www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্প---সম্পত্তি

গল্প: সম্পত্তি
সাইয়িদ রফিকুল হক

আব্দুল জব্বার সাহেব মারা যাচ্ছেন। মানে, তিনি আজ-কাল-পরশু-তরশু’র মধ্যে মারা যাবেন। যেকোনো সময়ে তার মৃত্যু হতে পারে। এজন্য অবশ্য চূড়ান্তভাবে কোনো দিন-তারিখ ঠিক করা নেই। তবে তার মৃত্যুর দিনক্ষণটা একমাত্র উপরওয়ালার হাতে। তার শরীরের অবস্থা মোটেই ভালো নয় বলেই লোকজন এসব অনুমান করে থাকে।
এতদিন তিনি শহরের এই বাড়িটাতে প্রায় একাকী বসবাস করতেন বলা চলে। নিকটাত্মীয় কিংবা আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না তার পাশে। শুধু তার একজন প্রিয় ছাত্র তার নিয়মিত দেখাশোনা করতো। আর সঙ্গে ছিল ময়নার মা। সে তাকে তিন বেলা রেঁধে খাওয়াতো। তার ছেলেমেয়েরা সব বিদেশে থাকে। আশেপাশের অন্যান্য দূরাত্মীয়-স্বজনরাও কেউ তার কোনো খোঁজখবর নিতো না। এজন্য তিনি কখনো কোনোরকম মনখারাপ করেননি। যেখানে তার নিজের সন্তানরাই খোঁজ নেয়নি, সেখানে তিনি অন্যের ওপর অহেতুক রাগ করে নিজের পাপতাপ বাড়াবেন কোন্ যুক্তিতে!
আব্দুল জব্বার সাহেব নিশ্চিত মারা যাবেন। তার দুটো কিডনিই ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ ড্যামেজ। ডায়ালাইসিস করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই, জগত-সংসারের পাঠ চুকাতে তার সময় বেশি লাগবে না। দেশের অভিজ্ঞ ডাক্তাররা হাসপাতাল থেকে তাকে বিদায় দিয়েছে ক’দিন আগে। তারা বলেই দিয়েছে—তার অবস্থা যখনতখন!

তার অনেক বিষয়সম্পদ। এই শহরে বিশ কাঠা জমির উপরে তার বিশালবড় একটা বিল্ডিং। আশেপাশে আছে আরও একটি দামি প্লট। আর ব্যাংকে কোটি দুয়েক টাকা মওজুত করা রয়েছে। সবমিলিয়ে তিনি একজন ধনী মানুষ। তা সত্ত্বেও, তার পাশে কোনো স্বজন-পরিজন নেই।
তার স্ত্রী মারা গেছে অনেক বছর আগে। বড় আশা করে তিনি ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায়। তারা পড়ালেখা শেষ করে সেখানেই বিয়েথা করে যে-যার মতো স্থায়ী হয়েছে। কেউ আর বাপের কথা মনে করেনি কিংবা মনে রাখেনি। সেই থেকে তিনি আজও নিঃসঙ্গ আর বড় একাকী!

তিনি খুব তাড়াতাড়ি আর যেকোনো সময় মারা যাচ্ছেন বলে আজ সকাল থেকে তার বাড়িতে লোকজনের সমাগম হয়েছে বেশ। সবাই তার নিকটাত্মীয়। এতদিন যারা তাকে চোখের দেখা দেখতে আসেনি—আজ তারাও এসেছে একবার দেখতে!
তার ছাত্র মাসুম যথেষ্ট সমাদর করেছে এসব লোকজনকে। কাউকে সে না-খেয়ে যেতে দেয়নি। স্যারের আদেশ সে পালন করেছে অক্ষরে-অক্ষরে।
তার দুই ছেলে আর এক মেয়েও এসেছে ঘণ্টাখানেক আগে। তারা এসে খুব মায়াকান্না করলো কিছুক্ষণ। তারপর মিনমিন করে বিসয়সম্পদের কথা তুললো একে-একে। আবার বাপের জন্য দরদও প্রকাশ করলো খুব! কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বিষয়সম্পদের ওপর দাবিটাই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠলো একসময়। অভিজ্ঞ প্রোফেসর সাহেবের তা বুঝতে আর বাকি রইলো না। তিনি তাদের লোভ ও লাভের হিসাব কষতে দেখে চোখের জল ফেললেন কয়েক ফোঁটা। তার বেদনাহত হৃদয়টা ভেঙে একেবারে চৌচির হয়ে গেল। সন্তানদের কাছে তিনি সম্পত্তি হতে পারেননি। তারা হয়েছে সম্পদমুখী! কেউ হয়নি সম্পত্তি। তিনি ভেবেছিলেন, দেরিতে এলেও হয়তো তাদের বোধোদয় হয়েছে! কিন্তু বিধি বাম! তারা তাদের আদর্শ ও চিন্তা থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়ায়নি।
বড় ছেলে একরাম বললো, “বাবা, এবার তবে উইলটা করে ফেলুন। বলা তো যায় না, আপনার শরীরের যা অবস্থা! কখন কি...।”
প্রোফেসর আব্দুল জব্বার একটু হাসলেন ছেলেমেয়েদের দিকে চেয়ে। তখন তার শরীরে যেন মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে।
ছেলেমেয়েদের কথা শুনে তবু তিনি কষ্ট করে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “তোমাদের কি এই বিষয়সম্পদ না-হলে চলবে না?”
বড় ছেলে এমন একটা প্রশ্নে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। কিন্তু বাপের কাছে সে ধরা দিবে না। তাই, সে বেশ ভারিক্কিচালে বলে বসলো, “না-না, বাবা। এসবের জন্য আমি আসিনি। আমি শুধু তোমাকে দেখতে এসেছি। আর এসব দিয়ে আমি কী করবো? সেখানে আমার কতবড় ব্যবসা! আমি শুধু তোমার দু’আ নিতে এসেছি। তোমার একটু স্নেহ চাই।”
ছোট ছেলে কামরান মাহমুদ প্রিন্স বললো, “এসব তো আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়। গত মাসে আমি নিউ জার্সিতে দুই কোটি টাকা দামের একটা গাড়ি কিনেছি। আমার নিজের একটা বাড়িও আছে সেখানে। কতবড় চাকরি করছি আমি! তুমি কি ভাবছো, তোমার এই সামান্য বিষয়ের জন্য এখানে এসেছি? আসলে, তা নয়, বাবা। তোমাকে দেখতে এসেছি। আর তোমাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি, বাবা!”
কথাগুলো সে খুব বড়মানুষের মতো আর ভারিক্কিচালে বলেছে।
আর পরিবারের সবার ছোট মেয়েটি বললো, “এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমার বাড়ি তুমি যা খুশি করগে। এব্যাপারে আমার বলার মতো কোনোকিছু নেই। বাবা, তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার নাতি-নাতনিদের স্কুলের পড়ালেখার ক্ষতি জেনেও এখানে ছুটে এসেছি। শুধু তোমার জন্য, বাবা! শুধু তোমার জন্য!”
তিনি সব শুনে বুঝলেন, এসব ওদের মুখস্থ কথা। ওরা তার সম্পদের লোভেই আজ একজোট হয়ে এখানে এসেছে। নইলে ওরা আমেরিকা থেকে এসেছে সপ্তাহখানেক আগে। অথচ, তার এখানে এসেছে আজ! সবাই এ-কয়েকদিন ব্যস্ত ছিল শ্বশুরবাড়িতে!
সবার কথা শুনে কিছুক্ষণ তার যেন দম বন্ধ হয়ে ছিল! জগতে আজকাল এত-এত অভিনয় চলে!
পরে অনেক কষ্টে প্রোফেসর আব্দুল জব্বার একটুখানি উঠে বসতে চাইলেন। তখনও তার ছাত্র মাসুম কাছে এগিয়ে এসে তাকে ধরলো। ছেলেমেয়েরা তখন পাশের রুমে বসে অন্য হিসাবনিকাশ কষছে!
অনেক কষ্টে তিনি একটুখানি বসতে পারলেন। তারপর ধীরেসুস্থে সবাইকে কাছে ডাকলেন। আর বললেন, “তোমাদের আমি চিনেছি। তোমরা আমার বড়আদরের সন্তান। তোমাদের আমি ভালো দেখতে চাই। সবসময় তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের জন্য রইলো আমার স্নেহ-ভালোবাসা। আজ তোমাদের সামনে আমার সমুদয় সম্পত্তির ব্যাপারে মৃত্যুকালে একটা লিখিত উইল ও ওসিয়ত করে যাচ্ছি।”
এইসময় তার বিশ্বস্ত উকিল সাহেব সবকিছু লেখার জন্য নড়েচড়ে বসলেন। তিনি যাবতীয় স্ট্যাম্প ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে একেবারে প্রস্তুত হয়েই এসেছেন।
প্রোফেসর সাহেব আগের মতো খুব কষ্ট করে বলতে লাগলেন, “আমার সমুদয় সম্পত্তি এই এলাকায় একটা বিশালবড় লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য দিয়ে গেলাম। এই শহরে এখন বড়-বড় অনেককিছু আছে। কিন্তু উন্নতমানের লাইব্রেরির বড় অভাব। আমার টাকায় গড়া এই লাইব্রেরি হবে জ্ঞানপিপাসু মানুষের জন্য। এখানে এসে মানুষ প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথ খুঁজে পাবে। আমার সন্তানতুল্য প্রিয় ছাত্র মাসুম এই কাজটি করবে। পারলে তোমরা তাকে সাহায্য করবে।”
প্রোফেসরের পরিচিত উকিল ততক্ষণে সবকিছু লিখিতভাবে তৈরি করে ফেলেছেন।
উইল শুনে ছেলেমেয়েরা আর দাঁড়ায়নি সেখানে। সবাই চলে গেছে দ্রুতপদে। কারও মুখে একটুখানি আলো দেখা যায়নি! সবার মুখে অমাবস্যার গাঢ় আঁধারের ছাপ যেন!

প্রোফেসর সেদিন মারা গেলেন ঠিক দুপুর একটায়। তবু তার কোনো সন্তান আসেনি জানাজায়।
সবকিছুর তদারকি করেছে মাসুম।
বাড়ি ছেড়ে সব লোক চলে গেছে। শুধু আছে মাসুম। তাকে এখানে একটা বিশালবড় লাইব্রেরি গড়ে তুলতে হবে। আর সে হবে এই লাইব্রেরির অবৈতনিক পরিচালক। উইলে তা-ই লেখা আছে।
তিনদিন পর প্রোফেসরের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে স্থানীয় মসজিদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হলো। তবু তার ছেলেমেয়েরা আসেনি!

প্রোফেসরের বাড়িটা সেই আগের মতোই আছে।
মাসুম কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে টাঙ্গিয়ে দিলো বিশাল একটা সাইনবোর্ড—প্রোফেসর আব্দুল জব্বার জীবনস্মৃতি লাইব্রেরি। তারপর সে সর্বশক্তি দিয়ে প্রোফেসরের নামে একটা আধুনিক লাইব্রেরি গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়লো।
এভাবে মুত্যুর পরও বেঁচে রইলেন একজন আদর্শ শিক্ষক আব্দুল জব্বার।


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৪/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast