www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মুজিববর্ষঃ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ১৭ মার্চ ২০২০। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তিনি গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। মা সায়েরা খাতুন একজন গৃহিণী। তাঁদের পরিবারের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে নিয়োজিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন; তখনই স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও যুদ্ধাপরাধীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর পর হত্যাকারীরা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করতে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানকে বিভিন্ন সংশোধনীর নামে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। কূটকৌশলে বদলিয়ে দিতে থাকে স্বাধীনতার মূল চিন্তা-চেতনা, বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের কর্মপরিকল্পনাকে। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ-বিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।

মুজিববর্ষ হল বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী পালনের সময়কাল। গত ৬ জুলাই, ২০১৯ তারিখে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ (বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন) থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে উদযাপন করা হবে। তবে, মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলবে ২৬ মার্চ (স্বাধীনতা দিবস) ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পূর্ণ হবে। আমরা পালন করবো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব। অপরদিকে, সরকারের ঘোষিত রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে বলে বিশেষজ্ঞগণের ধারণা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যথাযথভাবে উদযাপনে এ বছরটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন, বাঙালি জাতির ওপর এক বিশাল দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এ ছাড়াও, বিশ্বব্যাপী পালিত হবে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং জাঁকজমকের সাথে পালনের লক্ষ্যে, ২০২০ সালের ১০ই জানুয়ারী (বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস) মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা (ঈড়ঁহঃফড়হি) শুরু হয়। প্রশ্ন হতে পারে, মুজিব শতবর্ষের ক্ষণগণনা কেন ১০ জানুয়ারি ২০২০ থেকে শুরু করা হলো? এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১০ জানুয়ারি বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই তাৎপর্যপুর্ণ দিন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিনও বটে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের মানুষের উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পায়তারা হয়েছিলো। কিন্তু, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দক্ষ ও বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর জোরালো কূটনৈতিক প্রচারণায় এবং বিশ্বজনমতের চাপে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি। অন্যদিকে, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেণ্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোও চাননি বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে হত্যা করা হোক।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়ে স্বাধীন হলেও, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিরে না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। আমাদের স্বাধীনতার পূর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে। যখন বিজয়ী-বীরের বেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় স্বাধীন স্বদেশভূমি বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে আসার পথে তিনি যুক্তরাজ্যের লণ্ডন ও ভারতের নয়াদিল্লী হয়ে আসেন। উভয় দেশের জনগণ ও সরকার প্রধানেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নজিরবিহীন সন্মান প্রদর্শন করেন। ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের মানুষের মনে কী যে আনন্দ বয়ে গেছে, তা ভাষায় ব্যাক্ত করার মতো নয়। উৎফুল্ল মানুষেরা বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কষ্ট-বেদনার কথা সব ভুলে যায়, তাঁদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এক নজর দেখার পর। এজন্যই ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিকে স্মরণ করে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের প্রতীক্ষার ক্ষণগণনা শুরু করা হয়। তাই, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান বাহিনীর প্যারেড গ্রাউণ্ড এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা উদ্ভোধন করেন ১০ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিলো।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন। তারই দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে। এজন্য, আমরা বছরব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবো। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেক সময়ই রাজনৈতিক বন্দী হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্নে তিনি কখনোই আপোষ করেননি। তাই, ঘোষিত তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীটি আমাদের কাছে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে বছরটি পালনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

অপরদিকে, ২০১৯ সালের ১২-২৭ নভেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ সভার অধিবেশনে ২৫ নভেম্বরে ইউনেস্কোর সকল সদস্যের উপস্থিতিতে, বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে মুজিব শতবর্ষ পালনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অর্থাৎ, মুজিব জন্ম শতবর্ষ পালন শুধুমাত্র বাংলাদেশেই উদযাপন করা হবে না; বৈশ্বিকভাবেও মুজিব জন্ম শতবর্ষ উদযাপিত হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী, ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচির সূচনা হবে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে, আগামী ১৭ মার্চ ২০২০ তারিখে। ঐদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মুজিব জন্ম শতবার্ষিকীর উদ্বোধন করা হবে। মুজিববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ ও ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ‘জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’র অধীনে আটটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এ সকল উপকমিটির মাধ্যমে সারা বছর ধরে দেশে ও বিদেশে মুজিববর্ষ উদ্যাপনের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই কর্ম-পরিকল্পনায় জন্ম শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ, বঙ্গবন্ধুর নিজের রচনা, ভাষণ, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বইমেলা ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করার কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারের পাশাপাশি প্রতি বছরের মতোই তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস (১৫ আগস্ট) এবং জেল হত্যা দিবসও পালিত হবে। এছাড়াও, বাংলাদেশ সরকার জন্ম শতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। মুজিব জন্ম শতবার্ষিকী আমাদের জাতীয় জীবনের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করবে। এর মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্ম ও জীবন সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন অমিত সাহসী ও অকুতোভয় বাঙালির মূর্তপ্রতীক। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এ বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী বীর। তার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। অতীতে কেহই এ বাঙালিকে এভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি। জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তাঁর মতো কেউই জাগিয়ে তুলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুই সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং যা সময়ের প্রয়োজনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয় । পাকিস্তান সরকার যখন শান্তিপুর্ণভাবে সমাধানের সব পথ যড়যন্ত্রের মাধ্যমে রুদ্ধ করে দেয় এবং গণহত্যা শুরু করে; তখনই তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবি ন্যায়সংগত ও আইনগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমেরিকার বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং ও উপনিবেশবাদের বিরোধী দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার পর, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি অসহযোগ আন্দোলনকে সার্থকভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। তিনি নীরিহ ও নিরস্ত্র বাঙালিকে সাহসী ও সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ন হওয়ার মতো দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করে তুলেছিলেন।

১৯৭১সালের ৭ মার্চের প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালিকে স্বাধীনতা লাভের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের তাৎপর্য ছিলো সুদূরপ্রসারী। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ভাষণ ০৭ মার্চের ভাষণ। ওই অসাধারণ বক্তৃতাটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিকট ছিলো প্রেরণার উৎস। ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ন হওয়ার মতো মনোবলে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। এ ভাষণটিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে ‘মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড’-এর রেজিস্ট্রারে ০৭ মার্চের ভাষণটিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বৈশ্বিক ইতিহাসে এতদিন পর্যন্ত সেরা বক্তৃতা ছিল, আব্রাহাম লিংকনের তিন মিনিটের লিখিত ‘গেটিসবার্গ বক্তৃতা’। মার্টিন লুথার কিং -এর ১৭ মিনিটের লিখিত বক্তৃতা। আর এখন শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হলো বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ১৮ (ভাষণের শুরু ০২-৪৫ মিনিট এবং শেষ ০৩-০৩ মিনিট) মিনিটের অলিখিত ভাষণটি। এটি ছিলো স্বতঃপ্রণোদিত ও মুক্তিকামী মানুষের প্রতি দিক নির্দেশনামুলক একটি ভাষণ। আজ সে-ই বজ্রকণ্ঠের ভাষণই বিশ্বে শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদা পেয়েছে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠণ করেন চারটি মৌলিক নীতি- (১) জাতীয়তাবাদ, (২) সমাজতন্ত্র (৩) গণতন্ত্র ও (৪) ধর্ম নিরপেক্ষতা; উপর ভিত্তি করে। বন্ধুর জাতীয়তাবাদ ছিল পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদের ধারণা থেকে পৃথক। মার্কিন তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক, ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনার অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি শেখ মুজিবের জাতীয়তাবাদকে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ হিসেবে অভিহিত করেছে। কেউ কেউ এটিকে ‘মুজিববাদ’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদের বক্তব্য ছিল, ‘‘বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে-পরে সুখ-শান্তিতে থাকবে। বাংলায় কোন শোষণ বঞ্চনা থাকবে না’’।

বাংলাদেশ কারো দয়া বা দানে পাওয়া নয়। মরণপণ লড়াই করেই আমরা আমাদের স্বদেশভূমি অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, জনগণ ও বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন হয়ে গিয়েছিল আমাদের কাছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণাশক্তি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না বটে; তবুও, তাঁর নামেই যুদ্ধ পরচালিত হয়েছিলো। তখন প্রতিমুহূর্তে আমরা তাঁর অস্তিত্ব ও উপস্থিতি অনুভব করেছি। ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধ’ু ছিল আমাদের রণ-স্লোগান। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ- ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’’, এ বাণী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অধিক অনুপ্রাণিত করতো। তাঁদেরকে শত্রæর উপর চরম আঘাত হানার জন্য অমিত সাহসী ও তেজদীপ্ত করে তুলতো।

১৯৭০ এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নির্বাচনী প্রচারণায় কুমিল্লার দাউদকান্দীর এক জনসভায় গিয়েছিলেন; তখন আমি খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম। তিনি শিশুদেরকে খুবই ভালোবাসতেন এবং তাদেরকে আদর করতেন। আম্ওি তাঁর দক্ষিণ হস্তের স্নেহ-স্পর্শ পেয়েছিলাম। এখনেও চোখ বন্ধ করে কল্পনায় অতীতে বিচরণ করলে আমার চিবুকে তাঁর আদরের করস্পর্শ অনুভব করি। আর শেষবারের মতো চাক্ষুষ দেখেছিলাম ১৯৭১ এর ৭ মার্চের অমর কবিতার মতো ভাষণের সময়, রেসকোর্স ময়দানে।

মুজিব জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, বর্তমান প্রজন্মের শিশু, কিশোর, যুবকদের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সঠিক, পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে তুলে ধরা। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, বিশ্বাস, দর্শন ও ত্যাগের কথা সকলকে জানানো এবং দেশ-বিদেশে প্রচার করা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী শুধুমাত্র একটি জন্মদিনই নয়, প্রত্যেক বাঙালির কাছে একটি অনন্য দিন। মহান নেতার প্রতি সম্মান জানানোর বিরল সুযোগের দিন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নেতা। সকল মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাবে। শিক্ষা নেবে মুজিবের আদর্শ থেকে, তাঁর দর্শন থেকে, তাঁর ত্যাগী মনোভাব থেকে। একথা অনস্বীকার্য যে, যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততোদিন সশ্রদ্ধ চিত্তে বাঙালির চেতনায় উচ্চারিত হবে এই মহান স্থপতির নাম। তাই, শেখ মুজিব বাঙালিদের কাছে চিরঞ্জীব। মুজিববর্ষে বাঙালি জাতি অকৃপণ চিত্তে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মূল্যায়ন করবে ও তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানের শপথ নেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আরো সঠিকভাবে জানতে হলে, তাঁর লেখা বই- বিশেষ করে, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি প্রত্যেকটি বাঙালি পাঠ করা উচিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ। তাই, চিরঞ্জীব মুজিবের চেতনাকে বুঝতে হবে। তাঁর আদর্শকে ধারণ করতে হবে। সেই আদর্শকে সম্মুন্নত রাখার জন্য আমাদেরকে সততার সাথে কাজ করতে হবে। মুজিবাদর্শকে উর্ধে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে, মুজিব জন্ম শতবর্ষ পালন করা একটি আনুষ্ঠানিকতার বাহুল্য হয়ে দাঁড়াবে মাত্র।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচক আজ ইতিবাচক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই, আমরা আশা করতে পারি, ঘোষিত রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে। বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব। এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের আরও দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। গড়তে হবে বৈষম্যহীন, শোষনহীন ও ক্ষুধাামুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। এখন অনেক দেশই তাদের উন্নয়নের জন্য, বিশেষ করে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি বিশেষ পাওনা। আর এর পিছনে যার অবদান; তিনি হলেন, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়াই হোক মুজিববর্ষের আমাদের অঙ্গীকার।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

০৩/০৩/২০২০
মিরপুর, ঢাকা।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৪২৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/০৫/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • জেনে উপকৃত হলাম।
    তথ্যবহুল লেখা
  • তাৎপর্যপূর্ণ।
  • লেখা ভালো হয়েছে।
    ব্লগে স্বাগতম।
  • কুমারেশ সরদার ১৫/০৫/২০২০
    তথ্যপূর্ণ
 
Quantcast