www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ব্লাক পেন্সিল।

"ব্লাক পেন্সিল"
মুহম্মদ নিপুন নগরী।
'বিভাগঃ ছোট গল্প'।

"শিল্পীর শিল্পজগৎ আঁধার ভেঙে আলো তৈরী করে"


🍂.....
সিগারেটে আলতোভাবে শেষ টানটি দিয়ে; এক বুক ধোঁয়া ছাড়লো, মধ্য বয়স্ক চিরকুমার নিখিল শুভ্র'দা। হাতে ছোট একটা শুভ্র রাবার, এইচ টু-বি সেভেন পেন্সিল, শার্প করার জন্য খুব সুন্দর ছোট একটা আর্মি নাইফ, 'ধারালো'।

পৃথিবীর সমীকরণ অনুযায়ী পরিবার পরিজন সব হারিয়ে একাকী এক নিঃসঙ্গ মানুষ 'নিখিল শুভ্রজিৎ'। নিজের চিত্রকর্মের জন্য বেশ অনেকবার তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সন্মানিত হয়েছেন। জাতীয় পদকে অলংকৃত হয়েছেন তিনি। ভূষিত হয়েছেন চিত্রকলার 'কারুকাজ' নামে।

নিজের চিত্রকর্মে একাগ্রতা আর একান্ত মনোনিবেশ করার জন্য এ অবধি বিয়ে করেননি তিনি। তার ধারণা সংসার জীবন তার জন্য সুখময় হবে না। চিত্রকলা নিয়ে ব্যস্ত সময়ে, সংসার জীবনে তাল মেলাতে পারবেন না তিনি। ছবি আঁকা তার জীবনের সবকিছু। নিজের নিঃসঙ্গতার সবটুকু তিনি এর জন্য ব্যয় করেছেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনকে মেনে নিয়ে তিনি আর বিয়ে করবে না বলে, ঠিক করেছেন।

নিখিল শুভ্র'দা আনমনে কাঠ-পেন্সিল শার্প করছে..
কপালে মৃদু চিন্তার ভাঁজ।

ই'স বলে, আঙুল কামড়ে ধরলো হঠাৎ করে;
আঙুল কেটে রক্ত পরছে নিখিল শুভ্রদার! টক-টকে লাল রক্তের লোহিত কণা। নোনা স্বাদ।

নিখিল শুভ্র'দা লেফ্টি, ডান হাত 'কাটছে' বলে; ভাবলো না বেশি কিছু, যে করেই হোক পেইংটিং'টা আজকে এগিয়ে নিতে হবে নিখিল শুভ্রদার। অলসতার জন্য যদি, দামী ক্লায়েন্টের 'জলরঙ' এর ডেলিভারিটা না দিতে পারে তো অনেক খারাপ দেখায়। এভাবে চলে না; না খেয়ে মরতে হবে তাহলে।

আর আর্টটা ও একটু ভিন্ন, একটু জটিল। খেটেছে, সময় নিয়েছে, অবহেলা যতটুকু তা অলসতা।

🍂.....
মোবাইলে রুবী নামের অসম বয়সি একজন তরুন- চিত্রশিল্পীর সাথে কথা বলছে নিখিল শুভ্র'দা। শ্রাবণী আক্তার রুবী একজন মুসলিম। জনশ্রুতি রয়েছে এমন একজন চিত্রশিল্পী। চিত্রকলার খাতিরে ওনারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিখিল শুভ্রদার থেকে রুবী বয়সে অনেক ছোট। রুবী চারুকলা থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ছেন সাত বছর বছর আগে। এখন নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।

-'মরার জ্বালা। কেনরে এমন বলতো রুবী।'
অপর প্রান্ত থেকে রুবী--

-'কেন কি হইছে! এখনো হয়নি শেষ তোর "পেনসিল"?'

-'না, সাবজেক্ট থেকে দূরে আছি একটু। আঙুল
কেটে ফেলছিরে রুবী!'

-'মরার তোর আর হয়না না! দেখিস না?
জলদি করে ব্যান্ডেজ কর। বেশি কাটছে
নিখিল'দা

-'না, অল্পই।'

-'আচ্ছা তোর হইছে কি বলতো নিখিল'দা; ইম্পর্টেন্ট ক্লায়েন্টের, দ্য লাস্ট ডেট অব হ্যান্ডিংওভার অব ইয়োর আর্ট টু দ্য ক্লায়েন্ট ইজ কামিং ক্লোজ। আর তুই আর তুই! তুই এত স্লো কেন নিখিল'দা অলওয়েজ!'

-'এই তো শেষ প্রায় অনেকটা; অল্প কিছু রিফ্লেক্স আর অল্প কিছু ইনক্লুডিং স্কেচ বাকি দেন পিক আর ড্রাই হতে অল্প কয়েকটা দিন; ব্যাস হয়ে গেছে।'

-'বেষ্ট অব লাক নিখিল'দা। বাই।'

-'হুম 'বাই'। পরে কথা হবে; রাখি।'

🍂.....
এক দৃষ্টিতে ঝরে পরা লাল রক্তের ফোটা গুলো দেখছে নিখিল শুভ্র'দা! জবা ফুলের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন গাঢ় রক্ত। শুকিয়ে গেছে দ্রুত রক্তের ফোটা গুলো। হাতে ব্যান্ডেজ করছে আর ভাবছে নিখিল'দা। ফিনিশিংটা আসছে না কেন পেইংটিংটার। চিন্তিত দেখাচ্ছে নিখিল শুভ্র'দা কে কেবলি; একটু হতাশ।

অল্প কিছুক্ষণ আনমনে থেকে, কফি খেলো নিখিল শুভ্র'দা; 'কোল্ড কফি'; ওনার প্রিয় পানীয়। সিগারেট ধরিয়েছিল দু'টান দিয়েই ব্লু কালারের 'এঞ্জেল ফিস' সঁপিস ছাইদানিতে দু'আঙুলের নিপুণ ভঙ্গিতে নিভিয়ে ফেললো মৃত আগুন;

দ্রুত আধো-আঁকা পেইংটিং এর ক্যানভাসের সামনে গেলো নিখিল'দা। আঁকা শুরু করলো সুনিপুণ মমতায়। আঙুল নয় যেন প্রজাপতির মত পাখা ঝাপটাচ্ছে নিখিল শুভ্র'দা। তীব্র মনোযোগে। মেঘের মত বদলে যাচ্ছে- ক্যানভাসের আকাশ। সাথে গুটিকয় আঁচড়। আলপিনের আঁচড়ের মত।

টানা ছয় ঘন্টা নিঃশেষে; গভীর রাতে! খানিক হতাশা নিয়ে ঘুমোতে গেলো নিখিল শুভ্র'দা।

🍂.....
পরেরদিন সকালে নিখিল শুভ্রদার ঘুম ভাঙ্গলো মোবাইল রিংটোনের আওয়াজে। 'ক্রিং'ক্রিং' করে বেজেই চলছে মোবাইলটা। নিখিল'দা গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। এবার মোবাইলের ওপাশটা থেকে রুবীর কন্ঠ ভেসে আসলো।

'কিরে নিখিল'দা তোর হয়েছে। বলি পেইংটিংটা শেষ করতে পেরেছিস।' জবাবে নিখিল শুভ্র'দা বললো;

'নারে রুবী এখনো শেষ হয়নি, আরো দিন সতেরো লাগবে বলে মনে হয়।'

এবার রুবি একটু চিন্তিত, বললো; 'তা সঠিক সময়ে পারবি তো পেইংটিংটা হ্যান্ডওভার করতে নিখিল'দা।'

মৃদু হাসলো নিখিল শুভ্র'দা বললো, 'তোর এই বাচ্চাদের মত মনটাই আমার নজর কেড়েছে, আর তাইতো বন্ধুত্ব করেছি অসম বয়সের একটা মেয়ের সাথে। তা ভালোই! তুই অনেক বুদ্ধিমতী সুখি হবি জীবনে অনেক; তার জন্য তোর ভালো মনের একটা মানুষ দরকার! আমি ছাড়া।'

'হুম, হয়েছে...হয়েছে; রুবী এরপর বললো'-

'তোমাকে তো কতবার বলেছি নিখিল'দা এই 'বয়স-টয়স' কিছুনা তুমি চাইলে আমাকে বিয়ে করতে পারো। আর কত বছর তুমি একা থাকবে? এই পড়ন্ত বয়সেও বিয়ে'থা করলে না! দেখলে কিযে মায়া হয়।'

এর জবাবে নিখিল'দা প্রসঙ্গ বদলালো বললো, 'তোর প্রিয় রঙ নীল না রুবী।'

রুবী বললো, 'হুম।'

'আমি নীলের আরেকটা ভেরিয়েশন তুলে এনেছি 'জলরঙে' বুঝলি? অনেকটা আকাশের রঙ খুব ভালো!'

বললো নিখিল শুভ্র'দা।

নিখিল শুভ্রদার হেয়ালি দেখে রুবী বললো, 'প্রসঙ্গ বদলাবে না! তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবেনা ভালো! কিন্তু আজীবন তোমার পাশে থাকতে দিও! আমার তাতেই চলবে। আর কিছু চাইনা।' নিজের মনের ভালোবাসা প্রকাশ করে কথা বললে রুবী নিখিল'দা কে তুমি করে বলে।

জবাবে মৃদু স্বরে নিখিল'দা বললো, 'আচ্ছা ঠিক আছে- থাকিস! এখন রাখবো কফি খাবো; নাস্তা করবো পরে একটু বাইরে যাবো; অনেকদিন বৃষ্টি দেখা হয়না আজকে টি.এস.সিতে গিয়ে বৃষ্টি দেখবো; বৃষ্টির জল স্পর্শ করে - বিলীন হবো প্রকৃতিতে।

শুনে রুবী বললো, 'আমাকে নিবি নিখিল'দা?'

নিখিল শুভ্র'দা দ্রুতই বললো, 'সেজেগুজে চলে আয়। তোর আর বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি'।

বলে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ছাড়লো নিখিল'দা। রবীন্দ্রসংগীত; মোবাইল সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছেন।

"আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো, আমারো পরানো যাহা চায়"

গান শুরু হতেই আনমোনা হয়ে গেলো নিখিল শুভ্রজিৎ। কেন জানি অনেক বছর পর চোখে জল চলে আসলো! কেন তা নিখিল'দা জানে না। মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী বড় অভিমানি।

🍂.....
রিক্সায় করে যাচ্ছে নিখিল'দা আর রুবী। হুড তুলে দিয়ে শ্রাবণ ধারায় ভিজে নিচ্ছে। বৃষ্টি কি সুন্দর বৃষ্টি ঝরছে, শ্রাবণ মাসের শেষ দিকের বৃষ্টি। বেশ শীতল। আশে পাশের দৃশ্যপট দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। পেছনে চলে যাচ্ছে চোখের পলকে চিরচেনা এই শহরের পরিচিত রাজপথ। খুব সুন্দর একটি দিন। বেশ গোছানো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রুবী কে বলছে, নিখিল'দা -

'কিরে কথা বলছিস না যে মন খারাপ।'

রুবী বললো, 'না! মন খারাপ না! আমি ভাবছি তোমাকে নিয়ে, তুমি এত চমৎকার একটা মানুষ, তোমার সঙ্গ পেতে কার'না ভালোলাগে; কিন্তু আমাকে কেন জানি তুমি বুঝতে চেষ্টা করো না!'

নিখিল'দা একটু আনমনে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,

"মেয়েদের মন বোঝা মুসকিল তারচেয়ে -
'পুরুষদের ঠিকমত বুঝে নিয়ে চালিয়ে নিতে পারলেই ভালো'। আর আমিও তোকে নিয়ে ভাবি তুই মানুষটা অন্যরকম।"

এরকম ছোট খাটো খুটিনাটি বিষয় নিয়ে কথা বলেই বৃষ্টিতে ভীজে গেলো রুবী আর নিখিল'দা। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা বেশ সহজ বেশ সুন্দর। সুন্দর একটা দিন অতিবাহিত করে যে যার মত বিদায় নিলো।

আকাশে তখনো বৃষ্টি -

শ্রাবণের মেঘমালা। টি.এস.সি, কার্জন হল, মধু'র ক্যানটিনের পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে; দুপুরের আলোয় ল্যাম্পপোস্টের মত নিয়ন আলোর স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি হয়ে ঘিরে রেখেছে সব'টা আলোয় ভরা চারিপাশ!

🍂.....
নিকষ সন্ধ্যায়, শহরের ভাড়া বাড়ীর ছাঁদে একা দাঁড়িয়ে নিখিল শুভ্র'দা। সিগারেটের আলো জ্বলছে আর নিভছে। আধো আলো চারিপাশে। ছাঁদের রেলিঙের পাশ থেকে দূরে শহরটাকে দেখা যাচ্ছে, একা সঙ্গহীন। দূরে..

ল্যাম্পপোষ্টের নিয়ন বাতী জ্বলছে, কিছু ছুটন্ত গাড়ি দ্রুত চলে যাচ্ছে দৃষ্টি সীমার বাইরে। আর আকাশে তখন স্থীর রাতের তাঁরা আর ধূসর কালো নীল মেঘ চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল। চারদিকে পরন্ত শীতের মত কিছু আবছায়া কুয়াশা। নিশ্চুপ চারিদিক, শত'হাজার আলো জ্বলছে শহরে।

আনমনে ভাবছে নিখিল'দা। একমনে সিগারেটের শেষ জ্বলন্ত আগুন নিভিয়ে ফেললো। তখন হঠাৎ নিখিল- শুভ্রদার দামি আইফোন বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চিন্তার ভাঁজ পরলো নিখিল শুভ্রদার কপালে। কিছুটা এলোমেলো বেশ বড় চুল গুলো পেছনে ঝুটি করে বাঁধা কাধ অবধি। হতাশায় কাধ কিছুটা ঋজু হলো নিখিলের। মাথার চুল গুলো একবার আনমনে গুছিয়ে নিলো; পরে মোবাইল রিসিভ করে বললো;

"স্যার 'নমস্কার'।

কেমন আছেন, সব কিছু ঠিক আছেতো।"

জবাবে মোবাইলের ওপাশটা থেকে শিল্পপতি আফসার আনসারি বললেন, "হ্যা নিখিল এইতো বেশ আছি; তুমি ভালোতো।" জবাবের অপেক্ষায় না থেকে আফসার আনসারি কিছুটা উদ্বেগ কিছুটা শংকা আর স্নেহের পরশ মাখিয়ে বললেন;

"শোন নিখিল, মা মরা আমার একমাত্র মেয়ে নীরা। চোখে দেখেনা, গতবছরের ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার রেজাল্টের দিন খুব আনন্দ নিয়ে, আমার জন্মান্ধ মেয়েটা বৃষ্টিতে ভীজতে ভীজতে খুব শখ করে আমাকে একদিন বলেছিলো 'বাবা আমি বৃষ্টি ছুঁতে পারছি। আমার খুব ইচ্ছে বৃষ্টির পানির স্বচ্ছ ফোটাগুলো কেমন হয়! কেমন করে বৃষ্টি ঝরে দেখবো! খুব ইচ্ছে করে আমার।'

বলতে বলতে কল্পনায় নিজের জন্মান্ধ মেয়েটাকে বৃষ্টিতে ভীজতে ভীজতে বনে ঘুড়ে বেড়াতে দেখলেন ঠিক যেন একটা সাদা পরী মাটিতে নেমে এসেছে।

কল্পনা ভেঙ্গে; ভারি গলায় আবেগ'ভরা কন্ঠে আফসার আনসারি বলছেন! জানো নিখিল সেদিন খুব ইচ্ছে- করছিলো মেয়েটাকে বলি, হুম মা আমি তোমাকে বৃষ্টি দেখাবো।

আর তখন আমার শুধু মনে পরছিলো এমন একটা ক্যানভাস যদি মেয়েটার মনে কিছুটা আলো ফে'লে যেখানে বৃষ্টি থাকবে; ও একটু বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখতে পারবে; আমার খুব ইচ্ছে একটা ছবি যেটাতে কিছুটা 'ব্লাইন্ড ল্যাংগুয়েজ' থাকবে বৃষ্টির ছবি আঁকা থাকবে। আমার জন্মান্ধ মেয়েটা ! ছবির সাথে সাথে যদি বৃষ্টি'টুকুর একটু দৃশ্যপট ও! ওর অনুভূতি দিয়ে অন্ধমনে দেখতে পারতো!

তুমি তো ব্লাইন্ড ল্যাংগুয়েজ জানো আর তাইতো তোমার ওপরে ভরসা নিখিলি..নিখিল;..নিখিল তুমি পারবেনা আমার এই একটুকু ইচ্ছাটাকে তোমার জ্ঞান তোমার শিল্প দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে। আমি জানি আমার সবটা দিয়েও এই শিল্পের দাম দিতে পারবোনা তবে ভালোবাসার দামে না হয় কিনে নিবো আমার মেয়েটার জন্য একটুকু বৃষ্টির ছবি! একটু বৃষ্টির ছোঁয়ায় আলোকিত করতে পারবেনা নিখিল।"

শিল্পপতি আফসার আনসারি তার একমাত্র মেয়ে নীরার মা যখন মারা যায়, নীরা যখন ক্লাস এইটে পড়তো কেবল, তখন থেকে মা মরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এখনো বিয়ে করেননি, এত অর্থ; এত সম্পদ আর এতগুলো বিজনেস সব কিছু থেকে নিজেকে কোনক্রমে আলাদা করে তার সমস্ত চিন্তা চেতনা ভাবনা আর মায়া মমতার সবটুকু নীরাকে ঢেলে দিয়েছে। অবসরের সবটুকু সময় তার নিজের মা মরা জন্মান্ধ মেয়েটাকে মানুষ করার জন্য ব্যস্ত থাকেন।

আর নীরা একাকী আলোহীন জীবনে, নিজেকে গুছিয়ে নিতেই তার সবটুকু চিন্তা চেতনা তার অন্ধমনের আলোকিত জগৎটাকে আঁকড়ে ধরে আলোকিত করে রাখে; সুবিশাল বাড়ী টাকে, গৃহকর্মী আর দূরসম্পর্কের এক খালামুনি, তার পড়ার বই আর খেলার সাথি নানা রঙের আর শত বর্নের পাখি আর তার গানের জগৎ নিয়ে সবটুকু ঘর আলোকিত করে রাখে। রবীন্দ্রসংগীত বড় ভালো গলায় তুলে মেয়েটা অনেক সুন্দর আর খুব ভালো কবিতা লেখে নীরা। নীরার একটা কবিতার বই ও আছে 'আলোকিত আঁধার' শিরোনামে। একমাত্র বাবাই তার আলোকিত পৃথিবীর সবটা জুড়ে আছে ঠিক বন্ধুর মতন।

দীর্ঘ অনুভূতি প্রকাশের জবাবে নিখিল'দা -

একটু চুপ থেকে মৃদু স্বরে বললো;

'আফসার স্যার আমি আমার সবটা দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছি ক্যানভাসে নীরার জন্য কিছু করার জন্য, দীর্ঘ সময় ছবিটা নিয়ে কাজ করছি। নিজের শিল্পকলার সবটা দিয়েও যদি নীরার মনে এতটুকু স্পর্শ করাতে পারি বৃষ্টি টাকে; তাহলে এই একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে আর কিছুই চাই না।'

কথা শেষ হতেই দূরে ল্যাম্পপোষ্টের নিয়ন আলোয় নিঝুম বৃষ্টির ঝাপসা দৃশ্য দেখা গেলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজছেন নিখিল'দা। বৃষ্টি থেকে বাঁচার কোন আকুতি নেই। দু'হাত প্রসারিত করে দিয়ে বৃষ্টি অনুভব করছে নিখিল শুভ্র'দা। আর মৃদু স্বরে বলছে 'বৃষ্টি' আমাকে তুমি মৃন্ময়তা দাও অনুভূতি দাও, কিছুটা বৃষ্টি তুলো দাও চোখে! হে ঈশ্বর তোমার কাছে এই মোর প্রার্থণা।


🍂.....

ক্লান্ত দুপুরে; একাকি নিজের রুমে আনমনে গান শুনছে শিল্পপতি আফসার আনসারি সাহেবের জন্মান্ধ মেয়ে নীরা। রবীন্দ্র সংগীত এর শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর মোহিত সে সূর। অদ্ভুত একটা শান্ত নিরবতা; বিলাসবহুল নিজের রুমে নীরা গান শুনছে। বেজে যাওয়া রবীন্দ্র সংগিতের সূরে গলা মেলাচ্ছে সে।

"আমার বেলা যে যায় সাঝ বেলাতে, তোমার সূরে- সূরে, সূর মিলাতে...আমার বেলা যে যায় সাঝ বেলাতে..তোমার সূরে সূরে, সূর মিলাতে.."

এমন সময় ওর রুমে খাঁচায় রাখা, ময়না পাখিটা
হঠাৎ কথা বলে উঠলো হুবুহু মানুষের গলায়--

"নীরা...বৃষ্টি, নীরা...বৃষ্টি..নীরা..নীরা।"

গানের সূরে মগ্ন নীরার ধ্যান ভাঙ্গলো। অন্ধের লাঠি
দিয়ে অনুভব করে করে, আস্তে এসে খাঁচার সামনে
দাড়ালো নীরা। আনমনে বললো এতদিনে খুব সুন্দর করে আমার ভালোলাগার দুটি শব্দ বলতে পেরেছিস। এর আগের অন্য ময়না পাখি গুলোর মত আজকে তোর ও মুক্তি 'মিঠু'। রাখ তোরে মুক্ত করে দিচ্ছি। তুই গিয়ে বনে বনে ডেকে বেড়াবি-- নীরা.. বৃষ্টি..নীরা বৃষ্টি..। আমার কথা মনে পড়লে আসিস কিন্তু, এসে আমার নাম ধরে ডাকবি বুঝলি।

গুলশানের নিজের বাড়ীর ছাঁদে, নিজের দূরসম্পর্কের খালামনি মধ্য বয়সী বিধবা রাবেয়া আশরাফ কে নিয়ে 'মিঠু'কে মুক্ত করে দিলো নীরা।
খাঁচা থেক ছাড়া পেয়ে মুক্ত আকাশে উঁড়ে যাওয়ার আনন্দে ময়না পাখিটা বার কয়েক নীরার নাম ধরে ডেকে উঠলো।

'রাবেয়া খালা.. মিঠুকি উড়ে গেছে, দূরে আকাশে।'

'হ্যা, মা উড়ে গেছে মিঠু। আকাশে ওর কালো পিঙ্গল ডানা মেলে তোমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে গেছে।'

'আজকে আমার মন খুব ভালো, বাবাকে ফোন করো খালামনি। আজকে বাড়ির বাইরের খাঁচা গুলো থেকে হাজার হাজার মুনিয়া আর বাজীকর পাখি গুলো সব মুক্ত করে দিবো। তুমি কিন্তু একটা ছবি তুলে রাখতে ভুলবে না।

'ভাইয়া জান কে আগেই আসতে বলেছি নীরা। যখন ময়না পাখিটা কে মুক্ত করে দিবি বলেছিস তখনি ফোন করেছি। আসছেন উনি বাসয়, একটু অপেক্ষা করো মা'মনি।'

বিকেলের দিকে, এক দু'ঘন্টা পরে আফসার আনসারি সাহেবের হাত ধরে, বাড়ীর বাইরে চিড়িয়াখাঁচা থেকে--

পাখির খাঁচাটা উন্মুক্ত করে দিতেই হাজার হাজার মুনিয়া আর বাজীকর পাখি গুলোর কিচিরমিচির শব্দে আকাশ আনন্দে নেচে উঠলো। বাবার হাত ধরে দু'হাতে প্রসারিত করে নীরা বলছে, 'মুক্তি বাবা মুক্তি। কি এক মোহ নিও অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো যাবে না কখনও।'

শিল্পপতি আফসার আনসারি সাহেবের চোখে তখন
আনন্দ অশ্রু চিকচিক করছে। একান্তে নিজের মনে, আফসার আনসারি সাহেব বললেন,

'আমি আরো একটিবার তোর চোখেমুখে এমন আনন্দের আলোটুকু দেখতে চাই মা। জানি তোর পৃথিবীতে আলো নেই, কিন্তু তুই যে আমার পৃথিবীর সবটুকু আলো। তুই অনাবিল সুন্দর, তুই মুক্ত, তুই জগতের আলো মা'মি। '

বিকালের মুক্ত রক্তিম আকাশে তখন হাজার হাজার মুক্ত পাখির কলরব মিশে গিয়েছে; স্বাধীন বনের পাখি গুলোর সাথে নিজেদের নীড়ের খোজে মুক্ত আকাশে।


মুক্তির আনন্দ মনে, হাজারো স্মৃতি ভীড় করে দু'চোখে। কারো কারো জন্য সেই অনন্দটুকু মন থেকেই কেবল উপলব্ধি করা লাগে।


🍂.....
তখন রাত কিছুটা গভীর হয়েছে। এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন নিখিল'দা এক মনে বৃষ্টির কথা মনে একে নিচ্ছে। বাইরে তখনো বৃষ্টি পরছে। সেই সন্ধ্যা থেকে ঝরে ঝরে যেনো প্রকৃতি থেকে রসদ তুলে দিচ্ছে ক্যানভাসে- অর্ধআকা 'ব্লাক পেন্সিল' এর সাবজেক্ট টাতে।

একটা 'সতেরো, আঠারো' বছরের কিশোরি মেয়ে বনের ভিতর আনমনে বৃষ্টিতে ভিজেছে। নীল'শুভ্র ফ্রকে একটা পরীর মত দেখাচ্ছে যার একটা কৃত্রিম ডানা জুড়ে দেয়া আছে কাঁধে। একটা নীল ময়ুর বৃষ্টিতে ডানা প্রসারিত- করে তার সবটা পেখম মেলে দিয়েছে! সে সব কিছুই যেন মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেনা, অথবা দেখছেনা 'সে'।

আনমনে বৃষ্টির মধ্যে বনে একাকী ময়ুরের মত হেলেদুলে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বনের আরো গভীরে, স্বচ্ছ জলের স্ফটিক আলো ছড়িয়ে আছে নিয়ন সবুজে। আধো আঁকা ছবিতে কেবল গুটিকয় বৃষ্টির শুরু। এখানে সেখানে ছবির মধ্যেই কায়দা করে দৃশ্যপটের সাথে জুরে দেয়া 'ব্লান্ড ল্যাংগুয়েজের আলপিনের ফোটা গুলো'-

লুকানো কিন্তু ছুঁয়ে দিলে ঠিকি কিছুটা শীতল বৃষ্টি, প্রকৃতি, পেইংটিংটার ডিটেইল গুলো অন্ধের ভাষায় কিছুটা অনুবাদ করা ছবিটায়। একটু জটিল একটু ভিন্ন একটা আর্ট কিন্তু সেটা কারো জন্য কত মাইনে রাখে তা বোঝে নিখিল শুভ্রজিৎ'দা।

চুপচাপ এতক্ষন ছবিটা দেখছিলো আর পরবর্তী হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে আস্তে কিছুটা ধীরেসুস্থে -

ক্যানভাসের দিকে এগিয়ে গেলো নিখিল শুভ্র'দা, এক মনে রঙ তুলিতে জলরঙ তুলে নিয়ে ঠিক যেনো প্রজাপতির মত রঙ'তুলির ডানা ঝাপটাচ্ছে নিখিল- শুভ্রজিৎ। কিছুটা ধীর কিছুটা বাড়তি সর্তক যেনো। টানা অনেকক্ষণ প্রায় গভীর রাত অবধি নিভৃতে, একচিত্তে ছবি একে যাচ্ছে নিখিল শুভ্র'দা।

আশে পাশের দৃশ্যমান সব কিছু ধীরে ধীরে গভীর রাত হওয়ার দৃশ্যায়ণে ব্যস্ত। আর ক্যানভাসে তখন আধো রঙ্গিন আলোয় বৃষ্টি নিয়ে ব্যস্ত প্রকৃতি ফুটে উঠেছে নতুন করে যেনো নবান্ন নেমে এসেছে বনে।

🍂.....
পরের দিন সকালে; রুবী এসে দেখে ঘরের দরজা - জানালা খোলা চারিপাশে সিগারেটের ছাই সারা ঘরময় ছিটিয়ে আছে। হয়তো বাইরে থেকে 'ড্রিংক' করে এসে আর ঘরের গেট আটকাতে মনে নেই নিখিল শুভ্রদার।

টিভির রুমে সোফায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পারবে নিখিল'দা কে রুবী; তাই ভেবেছিলো। আপন করে প্রেম নিবেদন করে কথা বললে নিখিল শুভ্রদা কে, তুমি করে বলে সবসময় রুবী। অন্যথায় তুই করে বলে, দাদা ডাকে।

ঘরের কোথাও নিখিল শুভ্রদাকে দেখতে না পেয়ে আনমনে বললো 'গেলো কই নিখিল'দা, স্টাডি রুমে নয়তো। বলতে বলতে স্টাডি রুমের দিকে পা বাড়ালো রুবী।'

পেছনে ধীর পায়ের শব্দ, আর কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে পেয়েই নিখিল'দা পেছনে না ফিরেই বললো;

'কিরে রুবী আয় ভেতরে আয় দেখে যা। মেয়েদের এই এক দোষ চুড়ি পড়া হাতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনা। সবাইকে জানিয়ে রিনিঝিনি শব্দে মাতিয়ে রাখে। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে না চাইলেও অনিচ্ছায় হলেও শুনতে হয় রিনিঝিনি শব্দ।'

জবাবে রুবী একটু কেশে নিয়ে বললো, 'মেয়েদের চুড়ির শব্দ কার না ভালো লাগে। আর তুমি না শিল্পী তোমার তো বেশি ভালোলাগার কথা।' বলে ঘরে উঁকি দিয়ে রুবী দেখলো ক্যানভাসের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে; নিখিল শুভ্রজিৎ ।

রুবি বললো, "এইতোর 'ব্লাক পেন্সিল'।"

শুনে নিখিল'দা বললো, "না কেবল 'পেন্সিল'। ওটাতে এখনো আলো ফুটেনি। ঠিক করেছি গোটা দশ বারোটা দিন আর রুম থেকে বের হবো না, খাবো দাবো আর শুধু ছবিটা সময় মত মনমত করে এঁকে শেষ করবো। যেমনটা চাই ঠিক তেমন করে, অনেকটা সফল হতে চাই আমি।"

নিখিল শুভ্রদার কথা শুনে রুবী বললো, 'বেশ তো আঁকবি। তো সাবজেক্টটাও তো বেশ জটিল, খাটতে হবে খুব। নাস্তা করেছিস।'

নিখিল বললো 'না।'

তখন রুবী বললো, 'আয় একসাথে নাস্তা করবো। আমিও নাস্তা করিনি। সকালে শুধু এক কাপ চা খেয়েই চলে এসেছি।'

নাস্তার টেবিলে একমনে নাস্তা করছে 'শ্রাবণী আক্তার রুবী' আর চিরকুমার চিত্রশিল্পী নিখিল শুভ্রজিৎ। এটা সেটা নিয়ে কথা বলছে নিজেদের মাঝে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একটু দূর থেকে গানের শব্দ শুনা যাচ্ছে;

"আমার এই সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম"। শ্রীকান্ত আচার্যের।

নাস্তার টেবিলে তখন ওনারা, অবকাশে শান্ত-ক্লান্ত চোখে-চোখে কথা চলছে মুখে শুধু এলোমেলো খুটি নাটি শব্দহীন প্রান চঞ্চল হাসির দৃশ্যপট।

তারি মাঝে একটু দূর থেকে গান ভাসছে বাতাসে;

"তোমার মাঝেই হোক রাত্রি রচনা, এ আমার স্বপ্ন;
সুখের ঠিকানা.."


🍂.....
নিজের মনে ছবি আঁকাছে নবীন চিত্রশিল্পী রুবী।

রুবীর ক্যানভাসে একজন মধ্য বয়স্ক চিত্রশিল্পী তার নিজের ক্যানভাসে ব্যস্তসবুজ শান্ত প্রকৃতির মাঝে আত্মমগ্ন হয়ে ছবি আঁকছে। 'তার ক্যানভাসে' প্রকৃতির রুপ অংকিত। হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলো বনে, রুবীর অংকিত চিত্রশিল্পীর রুপে নিখিল শুভ্রজিৎ তার কাঁধ অবধি এলোমেলো শৈল্পিক চুল বাতাসে উড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটা থেকে নিজের আঁকা ছবিটি আড়াল করতে ব্যস্ত। কিন্তু তেমন সুবিধে হচ্ছে না, ক্যানভাসে দু'চার ফোটা বৃষ্টির অশ্রু ফুটে রয়েছে।

একমনে রুবী ছবিটিতে জলরঙে রাঙিয়ে তুলছে।
খুব জীবন্ত মনে হচ্ছে সব কিছু। কি অদ্ভুত স্ফটিক
রোদের ঝিকিমিকি, ছবিতে এখন ফুটে আছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে মৃদু আলোর রঙধনুর তিনটি রঙ। নীল, সাদা, হলুদ। বেগুনি আভা কেবল ধরেছে রঙধনুর মাঝে। সবুজ প্রকৃতির গাছের সবুজ পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা। ভেজা ঘাসে বৃষ্টির শিশির কণা। আত্মমগ্ন হয়ে ছবি আঁকছেন নিখিল শুভ্রজিৎ ছবিটির মাঝে।

ছবি শেষ কর নিজের ব্রান্ড সাইন করলো রুবী।
ডায়রিতে টুকে রাখলো সদ্য আঁকা ছবিটির শিরোনাম " স্মৃতির কপাট"।

ক্যানভাসের একটি ছবি তুলে নিখিল শুভ্রজিৎ দাদাকে ইমেইল সেন্ড করলো রুবী।

অল্প কিছুক্ষণ পরে উত্তর আসলো, " 'অসাধারণ '।
শুধু একটু আলো-ছায়ার অভাববোধ হলো। এখন
চাইলে একটু টাচ করে দেখতে পারিস। শুভকামনা

জীবন্ত স্মৃতি ক্যানভাসে ধরে রাখতে নেই। "

রুবী ইমেইলে একটা বড় নীল ব্যাঙের আলোকচিত্র
পাঠালো। আর শুধু লিখলো তুমি একটা ঘরকুনো কোলা ব্যাঙ। ভীজ এবার ক্যানভাসে বৃষ্টিতে- এভাবেই সারাজীবন।


🍂.....
রাত কেবল নেমেছে, সন্ধ্যা শেষে। গুলশানে নিজের বাড়ীতে আফসার আনসারি বাগানের ল্যাম্পপোষ্টের আলোর নিচে স্লেট বাঁধানো বসার স্থানে বসে চা খাচ্ছেন আর পত্রিকা পড়ছেন মনোযোগ দিয়ে। এমন সময় আফসার সাহেবের দূর সম্পর্কের খালাতো বোন 'রাবেয়া আশরাফ 'এসে বললেন ভাই জান তোমাকে অনেকদিন থেকে
একটা কথা বলবো ভাবছিলাম।

'কি কথা বলে ফেল, একটা কথা বলবি নিজের ভাইকে তাও আবার এত ভাবতে হয়।'

'না মানে ভাই জান তুমি নিজেকে নিয়ে কিছু ভেবেছো, দেখনা খালি বাড়ি। মানুষ জন নেই
তোমার কি আর কোন কিছুর অভাব। চাইলে একটা ভদ্র সুশিক্ষিতা, উচ্চ বংশের তোমার মনের মত; কোন ভালো মেয়ে দেখে সংসার টুকু তো শুরু করতে পার তাই না।'

নিরবে রাবেয়া আশরাফ এর কথাগুলো শুনে।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আফসার আনসারি বললেন।

'আপাত দৃষ্টিতে যেটা খুব সহজ মনে হয়, সেটা খু্ব সহজ না বুঝলি। তুই নিজের কথাটাই ভাব নিজের সন্তানেরা সেই যে প্রবাসে নিজেদের সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে। তারপরে ও তুই কিছু ভেবেছিস নিজের জন্য। না। তাহলে আমার বিষয়টা
আমার মাঝেই ছেড়ে দে। সন্তান বড় হয়ে গেলে অভিবাবকদের অনেক কিছুই মেনে নেয় না। একা আছি মেযেটার জন্য, ও মানুষ হোক। তখন ভাবা যাবে। তুই ভাবিস না এত। নীরা মামনি কি করে এখন।'

' নীরা...নীরা তো মনে হয় কি জানি লিখছে পড়ার রুমে বসে।'

'মনে হয় পড়া শেষ করে, কবিতা লিখছে। বড় ভালো কবিতা লিখে; নীরা কে বলিস নতুন কবিতা লেখা হলে আমাকে বলতে। নতুন একটা বই প্রকাশ হলে মেয়েটার ভালো লাগবে অনেক।'

'আর তোমার ভালো লাগবে না ভাইজান'

কথাটা শুনে আফসার আনসারি বললেন, 'সন্তানের সব কিছুই ভালোলাগে।

ভালো বাবা হতে গেলে আগে ভালো একজন মানুষ হতে হয়। আর সেই ভালো মানুষের মনোভাব সন্তানের মাঝে থাকলে তারা সবকিছুতেই নিজের একটা স্থান তৈরী করতে পারে আমি চাই ও এটাই করুক।'


🍂.....
এর'পরের কয়টাদিন নিখিল শুভ্রদার অনেক ব্যাস্ত সময় যাচ্ছে। রুমে নিজেকে প্রায় বন্দি রেখে একমনে শুধু ছবিটার কাজ শেষ করতে ব্যস্ত নিখিল শুভ্র'দা। ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে কখনও একমনে ভেবে যায়; ছবি আঁকে।

দূরে দাঁড়িয়ে ক্যানভাসে ছবিটা একমনে দেখে নেয়!

কখনও রঙতুলি ঠিক করে নেয়। কিছুটা সময় নেয়; আবারো প্রজাপতির মত ক্যানভাসে তুলির পাখা - ঝাপটাতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

বাইরের দৃশ্যপট বদলে যায়। দিন থেকে রাত হয়। রাত গভীর হয়।

গভীর রাতে নিখিল ঘুমোতে যায়। সাকালে কিছুটা সময় নাস্তা করে, এটা সেটা খেয়ে নেয়। আবারো ছবি আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বাইরের দৃশ্য পট বদলে যায়। দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে রাত হয়, রাত গভীর হয়। আবার গভীর রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে নিখিল শুভ্র'দা।

'ক্যালেন্ডারের পাতায়' দ্রুত দ্রুত সময়টা বদলাতে থাকে যেনো; চোখের নিমিষেই যেনো দিনলিপিতে দিন গুলো বদলে যায়, আরেকটা দিন আসে। এক মনে ছবি আঁকতে ব্যস্ত নিখিল'দা। দৃশ্যপট দ্রুত বদলাতে থাকে। পর্যায়ক্রমে আরেক'টি দিনের সূচনা হয়।

অবশেষে একসময় একটা সকালে ছবি আঁকা ফাইনালি শেষ হয়।

চোখে অশ্রু, ক্লান্তি, অবসাধ, নির্লিপ্ততা এঁকে দিয়ে কোন এক সকালে চায়ের কাপ হাতে ক্যানভাসের ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে "নিখিল শুভ্রজিৎ"।

ক্যানভাসে যেনো বৃষ্টিস্নাত সকালের স্ফটিক আলোয়- বনের গভীরে একটা শুভ্র পরী নেমে এসেছে যার একটা কৃত্তিম ডানা আছে, আশে পাশে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি; যেনো জীবন্ত ফোটাগুলো কোন এক কিশোরী মেয়ের চোখে না দেখতে পারা বেদনার অশ্রু নীলাভ'শুভ্র বৃষ্টির রঙ। কি অপরুপ মহনীয় বন, নীল ময়ুরের পেখম মেলা আশে পাশের বৃষ্টি ছাপিয়ে যেনো একটা জন্মান্ধ মেয়ে তার অন্তর্দৃষ্টির শক্তি দিয়ে বৃষ্টির দৃশ্য "অবতরণ" করেছে নিজের চির অন্ধকারের জগতের পবিত্র আলোতে।

তাইতো ক্যানভাসে আঁকা "ব্লাক পেনসিল" শিরোনামের ছবিটা দেখে এক'ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে নিখিল শুভ্রজিৎ এর চোখ "বেয়ে!"।

শিল্পের মধ্যে শিল্পীর একটা সত্ত্বা "জরিয়ে" থাকে। সেই শিল্পকর্ম যখন অন্য কারো কাছে চলে যায়; এ'যেন আত্বা থেকে প্রাণটুকু আলাদা হয়ে যাওয়া! হারিয়ে যাওয়া দূরে। কিন্তু নিখিল শুভ্রজিৎ এর চোখে তখন আনন্দ অশ্রু। এই অশ্রু হারোনের নয় বেদনার নয়;

''এই অশ্রু শিল্পের জন্মলব্ধ পবিত্র অশ্রু''

বড় অদ্ভুত এই অনুভূতি বড় অদ্ভুত! অবশেষে 'নিখিল' পেরেছে!!

যা করে দেখিয়েছে তা অনেক। বাদবাকি নীরার উপর, নীরার সেই কল্পনায় বহুবার দেখা আনন্দ'টুকুর জন্য মুখিয়ে আছে নিখিল শুভ্রদা। কে জানে সেই দৃশ্যপট কেমন হবে; কেমন হবে তার অনুভূতি! যা সম্পূর্ণ নীরার একার। আর তার চোখের আলোর ঝলকানিটুকু দেখার জন্য নিখিল উদগ্রীব।

🍂.....
শিল্পপতি 'আফসার আনসারি' সাহেবের বিলাসী ড্রয়িং রুমের দামি নীল পর্দার আড়ালে রাখা সামনের দৃশ্যপট; খোলা ক্যানভাসে নিখিল শুভ্রদার 'ব্লাক পেন্সিল' পেইংটিং'টা উন্মোচিত।

নীরা দাড়িয়ে আছে পেইংটিং'টার সামনে এক নিস্প্রভ চোখে পলক পরছে দ্রুত! হাত দিয়ে ছুঁয়ে অনুভব করে দেখছে নীরা! ছবিটায় স্পর্শ একে দিয়ে এলোমেলো হাতরে বেশকিছুটা সময় নিয়ে হুট করে খুব আনন্দিত হয়ে নীরা বলছে;

'খুব সুন্দর আমি যেন দেখতে পাচ্ছি বৃষ্টি কেমন! বৃষ্টি যেনো অনেকটাপানির মত; আর পানি যেনো অনেকটা আলোর মত বেশ দারুণ তো! একটা ময়ুরও আছে দেখছি?

'তুমি ছবিটায় বলেছো ময়ুরটা নীল আর ডানাকাটা একটা পরী আছে ছবিতে, তুমি বলেছো পরীটা শুভ্র, ও আনমনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর বনেতো এখন বৃষ্টি! আর বৃষ্টিতো আমি দেখতেই পাচ্ছি! কেমন স্বচ্ছ স্ফটিক কাঁচের মত শীতল তার জলের স্পর্শ!

অভাবনীয় সুন্দর একটা দৃশ্য।

ব্লাইন্ড ল্যাংগুয়েজে ডিটেল গুলো চমৎকার সাজিয়েছো। অনেক 'ধন্যবাদ'।

আচ্ছা শুভ্র'দা তুমি তো চাইলে আমাকে পৃথিবী দেখাতে পারো, তবে তুমি কেন আমাকে বিয়ে করছো না।'

একটু দূরে দাঁড়ানো নীরার বাবা আফসার আনসারি।

রুবী সবার পিছনে দাঁড়িয়ে; সবাই নীরার এমন কথা শুনে অশ্রু স্বজল চোখ মুছতে মুছতে আনমনে হেসে ফেললো।

নীরার আনন্দ নীরার অবাক করা চোখের দ্রুত পলক চোখের তাঁরায় আনন্দের বিস্ময়ের আলোটুকু ছুঁয়ে যাচ্ছিলো নিখিল শুভ্রজিৎ এর মনকে।

আর দূরে দাঁড়ানো নীরার বাবা আফসার আনসারি তখন এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখছিলো পরম মায়ায়।

কেবলি শতাধিক আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছিলো নিখিল শুভ্র'দা কে। নীরার এমন প্রশ্নের জবাবে;

একটা ঘোরের মধ্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিখিল শুভ্র'দা কেবলি বলে উঠলো;

'তুমি হয়তো দেখতে পারছোনা নীরা আমার প্রায় সব চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে; বুড়ো হয়ে গেছি আমি'

🍂.....
আনন্দের এই মুহূর্তটুকু নিখিল শুভ্রজিৎ এর মনে ছুঁয়ে যাবে সারাজীবন। নীরাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে শহরের রাস্তায় রিক্সায় হুঢ তুলে দিয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে নিখিল শুভ্র'দা আর রুবী।

রুবী বলছে, 'কিরে নিখিল'দা বৃষ্টি হচ্ছে দেখছিস।'
নিখিল মুদু স্বরে বললো, 'হুম।' বৃষ্টির জল, চোখের জল এক হয়ে নিখিল শুভ্রদার গ্রিবায় জমাট বেধেছে এক অদ্ভুত আলোর। রুবী বুঝতে পেরে বলে উঠলো;

'এমন দিনে বিয়ে করার জন্য একেবারে শুভ জানিস- শুভ্র'দা।'

'নিখিল শুভ্রজিৎ' রুবীর এমন কথায় নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে বললো, 'হুম একদম।' রুবী বললো,"কী"? নিখিল আবারে বললো, "হুম একদম।" রুবি বললো;

'তাইলে চল সোজা কাজী অফিসে।'

নিখিল শুভ্র'দা উত্তরে বললো,

"একদম চল, দেরি কেন। 'সমুদ্রে গড়েছি শয্যা শিশিরে কি ভয়'।"

কবিতার লাইন শুনে রুবী কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে বললো,

'ভালো হবে না নিখিল'দা এই তোমাকে বলে দিচ্ছি, চলোনা বিয়ে করে ফেলি।'

বলতে বলতে তাদের রিক্সাটা কিছুটা দূরে চলে যায়। পিছনে পরে থাকে এ শহরের ব্যস্ততা। দ্রুত শহরের রাস্তার দৃশপট বদলে যায়। রয়ে যায় পিছনে কেবল এই জগত- সংসার। দূরে কোথাও রাস্তার পাশে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শব্দ ভেসে আসে।

"দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, রইলো না; সেই যে আমার নানা রঙের দিন গুলো"!

বেজে চলে গানটা কিছুক্ষণ আনমনে বাজতে থাকে মনে...

আমাদের জীবনের রঙিন সংসারে বর্নীল ক্যানভাসে- আনন্দ বেদনার নানা রঙের দিনগুলো; এভাবেই পিছনে- পড়ে থাকে। দূরে নিখিল শুভ্র'দা আর রুবীর রিক্সার ছবিটা, ঝাপসা দেখায়।

-৷।০।।-
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৯৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/০৫/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast