www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভৌতিক মঞ্জিল

ভৌতিক মঞ্জিল

- জয়শ্রী রায়

তন্ময়ের মন আজ খুব খুশি । দেবদত্তর চিঠি পেয়ে সে অভিভূত । চিঠিতে দেবদত্ত তার বাড়িতে যেতে লিখেছে । দশ বছর আগে কলেজ জীবনে দেবদত্তই তার একমাত্র প্রিয় বন্ধু ছিল । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোজফিতে এম,এ, পাশ করার পর দেবদত্ত সেই যে কলকাতা ছেড়ে কাঁথির কাছাকাছি তাদের গ্রামের বাড়িতে গেল তারপর তন্ময় তার আর কোন সংবাদই পায়নি । তন্ময় তাকে বেশ কয়েকবার চিঠি লিখেছিল কিন্তু দেবদত্তর কাছ থেকে কোন উত্তর সে পায়নি । বারবার ফোন করেও লাইন না পাওয়ায় যোগাযোগের আশা সে ছেড়েই দিয়েছিল । দেবদত্তর চিঠি পেয়ে তন্ময়ের ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি সে ছুটে যায় দেবদত্তর বাড়িতে । কতদিন তার পুরনো বন্ধুকে সে দেখেনি । কিন্তু তন্ময়ের সমস্যা তার স্কুলের ছুটি নিয়ে । বে-সরকারি স্কুলে ডেপুটেশনে টিচারের চাকরি । কাজেই গরমের ছুটি পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে ।

গরমের ছুটি পড়তেই তন্ময় বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ব্যাগ নিয়ে রেডি । সকাল সাতটায় বেহালা ট্রাম ডিপো থেকে দীঘা যাবার স্টেট বাসে চড়ে বসল তন্ময় । আনন্দও যেমন হচ্ছিল তেমন একটু ইতস্ততঃ বোধও করছিল সে । কোথায় তারা আর কোথায় দেবদত্তরা । বেহালার শকুন্তলা পার্কের ছোট একটা ভাড়া বাড়িতে বাবা মা আর তার দুই ভাই বোনকে নিয়ে তাদের সংসার । বাবার একটা ছোট মুদিখানা-দোকান আছে । দেবদত্তর বাবা ডাক্তার । তার উপর আবার বিশাল জমিজমার মালিক । এককথায় জমিদার ফ্যামিলি । কিন্তু দেবদত্ত তো তার প্রিয় বন্ধু । সুতরাং ইতস্ততঃ করার কোন কারণ নেই । বন্ধুর সাথে এতদিন পর দেখা হবে ভেবে মন থেকে সব জড়তা ঝেড়ে ফেলল তন্ময় । স্টেট বাস বেশ ভালই চলছিল । হঠাৎ পথিমধ্যে এগরার কাছে মারাত্মক এক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তন্ময়দের বাস অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল । কাঁথিতে তার পৌঁছনোর কথা বেলা এগারোটা নাগাদ । সময়মত না পৌঁছনোয় দেবদত্ত চিন্তা করবে ভেবে তন্ময় কাছাকাছি একটা টেলিফোন বুথ থেকে দেবদত্তকে ফোন করল । ল্যান্ডফোন লাইনে ডিসটারবেন্স থাকায় দেবদত্তর কথা পরিস্কার শোনা যাচ্ছিল না । ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছিল । ডিসটারবেন্স থাকা সত্ত্বেও দেবদত্তর কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট শুনতে পেল তন্ময় । এর আগে অনেকবার সে দেবদত্তকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনদিনই তন্ময় তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়নি । হয় ঘড়ঘড় আওয়াজ করে লাইন কেটে গিয়েছে না হয় সাইলেন্ট থেকেছে । তবে উচ্চস্বরে অনেকক্ষণ কথা বলে এবার তন্ময়ের মনে হল দেবদত্ত তার দেরিতে পৌঁছানোর খবরটা শুনতে পেয়েছে । বাস ছাড়তে বেলা গড়িয়ে গেল ।

ক্লান্ত শরীরে তন্ময় যখন কাঁথিতে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে । সামনে পূর্ণিমা । চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গে উছলে পড়েছে সন্ধ্যার ধূপছায়া রঙের চাদরে । বাস থেকে নামতেই তন্ময় দেখল একটু দূরে একটা আমগাছের নীচে দেবদত্ত দাঁড়িয়ে । তন্ময় তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা নিয়ে প্রায় দৌড়েই দেবদত্তর কাছে পৌঁছে গেল । তন্ময়ের আনন্দ আর ধরে না । কতদিন পর তার প্রিয় বন্ধু দেবদত্তর সাথে দেখা । কিন্তু এতদিন পর তাকে দেখে দেবদত্তর মধ্যে কোন উচ্ছ্বাস ছিল না । শুধু একটু হাসল । তন্ময় দেখল দেবদত্তর চেহারা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে । নিজের প্রতি অযত্নের ছাপ সারা শরীরে । মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলোও অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে । পরনের পোষাকটাও মলিন । একটু অবাকই হল তন্ময় । দেবদত্তর তো এরকম থাকার কথা নয় । তার বাড়ির আর্থিক অবস্থাও বেশ ভাল । এখন তো সে বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে আছে । তাহলে দেবদত্ত কি কোন অসুখে ভুগছে ? তন্ময় হেসে দেবদত্তকে বলল – “ অনেক কষ্ট দিলাম তোকে , আই অ্যাম ভেরি স্যরি । রাস্তায় এক্সিডেন্টটা না হলে অনেক আগেই পৌঁছে যেতাম”।  দেবদত্ত মৃদু হেসে বলল – “না না, কষ্ট কিসের ? আমার প্রিয় বন্ধুর জন্য এটুকু ধৈর্য ধরতে পারব না”? দ্বিধাবোধ না করে তন্ময় এবার দেবদত্তকে জিজ্ঞাসা করল – “তোর এ কি চেহারা হয়েছে রে দেবা ? রিসেন্টলি তোর কি কোন অসুখ হয়েছিল”?  দেবদত্ত বলল – “না না, শরীর ঠিকই আছে । এখন এখানে ভীষণ গরম পড়েছে । তুই তো জানিস আমি একদম গরম সহ্য করতে পারি না । এখন তো আর আমি কলকাতায় নেই । গ্রামের ধুলো-মাটি মাখতে হচ্ছে”।  কথা বলতে বলতে দেবদত্ত তন্ময়ের হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে আম গাছের ও-প্রান্তে রাখা একটা মোটর গাড়ি দেখিয়ে বলল – “চল, তোর জন্য আমার পঙ্খিরাজ অপেক্ষা করছে”। তন্ময় দেখল বাসস্ট্যান্ডের গায়েই আমগাছের নীচে  পুরনো আমলের রঙ-চটা একটা ডজ গাড়ি পার্ক করা আছে । গাড়িটা দেখে তন্ময় বেশ অবাকই হল । এত পুরনো গাড়ি এখনও দেবদত্তরা ব্যবহার করছে ! দেবদত্তদের তো আর টাকার অভাব নেই । নতুন গাড়ি না কিনলেও গাড়িটা তো একটু রঙ করে নিতে পারে । এ-ব্যাপারে তন্ময় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না । এ-রকম গাড়ির প্রতি হয়তঃ ওদের ফ্যাসিনেসন থাকতে পারে । তন্ময় শুধু বলল – “তোর গাড়িটা তো ইংরেজ আমলের বলে মনে হচ্ছে”! তন্ময়ের কথা শুনে দেবদত্ত হেসে ফেলল । গাড়ির গায়ে হাল্কা হাত বুলিয়ে বলল – “জানিস তন্ময়, এই গাড়িটার একটা ইতিহাস আছে । এক ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে আমার ঠাকুরদার বাবা গাড়িটা কিনেছিলেন । বংশানুক্রমিক কেউই গাড়িটা পরিত্যাগ করতে চায় নি । হেরিটেজ, বুঝলি হেরিটেজ । বাবাকে নতুন গাড়ি কেনার জন্য অনেক বলেছি । কিন্তু বাবা এই পঙ্খিরাজকে কিছুতেই ছাড়তে পারবেন না । তবে দূরে কোথাও এটাকে আমরা ব্যবহার করিনা । প্রয়োজনে কাছাকাছি যেতে হলে আমিই গাড়িটা চালাই”। কথাগুলো বলে দেবদত্ত হো-হো করে হাসতে লাগল । এবার দেবদত্ত তন্ময়কে বলল – “ওঠ ওঠ, তাড়াতাড়ি ওঠ । মা হয়তঃ এতক্ষণে চিন্তা করতে শুরু করে দিয়েছে”। গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে তন্ময়কে বসিয়ে সামনে চালকের আসনে স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বসল দেবদত্ত । স্টার্ট দিতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাড়িটা চলতে শুরু করল । তন্ময় দেবদত্তকে জিজ্ঞাসা করল – “গাড়িটা অনেকদিন চালাসনি মনে হয়”! দেবদত্ত গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল – “হ্যাঁ, প্রায় এক বছর পর গাড়িটায় হাত দিলাম । এতদিন কোন প্রয়োজন পড়েনি”।

মাঠ-ঘাট পেরিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে গ্রামের প্রাকৃতিক শোভা মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল তন্ময়ের । লাল মাটির রাস্তার দু’পাশে মাঝে মাঝে মাটির দোতলা বাড়ি দেখে তন্ময় অবাক । মাটির দোতলা বাড়ির কথা সে অনেকের মুখেই শুনেছে কিন্তু নিজের চোখে সে এই প্রথম দেখল । চাঁদের আলো বন-হাসনুহানার ওপর আছড়ে পড়েছে । বন-হাসনুহানার সাদা ফুলগুলো চাঁদের কিরণের সুধা পাণ করে নতুন আবেশে গন্ধে মাতোয়ারা । গ্রাম্য অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে করতে দেবদত্তর গাড়িতে এগিয়ে চলেছে তন্ময় । দেবদত্তর হাতে স্টিয়ারিং, তাই দেবদত্তকে বিরক্ত করাটা সমীচীন মনে করলনা তন্ময় । কিন্তু প্রিয় বন্ধুর অবস্থা বুঝতে পেরে প্রকৃতির শোভাকে শেয়ার করার জন্য দেবদত্তই মুখ খুলল – “কিরে, কেমন লাগছে গ্রাম”? তন্ময় বিস্ময় প্রকাশ করে বলল – “কি বলব তোকে দেবা । এক কথায় এক্সেলেন্ট । তুই যদি ইনভাইট না করতিস তাহলে সত্যিই এ-রকম উপভোগ্য দৃশ্য থেকে বঞ্চিতই থেকে যেতাম”। আবার প্রকৃতির অপরূপ রূপে ডুবে গেল তন্ময় । হঠাৎ গাড়ির পিছনের বাঁ দিকের খোলা জানালায় একটা শব্দ হতেই চমকে উঠল তন্ময় । প্রকৃতির রূপ মন্থনে ছেদ পড়ল তার । তার বা দিকে তাকাতেই সে দেখল বেশ বড় সাইজের এক বন-বাদুড় চলন্ত গাড়ির খোলা জানালায় বসে তারই দিকে চোখ পাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে কিচ কিচ করে ডেকে উঠছে । তন্ময় ঘাবড়ে গিয়ে ভাবল  ভেতরে এসে আবার কামড় মারবে না তো ? তন্ময় যে একটু ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে দেবদত্ত বলল – “গ্রামে এ-সবের ভয় পেলে চলবে না বন্ধু । এরা কিছু করবে না । তোকে নতুন দেখেছে তাই হয়তঃ একটু আলাপ জমানোর লোভ সামলাতে পারেনি”। আরও একবার তন্ময়কে দাঁত খিঁচিয়ে এক ঝটকায় লাফিয়ে ঘন গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল বাদুড়টা । দেবদত্ত যাই বলুক না কেন তন্ময়ের মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল । গাড়িটা রাস্তার দু-তিনটে বাঁক পেরিয়ে এক প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল । বাড়িটা মেইনটেনেন্স-এর অভাবে কেমন যেন হতশ্রী হয়ে পড়েছে ।

সামনের গেট খুলে বিশাল লন পেরিয়ে সদর দরজা । দেবদত্তর সাথে তন্ময় অন্দর-মহলে ঢুকল । প্রথমেই দেখা হল দেবদত্তর মায়ের সাথে । গোলগাল চেহারা, ফর্সা গায়ের রঙ । লাল পাড় সাদা খোলের শাড়ি আটপৌরে করে পরা । কপাল জুড়ে টকটকে লাল সিঁদুরের টিপ । দেবদত্ত তার মায়ের সাথে তন্ময়কে পরিচয় করিয়ে দিল । তন্ময় পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতেই দেবদত্তর মা বাধা দিয়ে বললেন – থাক বাবা থাক, আমি আশীর্বাদ করছি, দীর্ঘজীবী হও বাবা”। দেবদত্তর মা দেবদত্তর দিকে তাকিয়ে বললেন – “তোদের দেরী দেখে আমরা খুব চিন্তা করছিলাম । রাস্তা-ঘাটের যা অবস্থা কোথায় কখন কি হয় বলা যায় না । যাক তন্ময় পৌঁছে যাওয়াতে নিশ্চিন্ত হলাম । ওকে তোর বাবার কাছে নিয়ে যা । উনি ওনার ঘরেই আছেন । বারান্দা পেরিয়ে দেবদত্ত তন্ময়কে নিয়ে দোতলায় উঠল । দোতলার বিশাল লম্বা বারান্দা পর পর অনেকগুলো গ্যাসের ল্যাম্প পোস্ট দিয়ে সাজানো । ল্যাম্প পোষ্টের  মৃদু আলো এক সুন্দর মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । পর পর অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে শেষ ঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলে তারা দু’জনে ঘরের ভিতরে ঢুকল । তন্ময় দেখল বিশাল ঘরের একদিকে বিশাল এক পালঙ্ক । তার পাশে একটা ইজিচেয়ারে অর্ধশোয়া অবস্থায় এক শক্ত-সমর্থ পৌঢ় । দেবদত্তর বাবা দেবব্রত বাবু । বেশ রাশভারী চেহারা । সামনের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন । দেবদত্ত তন্ময়কে নিয়ে তাঁর কাছে যেতেই তিনি তন্ময়ের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন । দেবদত্ত তন্ময়কে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই তিনি বললেন – “দেবু, তন্ময় এসে গেছে ? বাঃ, বেশ বেশ”। তন্ময়ের মনে হল তার কথা দেবব্রত বাবু দেবদত্তর মুখ থেকে অনেক শুনেছেন । আজ যেন তারই প্রতীক্ষায় তিনি বসে আছেন । তাঁর স্নেহশীল কথায় তন্ময় অভিভূত । তন্ময় তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন – “অসুস্থ মানুষকে প্রণাম করতে নেই বাবা । আমি আশীর্বাদ করছি দীর্ঘজীবী হও, সর্বদা ভাল থাকো”। এবার দেবদত্তর দিকে তাকিয়ে দেবব্রত বাবু বললেন – “দেবু, ওর বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দাও । ওর থাকবার ঘরটা পরিস্কার করিয়েছ তো ? এতটা পথ এসেছে, খুব ক্লান্ত । ওর যত্নের যেন কোন ত্রুটি না হয়”। দেবদত্ত ঘাড় নেড়ে দেবব্রত বাবুকে বলল – “বাবা তুমি চিন্তা কোরো না । সব ঠিক আছে”। দেবব্রত বাবু তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন – “যাও বাবা, আগে ফ্রেস হয়ে কিছু মুখে দাও, পরে কথা হবে”। তন্ময় দেবব্রত বাবুকে বিদায় জানিয়ে দেবদত্তর সাথে কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময় তিনি আবার দেবদত্তকে ডেকে বললেন – “দেবু, রত্নপ্রিয়ার সাথে তন্ময়ের পরিচয় করিয়ে দিও”। দেবদত্ত সম্মতি-সূচক মাথা নেড়ে বলল – “আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে”। বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেবদত্ত তন্ময়কে নিয়ে তিনতলায় এল । তিনতলার লম্বা বারান্দার ল্যাম্প-পোস্টগুলো থেকে বিচ্ছুরিত মৃদু আলো এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল তারা দু’জনে । ঘরের দরজা বন্ধ । ঘরের ভেতর থেকে পিয়ানোর একটা মিষ্টি সুর ভেসে আসছে । দরজায় নক করতেই একটি মেয়ের সুরেলা কণ্ঠ ভেসে এল – “কে, দাদাভাই ? আয়, ভেতরে আয়, দরজা ভেজানো আছে”। ভেজানো দরজা ঠেলে দেবদত্ত ঘরে ঢুকল । দেবদত্তর পিছন পিছন তন্ময়ও ঢুকল । ওরা ঘরে ঢুকতেই মেয়েটি পিয়ানো ছেড়ে উঠে দাঁড়াল । মেয়েটির চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে তন্ময় তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল । পরনে সাগরনীল রঙের সিল্কের শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ । কানে-গলায়-হাতে ছিমছাম সোনার গহনা, নাকে ঝকঝক করছে একদানা হীরের নাকছাবি । মটরের দানার মত গায়ের রঙ, পান-পাতার মত মুখ, বাঁশির মত নাক, টানাটানা চোখ । কুঁচকুঁচে কালো চুলগুলো টেনে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করা । আয়ত সুন্দর চোখ দুটোতে কোথায় যেন একটা বেদনার ছাপ । একই অঙ্গে এত রূপের ছটা তন্ময়ের চোখে এর আগে কোনদিন কোথাও ধরা পড়েনি । দেবদত্তর ডাকে তন্ময়ের আচ্ছন্নতা কাটল । এর জন্য মনে মনে সে একটু লজ্জাও পেল । দেবদত্ত মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল – “তন্ময়, এই হল আমার আদরের একমাত্র বোন রত্নপ্রিয়া”। দেবদত্তর কথা শেষ হতে না হতেই রত্নপ্রিয়া হাসতে হাসতে বলল – “আর ইনি হলেন তোর সেই প্রিয় বন্ধু, তাই না দাদাভাই”? রত্নপ্রিয়া তন্ময়কে নমস্কার করতেই তন্ময়ও প্রতি-নমস্কার জানাল । প্রীতি বিনিময়ের পর তন্ময়ই বলল – “পিয়ানো থামালেন কেন ? খুব ভাল লাগছিল পিয়ানোর সুর”। মৃদু হেসে রত্নপ্রিয়া সামনে রাখা একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল – “পরে শুনবেন, এখন বসুন না”। রত্নপ্রিয়া এবার দেবদত্তর দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে তন্ময়কে বলল – “আজ আপনি এসেছেন বলে বোধহয় আমার উপর থেকে দাদাভাইয়ের রাগ ভাঙ্গল । কতদিন রাগ করে আমার সাথে কোন কথা বলেনি জানেন”?  রত্নপ্রিয়ার কথা থামিয়ে দিয়ে দেবদত্ত বলল – “ রত্না, ওসব কথা এখন রাখ । তন্ময় এখন খুব ক্লান্ত”। এবার তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে দেবদত্ত হো-হো করে হাসতে হাসতে বলল – “ তুই পারিস বটে । রত্নাকে আপনি করে কথা বলছিস”। তন্ময় দেবদত্তর পিঠে হাত রেখে বলল – “ না না, ঠিক আছে । প্রথম পরিচয় তো ! আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে”। দেবদত্ত রত্নপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল – “রত্না, তন্ময় তো এখন কয়েকদিন থাকবে, পরে জমিয়ে গল্প করিস । সারাদিন বাসে ওর খুব ধকল গিয়েছে । আগে স্নান করে মুখে কিছু দিয়ে বিশ্রাম করুক”। এবার দেবদত্ত তন্ময়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল – “আয়, তোকে তোর ঘরটা দেখিয়ে দিই”।  রত্নপ্রিয়া করুণ দৃষ্টিতে তন্ময়ের চলে যাবার দিকে তাকিয়ে রইল । এ-দৃশ্য তন্ময়ের চোখ এড়ালো না । তন্ময়কে নিয়ে দেবদত্ত করিডর পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল । ভেজানো দরজা ঠেলে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল দেবদত্ত । প্রকাণ্ড ঘর । ঘরের এক পাশে বিশাল এক পালঙ্ক । অপর পাশে একটা আলমারি । তার পাশে শ্বেত পাথরের টেবিল আর সিংহাসন-তুল্য পুরানো আমলের একটা চেয়ার । দেওয়ালে আটকানো বড় একটা ঘড়ি টিকটিক করে বেজে চলেছে । প্রকাণ্ড ঘর আর পুরানো আসবাবপত্র দেখে তন্ময় অবাক । দেবদত্ত তন্ময়কে জিজ্ঞাসা করল – “অবাক হয়ে দেখছিস কি ? ঘরটা পছন্দ হয়েছে”?  তন্ময় নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল –“বলিস কি দেবা ! এ-রকম রাজার ঘর পেলে কিন্ত আমি এখান থেকে আর নড়ব না । দেবদত্ত মৃদু হেসে বলল – “থাক না , দেখব কতদিন তুই এখানে থাকতে পারিস”। তন্ময় হো হো করে হাসতে বলল – “ঠিক আছে, দেখা যাক”। ওদিকে রত্নপ্রিয়ার ঘর থেকে পিয়ানোর মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে । এই মুহূর্তে তন্ময়ের অদ্ভুত সুন্দর লাগছে সে সুরের মূর্ছনা । কোন দ্বিধা না করে সে দেবদত্তকে বলেই ফেলল – “তোর বোন খুব সুন্দর পিয়ানো বাজায়”। তন্ময়ের কথাটা শুনে দেবদত্তর মুখের হাসি হাসি ভাব হঠাৎ উবে গেল । উদাসিন ভাবে ঘরের কড়িকাঠের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল । তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল – “হ্যাঁ রে, সেটাই তো কাল । রত্না ঐ রাগের কথা বলছিল না ... , যাগগে, ওসব কথা এখন থাক । তুই এতটা পথ জার্নি করে এসেছিস, পথশ্রমে ক্লান্ত । এই ঘরের পাশেই টয়লেট আছে । স্নান করে ফ্রেস হয়ে আগে কিছু খেয়ে নে । আমি একটু পরে আসছি”।

টয়লেট থেকে স্নান করে ফ্রেস হয়ে এসে তন্ময় দেখল দেবদত্ত ফিরে এসে বিছানায় বসে আছে । একটু পরেই এক পরিচারিকা খাবার নিয়ে এল । এলাহি খাবার । গরম গরম কচুরি ও তরকারি, হরেক রকম মিষ্টি, সুগন্ধি আম টেবিলে সাজিয়ে দিল । দেবদত্ত বলল – “সারাদিন পেটে তো কিছুই পড়েনি । নে, টিফিনটা করে নে”। তারপর পরিচারিকাটিকে দেখিয়ে দেবদত্ত বলল – “এই হচ্ছে আমার পার্বতী মাসি । ছোটবেলা থেকে এই মাসির কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছি । পার্বতী মাসির রান্না একবার খেলে সারাজীবন মুখে লেগে থাকবে”। পার্বতী মাসি একটু মুচকি হেসে চলে গেল । টেবিলে সাজানো খাবারের দিকে তাকিয়ে তন্ময় বলল – “দেবা, এত খাবার কিন্তু আমি একা খেতে পারব না । তোকেও শেয়ার করতে হবে”। দেবদত্ত এবার বেশ খানিকটা গম্ভীর হয়ে অভিভাবকের সুরে বলল – “আর সময় নষ্ট করিস না তন্ময় । ডিনারের অনেক দেরি আছে । এ-টুকু জলখাবার তুই খেতে পারবি । প্লিজ খেয়ে নে”।  এ-সময়ে এত খাবার একদম পছন্দ হচ্ছে না তন্ময়ের । এখন একটু হাল্কা চা-স্ন্যাক্স হলে ভাল হত । দ্বিধা না করে তন্ময় দেবদত্তকে বলেই ফেলল – “দেবা, এখন এক কাপ চা আর সামান্য কিছু স্ন্যাক্স হলেই ভাল হত”। দেবদত্ত কিছু বলার আগেই হঠাৎ পার্বতী মাসি এসে হাজির । তার হাতের ট্রে-তে টি-পট আর কিছু স্ন্যাক্স বিস্কুট । সামনের টেবিলে ট্রে রেখে পার্বতী মাসি চলে গেল । তন্ময় আর কথা না বাড়িয়ে দুটো কচুরি আর কয়েকটা স্ন্যাক্স বিস্কুট চায়ের সাথে তুলে নিল । দেবদত্ত এবার একটু চঞ্চল হয়ে উঠল । উঠে দাঁড়িয়ে বলল – “তন্ময় তুই এবার বিশ্রাম নে । একটা বিশেষ কাজে আমি একটু বেরবো । ফিরতে দেরি হলে ডিনার করে নিস । কিছু মনে করিস না প্লিজ”। দেবদত্তর কাজের তাড়া আছে বুঝতে পেরে তন্ময় বলল – “ঠিক আছে । কাজটা সেরে তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু । দুজনে একসঙ্গে ডিনার করব”।

দেবদত্ত কথা না বাড়িয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । দেবদত্ত চলে গেলে তন্ময় বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল । ও-পাশের ঘর থেকে রত্নপ্রিয়ার পিয়ানোর মিষ্টি সুর হাল্কা ভেসে আসছে । রত্নপ্রিয়ার কথা মনে হতেই তন্ময় কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ল । মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দর, পিয়ানোর হাতও তেমন সুন্দর । প্রথম দেখাতেই ওর প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছে তন্ময় । তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা দুর্বলতা উঁকি দিচ্ছে । কিন্তু তন্ময় এ কি ভাবছে ? রত্না তার বন্ধুর বোন । এ-রকম ভাবনা তার কল্পনায় আসা উচিত নয় । নিজের মনকে শাসন করল তন্ময় । কোথায় দেবদত্তরা আর কোথায় তারা ! বামুন হয়ে চাঁদে হাত ! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ক্লান্ত তন্ময়ের  দুচোখের পাতা বুজে এসেছে তা সে নিজেও জানেনা । হঠাৎ ঘরের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজে তন্ময়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল । দরজার বাইরে থেকে মেয়েলি মিষ্টি কণ্ঠস্বর শোনা গেল – “আসতে পারি”? মেয়েলি কণ্ঠস্বর রত্নপ্রিয়ার বলেই মনে হল । তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে তন্ময় উঠে বসে বলল – “হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন । দরজা ভেজানো আছে”। তন্ময়ের সম্মতি পেয়ে রত্নপ্রিয়া ভেজানো দরজা খুলে ঘরে ঢুকল । ঘরের মৃদু আলোয় তন্ময় অবাক চোখে রত্নপ্রিয়াকে দেখতে লাগল । গাঢ় বেগুনী রঙের তাঁতের শাড়ি, বেগুনী রঙের হাইনেক ব্লাউজ রত্নপ্রিয়ার ফর্সা শরীরে খুব সুন্দর মানিয়েছে । এককথায় অপরূপা লাগছে । রত্নপ্রিয়াই তন্ময়ের ঘোর কাটাল – “কি হল ? অমন করে কি দেখছেন ? বসতে পারি”? তন্ময় সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল – “না না, কিছু না । আপনি একি বলছেন ? আপনাদের বাড়িতে আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন বসবেন কিনা ? নিশ্চয়ই বসবেন । আমার অনুমতির কোন প্রয়োজনই নেই”। রত্নপ্রিয়া মৃদু হেসে তন্ময়ের মুখোমুখি চেয়ারে বসল । দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠল তন্ময় । রাত সাড়ে দশটা । একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তন্ময়ের । এত রাতে একজন সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ের সাথে এক ঘরে বসে গল্প করবে সে ? দেবদত্ত দেখলে কি মনে করবে ? তবে এটা তো সত্যি যে রত্নপ্রিয়াই তার ঘরে এসেছে, সে তো আর রত্নপ্রিয়ার ঘরে যায় নি । তন্ময়ের মনের ভাব কিছুটা বুঝতে পেরে রত্নপ্রিয়া হাসতে হাসতে বলল – “চিন্তার কোন কারণ নেই । কেউ আপনাকে কিছু বলবে না”। রত্নপ্রিয়ার কথায় তন্ময় খানিকটা বিস্মিত না হয়ে পারল না । তবে ও যা বুদ্ধিমতী আর চালাক তাতে ওর পক্ষে যে কোন মানুষকে বুঝে নিতে অসুবিধা না হবারই কথা । রত্নপ্রিয়ার কথায় কিছুটা আস্বস্থ হয়ে আমতা আমতা করে বলল – “না না, ঠিক তা নয়”। রত্নপ্রিয়া বলল – “দাদাভাইয়ের কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি । এবার নিজের চোখে দেখবার সৌভাগ্য হল”। রত্নপ্রিয়ার কথা শুনে তন্ময় বেশ অবাকই হল । দেবদত্ত তাহলে তার কথা বাড়ির সবাইকেই বলেছে ।  তন্ময় বলল – “আপনাকে দেখার সৌভাগ্য আমারও হল । আপনি পড়াশুনা করেন নিশ্চয়ই”? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রত্নপ্রিয়া উদাসী কণ্ঠে বলল – “পড়তাম, কিন্তু পড়া আর হল কই”! তন্ময় বলল – “কাকাবাবু কি মেয়েদের বেশি লেখাপড়া পছন্দ করেন না”? রত্নপ্রিয়া ঘাড় নেড়ে চটজলদি বলল – “না না, বাবা এ ব্যাপারে খুব প্রগ্রেসিভ”। তন্ময় বলল – “তবে”? হঠাৎ নিজেকে শান্ত করে ঘাড় নিচু করে রত্নপ্রিয়া বলল – “থাক এখন ওসব কথা । পরে সব শুনবেন”। রত্নপ্রিয়া লেখাপড়ার ব্যাপারে কিছু বলতে চাইল না দেখে তন্ময় প্রসঙ্গ পালটে বলল – “আপনি খুব ভাল পিয়ানো বাজান”। রত্নপ্রিয়া বলল – “ভাল বাজাই কিনা জানিনা তবে পিয়ানোর সুর আমার খুব ভাল লাগে । আমাকে পাগল করে দেয় । তাই এটাকে এখনও ছাড়তে পারিনি”। তন্ময় জিজ্ঞাসা করল – “আপনাদের এখানে পিয়ানোর টিচার আছে”? তন্ময়ের মুখ থেকে প্রশ্নটা শুনে  মুখে কিছু বলল না রত্নপ্রিয়া । শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার । তার বেদনার্ত চোখ দুটো তন্ময়ের মুখের দিকে নিবদ্ধ হল । রত্নপ্রিয়ার অবয়বে পরিবর্তন লক্ষ্য করল তন্ময় । হঠাৎ কি হল রত্নপ্রিয়ার ? তন্ময় ভেবে পেল না এরকম সাধারন কথোপকথনে রত্নপ্রিয়ার এরকম পরিবর্তন হল কেন ? পরিস্থিতি হালকা করার জন্য তন্ময় একটু সাহসে ভর করে বলল –“পিয়ানো বাজিয়ে যদি একটু শোনান খুশি হব” ।  রত্নপ্রিয়া বলল – “এখন থাক । পরে শুনবেন । ঘড়ি দেখেছেন ? রাত পৌনে এগারোটা বাজে । এখন খেতে চলুন । মা আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাবার জন্য”। চোখে মুখে জল দিয়ে রত্নপ্রিয়াকে অনুসরন করে তন্ময় একতলার ডাইনিং রুমে গিয়ে উপস্থিত হল । বিশাল ডাইনিং রুম । ঘরের মাঝখানে শ্বেতপাথরের বিরাট বড় ডাইনিং টেবিল । তার চারপাশে পুরনো আমলের বেশ কয়েকটি চেয়ার । তন্ময়কে দেখে দেবদত্তর মা বললেন – “বাবা বসো । অনেক রাত হল, খেয়ে নাও”। কিন্তু  দেবদত্ত ছাড়া তন্ময় কি করে ডিনার করবে ? আর তা ছাড়া সে দেবদত্তকে বলেও দিয়েছে এক সাথে তারা দু’জনে ডিনার করবে । বাধ্য হয়েই তন্ময় বলল – “কাকিমা, আমি আর দেবা এক সাথেই বসবো”। দেবদত্তর মা বললেন – “দেবা একটা জরুরী কাজে একটু দূরে গিয়েছে । ফিরতে অনেক রাত হবে । তুমি খেয়ে নাও বাবা । সারাদিন পথের যা ধকল গিয়েছে । কাল একসাথে খেও”। কাকিমার কথা শেষ হতে না হতেই পার্বতী মাসি থালা সাজিয়ে খাবার নিয়ে এল । দেরাদুন রাইসের ফ্রাইডরাইস, মাটন-কষা, ইলিশ মাছের ঝাল, পাবদা মাছের টক আর তার সাথে বিভিন্ন রকমের তরিতরকারি, নানা রকমের মিষ্টি । কাকিমার কাছে কোন জোরাজুরি, ওজর-আপত্তি খাটল না । দেবদত্তকে ছাড়াই তন্ময়কে খাবার টেবিলে বসতে হল । খাবারের পরিমান দেখে তন্ময়কে বলতেই হল – “কাকিমা এত খাবার কি করে খাব”? কাকিমা সস্নেহে বললেন – “খাও বাবা, আস্তে আস্তে খাও । ঠিক খেতে পারবে । এই বয়সে খাবে না তো কবে খাবে”? এরপর রত্নপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেবদত্তর মা বললেন – “রত্না দেখিস তন্ময়ের কিছু লাগবে কি না । আমি একটু রান্নাঘরে যাচ্ছি”। তন্ময় বলল – “না না কাকিমা, আমার আর কিছু লাগবে না । এই খাবারই আমি খেতে পারব না । কিছুটা কমালে ভাল হত”। “আগে শুরুতো করো, তারপর দেখা যাবে”- কথাটা বলেই কাকিমা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন । কি আর করা যাবে ? অগত্যা তন্ময় খেতে শুরু করল । খাবার খেতে খেতে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। এত সুন্দর রান্না ? এরকম সুস্বাদু খাবার জীবনে সে কখনও খায়নি । ধীরে ধীরে সব খাবারই শেষ করে ফেলল তন্ময় । হাত-মুখ ধুয়ে কাকিমাকে বিদায় জানিয়ে রত্নপ্রিয়াকে অনুসরণ করে তন্ময় তার জন্য নির্দিষ্ট করা ঘরে চলে এল । রত্নপ্রিয়া তাকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল । দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই তন্ময় চমকে উঠল । বারোটা বেজে পনেরো মিনিট । এত রাত হয়ে গেল কিন্তু দেবদত্ত তো এখনও ফিরল না । দেবদত্তর এ-হেন আচরনে তন্ময় বেশ ক্ষুব্ধ হল । দেবদত্তর চিঠি পেয়েই তো সে তার বাড়িতে এসেছে । অথচ ডিনারের টেবিলেও সে সঙ্গ দিতে পারল না ! কিন্তু এটাই বা কেন করবে সে ? তন্ময় ভাবল নিশ্চয়ই তার নিজের কোথাও ভুল হচ্ছে । জরুরী কাজে দূরে যাবার জন্যই হয়তঃ ফিরতে রাত হচ্ছে । রাতে দেখা না হলেও সকালে তো দেখা হবেই । সারাদিন যা ধকল গেছে তাতে তন্ময় খুবই ক্লান্ত ।  বিছানায় শুয়ে গা এলিয়ে দিতেই তার দু’চোখের পাতায় নেমে এল গভীর ঘুম ।

রাত তখন বেশ গভীর । হঠাৎ একটা আওয়াজে তন্ময়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল । তার ঘরের দরজায় নকিং-এর শব্দ । তন্ময় ধড়মড় করে উঠে বসল । এত রাতে তার দরজায় কে নকিং করছে ? দেবদত্ত ছাড়া এই সময়ে আর কে আসবে ? এখনই হয়ত সে ফিরেছে । তবুও কনফার্মড হবার জন্য তন্ময় জোরে জিজ্ঞাসা করল – “কে ? কে”? দরজার অপর প্রান্ত থেকে এক মহিলা কণ্ঠের ফিসফিসানি উত্তর তন্ময়ের কানে এল – “ দরজাটা তাড়াতাড়ি খুলুন । আমি রত্নপ্রিয়া”। তন্ময় একটু অবাকই হল । এত রাতে রত্নপ্রিয়া তার কাছে কেন ? একটু ঢোক গিলে তন্ময় বলল – “এত রাতে কি ব্যাপার বলুন তো”? ফিসফিস করে রত্নপ্রিয়া ও-প্রান্ত থেকে বলল
– “খুলুন না দরজাটা, আপনার সাথে খুব জরুরী কথা আছে”।  এত রাতে কি কথা থাকতে পারে রত্নপ্রিয়ার ? অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই তো ওর ? তন্ময় ভাবল বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসে সে কোন স্ক্যানডালে জড়িয়ে পড়ছে না তো ? আর দেবদত্ত এ-সব জানতে পারলে সে-ই বা কি ভাববে ? তন্ময় ভেবে চিন্তে কোন কুল কিনারা করে উঠতে পারলনা এই মুহূর্তে সে কি করবে ? একটু ইতস্ততঃ ভাবে বলল – “কিছু বলার থাকলে কাল সকালে বলবেন”। তন্ময়ের কথা শেষ হতে না হতেই রত্নপ্রিয়া বলল – “না-না, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না । এখনই আমাকে বলতে হবে । আপনার কোন ভয় নেই, দরজা খুলুন প্লীজ”।  রত্নপ্রিয়ার কথা শুনে তন্ময় বিস্মিত হল । এমন কি জরুরী কথা যে তাকে এখনই বলতে হবে ? তন্ময় ভেবে পায় না সে এখন কি করবে ? কিন্তু রত্নপ্রিয়া যে ভাবে অনুরোধ করছে তাতে সে দরজা না খুলেও পারল না । অনিচ্ছা স্বত্বেও তন্ময় দরজা খুলতেই রত্নপ্রিয়া চুম্বক গতিতে ঘরে ঢুকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল । রত্নপ্রিয়ার পরনে সেই একই পোশাক । বেগুনি রঙের তাঁতের শাড়ি আর একই রঙের হাইনেক ব্লাউজ । কিন্তু তার চেহারা খানিকটা বিধ্বস্ত লাগছে, অনেক মলিন দেখাচ্ছে । দু’চোখে রাত জাগার কালিমা । তার আচরণেও ব্যাতিক্রম লক্ষ্য করল তন্ময় । এ রত্নপ্রিয়া যেন কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা রত্নপ্রিয়া নয় । তন্ময় থতমত খেয়ে বলল – “কি ব্যাপার বলুন তো ? কি হয়েছে আপনার ? এত রাতে আমার ঘরে আসা কি আপনার খুবই প্রয়োজন ছিল ? আমাদের উভয়ের পক্ষে কি এটা মঙ্গলজনক হবে”? তন্ময়ের সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রত্নপ্রিয়া শুধু বলল – “না না, আপনার মঙ্গলের জন্যই এত রাতে আপনার ঘরে আমাকে ঢুকতে হল । আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত”।  তন্ময় বলল – “না না, ঠিক আছে । বলুন কি বলতে চান”? রত্নপ্রিয়া বলতে শুরু করল – “ দু’বছর আগে আমি উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে বি,এ,-তে ভর্তি হয়েছিলাম । পড়াশোনা করছিলাম ঠিকই কিন্তু গানবাজনাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করত । এ-ব্যাপারে বাবা আমাকে সাহায্য করেছিলেন, উৎসাহও যুগিয়েছিলেন । ছোটবেলা থেকে গান শিখেছি । কলেজে ভর্তি হবার পর শখ হল পিয়ানো বাজনা শেখার । বাবাকে জানালাম সে কথা । বাবা কলকাতা থেকে আমার জন্য পিয়ানো আনালেন । মাষ্টারও ঠিক করে দিলেন পাড়ার এক কাকু । মাষ্টার হিসাবে তাপস বেশ ভালই ছিল । সপ্তাহে একদিন কলকাতার এক নামী গানের স্কুলে পিয়ানো শেখাতো । তাপস ছিল খুবই হ্যান্ডসাম । কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম । তখন আমি তাপসের জন্য পাগল । ওর জন্য সব কিছু করতে পারি । কলেজ পালিয়ে লুকিয়ে ওর সাথে বাইরে দেখাও করতাম । আমার আর তাপসের ব্যাপারটা দাদা কিছুটা বুঝতে পেরেছিল । এই নিয়ে দাদার সাথে কথা কাটাকাটিও হয়েছিল । একদিন দাদা আমার উপর রেগে গিয়ে বলল – “ভুলে যাস না রত্না তুই কোন বংশের মেয়ে । তাপস তোর মাষ্টার । ঐ পর্যন্ত থাকাই ভাল । এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবা উচিৎ নয়”। আমি বিনীত ভাবে দাদাকে বললাম – “তুই কি বলতে চাইছিস দাদা”? দাদা ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠে বলল – “আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা বোঝার মত যথেস্থ বয়েস হয়েছে তোর । আমি গতকাল তোর ঘরের পাশ দিয়ে ছাদে যাবার জন্য যাচ্ছিলাম । হঠাৎ তোর ঘরের দিকে চোখ পড়তেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । দরজার পর্দার আড়াল থেকে যা দেখেছি সেটা দাদা হয়ে তোকে না বলাই ভালো”। দাদার কথাকে গুরুত্ব দিলে সমস্যায় পড়ব ভেবে একটু চড়া সুরে বললাম – “দাদা, একদম বাজে কথা বলবি না”। আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই দাদা বলে উঠল – “রত্না, তোকে সাবধান করে দিচ্ছি । কথাটা বাবার কানে গেলে তোর পিয়ানো শেখা তো বন্ধ হবেই, কলেজে পড়াও চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যাবে । সেটা কি তুই চাস”? বাধ্য হয়ে আমি বললাম – “বেশি বকিস না । নিজের চরকায় তেল দে। এরপর আর কোন কথা না বলে দাদা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল”।  

রত্নপ্রিয়ার কথা শুনতে শুনতে তন্ময় ভেবে পাচ্ছিল না রত্নপ্রিয়া তাদের পারিবারিক কাহিনী এত রাতে তাকে কেন শোনাচ্ছে ? এ-সব জেনে তার কি লাভ ? তন্ময় বাধা দিয়ে রত্নপ্রিয়াকে বলল – “এ-সব কথা শোনাবার সময় তো পরেও পাওয়া যেত । এই গভীর রাতে আপনার কথাগুলো অন্য কেউ শুনতে পারে । সেটা কি খুব ভাল হবে ?” তন্ময়ের কথায় রত্নপ্রিয়া একটু রুষ্ট হল । সে আরও গলা চড়িয়ে বলল – “ না না, আপনাকে ধৈর্য ধরে এখনই আমার কথা শুনতে হবে । পরে আমি আর সময় পাব না”।  রত্নপ্রিয়াকে কিছুতেই থামানো গেল না । সে আবার বলতে শুরু করল – “পাপ করলে তো ফল ভোগ করতেই হবে । তাপস ছাড়া সারা দুনিয়া তখন আমার কাছে অন্ধকার । বাবা, মা, প্রানাধিক দাদাও তখন আমার কাছে তুচ্ছ । গ্রামে কোন খবর চাপা থাকে না । দাদা কথাটা বাবার কানে না তুললেও যেভাবেই হোক বাবা ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিলেন । বাবা রাশভারী মানুষ । কথা খুব কম বলেন । একদিন নিজের ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন । সেখানে মাও উপস্থিত ছিলেন । গুরুগম্ভীর স্বরে বাবা বললেন – “তোমাকে আমি যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিলাম । পারিবারিক প্রথা ভেঙ্গে কলেজে পাঠিয়েছিলাম । পিয়ানো শিখতে চেয়েছিলে, তারও অনুমতি দিয়েছিলাম । তাই বলে তুমি স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারো না”। মাথা নিচু করে আমি বাবাকে বললাম – “আমি কি করেছি বাবা ?” এবার মুখ খুললেন মা । রাগতস্বরে বললেন – “জান না, তুমি কি করেছ ? এ-বাড়ির মান-মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছ । গ্রামের মানুষ-জনের কাছে তোমার জন্য মুখ দেখানো দায়”। মা এবার বাবার দিকে তাকিয়ে
-১৮-      বললেন – “তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম মেয়েকে আর কলেজে পাঠাতে হবে না । ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দাও । তুমি আমার কথা কানেই নিলে না । মেয়ে বায়না ধরল পিয়ানো শেখার, রাজি হয়ে গেলে । বংশের প্রথা ভেঙ্গে পুরুষ মাষ্টার রাখলে । এখন বোঝো ঠেলা”। মায়ের কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাবা বললেন – “আমি বুঝতে পারিনি । রত্না আমাদের বংশের মুখে এভাবে চুনকালি মাখাবে”। মা বললেন – “তাপসকে কালই বিদায় করো । তাড়াতাড়ি ভালো পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও”। বাবা বাকরুদ্ধস্বরে  বললেন – “হ্যাঁ, তাই হবে । কিন্তু এসব কথা জানাজানি হলে ভালো পাত্র পাবো ভেবেছ ?”  বাবা-মায়ের কথাগুলো আমার কাছে ছিল ভীষণ হৃদয়-বিদারক । কারণ তাপসকে যে আমি অন্তর থেকে ভালবেসে ফেলেছিলাম । সেটাকে মিথ্যে করব কিভাবে ? আমার দু’চোখে তখন জলের ধারায় চোখের পাতাদুটো ভারী হয়ে উঠেছে । কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললাম – “না বাবা, আমার কলেজে যাওয়া তুমি বন্ধ কোরোনা । ভালবাসা কি পাপ ? আমি তাপসকে ভালবাসি । ওকে ছাড়া আর কাউকে আমি বিয়ে করতে পারব না”। বাবা আমার কথা শুনে ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন । তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “আমার মুখের উপর এত বড় কথা বলতে পারলে ? রায় চৌধুরী বংশের মেয়ে হয়ে তুমি পিয়ানোর মাষ্টার তাপস মণ্ডলকে বিয়ে করবে ?” বাবার কথায় আমার জেদ বেড়ে গেল । আমি বললাম – “বাবা, বংশ-জাতে কি এসে যায় ? মনুষ্যত্যই মানুষের বড় পরিচয়”। বাবা চিৎকার করে বলে উঠলেন – “চুপ করো তুমি । এত বড় সাহস তোমার ?” কথা আর শেষ করতে পারলেন না বাবা । বুকে হাত দিয়ে চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরলেন”। মায়ের চিৎকারে দাদা ছুটে এল । বাবার ডাক্তার-বন্ধু পাশের গ্রামের মৃত্যুঞ্জয় কাকুকে ফোনে খবর দেওয়া হল । তিনি এসে পরীক্ষা করে বাবাকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন । হার্ট অ্যাটাক । মা আমাকে যৎপরোনাস্তি শাপ-শাপান্তর করে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন । বাবার মৃতদেহ নিয়ে সকলে ব্যস্ত । ঘণ্টাখানেক কেটে গেল । মায়ের দেখা নেই । মায়ের খোঁজ করতে গিয়ে দোতলার কোণের ঘরে মায়ের নিঃস্প্রান দেহ আবিষ্কার করল পার্বতী মাসি । ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে মা-ও সেই দিনই চিরবিদায় নিলেন ।

রত্নপ্রিয়ার কথা শুনতে শুনতে তন্ময়ের হাত-পা অবশ হয়ে আসছে । এ-সব কি বলছে রত্নপ্রিয়া ? ওর কি মাথা খারাপ ? এই তো সন্ধ্যা বেলায় ওর বাবার সাথে দেখা হল । মায়ের সাথে কত কথা হল । রাতে কত সুন্দর খাবার খাওয়ালেন । রত্নপ্রিয়ার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ । না হলে এত অবিশ্বাস্য কথা গল্প করে এ-ভাবে এত রাতে বলতে আসে ? তন্ময় রত্নপ্রিয়াকে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করল – “ঠিক আছে । আপনার আরও কথা থাকলে কাল সকালে শুনব । আমার শরীরটা খারাপ লাগছে”। তন্ময়ের কথা কানেই গেল না রত্নপ্রিয়ার । সে বলেই চলল – “আমার ভালবাসার মানুষের সুন্দর চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত রূপটা ধীরে ধীরে টের পেলাম । বাবা-মায়ের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমার গর্ভে তাপসের সন্তান । শত চেষ্টা করেও ওকে ফোনে ধরতে পারলাম না । অনেক কষ্টে একদিন তাপসের সাথে দেখা করলাম । সমস্ত ঘটনা তাকে জানালাম । কিন্তু যে ভালবাসার মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম, যার প্রতি আস্থা রেখেছিলাম, সে সব অস্বীকার করল । আমি তখন দিশেহারা । কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না । সপ্তাহখানেক পর সংবাদ পেলাম বিষধর সাপের ছোবলে তাপস মারা গেছে । একেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে । এদিকে দাদাও আমার শরীরের পরিবর্তনের ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল । এটা তো সত্যি, বাবা-মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী । আমার খোঁজ-খবর ঐ পার্বতী মাসিই যা রাখত । গত বছর এই দিনে সন্ধ্যায় দাদা মাসিকে নিয়ে বাজার থেকে বাড়ির গাড়িতে ফিরছিল । বাড়ির সামনে রাস্তার বাঁকে একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিছন থেকে সজোরে গাড়িটাকে মারে । ওদের দু’জনের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে । স্পট ডেড”। রত্নপ্রিয়ার কথা শুনতে শুনতে তন্ময়ের হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে গিয়ে ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়তে লাগল । তন্ময় কাঁপা কাঁপা বলল – “এ-সব আপনি কি বলছেন ? এটা অসম্ভব । দেবদত্ত কয়েকদিন আগেই এখানে আসার জন্য আমাকে চিঠি দিয়েছে । চিঠিটা আমার কাছেই আছে”। রত্নপ্রিয়া বলল – “তন্ময়দা, চিঠির তারিখটা আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেন নি । দেড় বছর আগে লেখা চিঠি । কলেজ যাবার পথে চিঠিটা আমিই পোস্ট করেছিলাম । যে কোন কারনেই হোক চিঠিটা আপনার কাছে অনেক দেরীতে পৌঁছেছে”।

রত্নপ্রিয়ার কথায় তন্ময়ের টনক নড়ল । সত্যিই তো চিঠির তারিখটা সে দেখেনি । তন্ময় তাড়াতাড়ি তার ব্যাগ থেকে দেবদত্তর লেখা চিঠিটা বার করল । চিঠির তারিখ দেখে তন্ময় অবাক ।  রত্নপ্রিয়া ঠিকই বলেছে । চিঠিটা সে দেড় বছর পরে পেয়েছে । তন্ময়ের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল ।  সে নিজে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না । ভীষণ নার্ভাস লাগছে ।  কিন্তু এ-রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলানো ছাড়া কোন উপায় নেই । কোন রকমে কাঁপা গলায় সে রত্নপ্রিয়াকে জিজ্ঞাসা করল – “আচ্ছা, এ-বাড়িতে কি আপনি একাই থাকেন ?” রত্নপ্রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটু থেমে বলল – “হ্যাঁ” । কথাটা বলেই সে  চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ।  তার শাড়ির আঁচল ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল । কোনোরকমে আঁচল সামলাতে সামলাতে সে তন্ময়কে বলল – “একটা কথা বলছি, মনে কিছু করবেন না । ভোর হবার আগেই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন । তা না হলে চিরদিনের মত বন্ধুর কাছেই থেকে যেতে হবে”। রত্নপ্রিয়ার কথায় তন্ময় ভীষণ ভয় পেয়ে গেল । এখন সে কি করবে ? এই গভীর রাতে অজানা অচেনা জায়গায় বেরিয়ে সে কোথায় যাবে ? তার শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । এখন রত্নপ্রিয়ার সাহায্য ছাড়া সে যে কিছুই করতে পারবে না । এবার রত্নপ্রিয়া তন্ময়কে প্রায় আদেশের সুরে বলল – “এখানে একা না থেকে আমার ঘরে চলুন”। কথাটা বলেই রত্নপ্রিয়া দ্রুত গতিতে তার ঘরের দিকে এগিয়ে চলল । তন্ময় বিছানা ছেড়ে উঠে মন্ত্রমুগ্ধের মত রত্নপ্রিয়াকে অনুসরণ করল । বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রত্নপ্রিয়া তার ঘরের দরজার কাছে গিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল । তন্ময় ভাবল রত্নপ্রিয়া নিশ্চয়ই তার ঘরে ঢুকে গিয়েছে । তন্ময় রত্নপ্রিয়ার ঘরের দরজার সামনে আসতেই হঠাৎই দরজাটা একটু নড়েই খুলে গেল । আচমকা একটা দমকা হাওয়া এসে দরজার পর্দাটা সরিয়ে দিল । পর্দাটা সরতেই যে দৃশ্য তন্ময় দেখল তাতে তার হাড় হিম হয়ে যাবার যোগাড় । সে পরিস্কার দেখতে পেল ঘরের কড়িকাঠ থেকে রত্নপ্রিয়ার দেহটা ঝুলছে । জিভ অনেকটা বেরিয়ে এসেছে । চোখদুটো বিস্ফারিত । মুহূর্তের মধ্যেই রত্নপ্রিয়ার দেহটা অদৃশ্য । ঘরের পিয়ানোটা টুং টাং আওয়াজ তুলে বেজে উঠল । তন্ময়ের সারা শরীরে তখন রীতিমত কাঁপুনি দিচ্ছে । দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্ত-স্রোত শীতল থেকে শীতলতম হয়ে আসছে । লোমকুপগুলো খাঁড়া হয়ে উঠছে । গলা শুকিয়ে কাঠ । গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না । চিৎকার করে কাউকে ডাকতেও পারছে না । নিঝুম রাতে বিশাল বাড়িটাও তখন নিঝুম । তন্ময়ের মনে হল বাড়িতে কেউ কোথাও নেই । চারিদিক অন্ধকার । দিকবিদিক শূন্য তন্ময় সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগালো । কোনরকমে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে জোরে দৌড়তে লাগলো সে । সামনের সদর দরজা বন্ধ । প্রাণপণ শক্তিতে পাঁচিল টপকে ছুটতে লাগল তন্ময় । শরীরের রক্ত হিম, তবুও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল ।  পিছন থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে সে – “তন্ময় যাস না । আমায় ছেড়ে যাস না”। তারপরই রত্নপ্রিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে এল – “ভয় নেই, ভয় নেই”। তন্ময় তখন মরিয়া । আর পিছনে তাকানো নয় । সামনের রাস্তা দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে সে ছুটছে । দিকভ্রান্ত হয়ে কোনদিকে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, সে নিজেই জানেনা । ছুটতে ছুটতে একসময় পরিশ্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তন্ময় ।

পরদিন ভোরে কয়েকজন বয়স্ক লোক প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে দেখেন রাস্তার ধারে ঝোপের পাশে এক অ-পরিচিত যুবক অ-চৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে । পরনে স্যানডো গেঞ্জি আর পা-জামা । বয়স্কদের মধ্যে একজন ডাক্তার ছিলেন । তিনি পরীক্ষা করে দেখে অন্যান্যদের বললেন – “এখনও বেঁচে আছে”। অন্য একজন বললেন – “দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের ছেলে । কিন্তু এই পোশাকে এখানে ! রায় চৌধুরী বাড়ির কীর্তি নয় তো”? তন্ময়কে ধরাধরি করে তাঁরা ডাক্তার ভদ্রলোকের বাড়িতে নিয়ে গেলেন । ডাক্তার বাবুর চেষ্টায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তন্ময়ের জ্ঞান ফিরল ।  কিন্তু তন্ময় এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে কিছুটা সুস্থ হতে আরও দু’দিন লেগে গেল । সুস্থ হওয়ার পর ডাক্তার বাবু তার পরিচয় এবং সেদিনের ঐ পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলেন । তন্ময় তার পরিচয় দিয়ে প্রথম থেকে সেদিনের সমস্ত ঘটনা ডাক্তার বাবুকে বলতেই ডাক্তার বাবু চমকে উঠলেন । অবাক দৃষ্টিতে তন্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন – “বাপরে বাপ, তুমি খুব বাঁচা বেঁচে গেছো”। ডাক্তার বাবু এক গ্লাস জল খেয়ে নিলেন । তারপর বলতে শুরু করলেন – “ তোমাকে যেখান থেকে উদ্ধার করেছি সেখান থেকে ঐ বাড়িটার দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার । এর মানে তুমি এতটা পথ প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়েছ । মানসিক এবং শারীরিক – উভয় দিক দিয়েই ক্লান্ত ও বিধ্বস্থ হওয়ার জন্যই তুমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারোনি । শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে । এ-রকম পরিস্থিতিতে পড়লে অবশ্য সবারই তোমার মত দশা হবে । এই দেউলটি গ্রামের কোন লোকই সন্ধ্যার পর ঐ বাড়ির ত্রি-সীমানায়  যায় না । অনেকেই নাকি ভয় পেয়েছে । এ-সব ঘটনার বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন হলেও এটা সত্যি যে দেবদত্তর মৃত্যুর দিনই রত্নপ্রিয়া গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে । এখানে ওদের নিকট আত্মীয় কেউ ছিল না । তমলুক থেকে দেবদত্তর এক কাকা এসে পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে সব কাজ-কর্ম সমাধা করে চলে যান । তারপর তাদের কেউই আর ওই বাড়িতে আসেনি । তুমিই অলৌকিক ভাবে চলে এসেছ । তবে এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে ওদের প্রত্যেকের আত্মা ঐ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে”।  ডাক্তার বাবুর কথা শুনতে শুনতে তন্ময়ের মনে হল তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ খাঁড়া হয়ে উঠছে । কিন্তু না, আর নয় । মনকে ধীরে ধীরে শান্ত করবার চেষ্টা করল সে । প্রিয় বন্ধুর কথা মনে পড়তেই তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল । কিন্তু বাস্তবকে তো মেনে নিতেই হবে । পরদিন ডাক্তার বাবু ফোন করে তন্ময়ের বাবা-মাকে ডেকে তন্ময়কে তাঁদের হাতে তুলে দেন ।  ডাক্তার বাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারা তন্ময়কে নিয়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন । এই ঘটনার পর তন্ময় এতটাই মানসিক আঘাত পেয়েছিল যে তাকে বেশ কিছুদিন সাইক্রিয়াটিসটের চিকিৎসাধীনে থাকতে হয় ।।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৭০৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • মোবারক হোসেন ০৮/০৬/২০১৫
    ভৌতিক মানেই রোমান্স! ধন্যবাদ
  • অভিজিৎ ব্ড়ুয়া ০৬/০৩/২০১৫
    চ্মৎকার।
  • জাহিদুর রহমান ১১/০২/২০১৫
    Onak boro tai porta kosto holo tobe valo lagce
    • জয়শ্রী রায় ১১/০২/২০১৫
      সত্যিই গল্পটা বেশ বড় । পড়তে বেশ সময় লাগবে । তবে গল্পের শেষ দিকের রোমাঞ্চ অনুভব করতে ভুলবেন না যেন । শুভেচ্ছা রইল ।
  • রূপক বিধৌত সাধু ০৪/০২/২০১৫
    ভালো লাগলো ।
  • Tapan Kumar Patra ০৪/০২/২০১৫
    Darun sundur likha hacha valo daru sundur
  • Biplob ০৩/০২/২০১৫
    I like it sis
 
Quantcast