www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

১০০ বছর আগে

১০০ বছর আগে
তন্ময় নন্দী

জয় তারা ! জয় তারা ! আয়,এদিকে সরে আয়। আমার কাছে আয়,কোন ভয় নেই,এদিকে আয়।
অরূপ শাস্ত্রীজির কাছে সরে এলো। শাস্ত্রীজি অর্থাৎ গৌরব শাস্ত্রী মা কালীর চরণ থেকে ডান হাতের মাঝের তিন আঙুলে কিছুটা সিঁদুর তুলে নিয়ে অরূপের কপালে ভালো করে ঘষে দিল। তারপর দক্ষিণ হাত মা কালীর চরণে এবং অপর হাত অরূপের মাথার উপর দিয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র পড়ল। হঠাৎ চোখ খুলে শাস্ত্রীজি ওর মাথা থেকে তড়াক করে হাত তুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠল,সর্বনাশ!ঘোর সর্বনাশ! সর্বনাশ ঘটতে চলেছে তোর জীবনে আজ। আমি দেখতে পাচ্ছি কালো কালো বিপদ থাবা নিয়ে এগিয়ে আসছে তোর দিকে।
অরূপ ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। আরও কিছুটা শাস্ত্রীর কাছে সরে এসে ভয়ে ভয়ে বলল,কিসের সর্বনাশ বাবা, আমি কি কোন অন্যায় করে ফেলেছি।
সবই মায়ের ইচ্ছা বৎস। তিনি চাইলেই সব হয়,তিনি না চাইলে কিছুই হয়না। চোখ দুটো গোল গোল করে পাকিয়ে শাস্ত্রীজি উপরের দিকে তাকিয়ে বলল।
ধুপ-বাতির ধোঁয়ায় ভরে ওঠা আলো আঁধারি ঘরে তখন কেবল মাত্র দুটি বড়বড় মোমবাতি জ্বলছে।রুমে জানলা দরজা সব বন্ধ। কেমন এক সোদা সোদা গন্ধ। অরূপ শুটের পিছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা ২০০০ টাকার নোট শাস্ত্রীর পায়ের কাছে রেখে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল, আমাকে রক্ষা করুন বাবা,এই অধমকে রক্ষা করুন।
গৌরব শাস্ত্রী অরূপের মাথায় হাত দিলে সে উঠে হাঁটু গেঁড়ে প্রণামের ভঙ্গিতে বসলো।
আমি কে, তিনি তো সব, তিনি আছেন বলেই তো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আছে। তিনিই কালী, তিনিই দুর্গা আবার তিনিই মা তারা। শাস্ত্রীজি মা কালীর প্রতিমার দিকে হাত উঁচু করে বলতে থাকলো, শোন তেমন কোন ভয় নেই। শুধু মনের জোর হারাবি না কোন সময়। হিম্মত রাখবি, জানিস মা তারা কি বলে - এই হিম্মতই সব। আর সাহস হারালেই ঘোর বিপদ।ভয়ংকর মৃত্যুকাল নেমে আসবে। জয় তারা! জয় মা!
অরূপ - অরূপ পোদ্দার এমনিতেই খুব ভীতু মানুষ। মানুষ বললে ভুল হবে বছর ত্রিশের এক যুবক। ঠাকুর, দেব-দেবী,মন্ত্র-তন্ত্র এসবের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। বীরভূমের সিউড়ি স্টেট ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে কাজ করে।অরূপের বিশ্বাস শাস্ত্রীজির আশীর্বাদ আছে বলেই বেকারত্বে ভরা এই সময়ে সে চাকরি পেয়েছে।ওখানেই ওর বাড়ি। বিয়ে থা এখনো করেনি।করেনি বলা ভুল,আসলে এই গৌরব শাস্ত্রীই ৩৩ বছরের আগে ওকে বিয়ের দিকে পা বাড়াতে নিষেধ করেছেন।পাছে শাস্ত্রীজি বিরক্ত হন এই ভয়ে অরূপ কখনই কারণ জানতে চাইনি।তাই আজও কিসের সর্বনাশ,কেন সর্বনাশ- কিছুই জানতে চাইল না।
নতুন একটা চারচাকা কিনেছে অরূপ। সেই উপলক্ষেই তারাপীঠে পুজো দিতে এনেছে তার নতুন ফোর সিটের অল্ট গাড়িটিকে। এমনিতেই সে মাঝে মাঝে তারাপীঠে পুজো দিতে আসে। গৌরব শাস্ত্রীর সবচেয়ে ভালো খদ্দের অরূপ।গুরু-বাবা, তান্ত্রিক এসব লাইনে খদ্দের কথাটা ঠিক মানায় না বরং ভালো বাংলায় বলতে গেলে বলতে হয় - বাবার সবচেয়ে প্রিয় ভক্ত।
গৌরব শাস্ত্রী মাসে একদিন আসে তারাপীঠে - প্রথম মঙ্গলবার।বলাকা হোটেলের এক তলায় একটা রুম ভাড়া করে নিজের চেম্বার খুলেছে।চেম্বারের সামনে টানানো "মাঙ্গলিক দোষ কাটানোর একমাত্র সিদ্ধপুরুষ, তন্ত্র সাধনায় দীক্ষিত, জ্যোতিষশাস্ত্রে গোল্ড মেডেলিস্ট-- গৌরব শাস্ত্রী - সব মুশকিলের আসন"। চেম্বারে মা কালীর দেবীমূর্তিকে সকালবেলায় পূজা-অর্চনা করার পর বৈকালে খদ্দের দেখেন অর্থাৎ যারা মন্ত্র- তন্ত্র, ভুত -পুত এসবে বিশ্বাসী তাদের মগজ ধোলাই করেন। গালভরা গেরুয়া রং করা দাড়ি, কপালে লাল টকটকে সিঁদুরের তিলক, কালো ফতুয়া পরা ছয় ফুটের এই তান্ত্রিককে দেখলে এমনিতেই মাঙ্গলিক দোষ সব পালিয়ে যাবে।
শাস্ত্রীজির চরণ ধূলি মাথায় নিয়ে চেম্বারের সামনে দাঁড় করানো চেরি কালারের গাড়িতে চেপে স্টার্ট দিল অরূপ।
হাফ বেলা অফিস করে নিজেই গাড়ি চালিয়ে একাই এসেছিল । বিশেষ করে এসেছে শাস্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য। সন্ধ্যা নামবো নামবো করছে। সাদা আলোর চাদরটাকে কেউ সরিয়ে ভিজে কালো চাদর

ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে। অগ্রহায়ণের শেষের দিক, তাই সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসে। শীতও পড়েছে খুব এই সময়।
শ্বেত পাথরের তৈরি তারা মায়ের তোরণ টাকে ছাড়িয়ে বাঁদিকে টার্ন নিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে প্রবেশ করল অরূপ। অন্ধকারে ভরে উঠেছে চারিদিক। ১০ চাকার লরি, ডাম্পার গুলি হন হন করে তাকে ওভার-টেক করে চলে যাচ্ছে। দু একটা গাড়ি এমনভাবে তার পাশ ঘেঁষে যাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে পিষে গুড়িয়ে রাস্তায় মিশিয়ে দেবে।
বেশ খোশমেজাজেই গাড়ি চালাচ্ছিল অরূপ। কিন্তু শাস্ত্রীর কথা মনে পড়তেই মনটা আবার বিষাদে ভরে গেল।
রেললাইনের পাশ বরাবর বয়ে চলা এই রাস্তা ধরে অনেক বার রামপুরহাট এসেছিল অরূপ।প্রত্যেকবারই বাসে কিংবা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। একে একে তারাপীঠ স্টেশন রোড,মল্লারপুর ছাড়িয়ে অরূপের গাড়ি ঢুকল গণপুরের বনে। বীরভূমের একমাত্র শালবন। তার মধ্যে দিয়ে বুক চিরে চলে গেছে এই কালো পিচের এন এইচ ১৪।
অরূপ লক্ষ্য করলো যত বনের ভেতর এগোচ্ছে অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা তত কমে আসছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে বড় বড় লরি গুলো পাথর ভর্তি ডালা নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটছিল । তারা কি মাঝপথে এই রাত্রি বেলায় স্ট্রাইক করল ! ধাই করে গাড়িটা কিছু একটা তে আঘাত পেয়ে আপনা আপনিই স্টার্ট অফ হয়ে গেল। অরূপের মাথা সজোরে ধাক্কা খেলো স্টিয়ারিং এর সাথে। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল তার। নিজেকে সামলাতে কিছু টা সময় নিল সে।মাথায় ব্যথা নিয়ে দরজা খুলে হাতে একটা টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। দেখল আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকা একটা কাঠের গুড়ির সাথে তার গাড়িটা ধাক্কা খেয়েছে। গাড়ির সামনের দিকটা থেঁতলে গেছে। নতুন গাড়ির এই অবস্থা দেখে অরূপ মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেল।গুড়িটা খুব একটা বড় নয়।কনকনে চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধ পরিবেশ। চাঁদের আবছা আলোয় একটু একটু দেখা যাচ্ছে চারিপাশ। অদূরে কোন একটা গাছে পেঁচা ডেকে উঠলো।অরূপের ভয় ভয় করছে।এখন আর একটিও গাড়ি পাশ হচ্ছে না। জয় মা তারা বলে গাছের গুড়িটা কে সরাতে যাবে হঠাৎ গুঁড়িটা একটা কালো কুকুর হয়ে এক লাফে ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড়ে পালাল। সঙ্গে সঙ্গে অরূপ থতমত খেয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো ।হৃৎপিণ্ডের গতি ভয়ানক ভাবে বেড়ে গেল তার। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু একি স্টার্ট নিচ্ছে না কেন? দু তিনবার চেষ্টা করার পর গাড়ি স্টার্ট নিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ধরে ৫ মিনিট খুব জোরে চালিয়ে এসে গাড়ি থামাল।হেডলাইটের আলোয় দেখল পাকা রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো লাল মোরামের চওড়া পথে পরিণত হয়েছে।
বীরভূম লাল মাটির দেশ। আসার সময় তো কই এরকম রাস্তা চোখে পড়েনি? তাহলে কি রাস্তা ভুল করেছে সে। ভয়ে ভয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাঁদিকে নামল। হেড লাইটটা জ্বালাই আছে তবুও সঙ্গে টর্চটা সঙ্গে নিলো। এখানে জঙ্গল আরও গভীর। গাছগুলো পাশাপাশি লেগে আছে। উঁচু উঁচু শালগাছ গুলো দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে ব্যাপার স্যাপার লক্ষ্য করছে ।আকাশটা মনে হচ্ছে কিছুটা নিচে নেমে এসেছে।গাড়ির পিছন লাগোয়া মোটা গাছটার নিচে খর খর করে আওয়াজ হল। অরূপ ভয়ে ভয়ে টর্চের আলো ফেলল,দেখল তিনটি শেয়াল তার দিকে লাল লাল চোখ বের করে তাকিয়ে আছে। অরূপ ঢেলা কুড়ানোর ভঙ্গি করতেই ওরা দৌড়ে কোথায় গাছের মধ্যে মিশে গেল। এই গভীর বনে একাকী অরূপের ভীষণ ভয় করতে লাগলো। তবু শাস্ত্রীজির কথায় মনের জোর আনল।
এই জঙ্গলে বাঘ ভাল্লুক একদমই নেই। জঙ্গলটা পেরিয়ে গণপুর গ্রাম। সাঁওতালরা সেখানে বাস করে। এ বনের শালপাতা থেকে বাসনপত্র বানিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করে।
আসার পথে বনের স্নিগ্ধ শীতল অপরূপ দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করতে গিয়ে সেতুর মতো করে ফেলেছে।
লাল মোরাম জায়গাতে অরূপ খুব সাবধানে পা দিল। খুব বেশি জায়গা জুড়ে এই মোরাম অঞ্চলটি নেই। তারপর আবার পিচের রাস্তা শুরু হয়েছে। নিচু হয়ে দুটো মোড়ামের সাদা পাথর কুড়াতে যাবে এমন সময় মাথার উপরে দুটো পাখি ভয়ানক শব্দে চিৎকার করে উঠলো। অরূপ তাড়াতাড়ি ছুটে গাড়ির কাছে চলে এলো। গাড়ির লক খোলার চেষ্টা করলো।কিন্তু একি কেউ ভিতর থেকে দরজা লক করে দিয়েছে। প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করছে এমন সময় হে রে রে রে রে... আওয়াজ শুনে অরূপ সামনের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে যা দেখল তা বাস্তবে কখনই ঘটা সম্ভব নয়। দেখল গোটা কুড়ি লোক কোথা থেকে এসে ওই জায়গাতে গোল হয়ে দাঁড়ালো। তারপর দু দলে ভাগ হয়ে গেল তারা। উভয় দলের লোকদের গামছার মত করে পরা সাদা ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন,মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর ইয়া বড় বড় গোঁফ। একদলের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা এবং অন্য দলের সাদা ফিতে বাঁধা। কালো কালো পাষণ্ড চেহারার লোকদের তেল মাখানো গায়ে হেডলাইটের আলো পড়ে চিকচিক করছে।তারপর হাতে বল্লম ধরা লোকগুলো হে রে রে রে... করতে করতে একদল অপর দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারপর শুরু হল কিল, ঘুষি। কিছুক্ষণ বীরত্বের সাথে লড়াই করার পর বল্লমের খোঁচায় দেহ গুলি একে একে মাটিতে লুটিয়ে পরতে লাগল।
এই বাবু , উঠ্‌ উঠ।এখানে কি করছিস তু। অরূপ চোখ খুলে দেখল এক সাঁওতালি মেয়ে তাকে ডাকছে।চারিদিক তখন সূর্যের সাদা আলোয় ভরে গেছে। তার পোশাক আশাক লাল মোরামের ধুলো লেগে। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। দেখল এক লাল মাটির সরানে সে দাঁড়িয়ে আছে,পাশে একটা শুকনো ক্যানেল পাশ দিয়ে চলেছে এবং কিছুদূরে তার চেরি কালারের গাড়িটা খাড়া আছে ।ক’টা বাজে দেখার জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করতে গিয়ে দেখে একটি কাগজের টুকরোয় হাত পড়ল।পকেট থেকে বের করে বহু পুরনো বাদামী রঙের টুকরোটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগল।যা দেখে অরূপ চমকে উঠল। তাতে যা লেখা আছে তার সারসংক্ষেপ এই - ১৩ই অগ্রহায়ণ,১৩২৬ বীরভূম ঃ গনপুরের বনকে দখল করতে গিয়ে দুই ডাকাত পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারি হয় এবং শেষে বিষমাখা বল্লমের খোঁচায় দুই পক্ষের সব লোক প্রাণ হারায়।।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৯০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/০৬/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast