www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা

১৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - হাবুলের চায়ের দোকান, ঝন্দিগ্রাম

হাবুলের চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিল কানাইরা। সময় প্রায় রাত আটটা। নিতান্তই সাধারণ আড্ডা। মূল বিষয় ছিল আগের রাতের ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা। গত আধঘণ্টা শুধু শুনেছে শ্যাম। কিছু বলে নি। নিজের বক্তব্যটা একটু গুছিয়ে নিয়ে সবে যুবরাজ সিন-এর বাপ বাপান্ত আরম্ভ করেছে এমন সময় দেবুদার আগমন।
"হাবুল, একটা চা দে।" বেশ গম্ভীর গলায় বলল দেবুদা উরফে রুলিং পার্টির নেতা দেবাসিস হালদার।
"দুধ ছাড়া তো?" হেসে জিজ্ঞেস করল হাবুল।
"চা-টা দুধ দিয়ে কবে খাই?" একটু রেগেই বলল দেবুদা।
দেবুদার মাথাটা গরম আছে বুঝতে পেরে কানাই একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে দেবুদা, একটু গরম আছো?"
ওমনি বিস্ফোরণ।
"শালা, এত দিন পার্টি করল, যা দরকার দিলাম। আর আজ বলে, 'জমি দিতে পারব না। খাব কি?' হারামজাদা।" এক নিঃশ্বাসে বলে গেল দেবুদা।
"কার কথা বলছ?" প্রশ্ন করল মানিক, "নন্দুর?"
"আবার কার? বলে কিনা 'মরতে হয় মরব, জমি দেব না'। শালা..." রাগে গজগজ করতে লাগল দেবাসিস হালদার। "দেখাচ্ছি মজা...আমার সাথে বাওয়ালি।"
"দেবুদা, ওর বোন কিন্তু এই ঝন্দিগ্রামের হাই-স্কুলেই পড়ে। ক্লাস টেন," মুচকি হেসে বলল শ্যাম।
*     *     *


১৯ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - নন্দুদের বাড়ি

ব্যস্ত ভাবে বারান্দায় পায়চারি করছে নন্দু। সন্ধ্যে সাতটা বাজে, ওর বোন ময়না প্রমীলা এখনও স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে নি।
'মাসির বাড়ি গেল নাকি?' ভাবে নন্দু, 'কিন্তু না বলে কোথায় যাওয়ার মেয়ে তো নয় ও। তবে?'
মনটা অস্থির করছে নন্দুর। আর এই ঝন্দিগ্রামের আজকাল যা অবস্থা, তাতে ভয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। যবে থেকে এই লাটা কোম্পানির গাড়ির কারখানা বসার তোড়জোড় শুরু হয়েছে, তবে থেকেই এই হাল।
"কি রে ফিরল?" ভীতর থেকে জিজ্ঞেস করে নন্দুর মা।
"না। দাড়াও, আমি একটু দেখে আসি।"
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল নন্দু। মাসির বাড়ি একবার গিয়ে দেখবে। না পেলে শেষ রক্ষা পার্টি অফিস। এতদিন পার্টির জন্য সব কিছু করেছে নন্দু। আজ একটু সাহায্য তো পাওয়াই যাবে।
মাসির বাড়িতে গিয়েও প্রমীলার দেখা পেল না ও। তাই রওনা দিল পার্টি অফিস উদ্দেশ্যে।
'কোথায় যে গেল', এই চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। সেই কবে বাবা মারা গেছে, তার পর থেকে প্রমীলার ওই সব। যত আবদার ওর কাছেই। এই তো আগামী মাসে প্রমীলার জন্মদিন আসছে। বলেছিল, "দাদা, এবার কিন্তু ওই জিনস কিনে দিতে হবে।"
নন্দু রেগে বলেছিল, "না,না। জিন্স টিন্স হবে না। জিন্স পরছে।"
মুখে বললেও মনে মনে নন্দু ঠিক করেছিল একটা জিন্সই কিনে দেবে ওকে। কিন্তু...।

*     *     *


১৯ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - ঝন্দিগ্রাম পার্টি অফিস

বড় চেয়ারটায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল দেবুদা। কানাইরা মাটিতে বসে তাস খেলছিল, ব্রিজ। হন্তদন্ত হয়ে নন্দু প্রবেশ করল।
"দেবুদা?"
"কি রে? এত ঘামছিস কেন? কি হয়েছে?" প্রশ্ন করে দেবুদা।
"প্রমীলা বাড়ি ফেরেনি এখনও।" কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে নন্দু।
"এখন তো প্রায় সাড়ে সাতটা। স্কুল তো অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে।"
"একটু দেখ না কি করা যায়," কেঁদেই ফেলল ও।
"আরে কাঁদছিস কেন? কিচ্ছু হবে না। আমি তো আছি না কি?" এই বলে উঠে পড়ে দেবুদা। সঙ্গে কানাইরাও উঠে পড়ল।
"আগে থানায় চ, রিপোর্ট লেখাই। তারপর দেখছি।"
এই বলে নন্দুকে নিয়ে থানায় উদ্দেশ্যে রওনা হল ওরা। থানায় কাজ সেরে চারিদিকে অনেক খুজল ওরা। কিন্তু প্রমীলাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

*     *     *


২০ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - ঝন্দিগ্রাম থানা

দরজার পাশে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে নন্দু। বাইরে প্রচুর লোক নিয়ে স্লোগান তুলছে দেবুদা, "প্রমীলার ধর্ষণকারীর শাস্তি চাই। শাস্তি চাই।"
মাটিতে শোয়ানো আছে প্রমীলার  অর্ধনগ্ন দেহটা। কি পৈশাচিক দৃশ্য। নিজের জামাটা দিয়ে প্রমীলার শরীরটা ধেকে দেয় নন্দু। তার চোখ দিয়ে জল বেরচ্ছে না। চোয়াল শক্ত। মন বলছে, "বদলা চাই, বদলা চাই।"
"এখন তুই বাড়ি যা। ডাক্তার আসুক। তারপর কাল সকালে এসে বডি নিয়ে যাস। এখন যা। ভিড় বাড়াস না," গম্ভীর ভাবে বললেন দারোগাবাবু।
নন্দু ঠায় দাড়িয়ে আছে। এই 'বডি' -টা তো ওর বোন, ওর প্রমীলা। ওর মন পড়ে আছে প্রমীলার স্মৃতিতে। মন শুধু বলছে, 'বদলা চাই'।

*     *     *


২২ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - ঝন্দিগ্রাম হাই-স্কুলের পাশের গলি

পার্টির মিটিং শেড়ে বাড়ি ফিরছে মলয়। রাত সাড়ে দশটা। একা বাড়ি ফিরতে যে একটুও ভয় হয় না তা নয়। ফাঁকা শুনশান রাস্তা। না, না, ভূত প্রেতের ভয় ওর নেই। ভয় মানুষের। একে বিরোধী পার্টি করে, তার উপর আবার কলকাতার কিছু বড় নেতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ। এই সময় তা ভয়ের ব্যাপার তো বটেই। মলয় কিন্তু এই রক্তের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। ওর ছেলেদেরও তাই বলে। কিন্তু পার্টিতে ওই তো আর শেষ কথা না।
হাতের প্ল্যাস্টিকটা ক্যারিয়ারে আলতো করে রাখে ও। এক গাছা চুড়ি কিনেছে বউয়ের জন্য। ভারি খুশি হবে সে। এত মিটিং মিছিলের মাঝে এটাই আনন্দ।
এই সব ভাবতে ভাবতে গলির মুখটায় পৌছাল মলয়। হঠাৎ কোথা থেকে একজন সামনে এসে দাঁড়াল ওর। কিছু বলার আগেই চলল পরপর তিনটে গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও। ভেঙে ছড়িয়ে গেল নতুন কেনা চুড়িগুলো।

*     *     *


২৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - ঝন্দিগ্রাম থানার লকআপ

সেলের একটা কোনে চুপ করে বসে আছে নন্দু। আজ তার ভীষণ আরাম। ভীষণ প্রসন্ন মনটা। যে ওর বোনকে বেইজ্জত করেছে, কাল তাকে নিজে হাতে শাস্তি দিয়েছে ও। সত্যিই, জমিটার বদলে কি দারুণ উপহারটাই না দিল দেবুদা। ওর কাছে এখন ভগবান দেবুদা।
"সত্যি দেবুদা, তুমি সত্যিই আমাদের নেতা, আমাদের মাই-বাপ," মনে মনে ভাবে নন্দু।

*     *     *


২২ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - ঝন্দিগ্রাম পার্টি অফিস

"কি দেবুদা সব ঠিক তো?" ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করে কানাই।
"তা ঠিক,তবে ল্যাংড়াচ্ছিস কেন? পায়ের কাটাটা এখনও সারে নি?"
"আর বল কেন? শালি কি কামড়েছিল মাইরি! এখনও রক্ত জমে আছে।"
"আঃ, কানাই। ঠিক আছে। ওসব কথা অত জোরে বলে না। দেওয়ালের কান আছে," একটু ধমকের সুরে বলল দেবাসিস হালদার।
অট্টহাসিতে ভরে গেল ঝন্দিগ্রাম পার্টি অফিস।

*     *     *


২৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
স্থান - সুরমা কোচিং সেন্টার, বেহালা

"ধুস, কালকে পরীক্ষাটা বাতিল," বলে ওঠে সৌমি।
"কেন রে? কাল আবার কি হল?" প্রশ্ন করে রিমা।
"কি জানি, ঝন্দিগ্রামে কে রেপ হয়েছে না মার্ডার হয়েছে তাই। আর পারা যায় না। এই নিয়ে দুবার পরীক্ষা বতিল। রুলিং পার্টির বন্ধ। কে রিস্ক নেবে।"
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৯৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৯/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • বেশ লিখেছেন। এভাবেই আসল ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়।
    • অভিষেক মিত্র ০৬/১২/২০১৫
      ধন্যবাদ দাদা।
      একদম, আমরা যা কাগজে পড়ি তার কতটা ঠিক কে জানে?
      • হ্যা
  • কষ্টের ফেরিওলা ০৬/১০/২০১৫
    বেশ হয়েছে
  • তপন দাস ২৯/০৯/২০১৫
    পরিবেশ পরিস্থিতি থাকলে এটাই নাট্যরূপ দিতাম আমার নাটকে।
    • অভিষেক মিত্র ৩০/০৯/২০১৫
      চেষ্টা করুন না। আমার লেখা গল্পে নাটক হলে আমার খুব ভালো লাগবে।
    • তাপসী মালিকের ঘটনা নিয়ে ছবিও হয়ে গিয়েছে। তবে দৃষ্টি কোনটা আলাদা।
    • অভিষেক মিত্র ২৯/০৯/২০১৫
      ধন্যবাদ তপনদা।
      • তপন দাস ২৯/০৯/২০১৫
        আমার গল্পটাও পড়ার অনুরোধ রইলো।
  • নন্দীগ্রাম , সিঙ্গুর মিশে একাকার। সত্যিটা কি জানিনা। গল্পকার রিপোর্টার নন , তাই সত্যি মিথ্যে নিয়ে কথা বলতে চাইনা। গল্পটা ভালো লেখা হয়েছে , অনায়াসে একটা ১০ মিনিটের short film হতে পারে।
  • নীহার রঞ্জন মল্লিক ২৬/০৯/২০১৫
    Brilliant.
  • খুব সুন্দর লেখা, অভিষেক। একদম সত্যটা তুলে ধরেছ।
  • অর্ণব ০৯/০৯/২০১৫
    দারুণ।
  • সুন্দর উপস্থাপনা আর দিনলিপি। সমাপ্তি আরো সুন্দর ! স্বার্থপর !! শুধু সময়ের হেরফের !!! কত কঠিন, বাস্তব স্বার্থপর সমাজ আমাদের !!!!
  • এল. এস. ডি ০৫/০৯/২০১৫
    টানটান গল্প। ভালো লাগলো।
  • নীলিমা দাসগুপ্ত ০৩/০৯/২০১৫
    অপূর্ব লেখা। খুব ভালো লাগলো।
  • শ্রীতরুণ গিরি ০৩/০৯/২০১৫
    খুব ভালো লেখা। ভালো লাগল।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ০৩/০৯/২০১৫
    দারুন সুন্দর
 
Quantcast