www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

এই সব দিন্-রাত

শেষ কাজ

সায়নের পড়াশুনা কেমন চলছে?
না, ভালো নয়। পড়ায় মন নেই।
জানি। ব্যবহার খুব খারাপ। আমি কিছু বললেই বলে, এই বুড়ো তুমি চুপ!
তা বয়স অবশ্য হয়েছে। সত্তর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চলাফেরায় কোন ক্লান্তি নেই। রোজ বাজার করা, নাতিকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা। রোজ বিকেলে এই কাঠের দোকানে এসে বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত গল্পগুজব করা-বেশ সুস্থই দেখাত তিমির বণিককে। রঙ ধবধবে ফর্সা, ওপরের ঠোঁট দুটির মাঝে কাটা স্বভাবেও তাই ঠোঁটকাটা। যাকে তাকে মুখের উপর যা তা বলে দিত। ওর নাতির সঙ্গে আরও দুজন ছাত্র উনিই যোগাড় করে বললেন এদের তুমি ভাল করে পড়াও। তোমার উপর আমার খুব ভরসা। কিন্তু যখন তিনজন থেকে ছ’জন হয়ে গেল তখন একদিন ডেকে বললেন, তুমি তো এখন হরিঘোষের গোয়াল খুলেছ, পয়সা ছাড়া কিছুই চেন না। তোমার দ্বারা আর শিক্ষকতা হবে না। তা সে যাই হোক লোকটা খুব রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলতে পারত। জীবনে অনেক বৈচিত্র্য ছিল ওর। ওর এক আপন ভাই ছিল, কুচকুচে কালো আর খুব হামবড়া। সে ব্যাংকে চাকরি পেয়ে বিয়ে করল কিন্তু বাপের ভিটেয় থাকতে না পেরে দূরে ঘরভাড়া করে চলে গেল। লোকে বলে তিমির বাবুর অত্যাচারেই সে ঘরছাড়া হয়েছে। ওর চার ছেলের মধ্যে একজন হারিয়ে গেল বিয়ের পরে। কোথায় যে গেল কেউ জানে না। লোকে বলত তিমির সব জানে। তার বৌ মামলা করেছে, সেই মামলা এখনও চলছে।
বিডিও অফিসের কেরানী থেকে অফিসার হয়ে উনি অবসর নিলেন। দোতলা বাড়ীতে একটা অ্যালসেসিয়ান না ডোবারম্যান যেন ছিল। বাড়ির পাশেই রাস্তা সেখান থেকে হরিনাম করে মড়া নিয়ে যাবার সময় কুকুরটা খুব রেগে গিয়ে শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চাইত। তখন ওকে রাখা হল দোতলার ছাদে। মাঝে মাঝে ছাড়া থাকত। এইরকম একদিনে যেই না হরিনাম শোনা কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাদ থেকে সোজা হরিনামের উপর। পড়ে গেল পা ভেঙ্গে। চিকিৎসা করেও বাঁচানো গেল না। সেই কুকুরের শ্রাদ্ধে লোক খাওয়ানো হল। হরিনামও হয়েছিল। তিমিরবাবু কখনও কাঁদে নি কিন্তু কুকুরের শোকে কেঁদেছিল। কে কিজন্য কাঁদবে তা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
আজ ওর শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে এসে ওর ছবির সামনে বসে এইসব ভাবছিলাম। খাবার জন্য অসম্ভব ঠেলাঠেলি হচ্ছে। এক ব্যাচের খাওয়া শেষ হবার আগেই অন্যরা ঢুকে পড়ে তাদের পিছনে লাইন দিচ্ছে। দু-একজন দেখলাম ছবির সামনে ফুল দিয়ে নমস্কার করল। এটা ভাড়া বাড়ী। নীচে খুব এবড়ো খেবড়ো জায়গায় মাত্র কয়েকটা চেয়ার পাতা। সেখানে বসলে রিস্ক আছে বলে বেশীর ভাগ লোকই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ক্ষুধায় ক্ষিপ্ত হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন ধরে সায়ন পড়তে যাচ্ছে না। বাড়িতে লোকজন ভর্তি। ছেলেদের মধ্যে অনেক গোলমাল ছিল কিন্তু আজ বাবার কাজ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করছে। ম্যানেজমেন্ট খুবই দূর্বল বলে মনে হল। তিমির বাবুর পেটে খুব ব্যাথা হওয়ায় নার্সিংহোমে অপারেশন করা হয়। তারপরই শোনা গেল ক্যান্সার। মাত্র একমাসের মধ্যেই সব শেষ। সায়ন বলল কালীপুজোর দিন দাদু ডেকে বলল, কি রে তোর বাবা বাজি কিনে দিয়েছে? সায়ন মাথা নেড়ে ‘না’ বলায় খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওর বাবাকে বাজি কিনে দিতে বলে। তখন শুধু ফলের রস ছাড়া কিছুই খেতে পারছিল না। এমনও এখন শোনা গেল যে ওর আত্মা বাড়ীতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি যখন খাবার জায়গায় পৌঁছাতে পারলাম তখন এক যুবতী একা তিনটে চেয়ার দেখিয়ে বলছে এগুলো আমার সিট। শেষে খুব রুক্ষ হয়ে হেঁকে ওঠার পর একটা ছেড়ে দিল। প্রচুর পদ করেছে। ফ্রায়েড রাইস, সুক্তো, ভাজা, মুগের ডাল, মাছ, মাংস, চাটনী, রসগোল্লা, আইসক্রীম। কিন্তু আইসক্রীম খাবার আগেই চেয়ারের পেছলে ধাক্কা শুরু হল। পিল পিল করে লোক ঢুকে পড়ছে। আইসক্রীমটা প্লাস্টিকের গামলায় ফেলে দিয়েছি। আমরা যা ফেলে দেব তা আর একজন খেয়ে বাঁচবে। নীচে নামার সময় সকলেই জানতে চাইল উপরে ফাঁকা আছে কি না। খাদ্য খাদক, ব্যবস্থাপনা সবই আছে কিন্তু তিমিরবাবু আর কোথাও নেই। ক্ষুধার কাছে সব তুচ্ছ—অবশ্য সেই পরিত্যক্ত এবড়ো খেবড়ো জায়গায় চেয়ারের উপরে রাখা ওর ছবিটা এই সবকিছুই ড্যাব ড্যাব করে দেখে যাচ্ছে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৬০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/১১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সুন্দর হয়েছে লেখা
  • Rabia Onti ২০/১১/২০১৭
    খুব ভাল
  • সোলাইমান ১৯/১১/২০১৭
    ভালো লাগলো আপনার লেখাটি।
 
Quantcast