www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

এখন অনেক রাত

তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। যাকে বলে কুকুর বেড়াল বৃষ্টি ( মুষলধারে বৃষ্টি ), আষাঢ় মাস। গতকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। রাতুল গায়ের চাদর সরিয়ে জানালার কাঁচে তাকায়। তুমুল বর্ষণে ঘোলা কাঁচগুলো জানান দেয়, অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে নেয়, সকাল সাড়ে ১০ টা। সাথে ১৭ টা মিসড্ কল। দেখে এক প্রকার বিরক্তই হয়। নিজের প্রতি না। নিপার প্রতি। তার মতে কেউ ফোন রিসিভ না করলে বড়জোর ২য় বার ট্রাই করা উচিত। রিসিভ করার পরিবেশ কিংবা ইচ্ছে থাকলে মানুষ ২য় বারেই রিসিভ করে। এভাবে পর পর ১৭ বার কল দেয়াটা নিছক অভদ্রতা।  
- “যাক, আপনি বেঁচে আছেন তাহলে?”- ফোনের ও প্রান্ত থেকে নিপার কণ্ঠ।
- “মৃত্যু কামনা করেছিলে নাকি? অবশ্য তোমার সকাল শুরু হয় আমায় বকতে বকতে, রাতে ঘুমোতেও যাও আমায় বকতে বকতে। যাক ওসব, তুমি এখন কোথায়?”
- “তোমার মাথায়। আজ সকাল ৮ টায় ভার্সিটির সামনে থাকার কথা ছিল না? আমি মেয়ে হয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে বের হয়ে আসতে পারি, আর আপনি ছেলে হয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান! অলসের অলস কোথাকার!”
- “তুমি আর ২০ টা মিনিট ওয়েট কর। আমি এখনই আসছি”।
- আপনাকে আর আসতে হবেনা। আপনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান, সরিষার তেল এনে দিব?”
- “তুমি কিনে রাখো, আমি আসতেছি”।
- “কুত্তা, ইতর, বদমাশ............” ......ফোন কেটে দেয় নিপা।
তাড়াহুড়ো করে টি সার্ট টা পাল্টে বেরিয়ে পরে রাতুল। আজ ও কপালে রাহুর গ্রাস। দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে সাইকেলের লক খুলে মনে পড়ে, যা বৃষ্টি, মাথার ক্যাপটা নিয়ে নিলে ভালো হত। কিন্তু সেটা সম্ভব না। মা দেখলেই আর বের হওয়া যাবেনা। এই বৃষ্টির মাঝেই বাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাতুল। ভিজে জ্যাবজ্যাবে অবস্থায় শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছতে বেজে গেল ১১ টা।
- “এই বটবটি টা নিয়ে আসছো কেন? এটা এখন কোথায় রাখবা?”
- “এটাকে বটবটি বলবা না। হিরো ব্র্যান্ডের বাই সাইকেল। ৭৫০০/= টাকায় খরিদ করা। তোমার বাবার আদি কালের স্কুটি থেকে অনেক ভালো। এটার কল্যাণেই এতো তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছি”।  
- “এটা তাড়াতাড়ি! তা আপনার সকাল কখন হয় শুনি? এসেই আমার বাবার স্কুটি নিয়ে বাজে কথা বলা শুরু করছো! এমন একটা স্কুটি কিনে তারপর কথা বলতে আইসো। ফাজিল কোথাকার!”
- “ তুমি আমার বাই সাইকেল কে বটবটি বল নাই?”
- “হ্যাঁ, একশ বার বলবো। হাজার বার বলবো”।
নিপার চোখের দিকে চোখ পড়ে যায় রাতুলের। ঝগড়া করার আর সাহস পায়না রাতুল। এমনিতেই মায়ার চাঁদরে ঢাকা দুটো চোখ, তার উপর কাজল দিয়ে এসেছে। এই মেয়েটা এতো মায়াবী কেন?, নিজে নিজে অসংখ্যবার প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পায়নি রাতুল। চুলগুলো খুব বড় না। কিন্তু এতো সুন্দর করে সিতি করে আঁচড়ায়, যেন কোন নকশা। গায়ের রং ফর্সা। কিন্তু তা বাড়াবাড়ি রকমের ফর্সা না। নিটোল নাক টা যেন সুভ্রতার আবেশ ছড়ায়। উপরের ঠোটের বা’পাশে, সামান্য উপরে তিল টা নাহলেও চলতো। বোনাস হিসেবে বিধাতা এটাও দিতে কার্পণ্য করেনি। সাজসজ্জা বলতে চুল আঁচড়ানো, স্নিগ্ধ আবেশ ছড়ানো পারফিউম, চোখে কাজল। কাজল বাঙ্গালী নারীর এক অন্যতম হাতিয়ার, যা দিয়ে পুরুষদের খুব সহজে মায়ার বাঁধনে আটকে ফেলতে পারে। কিন্তু রাতুল প্রায়ই বলে, “ এত সেজেগুজে আসলে যে?” আজ ও বোকার মতো একই প্রশ্ন করলো।
- “আমি মোটেও সাজুগুজু করি নাই। তুমি কি ভাবছো, এসব বলে আমার মন ভুলিয়ে ফেলবা? ঝগড়া থেকে রেহাই পাবা? মোটেই না। নিপা সস্তা কথায় গলে যাওয়ার মতো মেয়ে না”।
- “সরি, বৃষ্টি তো, এতো বেলা হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। তাছাড়া একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখতেছিলাম। তাই উঠতে দেরি হয়ে গেল। প্লিজ...... সরি”।
- “সরিতে সব কিছুর সমাধান হয়না। এই সাত সকালে বৃষ্টি বাদল মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। রাস্তায় মানুষজন অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল। আমার ভয় লাগেনা?”.........
প্রচণ্ড অভিমানে চোখে জল চলে আসে নিপার। অপরাধবোধে মাথা নিচু করে ফেলে রাতুল। এই মেয়েটাকে কষ্ট ছাড়া আর কি কিছু দিতে পেরেছে? নিজের প্রতি খুব ঘৃণা জন্মে। দুজন চুপচাপ। ভার্সিটিতে আজ তেমন ছাত্র-ছাত্রী নেই। নিছক প্রেমিক জুটি ছাড়া আর কারো সাধ জাগেনা এই উত্তম ঘুমের পরিবেশ ফেলে কলেজে আসার। কয়েকজন অবশ্য করিডোর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। কিন্তু এই দুজনের প্রতি তদের কোন দৃষ্টিপাত নেই। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকার পর নিপা মুখ খোলে। হাতের রুমাল টা বাড়িয়ে দিয়ে মাথা টা মুছে নিতে বলে। বাধ্য ছেলের মত তাই করে রাতুল। সাইকেল টা পাশে রেখে বোটানি ভবনের সিঁড়িতে বসে দুজন। ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স টা বের করে রাতুলের দিকে বাড়িয়ে দেয় নিপা। বক্সটা হাতে নিয়ে উষ্ণতা আর ঘ্রানে বুঝে ফেলে বক্সে কি আছে।
- “গতকাল সন্ধ্যায় ভুনা খিচুড়ি রেঁধেছিলাম। খেয়ে নাও”।
- “দাঁত ব্রাশ করার সুযোগ পাইনি.........”
- “বাহ! খুব ভালো(!) সর্বশেষ কবে ব্রাশ করছো? আমার মনে হয় তুমি রেগুলার দাঁত ব্রাশ কর না”।
- “অপমান কর ভালো কথা, কিন্তু আমি দাঁত ব্রাশ করিনা, এটা সত্য না”।
- “আচ্ছা, এটা তাহলে বাসায় গিয়ে খেও। এই ভেজা কাপড়ে তো তোমার অসুখ করবে। বাসায় চলে যাও”।
- “সমস্যা নাই। ভেজার অভ্যাস আছে। চলো বৃষ্টিতে ভিজি”।
- “মাথা ঠিক  আছে?!...... মানুষ দেখলে কি বলবে ? আর আমি বাসায় ফিরে কি জবাব দিব?”
- “তাহলে চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই। রিকশা তো পাবেনা। সাইকেলের পিছনে বসো। সামনের মোড়ে রিকশা পেলে উঠে যেও”।
- “ভিজে যাব তো!...... মানুষ জন সাইকেলের পিছনে কোন মেয়েকে চড়তে দেখলেন কি ভাববে?...... মোটর সাইকেল হলে একটা কথা ছিল......”।
- “ওটা কেনার তো সামর্থ্য নেই। যাক, উঠতে হবেনা। তুমি বসো, আমি রিকশা খুঁজে আনি”।
- “রাগ করছো, আচ্ছা চলো, সাইকেলে উঠবো”।
- “না, উঠতে হবেনা। যেদিন মোটর সাইকেল কিনবো, সেদিনই উইঠো”।
- “এমনি আজ দাড়িয়ে থেকে মেজাজ বিগড়ে আছে। তুমি আরও রাগাইও না। চলো......”।
রাতুল আর রাগ দেখায় না। বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বেশ কম। নিপাকে সাইকেলে নিয়ে চড়ার উত্তম পরিবেশ। বাসা থেকে বেরিয়ে এটাই ভাবতে ভাবতে এসেছে রাতুল। এর আগেও বেশ কবার রাতুলের সাইকেলে চড়েছে নিপা। সেটা নিতান্তই ছোট পরিসরে, “ ভাবুক সমাজ” ক্লাবের সামনের ছোট মাঠে। কিন্তু রাজধানীর ব্যস্ত পথে এটাই আজ প্রথম সাইকেলে চড়া। ভয়ের পাশাপাশি কিছুটা রোমাঞ্চও কাজ করে নিপার মাঝে। পা দুটো একপাশে রেখে এক হাতে রাতুলের কোমর জড়িয়ে ধরে উঠে বসে নিপা। সাইকেল চলতে শুরু করেছে শব্দহীন ছিটছিটে বৃষ্টির রাস্তা মাড়িয়ে। সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায়। এই পথ টা খুব ভালো লাগে নিপার। বিজয় স্মরনীর নতুন রাস্তাটাও তার খুব প্রিয় । সেনাবাহিনীরা এই রাস্তা টা নতুন করেছে। র‌্যাংগস ভবনের সামনের সিগন্যালের জ্যাম কমাতে। বিজয় স্মরনী থেকে আগাঁরগাও পর্যন্ত। নিপা প্রায় ভাবে, ঢাকার সব রাস্তা গুলো যদি এটার মতো হত! সরকার সব রাস্তা সেনাবাহিনী দিয়ে করায় না কেন?! নিপা প্রধানমন্ত্রী হলে তাই করতো। রাস্তা থেকে পাশের দেয়াল তোলা পুরাতন এয়ারপোর্ট টা দেখা যায়। এটার ভেতর একটা সাঁনবাধানো পুকুর আছে। পুকুরের চারপাশে বসার জন্য চেয়ার বসানো আছে। আছে ছাতার মত ছাউনি। পুকুরের পাড়ে পরিকল্পিত গাছের সারি। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। নিপার স্বপ্ন, একদিন এই পুকুরের পাড়ে রাতুলের সাথে বসে গল্প করবে। যদিও সে জানে, এখানে সাধারন মানুষকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়না। সাইকেল এখন তার প্রিয় বিজয় স্মরনীর রাস্তায় চলে এসেছে।  আজ এই পথে রাতুলের পাশে বসে সাইকেলে চড়ে যেতে যেতে নিপা যেন কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়।  ঝাপটার মতো বৃষ্টির ফোটা গুলো এলো মেলো করে দেয় নিপার চুল গুলো। নিপা ভাবে, রাতুলের সাথে সাইকেলে না উঠলে এত সুন্দর মুহূর্তটা তার মিস হয়ে যেত। সকালের সব রাগ ভুলে যায় নিপা। খুশিতে আত্মহারা হয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে।
- “বসতে সমস্যা হচ্ছে ?”_____ রাতুলের প্রশ্ন।
- “না”।
- “সমস্যা হলে বইলো। বাতাস খুব বেশি। তার উপর বৃষ্টির ঝাপটা। রাস্তাটা সুন্দর না ?...... এই রাস্তায় এলে মনে হয় আমি ঢাকায় না, অন্য কোথাও আছি। কোন জ্যাম থাকেনা। মনে হয় মোস্ট ওয়ান্টেড গেমের রাস্তা। নিড ফর স্পিড, মোস্ট ওয়ান্টেড গেম টা খেলছো না?”
- “হুম...... আমার ইচ্ছে করছে হেটে যেতে। চলো হাটি”।
নেমে দু’জন হাটতে থাকে। রাতুল এক হাতে সাইকেল আরেক হাতে নিপার হাত ধরে হাটতে থাকে। মাঝে মাঝে নিপার বৃষ্টি ভেজা মুখ খানি দেখার লোভ সামলাতে পারেনা। মাঝে মাঝে মেঘের মৃদু গর্জনে নিপা কেঁপে কেঁপে উঠে। সেও এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ তার কাছে। তারা হাটতে থাক। এই ফাঁকে “ভাবুক সমাজ” ক্লাবের পরিচিতি তুলে ধরি।


ক্লাব “ভাবুক সমাজ”  
ঠিকানা ১৩/বি, তালতলা, আগাঁরগাও। এই ক্লাবের উদ্যোক্তা ৪ জন। রাতুল, জাহিন, হিমেল, কৌশিক। একই পাড়ায় আছে জন্ম থেকে।  স্কুল জীবন থেকে ওদের বন্ধুত্ব। ৪ জনেরই বাসা পাশাপাশি। রাতুল আর কৌশিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। জাহিন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর হিমেল ঢাকা কলেজে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স । ক্লাসের সময়টা বাদ দিলে বাকি দিন ওদের একসাথেই কাটে। ক্লাবের জায়গাটা এক সময় ছিল ইয়াকুব মিয়ার ডিশের সংযোগের দোকান। জায়গাটা ইয়াকুব মিয়ার নিজস্ব। এলাকায় এক নামে চিনতো ইয়াকুব কে। সন্ধ্যার পর এই দোকানে মদ আর জুয়ার আড্ডা বসতো। সামনে ছোট খাটো একটা খেলার মাঠ। ছোট বাচ্চারা ফুটবল খেলে। একসময় ইয়াকুব মিয়া বদলে যায়। ডিশের ব্যবসায় বাদ দিয়ে পুরোদস্তুর হুজুর বনে যায়। দাড়ি রেখেছে, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।  পুরান ঢাকায় বিরানীর দোকান করেছে। পরিবার নিয়ে এখন পুরান ঢাকায়ই থাকে। যাবার আগে দোকান টা রাতুল, হিমেলদের দিয়ে যায়। ক্লাবের নামটি কৌশিকের দেয়া। এই ক্লাবে বসে তারা ৪ জন নানা পরিকল্পনা করে। কোথায় ট্যুর দেয়া যায়, কোন সিনেমা হলে মুভি দেখতে যাওয়া হবে, পাড়ার কোন কোন বাসায় সুন্দর মেয়ে আছে...... ইত্যাদি। ক্লাব দেখা শোনায় (ঝাড়া মুছা আর চা সিগারেট আনা) নিযুক্ত আছে বিল্লাল হোসেন। বয়স ২১, এতিম, মাদ্রাসায় থাকতো। খাবার নিয়ে মারামারি করতে গিয়ে এক ছেলের মাথা ফাটিয়ে পালিয়ে আসে। আগারগাঁওয়ের বাচ্চু মিয়ার হোটেলে প্লেট ধোয়ার কাজ করত। সেখান থেকে হিমেল তাকে নিয়ে আসে ক্লাবের দেখা শোনার কাজে। রাতে থাকে ক্লাবেই। মাসে ৫০০ টাকা বেতন। খাওয়ার টাকা ক্লাব থেকেই পায়। বেতন তার কাছে মুখ্য না। তার বিশ্বাস, খাওয়ার ভাবনাই আসল। এবার একে একে “ভাবুক সমাজ” এর সবার পরিচয় জেনে নিই।
রাতুলঃ  দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। বাবা সরকারী চাকুরে। বড় ভাই রোমান, লালমাটিয়া সরকারী মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। তিন বোনই সংসারী। বাসায় ভাই, ভাবি, মা,বাবা আর ৩ বছরের ভাতিজা আনাফ।
কৌশিকঃ  এক ভাই এক বোন। ছোট বোন সীমা নবম শ্রেণীতে পড়ে। বাবা সরকারী ব্যাংকে চাকরি করে।
হিমেলঃ ২ ভাইয়ের মধ্যে বড় সে। ছোট ভাই ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। ছোট বোন ৮ম শ্রেণীতে পড়ে। তাদের একটা রেস্টুরেন্ট আছে শেওড়াপাড়ায়। আল-মদিনা রেস্টুরেন্ট। তার বাবা এটা দেখাশোনা করেন।
জাহিনঃ অন্যদের চেয়ে আলাদা তার পরিবার। বাবা বিজনেসম্যান। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। ছোট বোন বেসরকারী স্কুলে ১০ম শ্রেণীতে পড়ে। নিজেদের গাড়ি আছে। যে বাড়িতে থাকে, সেটাও তাদের নিজেদের। বন্ধু মহলে জাহিন অদ্ভুত ছেলে নামেই পরিচিত। তার বড় অদ্ভুত গুন হচ্ছে তাকে ফোনে পাওয়া মুশকিল। বাসায় টানা ৫ ঘণ্টা ধরে ফোন করলেও সে ফোন রিসিভ করেনা। শুধু সে না, তার মা ও। জাহিন কে ফোনে পাওয়া মানে বিশাল ব্যাপার। তার এই অদ্ভুত রহস্য কেউ ধরতে পারেনি। আরও অদ্ভুত গুন আছে। সে কথা বলে খুব কম। তবে যা বলবে, তা ভেবে চিন্তে বলবে। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায় কয়েকদিনের জন্য। তার বাসায় অন্যদের যাতায়াত খুব কম।
                                               পর্ব -২
জাহিন মালিবাগ মোড়ের জ্যামে আটকে আছে। গুলিস্তানে অপেক্ষা করছে রাতুল, হিমেল, কৌশিক। স্পোর্টস মার্কেট থেকে জার্সি কিনতে হবে। “ভাবুক সমাজ” ক্লাব আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্ট। দুদিন বাদে ফাইনাল। এখনো জার্সিই জোগাড় হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্লাসে ছুটতে হয়েছে। এই জ্যামের কল্যাণে দুপুর গড়িয়ে গেল। ওদিকে বার বার ফোন দিচ্ছে রাতুলরা। ফোনের দিকে জাহিনের বিন্দু মাত্র দৃষ্টি নেই। বাসে যাত্রী নেই তেমন। জাহিনের পেছনের সিটে এক যুবক অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। কথা বার্তায় বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা গাড়ির মেকানিক। গায়ের কালি মাখা জবু থবু টি- শার্টে তার যথার্থ প্রমান রয়েছে। “এতো জাম দেখার পরেও আধা ঘণ্টা ধইরা বেটা ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়া রাখছে। গাড়ির তেল পুরতাছে, ইঞ্জিন ও গরম হইতাছে। রাস্তার মইদ্ধে ইঞ্জিন হঠাৎ বন্ধ হয়া গেলে বেটা বুঝবো মজা। হে হে হে হে”, জাহিন কে পিছনে তাকাতে দেখে ছেলেটা কথা বলার আরেকটু উৎসাহ পেল। “ ভাই, হে গো লাইগাই গাড়ি নষ্ট হয়, আর ক্ষতি হয় মালিকের”  জাহিন শুধু মাথা ঝাকালো। কথা বলার আগ্রহ দেখাল না। জ্যাম ছাড়ার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। বাসের সবাই চুপচাপ। মেকানিক ছেলেটি চেষ্টা করেও চুপ থাকতে পারছেনা। হঠাৎ ছেলেটি গান ধরলো,
          “গাড়ি চলেনা, চলেনা, চলেনা রে,
           গাড়ি চলেনা।
           চড়িয়া মানব গাড়ি, যাইতাছিলাম বন্ধুর বাড়ি.........”
সময়োপযোগী গান শুনে সবাই হেসে উঠলো। যান্ত্রিক নগরীর এই যান্ত্রিক সময়ে কিছুটা বিনোদনের সুবাতাস।  জাহিন আবারও ছেলেটিকে দেখার জন্য পেছনের দিকে তাকালো। ছেলেটি হাসিমুখে জাহিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “ কি করমু কন তো ভাই, এক জায়গায়ই যদি বাস ৫০ মিনিট আটকায়া থাকে!! কষ্টে মুখ দিয়া বাপ্পার গান বাহির হইয়া গেল” জাহিনের মনে হল, ছেলেটি লেখা পড়া জানা। বাপ্পা মজুমদার কে যে চিনে, সে যে লেখা পড়া জানা ছেলে তা অনুমান করাই যায়। ছেলেটির গানের গলা ভাল। বেশ দরদ দিয়ে গেয়েছে। জাহিন মনে মনে বেশ খুশি হল। তবে একটা তথ্যে ছেলেটার ভুল আছে। গানটি বাপ্পার নিজের না। এটি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান। বাপ্পা অনুমতি নিয়ে গেয়েছে। বাপ্পা একা না, সঞ্জীব চৌধুরী সহ। এই অসাধারন রুপক গানটি এমন একজন লোকের তৈরি ও সুর করা, যার সঙ্গীত বিষয়ক কোন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান তো নেইই, প্রাথমিক লেখা পড়াও করে নাই। কোন প্রাতিষ্ঠানিক লেখা পড়া ছাড়া নোবেল জয়ী সাহিত্যিক হওয়ার উদাহরণ আছে, আছে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হওয়ার। জীবনমুখী এমন রুপক গানের স্রষ্টার কি উদাহরণ আছে? জাহিন ভাবতে থাকে। এই গায়কের পায়ের ধুলো নিতে পারলে বেশ ভাল হত। আহারে...... আমরা মানুষ চিনি তার বিদায়ে......।    
- “ফোন রিসিভ করতে না চাইলে ফোন পকেটে নিয়া ঘুরিস কেন?”__ কৌশিক রেগে গেল।
জাহিন,- “ আমি তো তোদের বলি নাই আমারে ফোন দে। আমি রিসিভ করুম না। আমার ইচ্ছা”।
হিমেল,- “ এই রোদের মধ্যে কতক্ষন দাঁড়াইয়া থাকা যায়? তুই ফোন রিসিভ করে বলতে সমস্যা কি?”
জাহিন,-“ আমার ফোনে কথা বলতে বিরক্ত লাগে। তোদের আগেও বলছি। আমি খুব দরকার না পড়লে ফোনে কথা বলিনা”।
পরিস্থিতি ঝগড়ার দিকে যাচ্ছে দেখে রাতুল তিনজন কে টেনে দোকানের দিকে নিয়ে যায়। টুর্নামেন্ট অনূর্ধ্ব ১৫ বছরের ছেলেদের। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে তিনজনের শরীর মোটা। ওদের সাইজের জার্সি দোকানদার বেশি দাম চাচ্ছে। তারা যে টাকা জোগাড় করেছে, জার্সির দাম তা থেকে ৬০০ টাকা বেশি হচ্ছে। রাতুলের পকেটে আর টাকা নেই। জাহিন ১২০ টাকা বের করে দিল। কৌশিকের কাছে আছে ৪৫৫ টাকা। কিন্তু এই টাকা দিয়ে দিলে এই মাস তার পকেট ফাঁকা থাকবে। এখন মাসের ২৫ তারিখ। টিউশনির টাকা পেতে আরও ৭ দিন বাকি। হিমেলের কাছে টাকা থাকেনা। তবে যেদিন ওর বাবা রেস্টুরেন্টে থাকেনা, সেদিন তাকে ক্যাশে বসতে হয়। সেদিন তার পকেট গরম থাকে। হিমেল বলল,
“কৌশিক, তুই এখন টাকা টা দে, আমি পরে তোকে দিয়ে দিব”।
কৌশিক,- “ কালকের মধ্যে দিতে হবে কিন্তু?”
-“ কালকে আব্বা রেস্টুরেন্টে না থাকলে কালকেই পাবি”।
-“ তোর বাপ রেস্টুরেন্টে থাকুক না থাকুক সেটা আমি বুঝুম না। আমারে কালকেই দিতে হবে”।
রাতুল,- “ তুই চিন্তা করিস না, তোর টাকা ম্যানেজ হয়ে যাবে। এখন দে”।
দোকানদারের সাথে দরাদরি করে ২০০ টাকা ছাড় পাওয়া গেল। বাসে উঠার আগে সিগারেটের দোকান থেকে এক প্যাকেট গোল্ড লিফ সিগারেট নিয়ে নিল রাতুল। পকেটে আছে ১০০ টাকার মত। এটা বাস ভাড়া।
-“গোল্ড লিফ নিছস কেন? আমি বেনসন ছাড়া সিগারেট খাইনা জানস না?” __ হিমেল।
কৌশিক,- “যাওয়ার ভাড়া নাই, নবাব সাহেব বেনসন সিগারেট চায়!। নিজের টাকায় কিনে খা”।
হিমেল সত্যি সত্যি ২ টা বেনসন সিগারেট কিনে আনলো। কৌশিক জিজ্ঞাসা করল,
_ “ তুই না তখন বললি তোর কাছে টাকা নাই?”
- “ ২০ টাকা ছিল”।
- “ শালা মিথ্যুক”।
জাহিন সিগারেট খায়না। তাই এসব আলোচনায় যোগ দিল না। চুপচাপ বাসে উঠে গেল ওদের সাথে।  

আজমল সাহেব চায়ের কাপ হাতে পেপার পড়ছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছেনা। পাশের রুম থেকে গানের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।
                  “ আলগা করো গো, খোপার বাঁধন,
                       দিল ওহি মেরা ফাঁস গাই......”
জাহানারা বেগম প্রতিদিন সকালে গান শুনেন। আজও তার ব্যাতিক্রম হচ্ছেনা। আজমল সাহেব গানের দিকে মনযোগ দিতে গিয়ে খবরের তাল হারিয়ে ফেলছেন। খবর টা খুবই ইন্টারেস্টিং। “ স্বামীর কামড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা আহত” অবশেষে সম্পূর্ণ সংবাদ টা পড়ে শেষ করলেন। ২ বার পড়লেন। পড়ে খুব বিরক্ত হলেন। দেশের শীর্ষ একটি পত্রিকায় কোন সংবাদের এমন শিরোনাম হতে পারে, তা তিনি আশা করেননি। আজকাল সব কিছুতে মানুষ অশ্লীল আনন্দ খোঁজে। পত্রিকার সম্পাদকরা ও যুগের চাহিদা মেটাতে সেদিকে ধাবিত হচ্ছেন। এটা জাতির জন্য ভালো কিছু হতে পারেনা। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, আজ থেকে বাসায় আর কোন বাংলা পত্রিকা রাখবেন না। বাংলা পত্রিকা আউট, ইংরেজি পত্রিকা ইন। বিরক্তির আরেকটি কারন নজরুল সঙ্গীত।  বাংলা- উর্দু মিশিয়ে গান, তার উপর সেটা নজরুল সঙ্গীত। অনেকটা এ যুগের রিমিক্স গানের মত মনে হচ্ছে। আজমল সাহেব গান বোদ্ধা না, তাই এ বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না। কাজের বুয়া কে আরেক কাপ চা দিতে বললেন। জাহিন বেরিয়ে যাচ্ছিল। আজমল সাহেব ডাকলেন-
“ সাত সকালে নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছো ?”
জাহিন, “ ক্লাব মাঠে। ফুটবল খেলবো”।
আজমল সাহেব, “ দাঁত ব্রাশ করেছো ? নাস্তা খেয়ে তারপর যাও। জারিনের ঘুম ভেঙ্গেছে কিনা দেখ। ওকে ডাইনিং টেবিলে আসতে বল”।
জাহিন অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর জারিন দরজা খুলে বিরক্তি নিয়ে তাকালো,
-“ সাতসকালে এমন হকারের মত না ডাকলে হয়না?”
-“ বাবা তোকে ডাকছে। খাবার টেবিলে”।
খাবার টেবিলে আজ ঘরের সবাই একসাথে। এমনটা সচরাচর হয়না। জাহানারা সাধরনত একাই নাস্তা করেন। আজমল সাহেব টেবিলে পান শুধু জাহিন কে। তা ও সব সময় না। আজ জারিন, জাহানারা কেও একসাথে টেবিলে পেয়ে আজমল সাহেব বেশ খুশি হলেন। রাতুলের সকালে নাস্তা করতে ভালো লাগেনা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজমল সাহেবের সাথে সকালে মুখোমুখি হলে নাস্তা করতে হয়। আজ বেশ তৃপ্তি সহকারে নাস্তা খাচ্ছে জাহিন। নাস্তার মেন্যু অবশ্য তেমন মজা করে খাওয়ার মত না। ডিম, স্যূপ, রুটি আর কিছু ফল। জাহিনের পছন্দের খাবারের তালিকায় এগুলো পড়েনা। তবুও এত তৃপ্তি লাগার কারন কি ? সবাই একসাথে বসে নাস্তা খাচ্ছে বলেই কি ?......... হতেও পারে। জগত সংসার বড়ই রহস্যময়।
*********
ক্লাব মাঠে পাড়ার ছোট বড় মিলে ফুটবল খেলা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য ছোটদের কে টুর্নামেন্টের জন্য প্রস্তুত করা। টুর্নামেন্টে খেলবে ৬ টি দল। আগারগাও থেকে যে দলটি খেলবে, রাতুল, জাহিনরা তাদের ট্রেনিং করাচ্ছে। দলের নাম “ভাবুক সমাজ ক্রীড়া চক্র”,  এছাড়াও বাকি ৫ টি দল হল শেরে বাংলা নগর ফুটবল ক্লাব, কল্যাণপুর স্পোর্টিং ক্লাব, শ্যামলী জাগরণী ক্রীড়া চক্র, লালমাটিয়া নবারুন সংঘ ও কাজিপাড়া যুব সংঘ। টুর্নামেন্ট শুরু ৬ ই অক্টোবর। হাতে আর মাত্র ৪ দিন। রাতুল বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। তাদের দলে স্ট্রাইকার মাত্র একজন। একজন দিয়ে আক্রমন ভাগ সাজানো ভালো দেখায় না। তার চিন্তা খেলার ফরমেশন টা ১-৪-৪-২। ৪ জন ডিফেন্ডার, ৪ জন খেলবে মিড ফিল্ডে, এখান থেকে ২ জন কে ২ উইং আর ২ জন সেন্টার মিড ফিল্ডার রাখার প্ল্যান।  বাকি ২ জন আক্রমন ভাগে । জাহিন তাতে সম্মতি জানালেও কৌশিক নির্ভর করতে পারছেনা। কারন আরেকজন  স্ট্রাইকার নাই। ধরে বেঁধে কাউকে স্ট্রাইকার হিসেবে দাড় করানো টা বোকামি।  ( চলবে )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৯০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সহিদুল হক ২২/০৯/২০১৩
    লেখার ধরনটা বেশ ভাল লাগল।বাকি অ্ংশের অপেক্ষায়----
  • ভালো লাগলো।
  • Înšigniã Āvî ২১/০৯/২০১৩
    ছোট্ট খাটো মিষ্টি খুনসুটি...
    সর্বোপরি জীবনের গল্প খুব ভাল লাগলো....
    পরেরটার অপেক্ষায়
  • মাহমুদ নাহিদ ২১/০৯/২০১৩
    ভালো লাগলো ।তবে একটু ছোট করে লিখলে পড়তে একটু সহজ হতো ।
    • আতিক রহমান ২৩/০৯/২০১৩
      একটা ধারাবাহিক গল্প লেখার ইচ্ছা। ছোট করি কীভাবে বলুন তো......... পরের পর্ব গুলো ছোট করে পোষ্ট দিব। আপনাদের অনুপ্রেরণা লেখা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেবে। ধন্যবাদ।
 
Quantcast