www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

চুমুর চুমুক আর আন্দোলন

এক প্রবীণ সাংবাদিক ‘প্রকাশ্যে চুম্বন গ্রেফতারযোগ্য অপরাধ’ প্রসঙ্গে ইমমরাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট-এর প্রসঙ্গ এনে লিখেছেন, “দেশের আইন মোতাবেক প্রকাশ্যে যৌনক্রিয়াকলাপের অপরাধে তারাও অপরাধী সাব্যস্ত হবেন।” তিনি নিশ্চয়ই জানেন, ইমমরাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। “ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমু খাওয়া যৌনক্রিয়ার অঙ্গ’, এটা কোন আইনে আছে? আইন কিন্তু বলছে, বড়জোর প্রকাশ্যে ব্যক্তিগত আবেগের প্রদর্শণ রোধ আইনে গ্রেফতার করতে পারে, কিন্তু তা জামিনযোগ্য। কেরালায় ৫০ জনকে তাই গ্রেফতার করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রকাশ্যে নগ্নতা প্রদর্শণও তো দণ্ডযোগ্য অপরাধ। সেই সাংবাদিক কি মনিপুরের সেই মায়েদের গ্রেফতার দাবী করছেন? তাই প্রশ্ন, মানুষের জন্যে আইন হবে, না আইনের জন্য মানুষ? আইন অমান্য করেই তো আন্দোলন হয়। সেদিন যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশ্যে চুমু খেয়ে তো আন্দোলনই করেছেন। স্লোগান দিয়েছেন, ‘আমার শরীর আমার মন/ দূর হঠো রাজশাসন’। প্ল্যাকার্ডে কবীর সুমনের গানের লাইন “বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি/ আমি তোমাকেই চাই’। অর্থাৎ, মেয়েরা নিজেদের শরীরের উপর নিজেদের অধিকারের দাবিটাও একসঙ্গে তুলছে। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধ্বনী। তাকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা কেন?
এই আন্দোলন দিল্লি সহ ভারতের আরও কিছু রাজ্যে হয়েছে। সেখানে এ-নিয়ে কোনও হৈ-চৈ নেই। এই রাজ্যে এক মন্ত্রীর নাকি ‘মাথা লজ্জায় হেঁট’ হয়েছে। চুমুর রগরগে ছবি ছেপে শাসক দলের পদলেহী একটি পত্রিকা লিখেছে “প্রকাশ্যে চুম্বন! বঙ্গ সংস্কৃতি চুরমার করলো যাদবপুরের ছাত্র ছাত্রীরা”। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন “এটা কোনও প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। কুরুচির পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়।” একদা বিপ্লবী অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “আন্দোলনের স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেললে এরকমই হয়।”
উল্লেখ্য, এটি ছিল কিছু ঘটনার প্রতিবাদে দেশ জোড়া আন্দোলন। ‘অ্যাকশন’ নয়, ‘রিঅ্যাকশন’। স্টিং অপারেশনের নামে কিছু দিন আগে কেরালার এক পার্কিং স্পেসে দুই তরুণ-তরুনীর চুম্বনদৃশ্য টিভিতে সম্প্রচারের পর। ‘ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত ঠিকাদার’ আরএসএস একটি ক্যাফেতে হামলা চালায়। তারই প্রতিবাদে দোসরা নভেম্বর কোচির ছাত্রছাত্রীরা মেরিন ড্রাইভে ‘কিস অফ লাভ’ আন্দোলন করেন। সেদিন কিন্তু চুমু খাওয়া ঠেকাতে নিজেদের বিরোধ ভুলে একজোট হয় জুজুধান হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান সংগঠনগুলি। তার ক’দিন আগেই কলকাতায় স্টার থিয়েটার কর্তারা ১৭ বছর বয়সী এক দর্শককে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা স্কার্ট পড়ার জন্য জনসমক্ষে গালমন্দ করে। বলে তার পোশাক নাকি ‘দৃষ্টিকটূ’।
কেরালার ঘটনায় আইন নিজেদের হাতে নেওয়ার অধিকার কে দিল আরএসএসকে? তখন কোথায় ছিলেন সমাজবিজ্ঞরা? শীর্ষেন্দুবাবু, মন্ত্রীমহোদয় বা চুমু আন্দোলনের বিরোধীরা তার প্রতিবাদ করেন নি। ২৩ অক্টোবর মহারাষ্ট্রে উচ্চবর্ণের মেয়েকে ভালবাসার অপরাধে এক দলিত যুবককে পুড়িয়ে মারা হয়। তার আগেই ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কের বিরুদ্ধে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে বিজেপি-র ছাত্র শাখা এবিভিপি। দেশে প্রতি মাসে ‘অনার কলিং’ এর নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। খাপ পঞ্চায়েত ছড়ি ঘোরাচ্ছে আর ‘লাভ জেহাদ’-এর মিথ্যে অজুহাতে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ ছড়ান হচ্ছে। এ-সবের বিরুদ্ধে চুমুর আন্দোলন তাই ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় মৌলবাদী হস্তক্ষেপের সোচ্চার প্রতিবাদ।
উল্লেখ্য, ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময় বিটলস-এর জন লেনন প্রকাশ্যে উলঙ্গ হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “যৌন সঙ্গম করো, কিন্তু যুদ্ধ করো না।” সেই ঘটনাকে কি নিন্দা করবেন শীর্ষেন্দুবাবু,মন্ত্রী বা সেই প্রবীণ সাংবাদিক। আসলে প্রতিবাদের ধরণ ঠিক করে প্রতিবাদীরাই, অন্যরা নন। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের সশস্ত্র প্রতিবাদ আজ হলে দেশবাসী তাকে বলবে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলবেই। সেদিন বলত দেশপ্রেম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের ধরণও পাল্টায়। শর্মিলা চানু গান্ধিজীর ধরণে অনশন করে ১৫ বছর আছেন, শীর্ষেন্দুবাবুর কলম তা নিয়ে কতবার গর্জেছে? ব্রাত্যজনের নাটকে চানুর চরিত্র ক’বার এসেছে?
মন্ত্রী বলেছেন, প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ায় তার ‘মাথা হেট হয়ে গেছে’। ‘অহো কী আনন্দ!!’ ইডেনে শাহরুখ একবার মুখ্যমন্ত্রীর ডান হাতে আর আরেকবার ঘেমো শরীরে মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে ও মাথায় চুমু খান। সেদিন এই মন্ত্রীর মাথাটা নিশ্চয় উঁচু হয়েছিল? সাহস থাকলে প্রকাশ্যে বলুন। ঊর্দিপড়া মহিলা পুলিশকে শাহরুখ খান কোলে তুলে নিলেও সরকার চুপ থাকে এবং 'ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর' করেই রাখে। ধর্ষকরা সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত পায়। শাসক দলের ছাত্র নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়ন রুমে মদ খেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ছবির সামনে আর্ধ-উলঙ্গ হয়ে নাচে। আরেক নেতা বর্ষবরণে যৌনউত্তেজক ক্যাবারে ডান্স করান। এক সাংসদ প্রকাশ্যে ‘ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করে দেব’ বলে হুঙ্কার দেন। সেই সরকারের মন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের অধিকার নেই।
সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের মুখেও ভারতীয় সংস্কৃতির কথা অসহ্য। প্রকাশ্য মঞ্চে এক বিশিষ্ট শিল্পপতিকে চুমু খান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি সাংসদ ধর্মেন্দ্রকে প্রকাশ্যসভায় চুমু খান তৎকালীন বিজেপি নেতা রাম জেঠমালানি। উমা ভারতী জনসভা মঞ্চে বিজেপি নেতা লালজি ট্যান্ডনকে চুমু খান। এগুলি ভারতীয় সংস্কৃতির উজ্জ্বল নিদর্শণ, তাই তো? বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মাতা অমৃতানন্দময়ী ‘ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় দিতে’ ভক্তদের টেনে এনে গালে চুমু খান? এসবেরই প্রামাণ্য ফটো রয়ে গেছে।
দয়া করে, ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত কমান্ডার আর নীতি-পুলিশদের আইন ভাঙ্গাকে প্রতিহত করুন। মানুষের অধিকারকে মর্যাদা দিন। আর কিছু করতে হবে না। মানুষের কাঁধে ব্রহ্মদত্যির মতো অসংখ্য নীতিমালা আর বিধিনিষেধ চাপাবেন না। মানুষের গতি দুর্বার নদীর মতো। তাকে আটকালে সে বাঁধ ভাঙবেই। আটকনোর ক্ষমতা কারো নেই।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ১৫৫১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/১১/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • কষ্টের ফেরিওলা ০৮/০৮/২০১৬
    অনেক সুন্দর হয়েছে
  • কষ্টের ফেরিওলা ২৭/০৯/২০১৫
    বেশ হয়েছে,
  • আপনার অনেকগুলো কথাই অনেক ভালো লেগেছে। মূল উৎপাটন করতে হবে যা ইচ্ছা তাই আইন করে নয় যথাযথ উপায়ে.................
    • চন্দ্রশেখর ২৭/১১/২০১৪
      সজীব ভাই,
      অনেকটাই ধরতে পেরেছেন।আসলে আইনের চেয়েও অনেক জরুরি,মানুষের অনুভূতি। আসলে সকলেই একটা আন্দোলনে যোগ দেন। সেটা চক্সহিল্নীতিপুলিশীর বিরুদ্ধে।চুমুটা জুস্ট প্রতিকী
  • একনিষ্ঠ অনুগত ২৩/১১/২০১৪
    আন্দোলনের সংজ্ঞাই যেন পাল্টে গেছে, আর মানুষ গুলোও যেন ভুলে গেছে কোনটা নিয়ে আন্দোলন করা যায়, কিংবা কোনটা নিয়ে প্রতিবাদ করলে তাকে আন্দোলন বলা যায়...।

    মানুষের 'মান এবং হুশ' দুটির একটি থাকলেও এসব কি সম্ভব...?
    • চন্দ্রশেখর ২৭/১১/২০১৪
      সেটা থাকলেই সম্ভব। চুমুর মধ্যে অপমান কোথায়। চুমুর সঙ্গে যৌনতাকে জড়াচ্ছেন কেন? চুমুর প্রশ্নে ১৯৫৮-এ প্রথম মানবাধিকারের আন্দোলন হয়েছে। চুমু আমাদের কবিতায় সাহিত্যে শিল্পে ভাস্কর্যে চিত্রকলায় রয়েছে। একে অস্বীকার করা কেন? মণিপুরের মায়েদের উলং হয়ে প্রতিবাদ কি যৌনতা?
  • কষ্টের ফেরিওলা ২২/১১/২০১৪
    ভালো লাগলো
 
Quantcast