www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নৈঃশব্দ্যে শব্দচারী

এক

হয়তো তখন আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম।তখন রাত দুটো কি তিনটে বাজবে বোধহয়।আকাশে হয়তো চন্দ্রকুমারী চন্দ্রিকা ও সপ্তর্ষিমন্ডলের সাতটি তারার গুচ্ছের সাথে ঈশানী ছোঁয়ে সারিবদ্ধভাবে তিনটে তারা মিটমিট করে জলছিল। জ্যোৎস্নাকুমারী জ্যোৎস্না অবিরামভাবে গগন ছেদ করে নিঃসৃত হচ্ছিল।তবে মাঝেমাঝে হইতো অকালজলদোদয়ে ভাটা পড়ছে চন্দ্রিকাময়ী রূপ যৌবন।তখন হয়তো চাঁদোয়া রজনীর বদলে বাসা বাঁধছে তমসালয়।মাঝেমাঝে ব্যাঙের ঘ্যানঘ্যান শব্দ হচ্ছিল। ঝিঝি পোকাগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে,তাই তারা নীরবে অবস্থান করছিল। কখনো মৃদু হাওয়া,কখনো ঝড়ো হাওয়া বাতায়ন দিয়ে আমার নিদ্রালয়ে প্রবেশ করছিল, আমি কিছুটা হলেও টের পাচ্ছিলাম।
হয়তো তখন আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। হঠাৎ অসম্ভাবিতরূপে আমি দেখলাম, একটি ঘুটঘুটে কালো হাত বাতায়ন দিয়ে আমার ঘুমালয়ে প্রবেশ করলো। তারপর সেই হাত আমার মোবাইল, বই, ক্যামেরা মুষ্টিবদ্ধ করছে।
হয়তো তখনও আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। আমার চক্ষু সম্মুখে ঘটছে,ঘটে চলছে। কিছুতেই কিছু করতে পারছি না।শুধুই বিছানাতে কাতরাচ্ছি। এবং বজ্রশব্দে শব্দ করতে চেষ্টা করছি। কিন্তু শব্দ যেন তখন জটিল বাঁধুনিতে বাঁধা পড়ে আছে। তাই বজ্রশব্দ নৈঃশব্দ্য হয়েই পরে রইলো তবু জাগতে পারলাম না।
তন্দ্রাচ্ছন্ন, নয় ঘুম,নয় সজাগ। বহুক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন ও সজাগের সঙ্গে লড়াই হলো আমার। বারবার যেন রবার্ট ব্রোসের মতো আমি হেরে চলছিলাম। অবশেষে সজাগ হলাম।
সজাগ হয়ে আমি নিজেই একটু অবাক হলাম। এক রহস্য আবিষ্কার করলাম।
আবিষ্কার করলাম নিজেকে, একটা মনোমুগ্ধকর বলতে সচরাচর আমরা যেই রাতকে বলে থাকি সেই রকমকে একটা রাতকে। রাত এতো সুন্দর হতে পারে, না জাগলে কখনোই বুঝতাম না।
ষোলকলায় পরিপূর্ণ চন্দ্র চন্দ্রিকাময়ী রূপ যৌবন অবিরামভাবে বিলি করছে অকৃপণ চিত্তে আমার ঘুমালয়ে।বাতায়ন পাশে সারিবদ্ধভাবে দেবদারু গাছ ছিল। ঝড়োহাওয়ায় বৃক্ষরাজির পত্র গুলি নৃত্য করছে।কিছুকালের জন্য হাওয়ার দল নীরবতা পালন করছে, এর সাথে বৃক্ষপত্র এবং তার নৃত্য । খানিক বাদে সে কি নৃত্য! এইভাবেই কখনো বাতাস একটু জিরায়, মেঘের আড়ালে লুকায় চাঁদ,জিরায় পাতায় পাতায় ঘর্ষণের শব্দ, জুনাকির আলো জ্বলে আর নিভে, কখনো ব্যাঙ, কখনো ঝিঝিপোকার দল ফরেস্ট মিউজিকে লিপ্ত হয় কখনো আবার গভীর ঘুমে চলে যায়। তখন রাতটি থাকে অনেক শান্ত, আবার শান্তময় রাত্রির বুক ছিঁড়ে শিয়াল কুকুরের চিৎকার।

দুই

তারপর কিছু দেবদারুর পাতা জোছনার চলার পথে রোধ সৃষ্টি করে বসেছিল এবং সে ছায়া আমার ঘুমালয়ে প্রবেশ করছিল। যেন সেই ছায়া রূপ ধরেছে বিভীষিকাময় জ্যান্ত কৃষ্ণ কায়া। সেই কায়া উন্মাদ নৃত্য করছে বাতাসের তালে তালে দেবদারুর পাতা। যেন এক জ্যান্ত মানবের ঘুটঘুটে কালো হাত আমার পড়ার টেবিলে ঘাটাঘাটি করছে কিছু একটা খোঁজছে হয়তো।খুব মজাই লাগলো বিষয়টা।
মানুষের মস্তিষ্ক সত্যিই ঘুমায় না।সব কিছু ঘুমিয়ে যায় কিন্তু মস্তিষ্কের ঘুম নেই। ঘুম নেই যেমন হৃদপিন্ডের আর রক্ত কণিকার।মানুষ যেটা বেশি ভাবে সেটাই ঘুমানোর পর স্বপ্নে হানা দেয়। কারণ মস্তিষ্কের তো ঘুম নেই। তাই সে মানুষকে ঘুমোতে দেয়না। তাছাড়া মস্তিষ্ক বাবু অবসর থাকার লোকও নয় বটে।হিপোক্রেটাস বলেছিলেন...
"ব্রেইন থেকে, এবং শুধুমাত্র ব্রেইন থেকে-ই,উৎপত্তি আমাদের আনন্দ,উল্লাস,হাসি এবং কৌতুক, যেমন উৎপত্তি আমাদের দুঃখ,ব্যাথা-বেদনা, মনস্তাপ, অনুশোচনা এবং কান্না..."
তাই এই রাতকে ভাগে পেয়ে মস্তিষ্ক তাকে ছাড়তে নারাজ।

তিন

যাক ভালোই হল, এই রাত্রিরে একটু হেঁটে আসলে মন্দ হবে না। তাই বের হয়ে পড়লাম হাঁটার জন্য। অবশ্য মস্তিষ্কবাবুকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। সে যদি আমাকে এই রাতকে এই ভাবে মনের মধ্যে উপস্থাপন না করতো আমি কিন্তু এই রাতকে উপভোগ করতে পারতাম না। ভয় পেলেও ইন্টারেস্টিং ছিল পুরো বিষয়টা। ধন্যবাদ ব্রেইন।
এই রাতে হাঁটার লোভ কয় জন আর বল মিস করতে চায়।আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আর যারা এই রাতের পরিবেশ, ওঙ্কার পছন্দ করে না,যার মনে ধরে না এই রাত্রির রূপ,তার ভিতরে মন আছে কিনা আমার সন্দেহ হয়। আমি আরো বলতে, 'পারি সে ভালোবাসা কী জানে না! 'হাঁটতে বের হয়ে পড়লাম। হাঁটছি তো হাটছি, কতক্ষণ হেঁটেছি খেয়ালে রাখিনি। মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম।।হঠাৎ পিছন ফিরে দেখি একটি মানুষ! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে তিনটে ছোঁয় ছোঁয়।এতো রাতে তো মানুষ হাঁটার কথা না। তাও আবার আমার পিছুপিছু...

এই, এই আপনি কে! আপনি কে?
আমার পিছু নিয়েছেন কেন?
-আ...মি! আমি খুনি!
মনে মনে ভাবলাম আমার সাথে মজা করছে। আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'আমি আপনার পেশা কি জানতে চাইনি! জানতে চেয়েছি আপনার নাম কী!'
সে গম্ভীর গলায় বললো," এখন আর আমার তেমন কোনো নাম নেই, খুন করি যেহেতু খুনি বলেই ডাকতে পারিস!
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,'খু...খু.খুনি!'
কিন্তু আমি আরেকটি বিষয় দেখে সত্যিই ভয় পেয়েছি। তার কোনো ছায়া নেই। আমি বললাম,"
-এই জো... জো.. জো...ছনা রাতে আপনার ছায়া কোথায়?
আমার ছায়া! আমার ছায়াকে আমি ছুটি দিয়েছি।
কি বলছেন এসব পাগলের মত? মনে মনে ভাবলাম, 'মনে হয় সে আত্মহত্যা করেছে।'তাই তার প্রেতাত্মা মুক্তির জন্য ঘুরাফেরা করছে।' ভয়কে চেপে রেখে
একটু সাহস নিয়ে বললাম,'পরিষ্কার করে বলুন তো।'
খুনি বললো,'গত রাতে আমি আমার ছায়াকে খুন করেছি!'
ছায়াকে খুন! মানে..!
বুঝলি নাতো বুঝবি না।কাছে আয় দেখাচ্ছি।আমি এসেছি তোর ছায়াকে মুক্তি দিতে।
ছায়া খুনি! ছায়া মুক্তি মানে কি!
কি বলছেন এসব! আমার পিছু ছাড়েন বলছি।
হ্যাঁ আমি তোর পিছু ছাড়তেই এসেছি,চিরতরে ছেড়ে দিব তোর পিছু।আয়, কাছে আয় বলে খুনি আমার গলা টিপে ধরলো। আমি তার হাত গলা থেকে ছাড়াতে হাত ছুটাছুটি করতেই আমার মোবাইল মাটিতে পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল।

চার

তখন হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মোবাইল পড়ে আছে মেঝেতে। এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম । ঘুমের ঘোরে কখন যে বাহির থেকে বিছানায় এসে শুয়েছিলাম, তা আমার একদম খেয়ালে ছিল না। সারারাত এমনিতেই ঘুম হয় নি ওই কালো হাতের জন্য। সব দোষ এই জানালার। এখনি বন্ধ করে ঘুম দিচ্ছি এই ভয়ঙ্কর সুন্দর রাত আমার প্রয়োজন নেই, ওহ! যদি জানালা খোলা না থাকতো, এই হাতও চোখে ভাসতো না আর ভাবনায়ও এতো কিছু আসতো না। সব দোষ জানালার। দ্রুত বিছানা ছেড়ে টেবিলে গিয়ে এক গ্লাস পানি পান করলাম।মনিষীরা বলেছেন, " ভয়কে জয় করতে হলে ভয়ের মুখামুখি হতে হবে, ভয় থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইলেই ভয় হানা দেয়।" তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। আজ রাতে একটু বেশিই গরম পড়েছে বটে। তার মধ্যে আবার ইলেক্ট্রিসিটি এই মফস্বল শহরে বড়ই ব্যাঘাত ঘটায়। সাত পাঁচ ভেবে আর জানালা বন্ধ করা হল না।
তাই জানালা বন্ধ না করে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম আবার।
কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না।অবশেষে বোধহয় চোখ বুঝেছিলাম।
তখন কি আমি গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলাম, না তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম, না সজাগ ছিলাম ঠাহর করতে পারছিলাম না।আবারও গল্পের পুনরাবৃত্তি, কিন্তু বাস্তব আর গল্পে তফাৎ করতে পারছি না।কেননা বাস্তব আমি তো জানি এই কালো হাত, হাত নয়, দেবদারু গাছের পাতার ছায়া রবির কিরণের মাঝে দোলাচ্ছে হাওয়ার দল। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে বাস্তব এটা না বাস্তব হচ্ছে এটাই যে, এটি একটি জ্যান্ত মানুষের হাত। কেননা এখন চোখ তো ' একটি জ্যান্ত হাত।' নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায় না। হয়তো তখন শেষ রাত্রির শুকতারাটি জেগে উঠেছিল।হয়তো তখনও অকৃপণ চিত্তে জ্যোৎস্নাকুমারী জ্যোৎস্না বিলি করছিল।

পাঁচ

সেই কায়ার প্রেতবৎ রূপি কালো হাত। সে আমার প্রিয় ডায়েরিটি মুষ্টিবদ্ধ করছে।
আবার দেখলাম, সে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। কি যেন শন শন শব্দে পড়ছে, তা বুঝতে পারছিনে, হয়তো কোনো কবিতা হবে কেননা শন শন শব্দে একটা আবৃত্তি সুরও খোঁজে পাচ্ছিলাম। তবে কী পড়ছে তা বুঝে উঠতে পারছি না! আমি ভাবছি,
কোনো অতৃপ্ত পাঠকই হতে পারে।আজ হয়তো তাঁর কোনো পুস্তকই মন ভরে নাই। তাই এই রাত্রিরে রবিরশ্মিতে আমার কবিতা চুরি করে পড়ছে।
যাক পড়ুক গে, কিন্তু সে কে একটু জিজ্ঞেস করে দেখা যাক,আমি বললাম, 'কি?কে?কে তুমি?আমার ডায়েরী পড়ছো? আমার কবিতা পড়ছো?'
কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলাম না।সে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে আর নিভৃত চিত্তে পড়ে যাচ্ছে। তারপর আমি উচ্চঃ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে আমি চন্দ্রের পৃষ্ঠে চেঁচাচ্ছি, তাই শূণ্য ডিসেবল শব্দ আমার থেকে উৎপন্ন হল না। না আরেক বার চেষ্টা করে দেখি।আমি বললাম, 'পাঠক সাহেব শুনছেন আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই, তবে আপনি যদি কিছু মনে না করেন।' এবার হয়তো সে রাগ করেছে। পাঠক সাহেব তথা সেই প্রেতবৎ রূপি কালো হাত উচ্চশব্দে শন শন করে চলে যাচ্ছে,এবং এর সাথে আমার প্রিয় ডায়েরিটা নিয়ে যাচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বললাম, 'কী ভাই ? দয়া করে আমার ডায়রী টা নিবেন না। আমার কবিতা নিবেন না, গল্প নিবেন না, প্লিজ।'
কিন্তু কে শুনে কার কথা। ধীরেধীরে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছয়

তারপর,তারপর হয়তো,
জ্যোৎস্নাকুমারী মেঘমল্লার অভ্যন্তরে ডুব দিয়েছিল।
অতঃপর হয়তো সারা বিশ্বে বিশেষ করে আমার ঘুমালয়ে আধারের সুযোগ পেয়ে প্রেতবৎ নাচছিল। হয়তো তখন উন্মাদ হাওয়া বইছিল। হয়তো খোলা জানালায় ভোরের বাতাসের মিছিল চলছিল।
তখন আমি কি করছিলাম তা বলতে পারবো না, হয়তো গভীর ঘুমে মুগ্ধ ছিলাম, নয়তো তন্দ্রাচ্ছন্ন..

আম্মার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। অবশেষে সকাল হলো তাহলে। আম্মা এসে বললো, "কিরে কবীর, তোর ডায়েরী, বই, খাতা-কলম সব কিছু মাটিতে পড়েছিল কেন? তোকে রাত্রে কত করে বললাম প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছে জানালাটা বন্ধ করে ঘুমো, না তবুও জানালা খোলেই ঘুমাইলি। এখন হলো তো, খাতা-ডায়েরী সব কিছু মেঝেতে পড়েছিল।বিছানাতে শীতে কাতরাচ্ছিলি। দেখ বিছানাকে কি করেছিস! বিছানায় চেয়ে দেখলাম অনেক অগোছালো।
আমার কথা আর তোরা ভাইবোনের কারো কর্ণপাত হয় নাকি বাপু। নে ধর চা খেয়ে আমায় উদ্ধার কর, আমি গেলাম।আমি তখন আম্মার কথা গুলি একে একে ডুক গিলছিলাম।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮২২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ইমরান খাঁন সুজল ২৬/০৫/২০১৭
    ভাল খিখেছেন!
  • তুষার রায় ২১/০৫/২০১৭
    তন্দ্রায় তন্দ্রানুভূতি। ভালো লাগল প্রিয়জন
  • মধু মঙ্গল সিনহা ২১/০৫/২০১৭
    সুন্দর অনুভূতি।
  • সাঁঝের তারা ২০/০৫/২০১৭
    বেশ তো
 
Quantcast