www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বসন্তের বৃষ্টি এবং একটি হলুদ পাতার গল্প

ষাট বছরের থুরথুরে বুড়োটা লাঠিতে ভর করে কাঁপতে কাঁপতে অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে....
দো'তলা বাড়ির প্রকান্ড গেটটা ভেতর থেকে কেউ খুলে দিচ্ছেনা!
বুড়ো মানুষটা যে এসেছে... তা এই বাড়ির গৃহিনী অনেক আগে থেকেই জানেন!
মিনিট দশেক পর প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উনি নিচে নেমে এলেন।
গেটটা খুলেই মুখে একটা কৃত্রিম হাসি হেসে উনি বুড়ো লোকটিকে বললেন,
"আব্বা! আপনি কখন এলেন! একটা ডাক দেবেন নাহ? ভেতরের রান্নাঘরে ছিলাম তো, তাই শুনতে পাইনি !"

বুড়ো লোকটি কাশতে কাশতে বলল, 'নাহ মা, ঠিক আছে। আমি আসছি কিছুক্ষন হবো। ডাকছি... হয়তো কেউ শোনে নাই। মা, ফিরোজ আর বাচ্চাদের জন্য কয়টা পাকা আম নিয়া আসছি। কাঁচা মিঠা গাছের আম। একদম গাছ পাকা। খাইতে দারুন মিঠা। ছোটবেলা ফিরোজ এই গাছের আম খুব পছন্দ করতো। এই নাও, রাখো মা....'

এই বলে বুড়ো লোকটা কাঁপা হাতে আমের ব্যাগটা গৃহিনীর হাতে দিতেই প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করলেন উনি।

তা বুড়ো লোকটির চোখ এড়ালোনা...

বিরক্তি সামলাতে না পেরে উনি বেশ খানিকটা চেঁচিয়ে কাজের মেয়েকে ডাকলেন।

মেয়েটার নাম ফুলি। দেখতে যেমন মিষ্টি, কাজেও তেমনি চটপটে। ফুলি বুড়ো লোকটাকে দেখেই আনন্দের আতিশায্যে বলে ফেলল,
'ও আল্লাহ, দাদাজান! কখন আসলেন আফনে? বাইরে দাঁড়ায়া রইছেন ক্যান! ভেতরে আসেন!'
ফুলির কথা শুনে গৃহিণী রাগে দাঁত কড়মড় করতে লাগলেন। গৃহকর্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে ফুলি মেয়েটা একদম চুপসে গেলো।
উনি বেশ খানিকটা ধমকের স্বরে ফুলিকে আমের ব্যাগটা হাতে দিয়ে বললেন, 'এটা নিয়ে যাহ! ড্রাইভার এলে খেতে দিস!'

ফুলি মেয়েটা এক অযাচিত যন্ত্রণা চেপে কাঁচা-মিঠে আমের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল...

তারপর গৃহিনী বুড়ো লোকটাকে বেশ কড়া করে বললেন, 'আব্বা, আপনাকে আমি কতবার বলেছি এইসব আম-টাম আর আনবেন না... রোহান আর রাইসাকে আমি ডেইলি ম্যাংগো জুশ খাওয়াই। কেন যে আপনি কষ্ট করে এতদূর থেকে এসব এনে ঝামেলা করেন। আপনার ছেলে গেছে অফিসে। আসতে রাত হবে। বাচ্চারাও স্কুলে। আব্বা আপনি বৈঠকখানায় বসে একটু রেস্ট নেন.... আমি ফুলিকে দিয়ে চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।'

একমাত্র ছেলের বউয়ের কথা গুলো শুনে বেচারা বুড়ো মানুষটা ততক্ষনে যেন একদম মাটির সাথে মিশে গেছে।

সে অনেক কষ্টে বলল, 'মা, আজ যাই তাহলে। ফিরোজ আসলে বইলো আমার কথা। গত মাসে শহরে আইসাও ওকে দেখি নাই। তোমরা ভালো থাইকো মা____'

'আপদ বিদেয় হল' বলে গৃহিনী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দোতলায় চলে গেলেন।

ফুলি গেট লাগাতে যাবে এমন সময় বুড়ো মানুষটা উনার পাঞ্জাবির পকেট থেকে চুপিসারে একটা চকচকে পাঁচশত টাকার নোট বের করে ফুলির হাতে দিয়ে বলল,
'ফুলি রে, জানিনা আমার ছেলে আর বৌমা তোকে কিছু কিনে দেয় কি না। আমি দরিদ্র বুড়ো মানুষ। কতটুকুই বা আমার সামর্থ্য! এই টাকাটা রাখ। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে কিনে খাস! আমার নাতনি দু'টোর খেয়াল রাখিস। অনেক মন পোড়ায় রে ওদের জন্য___'

এইটুকু বলে বুড়ো মানুষটা ফুলির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলো।

ফুলি মেয়েটা পাঁচশত টাকার চকচকে নোটটা হাতে নিয়ে পাঁজর ছেঁড়ার যন্ত্রণা বুকে চেপে গেটের বাইরে ঠাঁয়
দাঁড়িয়ে আছে....

জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া উপেক্ষিত বুড়ো মানুষটা সবার অলক্ষ্যে চোখ মুছে লাঠি হাতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে খুব ধীর পায়ে সামনের দিকে এগুচ্ছে।

দৃশ্যটা দেখে ফুলির চোখে জল চলে এলো____

বসন্তের টান পড়েছে চারিদিকে। নতুন কুঁড়ি গুলোর কাছে মৃতপ্রায় হলুদ পাতাগুলো শেষবারের মত একটুখানি ভালোবাসা চাইছে_____
শীতে হলুদ পাতাগুলো একটি একটি করে ঝরে পড়ছে!

বুড়ো মানুষটার চলে যাওয়া পথের পানে ফুলি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে_____

কেন জানি, ওই বুড়ো মানুষটাকে ওর কাছে ঠিক শীতের ঝরে যাওয়া হলুদ পাতার মত লাগছে!

আজ অনেকদিন পর, কেন জানি চিৎকার করে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছুতেই ও কাঁদতে পারছেনা!

কে যেন খুব করুণ কন্ঠে গেয়ে চলেছে সেই গানটা...

"এমন কিছু কান্না আছে
অশ্রু ঝরায় না......
মনটা ভিজে দুখের জলে
চোখে গড়ায় না____"
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৫৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast