www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আবুল কালাম আজাদ ১২৫ বছর

Tomorrow is his 125 th Birdthday
জিন্নার দ্বিজাতিতত্বের পতাকার প্রকৃত বাহক সর্দার প্যাটেল, লিখেছিলেন আজাদ
সম্প্রতি গুজরাতে সর্দার প্যাটেলের একটি বিশালাকার মূর্তির উদ্বোধন করিয়েছেন বিজেপি-র অঘোষিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও। দুজনেই সর্দার প্যাটেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন, তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক করে তোলেন। তাঁর কিছুদিন আগেই মুসলিম-প্রধান হায়দরাবাদে এক জনসভায় নরেন্দ্র মোদী আরেকবার মুখোশের আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি বলেন, বিংশ শতকের ভারতের তিনজন মাত্র মনীষীকে তিনি শ্রদ্ধা করেন – মহাত্মা গান্ধী, ড রামমনোহর লোহিয়া এবং দীনদয়াল উপাধ্যায়। অদ্ভূত কারণে সেদিন কিন্তু তিনি সর্দার প্যাটেলের নাম করেন নি, যার বিশালাকার মূর্তি তারই উদ্যোগে আহমেদাবাদে বসানো হল। এমনকি বিজেপির প্রাক্তন সংগঠন হিন্দু মহাসভার সভাপতি ড শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায়ের নামও তিনি ভুলে গেছেন। না কি, আসলে প্যাটেল-শ্যামাপ্রসাদকে ভোলেন নি, বরং খুব জেনে-বুঝেই হায়দরাবাদে তাঁদের নাম উচ্চারণ করেন নি? কারণ, নিজামের রাজ্যকে ভারতভূক্তির সময়ে এই দুজনের ভূমিকা সেখানকার ‘ভোটারদের’ ক্ষেপিয়া দিতে পারে, এটা তিনি জানতেন। আর জানতেন বলেই সেই মহাত্মা গান্ধীর নাম উচ্চারণ করেন, যার হত্যার সঙ্গে মোদীর আসল সংগঠন আরএসএস জড়িত। কারণ, তাঁর দলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, যাকে দলের মুখ না বলে মুখোশ বলেই বিশ্ব জানে, সেই অটল বিহারী বাজপেয়ীকেও কংগ্রেসের নেহরুবাদের মোকাবিলায় ‘গান্ধীবাদী সমাজবাদ’-এর কথা বলতে হয়েছিল। আজ তিনি যে সেই পদের লোভেই লালায়িত, তা মোদী কি করে ভোলেন!
তা যে প্যাটেলকে মনমোহন সিং ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন আর ‘ছোটে সর্দার’ মোদী যাকে ‘লৌহপুরুষ’ বলে গর্ব অনুভব করেছেন, তিনি ওই গান্ধী-হত্যাকারী আরএসএস প্রসঙ্গে কি বলেছিলেন? গান্ধী হত্যার সাড়ে ছয় মাস পর ১৯৪৮-এর ১৮ আগস্ট শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখে সর্দার প্যাটেল লিখছেন, “There is no doubt in my mind the extreme section of the Hindu Mahasabha was involved in this conspiracy. The activities of the Rashtriya Swayamsevak Sangh (RSS) constituted a clear threat to the existence of the government and the state… our reports do confirm that as a result of the activities of these two bodies, particularly the former, an atmosphere was created in the country in which such a ghastly tragedy became possible.” (কোনও সন্দেহ নেই যে, হিন্দু মহাসভার কট্টর অংশ এই ঘটনার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কাজকর্ম সরকার এনং দেশের প্রতিই বিপজ্জনক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।… আমাদের রিপোর্টগুলি স্পষ্ট করেই বলছে যে, এই দুটি সংগঠনের কাজকর্ম, বিশেষত প্রথমটি, এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যার ফলে এই নৃশংস ঘটনা ঘটতে পেরেছে।)
এখন মোদীর কাছে ভোট দখল গুরুত্বপূর্ণ, তাই হয়তো তিনি মুসলিম প্রধান এলাকায় সর্দার প্যাটেলকে ভুলে যাবেন, মনমোহন সিং গুজরাতে গিয়ে প্যাটেলের প্রশংসা করবেন, কিন্তু বাস্তবে কেউ কি নিজের নিজের দলের রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টাবেন! অসম্ভব। গুজরাত দাঙ্গার সময় ‘থিও-ফ্যাসিস্ট’ চেহারা প্রকাশ্যে এনে সে কথা সোচ্চারেই জানিয়ে ও বুঝিয়া দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী।
তাহলে হঠাৎ এই প্রসঙ্গে অবতারণা করলাম কেন? কারণ এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কথা, সোমবার যিনি ১২৫ বছরে পা দেবেন। স্বাধীন ভারতে শিক্ষাবিস্তারে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণে রেখে তাঁর জন্মদিন ১১ নভেম্বর ভারত সরকার সারা দেশে "জাতীয় শিক্ষা দিবস" হিসেবে পালন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতে প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। স্বাধীন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার জন্য আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি চালু করেন। তিনিই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্থাপন করেন। কিন্তু এমন একজন মানুষের থেকে কি শিক্ষা আমরা নিলাম?
ইতিহাস বলছে, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতীক এবং জিন্না-সর্দার প্যাটেলদের দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের তীব্র বিরোধী। তাঁর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বইতে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটনকে ভারতের ভাইসরয় করে পাঠান। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী অবিভক্ত ভারতকেই স্বাধীনতা দেওয়ার কথা। কিন্তু জিন্না দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান প্রস্তাব দিয়েছেন, এবং মাউন্টব্যাওটন তাকেই রূপায়ন করতে চান। সেই সঙ্গে মাউন্টব্যাটন চান যে , নেহরু এবং প্যাটেল যেন তাঁকে সমর্থন করেন। গান্ধিজী শুরু থেকেই ভারতভাগের বিরোধী। তিনি হুমকি দিয়েছেন, দেশ যদি ভাগ হয়, তা হবে তাঁর লাশের উপর দিয়ে। তবু, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাউন্টব্যাটন একসময় সত্যি সত্যি বল্লবভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহুরুকে পাশে পেলেন। জওহরলাল প্রথম দিকে ভারত-ভাগের বিরোধীই ছিলেন, কিন্তু লেডী মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তাঁর ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিগত সম্পর্ক (যা মাউন্টব্যাটনের কন্যা খোলাখুলিই লিখে দিয়েছেন) নেহরুর মত বদল করিয়ে ফেলে।
সে প্রসঙ্গে কি লিখেছেন আবুল কালাম আজাদ? লিখছেন, “জওহরলালের ভোল বদলের পেছনে একটা কারণ লেডি মাউন্টব্যাটেন। ভদ্রমহিলা যেমন অতীব বুদ্ধিমতি তেমনি ভারী মায়াবী আর বন্ধুভাবাপন্ন। তিনি ছিলেন তাঁর স্বামীর খুব গুনগ্রাহী এবং বহুক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর সঙ্গে যাদের গোড়ায় মতের অমিল হত তাদের কাছে তিনি স্বামীর বক্তব্য ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন” (ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, পৃ. ১৩৭)। গান্ধীজীও প্রথম দিকে ভারত-ভাগের বিরোধী ছিলেন। ভারত-ভাগ ঠেকাতে শেষ চেষ্টা হিসেবে মৌলানা আজাদ গান্ধীজীর শরনাপন্ন হয়ে বলেন, “যেমন এতদিন, তেমনি এখনও আমি দেশভাগের বিরুদ্ধে। বরং দেশভাগের বিরুদ্ধে আমার মনোভাব আগের চেয়েও কড়া।… এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। আপনি যদি দেশভাগের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, এখনও আমাদের শেষ রক্ষার আশা আছে। তবে আপনি যদি চুপ করে থাকেন তো আমার ভয়, ভারতের ভরাডুবি হবে” (ঐ, পৃ. ১৪০)। প্রত্যুত্তরে গান্ধীজী বলেন, ‘দেশভাগ হলে আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে হবে।’ তা সত্ত্বেও ভারত ভাগ হয়। গান্ধিজীর জীবন নিয়ে গবেষণাগ্রন্থের রচয়িতা জোসেফ লেলিভেল্ড জানিয়েছেন, গান্ধিজী বলেছিলেন জিন্নাকে রাষ্ট্রপতি করে নেহরু প্রধানমন্ত্রী হোন। নেহরু তাঁকে বলেন, দর্দার প্যাটেলের সঙ্গে কথা বলতে। আর প্যাটেল জানান, ‘দেরী হয়ে গেছে। জওহর মাউন্টব্যাটনকে চূড়ান্ত মত জানিয়ে দিয়েছেন’।
এরপর গান্ধিজী সিদ্ধান্ত নেন, স্বাধীনতা-প্রাপ্তির দিন তিনি দিল্লিতে থাকবেন না। তিনি ওইদিন ছিলেন কলকাতায়, বেলেঘাটায়, হায়দর নামে মুসলিম নাগরিকের বাড়িতে। অনশন পালন করেছেন দেশভাগের বিরুদ্ধে। আরে কি বলেছিলেন মৌলানা আজাদ? গভীর দুঃখ নিয়ে মৌলানা আজাদ বলেন, “প্যাটেলকে আজ জিন্নার চেয়েও দ্বিজাতিতত্ত্বের বড় সমর্থক হতে দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। দেশ ভাগের পতাকা জিন্না তুলে থাকলেও তার প্রকৃত পতাকাবাহক এখন প্যাটেল” ( ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, পৃ. ১৩৯)।
(১৮৮৮-১৯৫৮)।
অবিভক্ত ভারতের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি স্থাপন ও আধুনিক শিক্ষার রূপায়নকারী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মের সময় নাম ছিল ফিরোজ বখ্ত। ১৮৫৭-এর সিপাহী বিদ্রোহের পর তাঁর বাবা মৌলানা খইরুদ্দিন মক্কায় চলে যান এবং সেখানে ১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর আজাদের জন্ম হয়। তার পূর্বপুরুষরা বাবরের আমলে আফগানিস্তানের হেরাট থেকে ভারতে এসেছিলেন এবং তাদের অনেকেই প্রসিদ্ধ পণ্ডিত এবং প্রশাসক। জন্মের দুবছর পর তাঁর পুরো পরিবার আবার কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। পরে তাঁর নামকরণ হয় আবুল কালাম মহিউদ্দিন আহমদ নামে। পরে তিনি মহিউদ্দিন আহমদ-এঁর জায়গায় ‘আজাড’ ছদ্মনাম গ্রহন করেন। শিক্ষালাভ বাড়িতে বাবা এবং গৃহশিক্ষকের কাছে। তরুণ বয়স থেকেই তিনি উর্দু ভাষায় কবিতা, ধর্ম ও দর্শন নিয়ে লেখালেখি করতেন। মৌলানা আজাদ ১৯১২ সালের জুলাই মাসে কলকাতার উর্দু সাপ্তাহিক ‘আল- হিলাল’ প্রথম প্রকাশ করেন। ১৯১৪ সালে ইউরোপ যুদ্ধের সময় পত্রিকাটি প্রেস আইন অনুসারে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে তিনি ১৯১৫ সালের নভম্বের মাস থেকে আর একটি উর্দু সাপ্তাহিক ‘আল-বালাঘ’ প্রকাশ করতে শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে সোচ্চার হবার কারনেই ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে ভারতরক্ষা আইন অনুসারে তাঁকে কলকাতা থেকে বহিস্কার করা হয়। এইসময় বোম্বাই, পাঞ্জাব, দিল্লী এবং উত্তরপ্রদেশের সরকার তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এবং আজাদ তখন বিহারে চলে যান।
মূলত ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ-র সময়ে তার রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। ১৯১৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে তিনি আরও পরিচিতি লাভ করেন। রাঁচীতে ১৯২০ সালের ১লা জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি অন্তরীণ খাকার পরে আজাদ সারা ভারত খিলাফত কমিটির (কলকাতা অধিবেশন, ১৯২০) এবং একতা অধিবেশনের (দিল্লী, ১৯২৪) সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সালে আজাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে জাতীয় মুসলিম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এবং ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর সময় কংগ্রেস পার্টির তরফ থেকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রস্থের মধ্যে আছে ‘আল-বায়ান’ (১৯১৫)এবং ‘তারজমান-উল-কোরান’ (১৯৩৩-১৯৬৯)। এই দুটিই হল ধারাবিবরণী। এছাড়া ‘তাজকিবাহ’ (১৯১৬)হল আত্নজীবনীমূলক রচনা এবং‘গাবর-ই-থাতির’(১৯৪৩) চিঠিপত্রের সংকলন অন্যতম।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ১৩০৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Înšigniã Āvî ১১/১১/২০১৩
    অনেক কিছু নতুন তথ্য জানলাম,
    একটা জায়গায় ভুলবশত দর্দার প্যাটেল লিখেছেন, একটু ঠিক করে নিন।
    • চন্দ্রশেখর ১৮/১১/২০১৩
      আসলে দেশ ভাগের জন্যে আরএসএস-ওয়ালারা গান্ধীজিকে বদনাম করে। অথচ, তাদের নেতা সর্দার প্যাটেলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে না। মোলানা আজাদের নাম করলেই বোঝায়, ওরা দেশ ভাগ চেয়েছিল। আরে, আরএসএস-এর সরসঙ্গচালক নানাজি দেশমুখ পর্যন্ত স্বীকার করেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলন-এ তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না, বরং ইংরেজের ডিভাইড অ্যান্ড রুলে তাঁরা সাহায্য করেছেন।
      তাই ইতিহাসকে ধরিয়ে দিতে একটু চেষ্টা করেছিলাম।
  • দীপঙ্কর বেরা ১০/১১/২০১৩
    বেশ
  • এত বড় লেখা! একটু পড়েছি।
    মাইণ্ড করো না ভাইয়া। আরো ছোট করে লিখবেন। আচ্ছা?
 
Quantcast