তাগাদা দিল-বল?
তোর কথা ভেবে । নাজিয়া বসে পড়ল বিছানায় । তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতে লাগল ।
তুমি কী আমার কথা সত্যি ভাব ? মনীষার চোখ ছলছল করছে ।
কী বলতে চাস ? তোর কোন অভাবটা অপূর্ণ রেখেছি ? নাজিয়ার কন্ঠ বেশ দৃঢ় । তার পিঠ টানটান হল ।
বাবার । মনীষার বাম চোখ গলে একফোটা জল চিবুকে এসে থেমে গেল । তুমি তো জান না মা বাবা এখনও তোমার  ছবির দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে । মনীষার অপর চোখও ভিজে গেল ।
নাজিয়া বাকরুদ্ধ । বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে । বুঝতে পারল সন্তান লালন-পালনের জন্য মায়ের যেমন প্রয়োজন আছে তেম্নি বাবার আদর-স্নেহেরও দরকার আছে । নাজিয়া এখন কি করবে ? অপমান অবজ্ঞার কথা ভুলে গিয়ে কম্প্রোমাইজ  করবে ? আবার আশফাকের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস শুরু করবে ? যদি তাই করতে হয় তাহলে দীর্ঘ পনের বছর সংগ্রামী জীবনের কিবা অর্থ হয় । এটার আদৌ প্রয়োজন ছিল কী ? আবার নিজের কথা ভাবতে গিয়ে সে কী একবারও মনীষার কথা ভেবেছিল ? নাজিয়ার মনের ভেতর কে যেন বলে উঠল,ছিঃ নাজিয়া তুমি এত স্বার্থপর !
নাজিয়া ধীরে ধীরে চিঠিখানা হাতে তুলে নেয় । তার হৃদয়ে ঝড় আসে । সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে । তার হাত কাঁপছে । চিঠি মনীষার হাতে দিয়ে বলল, তুই খুল ।
মনীষা চিঠির খাম খুলে আবিষ্কার করল একখানি রেজিস্ট্রি দলীল ও ছোট্ট একটি চিরকুট । আশফাক তার সব বিষয়-সম্পত্তি নাজিয়ার নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে, আর চিরকুটের ভাষা ছিল এরকম-
প্রিয় নাজিয়া,
        আজীবন তোমার অপেক্ষায় থাকব। আশফাক ।  
দীর্ঘ পনের বছর পর মনীষা মায়ের চোখে জল দেখল । সে মাকে  জড়িয়ে ধরে। নাজিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
নাজিয়া কোথাও বেরিচ্ছিস নাকি ? মনীষার নানুর চেহারায় বুয়াকে বকাবকির ছাপ এখনও মিলিয়ে যায়নি ।  
হাঁ মা । মনীষাকে নিয়ে নাটক দেখতে যাচ্ছি টাউন হলে । কিছু  বলবে ? নাজিয়া ঘাড় কাত করল ।
আসার পথে আমার জন্য ব্যাথার ওষুধ নিয়ে আসবি । কোমরের ব্যাথাটা দিন দিন বাড়তেছে । মনীষার নানুর বাম হাত কোমরের উপর চলে গিয়ে ত্রিভুজ আকৃতির হয়ে থাকে ।
নানু তুমিও চলনা নাটক দেখবে । মনীষা নানুর গালে চুমু খায় ।
তোমরা যাও । আমার কোমরের ব্যাথা বেড়েছে । নানু হেসে মনীষার গাল টেনে দেয় ।
নাজিয়াদের বাসা থেকে টাউন হল খুব দূরে নয় । কুড়ি মিনিটের জার্নি । টেক্সিতে বসে মনীষা বলল, তোমাকে খুব গম্ভীর লাগছে মা ।
নাজিয়া হাসল । তোর বাবাকে ফোন করে বল, আসতে । সেও এক সময় নাটক করত । নাটকের জন্য পাগল ছিল । নাজিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ।
তোমার জন্য পাগল ছিলনা ? মনীষা মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ।
নাজিয়া হাসল । ঘাড় বাঁকা করে মেয়ের দিকে ফিরে তাকাল । মনীষা মায়ের এরকম হাসি তার জীবনে প্রথম দেখল ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১১৩৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৬/০৮/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Shopnil Shishir(MD.Shariful Hasan) ১৭/০৮/২০১৪
    osombov sundor hoise excelent
  • সুরজিৎ সী ১৭/০৮/২০১৪
  • আহমাদ সাজিদ ১৬/০৮/২০১৪
    ভালো হয়েছে, বানান ঠিক করে নাও,,, যেমন,পরেছে, আশফক..
    গল্প দ্রুত এগোলে ভালো হতো, বর্ণনা বেশি,গতি কম।
    একটি গল্পের জন্য ধন্যবাদ
  • সুন্দর
 
Quantcast